![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শিব্বির আহমদ ওসমানী: শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ধর্ম ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের কথা বিধৃত হয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি সুবিচারের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম শ্রমের প্রতি যেমন মানুষকে উৎসাহিত করেছে। তেমনি শ্রমিকের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পূর্ণ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব দৈহিক, মানসিক ও কৌশলগত শক্তি রয়েছে। এগুলি বিনিয়োগ করে কাজ করার নাম শ্রম। শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি শ্রমিক। শ্রমের দ্বারা মানুষ তার ভাগ্যের দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর সব মহৎ কাজের পিছনে অজস্র মানুষের শ্রম ও মেধা জড়িত।
মহান আল্লাহ তায়ালা শ্রমের গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘মানুষ যতটুকু চেষ্টা করবে, ততটুকু সে পাবে’। মানবতার মুক্তির সোপান নবী করীম (সঃ) শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। কারণ যারা মানুষের সুখের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেদেরকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয় তারাতো মহান আল্লাহর কাছেও মর্যাদার অধিকারী। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, ‘কারও জন্য নিজ হাতের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য বা খাদ্য আর নেই’।
শ্রমিকের প্রথম দাবী বা অধিকার হল তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। মজদুরের মজুরী লাভ করা তার নায্য দাবী। এ দাবী পূরণে নানাজন নানাভাবে নির্ধারণের কথা বলে থাকেন। পুঁজিবাদীরা দ্রব্যমূল্য চাহিদা ও যোগানের অনুপাতে শ্রমের মূল্য নির্ণয় করেন। এ সমস্ত মতবাদ অনুসারে শ্রমিকের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। তাদের পূর্ণ অধিকার আদায় করতে হলে শ্রমিকের প্রয়োজন অনুসারে মজুরী নির্ধারণ করতে হবে। মহানবী (সঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যাক্তি কোন শ্রমিক দ্বারা কাজ করিয়ে শ্রমিকের পারিশ্রমিক পরিশোধ না করবে, কেয়ামত দিবসে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার বিরুদ্ধে বাদী হবেন।’ বোখারী শরিফ)
অনেক সময় মালিকগণ শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উপযুক্ত মজুরী না দিয়ে ইচ্ছামত মজুরী দেয়। শ্রমিকগণ চাকরী হারানোর ভঁয়ে তা নীরবে সহ্য করে থাকে। এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাসুল (সঃ) বলেছেন, ‘মজদুর দ্বারা কাজ করালে মজদুরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরী আদায় করে দাও।’ (মেশকাত শরীফ)। এ ব্যাপারে রাসুল (সঃ) আরও বলেছেন, মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন তিন ধরণের ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। তার মধ্যে একজন হল, যে শ্রমিকের নিকট থেকে পূর্ণ শ্রম গ্রহণ করে, অথচ তার পূর্ণ মজুরী প্রদান করে না’
শ্রমিককে মজুরী দিবে বলে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা যাবে না। শ্রমিকের সাথে সুন্দর ব্যবহার করতে হবে। ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হবে পিতা-সন্তানের ন্যায়। নিজের সন্তানের মতোই শ্রমিকের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা, পরিবারের সদস্যদের মতই তাদের আপ্যায়ন করা, শ্রমিকের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি মালিকের খেয়াল রাখা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করা মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শ্রমিককে তার প্রাপ্য পূর্ণভাবে যথাসময়ে প্রদান করাও মালিকের একটি প্রধান দায়িত্ব। শ্রমিককে কখনো ঠকানু যাবে না।
মানুষের জীবনে চাহিদার শেষ নেই। চাহিদা বহুল জীবনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন। শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিকদের অর্থ-উপার্জনের একমাত্র পথ। মালিকগণ শ্রমিকদের যে অর্থ প্রদান করে থাকে, এতে যদি তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ না হয়, তবে তাদের নুন্যতম প্রয়োজন মেটানোর জন্য মালিকগণ যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। তাদের যথোপযুক্ত দাবী পূরণের কথা উল্লেখ করে মহানবী (সঃ) বলেন, ‘শ্রমিকদেরকে যথারীতি খাদ্য ও পোষাক দিতে হবে’।
