নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শেহজাদ আমান

একজন সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

শেহজাদ আমান

একজন সাংবাদিক ও সৃষ্টিশীল লেখক

শেহজাদ আমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

টাইটানিক যখন ডুবছিল (ওয়াল্টার লর্ডের এ নাইট টু রিমেম্বার বইয়ের অনুবাদ - প্রথম অধ্যায়)

০৯ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:৪৭



বিশাল সাগরে মৃত্যু

নৌকা থেকে দেখে মনে হলো মৌচাকে যেমন করে মৌমাছি ঝুলে থাকে, তেমনি যাত্রীরা জাহাজ থেকে ঝুঁলে আছে। বিশাল এবং অনিশ্চিত কিছু যেন একসাথে দুলে উঠলো মোচড়ানো কোমড় থেকে যখন কিনা বো (জাহাজের সম্মুখভাগ) গভীরে ডুবে গেল এবং পশ্চাদভাগ উপরে জেগে উঠলো।বসন্তের ক্ষতি ব্যর্থ সংগীতকার আর বাদ্যযন্ত্রের ভিড়ে চাপা পড়ে গেল। বাতি নিভে গেল, আবারও জ্বলে উঠলো, অতঃপর চিরতরে নিভে গেল। একটি নিঃসঙ্গ কেরোসিনের বাতি জাহাজের মাস্তুলের উচ্চ অবস্থান থেকে কেবল তার প্রভা বিলিয়ে গেল।

টাইটানিক এখন পুরো খাড়া অবস্থায়, তার তিনটি ভারী প্রপেলার এমনকি অন্ধকারের মধ্যেও চমকাতে থাকলো। এদিকে নৌকায় অবস্থানকারী, তাদের নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। পুরো দুই ঘন্টা ধরে তারা কেবলই তাকিয়ে ছিলো আশার পর আশা নিয়ে, যেমন করে টাইটানিক ক্রমাগত তলিয়েই যাচ্ছিল। যখন পানি তার লাল এবং সবুজ বাতির কাছে পৌঁছে গেল, তখন তারা বুঝল চূড়ান্ত পরিণতি খুবই কাছে… কিন্তু কেউই এমন কিছু ঘটার স্বপ্ন দেখেনি – অপার্থিব কোলাহল, ৯০ ডিগ্রি কোণ করে থাকা কাল রংয়ের হাল, ক্রিসমাসের কার্ডের মত করে পটভূমিকায় থাকা অত্যুজ্জ্বল তারারা।


আরেকটি বেলফাস্ট যাত্রা


নতুন হোয়াইট স্টার লাইনার জাহাজের কাক্কুস নেস্টে (চারিদিকে নজর রাখার জায়গা) বসে ফ্রেডেরিক ফ্লিট জমকালো রাতের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এটি ছিলো শান্ত, পরিস্কার আর তীব্র শীতের এক রাত্। আকাশে চাঁদ ছিল না, ক্লিন্তু মেঘহীন আকাশ তারার আলোয় চমকাচ্ছিল। আটলান্টিক ছিলো পালিশ করা থালা-গ্লাসের মতো; পরবর্তীতে লোকেরা বলেছিল, তারা এর মত মসৃণ আর কিছুই দেখেনি।
এটি ছিল নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে টাইটানিকের প্রথম যাত্রার পনচম রাত্রি, আর ইতোমধ্যেই এটি পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে, সে (টাইটানিক) পৃথিবীর বৃহত্তম জাহাজই শুধু নয়, অন্যতম আকর্ষনীয়ও বটে। এমনকি যাত্রীদের কুকুরগুলোও ছিলো আকর্ষণীয়। জন জ্যাকব অ্যাস্টর ছিলেন তার এয়ারডেল কিটিকে নিয়ে। প্রকাশনা ফার্মের হেনরী স্লিপার হার্পার ছিলেন তার পুরষ্কার পিকিঙ্গিস সান ইয়াত-সেনকে নিয়ে। ফিলাডেলফিয়ার ব্যাঙ্কার রবার্ট ডব্লিউ ড্যানিয়েল তার ব্রিটেন থেকে কেবলই কেনা চ্যাম্পিয়ন বুলডগটিকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। ওয়াশিটনের ক্ল্যারেন্স মুরও কুকুর ক্রয় কিনেছিলেন, কিন্তু লুডন শিকারের জন্য তার কেনা ৫০ জোড়া ইংলিশ ফক্সহাউন্ড এই যাত্রায় ছিল না।

সেটা ছিল ফ্রেডেরিক ফ্লিটের কাছে অন্য এক পৃথিবী। তিনি ছিলেন টাইটানিকে কর্মরত ছয়জন দর্শনকর্মীর একজন, দর্শনকর্মীরা যাত্রীদের সমস্যা সম্মন্ধে চিন্তিত ছিল না। তারা ছিলো ‘জাহাজের চোখ’, আর এই বিশেষ রাতে ফ্লিটকে আইসবার্গ নজরে রাখার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল।

সবকিছু ভালই চলছিল। দায়িত্বরত অবস্থায় ১০টার সময়ে… বরফের সমস্যা সম্পর্কে দর্শনকর্মী রেগিনাল্ড লি’র সাথে কিছু কথা হচ্ছিল তার, যে একই দায়িত্বে ছিলো… আরও কিছু কথা হচ্ছিলো ঠান্ডা সম্পর্কে… কিন্তু, বেশিরভাগ সময়ই তারা নীরব ছিলেন, যেমন করে দুজন মানুষ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

তখন দর্শনদারীর দায়িত্ব ছিল প্রায় শেষের পথে, এবং তখনও সেখানে অযাচিত কিছু ছিল না। শুধু ছিল রাতটি, তাঁরারা, চরম ঠান্ডা, দড়িগুলোর ভিতর দিয়ে বাতাস শিস দিয়ে যাচ্ছিলো যেমনটি টাইটানিক সাড়ে বাইশ নটে শান্ত, কালো সমুদ্রের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সময় ছিল প্রায় ১১ঃ৪০, রবিবার, ১৯১২ সালের ১৪ই এপ্রিল।

হঠাত করে ফ্লিট সামনে কিছু একটা দেখতে পেল, যা অন্ধকারের থেকেও ছিল বেশী কালো। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন এটি আকারে ক্ষুদ্র, ( দুটো টেবিল জোড়া লাগালে যেরকম হয়, অনেকটা সেরকম) কিন্তু প্রতি মুহূর্তে এটি বড় হতে লাগলো আর কাছে চলে আসতে থাকলো। দ্রুত ফ্লিট সামনে বিপদের সঙ্কেত হিসেবে ক্রো’স নেস্টের ঘন্টা বাজালেন, তিনবার। একই সময়ে তিনি ফোনটি তুলে নিলেন এবং যোগাযোগের নম্বরে ডায়াল করলেন।
“আপনি কি দেখতে পেয়েছেন?’ অন্যপ্রান্তে থেকে শান্ত গলায় একজন জিজ্ঞাসা করলো।
“আইসবার্গ, একেবারে সামনে,’ ফ্লিট জবাব দিলেন।
“ধন্যবাদ,” কন্ঠস্বরটি কৌতুহলের সাথে কৃতজ্ঞতা জানালো, যেখানে ছিল না সৌজন্যতা। আর কিছুই বললো না।

পরবর্তী ৩৭ সেকেন্ড ফ্লিট আর লি নীরবে পাশাপাশি বসে রইলেন, বরফখন্ডটিকে কাছে আসতে দেখতে লাগলেন। এখন তারা ছিলেন প্রায় এর চূড়ায়, এবং তখনও জাহাজের মুখ ঘোরানো হয়নি।সুউচচ বার্গটি ছিলো ভেজা ও চকচকে, ডেকের অনেক উপরে। উভয়েই সম্ভাব্য সংঘর্ষের আশঙ্কায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন। শেষ মুহূর্তে ধাক্কা লাগল পরিস্কারভাবে, আর বরফ স্টারবোর্ডের দুই পাশ দিয়ে মসৃণভাবে বেরিয়ে যেতে লাগলো।এই কর্তনপ্রণালী ছিলো ফ্লিটের একেবারেই নিকট দিয়ে।

এই সময়ে কোয়ার্টারমাস্টার জর্জ থমাস রোয়ি আফটার ব্রিজের উপরে দাড়িয়ে ছিলেন। তার কাছেও এটি ছিল এক ঘটনাবিহীন রাত্রি – শুধু সাগর, তারাগুলো আর চরম ঠান্ডা। তিনি ডেকের উপরে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে যাকে তিনি এবং তার সঙ্গীরা ‘বলতেন আলোর চারিদিকে চমতকার কিছু’, সেটি দেখতে পেলেন—বাতাসে বরফের ক্ষুদ্র টুকরো, ধুলোর মত সুক্ষ, যা অসংখ্য উজ্জ্বল রঙ উপহার দিচ্ছিলো, যখন সেগুলোতে ডেকের উজ্জ্বল আভা প্রতিফলিত হচ্ছিল।

তখন হঠাত করে তিনি একটি অদ্ভুত গতি অনুভব করলেন যা ইঞ্জিন রুমের স্থির ছন্দকে ভংগ করলো। এটি ছিল কোন ডকের দেয়াল দ্রুতবেগে আসার চাইতেও অপেক্ষাকৃত বেশী কিছু। তিনি সামনে তাকালেন এবং আবার এগোতে থাকলেন। একটি উইন্ড জ্যামার, সেইল সেট মনে হল স্টারবোর্ডের পাশ দিয়ে চলে গেল। তখন তিনি অনুভব করলেন যে, এটি একটি আইসবার্গ, সম্ভবত পানির উপরে ১০০ ফুট পর্যন্ত জেগে আছে। পরমুহূর্তেই এটি হারিয়ে গেল, পিছনে ভেসে অন্ধকারে।

এদিকে, ডি ডেকের প্রথম শ্রেণিয় ডাইনিং সেলুনের নিচে টাইটানিকের ক্রুদের পরিবারের চারজন সদস্য টেবিলগুলোর চারিদিকে বসে ছিল। শেষ রাতের খাবার অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, এখন এই দলটিকে বাদ দিলে বিশাল সাদা জ্যাকোবিন রুম ছিলো ফাঁকা। তারা ছিল ডাইনিং-স্যালুন স্টুয়ার্ডস, সব স্টুয়ারর্ডের কাজ শেষের সম্মানিত অবসর সময়ে নিয়োজিত ছিল – তারা তাদের যাত্রীদের সম্মন্ধে গল্প করছিল।

যখন তারা বসে গল্প করছিল, একটি মৃয়মাণ চূর্ণ করার মত কর্কশ শব্দ মনে হল জাহাজের ভেতর থেকে আসতে থাকলো। এটা তেমন বেশী কিছু ছিল না, কিন্তু তা আলাপচারিতা ভেঙ্গে দেয়া এবং পরের দিন সকালের নাস্তার জন্য পাতা ধাতবসামগ্রীকে ঝাকুনি দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

স্টুয়ার্ড জেমস জনসন অনুভব করলেন, যা হচ্ছে, তা তিনি জানেন। যখন তিনি জাহাজের প্রপেলার ব্লেড চালু করেন, তখন জাহাজ যেভাবে থরথর করে কেঁপে ওঠে তিনি সেটি সম্পর্কে পরিচিত, এবং তিনি জানতেন এই ধরণের ত্রুটি-বিচ্যুতির অর্থ হল বেলফাস্টের হারল্যান্ড ও উল বন্দরে পুনরায় যাত্রা করা – যেখানে বন্দরের আতিথেয়তা উপভোগ করার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে রয়েছে। তার কাছেরই একজন একমত হলেন তার সাথে এবং উল্লাসে বলে উঠলেন, “আরেকটি বেলফাস্ট যাত্রা।”

জাহাজের সামনের গ্যালারিতে প্রধান নৈশ বেকার ওয়াল্টার বেলফোর্ড পরের দিনের জন্য রোল তৈরি করছিলেন ( চমতকার প্যাস্ট্রি তৈরি করার সম্মান দিনের বেলার জন্য সংরক্ষিত ছিল )। যখন ঝাঁকুনি লাগলো, এটি বেলফোর্ডকে স্টুয়ার্ড জনসনের চেয়ে বেশী মুগ্ধ করলো – সম্ভবত নতুন রোলের একটি পাত্র চুলার উপর থেকে ছিটকে পড়লো এবং মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল।

তাদের কেবিনের যাত্রীরাও কর্কশ শব্দটাকে অনুভব করল এবং পরিচিত কিছুর সাথে এর যোগসূত্র স্থাপন করতে চেষ্টা করল। বাবার সাথে ব্যবসায়িক যাত্রায় সংগ দেয়া মার্গারিট ফ্রোলিচার ঘুম থেকে কেবলই জেগে উঠল। অর্ধ-ঘুমন্ত অবস্থায় এ কেবলই জুরিখের ছোট্ট সাদা ফেরিগুলোর তীরে পৌঁছাবার কথাই কেবল ভাবতে পারল। নরম গলায় সে নিজেকেই শোনাল, ‘ এটা কি মজার নয়… আমরা পৌঁছে যাচ্ছি।’

মেজর আর্থার গডফ্রে পিউশেন রাতের জন্য তার পরনের কাপড়গুলো ছাড়াচ্ছিলেন, যদিও এটি ছিল জাহাজকে বিশাল কোন ঢেউ আঘাত করার মতই একটা ব্যাপার। যখন জাহাজটি মনে হল ‘এক হাজার মার্বেল গড়িয়ে দিয়েছে’, তখন মিসেস যে স্টুয়ার্ট হোয়াইট তার বিছানার কোণায় বসে ছিলেন, বাতি নিভিয়ে দেয়ার জন্য কেবলই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। লেডি কসমো ডাফ গর্ডনের কাছে ধাক্কা খেয়ে জেগে ওঠাটাকে মনে হলো “কেউ যেন জাহাজের গায়ে তার দানবীয় পরশ বুলিয়ে দিয়েছে।” মিসেস জন জ্যাকব এস্টর এটিকে রান্নাঘরের কোন একটি ঝামেলা বলে মনে করেছিলেন।

কয়েকজন এটিকে অন্যদের থেকে এটিকে বেশি তীব্রভাবে অনুভব করল। মিসেস ক্যাডওয়েলের মনে হল বড়সড় কোন কুকুর তার বাচচাটিকে মুখে করে ঝাঁকাচ্ছে। মিসেস ওয়াল্টার বি স্টিফেনসন তার সানফ্রান্সিসকো ভূমিকম্পের প্রথম কাঁপুনির অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করলেন- আর ভাবলেন এটা মন্দ নয়। মিসেস ইডি আপলেটন মোটেই কোন ধাক্কা অনুভব করলেন না, কিন্তু তিনি একটি কর্কশ ছিঁড়েখুড়ে ফেলার শব্দ অনুভব করলেন… যেন কেউ একটি দীর্ঘ দীর্ঘ ক্যালিকোর টুকরোকে ছিঁড়ে ফেলছে।

হোয়াইট স্টার লাইনের (টাইটানিক জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মে ব্রুস ইসমের কাছে এটিকে তার চেয়ে বেশি কিছুই মনে হল, টাইটানিকের প্রথম যাত্রায় যেতে পেরে যিনি খুবই উতসবের আমেজে ছিলেন। ইসমে আচমকা বি ডেকে তার বিলাসবহুল স্যুটের ভিতর জেগে উঠলেন - তিনি নিশ্চিত অনুভব করলেন জাহাজটি কোনকিছুকে আঘাত করেছে, কিন্তু তিনি জানতেন না সেটি আসলে কি।

যাত্রীদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে জবাবটা জেনে গেছে। কেবিন ই-৫০’র তরুণ মধুচন্দ্রিমার যুগল মিস্টার ও মিসেস জর্জ এ. হার্ডার তখনও জেগে ছিলেন, যখন তারা একটি নিরস ধুমধাম শব্দ শুনতে পেলেন। তারপর তারা জাহাজের কাঁপুনির শব্দ শুনতে পেলেন এবং জাহাজের ভিতরে তখন এক রকমের ঝুঁমঝুঁমির, ভাঙ্গাচোড়ার শব্দ হচ্ছিল। মিস্টার হার্ডার বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলেন এবং পোর্টহোলের দিকে দৌড়ে গেলেন। তিনি যখন কাঁচের ভিতর দিয়ে তাকালেন, বরফের দেয়ালকেই পাশ দিয়ে যেতে দেখলেন।

ফিলাডেলফিয়ার জিমবেলস ক্রেতা জেমস বি ম্যাকগফের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটল, শুধু তার অভিজ্ঞতাটি ছিল কিছুমাত্রায় বেশি বিরক্ত উদ্রেককারী। তার পোর্টহোল খোলা ছিল, এবং যখন আইসবার্গটি আঁচড় কেটে বেরিয়ে যাচ্ছিল, বরফের টুকরো তার কেবিনের ভিতর এসে পড়ল।

মিস্টার ম্যাকগফের মত টাইটানিকের বেশিরভাগ যাত্রীই বিছানায় ছিলেন যখন ধাক্কাটি লাগল। এই শীতল রোববার রাতে একটি উষ্ণ ও আরামদায়ক পলায়নই মনে হতে থাকলো সেরা স্থান হিসেবে। কিন্তু, কিছু শিপবোর্ডের দুর্দমনীয় মানুষ ছিল তখনও সজাগ। যথারীতি বেশিরভাগই ছিলো এ ডেকের প্রথম শ্রেণির স্মোকিং রুমে।

আর যথারীতি এটি ছিল খুব মিশ্র একটি দল। একটি টেবিল ঘিরে বসে ছিল ট্যাফট মিলিটারি আইডের আর্চি বাট; হাউন্ড কুকুরদের ভ্রমণরত মালিক ক্ল্যারেন্স মুর; ফিলাডেলফিয়ার রাস্তায় চলা গাড়িগুলোর ধনকুবের হ্যারি ওয়াইডেনার; আর আরেকজন মেইন লাইনার উইলিয়াম কার্টার। তারা জাহাজের কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড যে স্মিথের সম্মানে উইডেনারের বাবার দেয়া ছোটখাট ডিনারটির সমাপ্তি টানছিলেন। ক্যাপ্টেন আগেই সেই স্থান ত্যাগ করেছিলেন, নারীরা শয্যা নিতে চলে গিয়েছিল, আর পুরুষরা চলে যাওয়ার আগে সিগারের শেষ অংশটুকু উপভোগ করছিলেন। আলোচনা চলছিল রাজনীতি থেকে শুরু করে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ক্ল্যারেন্স মুরের অভিযাত্রা পর্যন্ত। যে সময় তিনি বুড়ো কলহবাজ পর্বতারহী আনসে হার্টফিল্ডের সাক্ষাতকার নিতে সাহায্য করছিলেন।

কাছেই একটি চামড়ার আর্মচেয়ারে শুয়ে শুয়ে স্পেন্সার ভি সিলভারথ্রোন, সেন্ট লুইসের নুজেন্টস ডিপার্টমেন্টের একজন নবীন ক্রেতা, ‘দ্যা ভার্জিনিয়ান’ নামে নতুন একটি বেস্ট-সেলার বই নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। বেশি দূরে নয়, লুসিয়েন পি স্মিথ (আরেকজন ফিলাডেলফিয়ান) তিনজন ফরাসীর সাথে একটি ব্রিজ গেম খেলার সময় ভাষাগত সমস্যা নিয়ে ঝামেলায় পড়েছিলেন।

আরেকটি টেবিলে আরেকদল তরুণ ব্রিজের একটি কোলাহলপূর্ণ খেলায় মত্ত ছিলেন।সাধারণভাবে তরুণ পুরুষেরা বি ডেকের ঠিক নিচের অপেক্ষাকৃত প্রাণবন্ত ক্যাফে প্যারিসেনকেই পছন্দ করত, আর প্রথমত আজকের রাত কোন ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। কিন্তু, সেদিন এত বেশি ঠান্ডা পড়েছিল যে সাড়ে এগারোটার দিকে মেয়েরা ঘুমোতে গিয়েছিল, আর ছেলেরা একটি নাইটক্যাপের জন্য হেঁটে হেঁটে স্মোকিংরুমের দিকে গিয়েছিল। দলটির বেশিরভাগই হাইবলস খেলায় মত্ত ছিল; ইংলিশ ভাস্কর হিউ উলনার গরম হুইস্কি আর পানি টেনে নিলেন; ওয়াশিংটনের পথে থাকা তরুণ সুইডিশ মিলিটারির লোক লেফটেনেন্ট হোকান বিওর্নস্ট্রম স্টিফ্যানসন বেছে নিয়েছিলেন লেমনেড।

কেউ কেউ কার্ড সাজিয়ে বসেছিল, আর যখন তারা খেলায় আর হাস্যরসে মত্ত ছিলেন, হঠাত এলো সেই কাঁপিয়ে দেয়া ধাক্কা। খুব বেশি ধাক্কা দেয়ার মতো ছিল না, কিন্তু একজন মানুষকে তা ভড়কে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। ততক্ষণাত স্মোকিং-রুম স্টুয়ার্ড এবং মিস্টার সিলভারথ্রোন সটান দাঁড়িয়ে গেলেন… জাহাজের পিছন দিকের দরজা দিয়ে… পাম কোর্ট পেরিয়ে… আর ডেকের উপর পর্যন্ত। তারা আইসবার্গকে টুকরো টুকোরো হয়ে, বোর্ড ডেকের একটু উঁচু দিয়ে, স্টারবোর্ড ঘেষে চলে যাওয়া দেখার জন্য সঠিক সময়ে ছিলেন। আর এটি তরতরিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেল, আর তারা দেখলো আইসবার্গের অংশগুলো টুকরো টুকরো হয়ে আর হুড়মুড় করে পানিতে পড়ে যাচ্ছে। আরেক মুহূর্তেই এটি জাহাজের পিছনের অন্ধকারভাগে হারিয়ে গেল।

স্মোকিং রুমের অন্যরা এখন একসাথে ভিড় করল। যেই হিউ উলনার ডেকে পৌঁছলেন, তিনি একজনকে বলতে শুনলেন, “আমরা একটা আইসবার্গকে আঘাত করেছি – এই যে সেটি।”
উলনার রাতের আধারের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালেন। প্রায় ১৫০ গজ জাহাজের পশ্চাদভাগে তিনি তাঁরকাজ্জ্বল আকাশের পিছনে বরফের পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তারপর এটি অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

শীঘ্রই উত্তেজনা তিরোহিত হয়ে গেল। টাইটানিককে আগের মতই নিরেট মনে হল, আর এত বেশি ঠান্ডা ছিল যে বাইরে থাকা সম্ভব ছিল না। ধীরে ধীরে দলটি নিজেদের গুছিয়ে নিলো। উলনার হাত চালালেন, আর ব্রিজ খেলা চলতে থাকল। ভিতরে ঢোকা শেষ ব্যক্তি ভাবল, যেই তিনি সশব্দে ডেকের দরজা বন্ধ করলেন, ঠিক সেই সময়েই ইঞ্জিন থেমে গিয়েছে।

তিনি ঠিক ভেবেছিলেন। ব্রিজের উপরে ফাস্ট অফিসার উইলিয়াম এম মার্ডক কেবলই সবটুকু দিয়ে ইঞ্জিন-রুমের টেলিগ্রাফের হাতল চেপে ধরে “থাম” লেখার জন্য চেষ্টা করলেন। এই পক্ষে মার্ডক ছিলেন সেতুর দায়িত্বে, আর এটা এখন পুরোটাই ছিল তার সমস্যা, যখন কিনা ফ্লিট ফোন করে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। সেই থেকে একটি চিন্তাযুক্ত মিনিট পার হলো - কোয়ার্টারমাস্টার হিচেনের কাছে পৌঁছে গেল শক্ত ব্রেক কষে স্টারবোর্ডটিকে থামানোর… “পূর্ণ গতির এস্টার্ন”-এর জন্য ইঞ্জিন রুমের টেলিগ্রাফকে ঝাঁকুনি দেয়া হল… পানিনিরোধী দরজাগুলো বন্ধের জন্য জোরালো টিপ…আর অবশেষে সেই ৩৭ সেকেন্ডের শ্বাসরুদ্ধকর প্রহর।

অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হল, আর সবদিক থেকেই অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। যখন গুড়িয়ে দেয়ার শব্দ থেমে গেল, ক্যাপ্টেন স্মিথ তার হুইলহাউসের পর অবস্থিত কেবিনের থেকে সেতুর দিকে দৌঁড়ে গেলেন। সেখানে অল্প কিছু বাতচিত হলোঃ
“মিস্টার মার্ডক, ওটা কি ছিল?”
“একটা আইসবার্গ স্যার। আমি স্টারবোর্ডে শক্ত ব্রেক দিয়েছি আর ইঞ্জিনকে ঘুরিয়ে দিয়েছি, আর আমি নিকটবর্তী বন্দরে নেয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু সে (আইসবার্গ) ছিলো খুবই কাছে। আমি আর কিছুই করতে পারতাম না।”
“জরুরী দরজাগুলো বন্ধ করে দাও।”
“দরজাগুলো ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”
সেগুলো বন্ধ ছিলো, ঠিকঠাকভাবেই। যখন সতর্কতার ঘন্টা বাজানো শোনা গেল ও জাহাজের পিছন দিগকার পানিনিরোধী দরজাগুলোর ওপরে আলো লাল হয়ে চমকাল, তখন ৬ নাম্বার বয়লার রুমে জ্বালানী কর্মী ফ্রেড ব্যারেট কথা বলছিলেন এসিসট্যান্ট সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার জেমস হেসকেথের সাথে। দ্রুত চিতকার করে দেওয়া সতর্কবাণী – কানে তালা লাগিয়ে দেয়া সংঘর্ষ - আর মনে হয় পুরো স্টারবোর্ডের পার্শ্বটাই শেষ হয়ে গেছে। সমুদ্র ঝর্ণায়িত হয়ে পাইপ আর ভালভের ভিতর দিয়ে ঘুরতে লাগল, আর দুইজন মানুষ দরজা দিয়ে লাফিয়ে বের হল, আর সেটি তাদের পেছনে সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

যে বাজে অবস্থায় আছেন, সেভাবেই ব্যারেট যেন সবকিছুকে পেলেন, পাঁচ নাম্বর বয়লার রুমে। বন্ধ কম্পার্টমেন্ট দরজার দুই ফুট পিছনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়ে পাঁচ নম্বর রুম পর্যন্ত গেল, আর গর্তটি দিয়ে বিপুল পরিমাণে সমুদ্রের পানি পূর্ণবেগে ঢুকে পড়ছিল। কাছেই সজ্জাকার জর্জ ক্যাভেল নিজেকে বাঙ্কার থেকে উপচে পড়া কয়লার ধস থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিলেন। আরেকজন কয়লা-শ্রমিক একটি যন্ত্রের স্তুপের উপর উল্টে পড়া সুপের বাটিটাকে দুঃখ ভরে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।

জাহাজের দূরবর্তী পশ্চাদভাগের বয়লার রুমগুলো ছিল শুকনো, কিন্তু পরিস্থিতি ছিল প্রায় একই – লোকজন একে অপরকে জিজ্ঞাসা করছিল, ডাকাডকি করছিল, জানতে চাইছিল আসলে কি হয়েছে। এটার বর্ণনা করা ছিল কঠিন। তখন পর্যন্ত টাইটানিকে একটি বনভোজনের আমেজ চলছিল। একটি নতুন জাহাজের প্রথম যাত্রায় সবকিছুই ছিলো নিঁখুত। অগ্নি-নির্বাপন কর্মী জর্জ কেমিশ যেমন এখনো স্মরণ করতে পারেন, ঠিক তেমনি ছিল সবকিছু, “দারুণ একটা কাজ… পুরনো জাহাজে আমরা যেমন আমাদের ক্ষোভগুলো উগড়ে দিতে আর গরমে সিদ্ধ হতে অভ্যস্ত ছিলাম, সেই রকম কিছু এখানে নেই।”

সব অগ্নি-নির্বাপণ কর্মীকে যা করতে হত তা হল ফারনেসকে ভরিয়ে রাখা। স্লাইস বার, প্রিকার বার আর রেক নিয়ে আগুনকে চালনা করতে হত না। তাই, এই রোববার রাতে তারা স্বাচ্ছন্দেই সময় পার করছিল- তারা বালতিগুলো আর ট্রিমার্স আইরন হুইলব্যারোর আশেপাশে বসে ছিল, বাতাসকে আলোড়িত করছিল আর ১২ টা থেকে ৪টা পর্যন্ত পরবর্তী শিফটের জন্য অপেক্ষা করছিল।

ঠিক তখনি হল সেই ধূপধাপ করে ভেঙ্গে পড়ার শব্দ…চূর্ণ করার আওয়াজ…ছিঁড়ে ফেলার শব্দ…পাগলের মতো বেজে ওঠা টেলিগ্রাফ…পানিনিরোধী দরজাগুলোর হুড়মুড় করে বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ। বেশিরভাগ লোকই ধারনা করতে পারলো না এটা কি ছিলো – গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে টাইটানিক নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের তীরে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই তাই ভেবেছিল, এমনকি একজন সজ্জাকারী উপর থেকে নিচে ছুটে আসতে আসতে যখন বলল “ইশ্বর আমাকে অন্ধ করে দাও! একটা আইসবার্গের সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়েছে”, তখনও তারা এটাই মনে করল।

দশ মাইল দূরে লন্ডন থেকে বোস্টনগামী লেল্যাড লাইনার ক্যালিফোর্নিয়ানের স্তুর উপর দাঁড়িয়ে ছিলো। ৪৭ প্যাসেঞ্জারের জন্য কামরাওয়ালা ধীরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে চলা সেটি তখন আর কাউকে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল না। এই রোববার রাতে ভেসে চলা বরফে পুরোপুরি আটকে গিয়ে সে রাত ১০ঃ৩০থেকে থেমে ছিল।

১১ঃ১০’র দিকে গ্রুভস আরেকটি জাহাজ থেকে আলো আসতে দেখতে পেল, পূবদিকে থেকে যেটি স্টারবোর্ডের দিকে ধেয়ে আসছিল। যেই নতুন আগত জাহাজটি গতিহীন ক্যালিফোর্নিয়ানকে ছাড়িয়ে গেল, ডেকের এক টুকরো আলোতে দেখা গেল সে হচ্ছে একটি যাত্রীবাহী জলযান। ১১ঃ৩০’র দিকে তিনি চার্ট রুমের ভেনেসিয়ান দরজায় কড়া নাড়লেন এবং ক্যাপ্টেন স্ট্যানলি লর্ডকে এই ব্যাপারে বললেন। লর্ড মোর্স ল্যাম্পের মাধ্যমে নতুন জাহাজটির সাথে যোগাযোগ করতে বললেন আর গ্রুভস এটা করার জন্য প্রস্তুতি নিলেন।
তারপর, ১১ঃ৪০’র দিকে তিনি বড় জাহাজটিকে হঠাত করে থেমে যেতে এবং এটির বেশিরভাগ বাতি নিভিয়ে দিতে দেখলেন। এটি গ্রুভসকে খুব বেশি অবাক করেনি। তিনি দূরপ্রাচ্যের ব্যবসায় বেশ কিছুকাল কাটিয়েছিলেন, যেখানে সেখানে তারা ডেকের বাতিগুলো নিভিয়ে দিত যাত্রীদের তাদের বাতিগুলো জ্বালাতে উতসাহ দিতে। তিনি এটা কখনো ঘটতে দেখেননি যে তখনও বাতিগুলো জ্বালানো থাকবে…আই সেগুলোর নিভে যাওয়াই ধর্তব্য ছিল, কেন না সেটি এখন আর ব্রডসাইডে নেই কিন্তু দ্রুত মোড় ঘুরে বন্দরের দিকে চলল।


মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০১

ক্লে ডল বলেছেন: খুব ভাল লাগল!!!
অনুবাদে আর একটু প্রাঞ্জলতা আনা যায় কিনা দেখতে পারেন।

১৯ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১:৩৯

শেহজাদ আমান বলেছেন: ধন্যবাদ! আমিও আরো প্রাঞ্জলতা আনার চেষ্টায়ই আছি সবসময়। এটা ফাইনাল অনুবাদ না। এটা আরো বেশ কয়েকবার এডিট হবে। বইটির পুরো অনুবাদই কমপ্লিট। এটা আরো কয়েকবার প্রুফ আর এডিটিং আর রিরাইটিং হবে। তখন এতে আরো প্রাঞ্জলতা যোগ হবে নিশ্চয়।
আর তারপর মাস তিনেকের মধ্যে বইটা বের হবে আশা করি, সন্দেশ প্রকাশনী থেকে।

২| ১১ ই মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৫

:):):)(:(:(:হাসু মামা বলেছেন: অনেক ভাল লাগল অনুবাদ। B-)

১৯ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১:৪০

শেহজাদ আমান বলেছেন: খুব বেশি ভাল হয়নি; এটাকে কাটাছেড়া আর রিরাইটিং করে আরো ভাল করার চেষ্টায় আছি।

৩| ১২ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ১০:৪২

রবি১০ বলেছেন: view this link

৪| ১২ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ১০:৪৩

রবি১০ বলেছেন: খুব ভাল লাগল!!!

http://insectscontrol.my-free.website/

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.