অপরদিকে একজন শ্রমিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা। সময়ের কাজ সময়ের মধ্যে সম্পাদন করা। কাজে ফাঁকি দেয়া ইসলাম সমর্থন করে না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ ঐ শ্রমিককে ভালবাসেন যে সুন্দরভাবে কার্য সমাধা করে’। কিন্তু কোন কোন শ্রমিক মালিকের কাজে ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত হাযিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বেতন উত্তোলন করে থাকে, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এজন্য তাকে ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
শ্রমিক তার কোন কাজে অলসতা প্রদর্শন করলে তার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের জন্য দুর্ভোগ রয়েছে, যারা ওযনে কম দেয়। ওযন নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে এবং দেওয়ার সময় কম করে দেয়’। আর যদি শ্রমিক তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে, তাহলে তার জন্য রাসূলুল্লাহ (সঃ) দ্বিগুণ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে বলেন, ‘তিন শ্রেণীর লোককে দ্বিগুণ ছওয়াব প্রদান করা হবে, তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক হল, ‘ঐ শ্রমিক যে নিজের মালিকের হক্ব আদায় করে এবং আল্লাহর হক্বও আদায় করে’।
শ্রমিকের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হল কাজের সময় নির্ধারণ। শ্রমিক তার শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে, তাকে জোর করে বেশী সময় কাজ করানো যাবে না। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হল, শ্রমিকের নিকট হতে ততক্ষণ কাজ করে নেয়া যাবে, যতক্ষণ সে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সক্ষম।
পুঁজিবাদী দেশগুলোতে মালিকগণ যতক্ষণ ইচ্ছা শ্রমিকের কাছ থেকে কাজ করিয়ে নিত। শ্রমজীবী মানুষের জন্য শ্রমের কোনো সময়কাল নির্ধারণ ছিল না। এতে শ্রমিকদের অত্যাচারের সীমা থাকত না। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত শ্রমিকগণ ১৯৮০ সালে মে মাসে শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা কাজ করার দাবীতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। শেষ পর্যন্ত দাবীর মুখে তা গৃহীত হয়। পাশ্চাত্য উপলব্ধির অনেক আগেই ইসলাম শ্রমিকের অধিকার যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করেছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, দূর্বলের স্বার্থ এবং অসহায়দের হক ফিরিয়ে দয়ার জন্য অনেক আগেই মানবতার মুক্তির কান্ডারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট্র মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সঃ) যে বাণী বিশ্ববাসীর সামনে রেখে গেছেন; যার বাণী ও কর্মে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পেশা বা কর্মস্থল পরিবর্তনে শ্রমিকের পূর্ণ অধিকার থাকবে। এতে কারও হস্তক্ষেপ করার অর্থই তার স্বাধীন সত্তায় বাধা দেয়া। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে যা শ্রমিককে তার মানবিক স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত করা হয়েছে। তা কোনো ভাবেই ইসলাম সমর্থন করে না। ১৯৪০ সালে স্টালিনের আমলে শ্রমিকদের স্থানান্তরের অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়। তা কোনো ভাবেই সঠিক নয়। এতে শ্রমিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে শ্রমিক মালিকের দাস নয়, বরং সে তারই সমমর্যাদার অধিকারী স্বাধীন এক সত্তা।
শ্রমিক মালিকের একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, এমন কোন কাজ বা আন্দোলন করা যাবে না যাতে কাঁরখানার ক্ষতি হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট ভাংচুর করা যাবে না। যেকোন ব্যক্তির যানবাহন চালানোর বা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট খোলা রাখারও অধিকার আছে। তাতে বাধা দানের অধিকার কারো নেই। তেমনি ভাবেই প্রত্যেক শ্রমিক তার সাধ্যমতো কাজে যুগদান করবে তাতে কারো জোর প্রদর্শন করা যাবে না। হযরত ওমর (রাঃ) সরকারী কর্মচারীদেরকে নির্দেশ দিতে গিয়ে বলতেন, ‘সবচেয়ে ভাল এবং সৎ শাসনকর্তা সেই যার অধীনে সাধারণ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার সাথে থাকে। আর সবচেয়ে খারাপ শাসনকর্তা সেই, যার প্রজা-সাধারণ অভাব ও অশান্তিতে দিন যাপন করে।’
পরিশেষে বলা যায়, এ বিশাল পৃথিবীর রূপ-লাবণ্যতায় শ্রমিকদের কৃতিত্বই অগ্রগণ্য। কিন্তু আক্ষেপ সভ্যতার কারিগর এ শ্রেণীটি সর্বদাই উপেক্ষিত, অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত। উদয়াস্ত উষ্ণ ঘামের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নিয়ে খেটে যে শ্রমিক দেশের অর্থযন্ত্রটি সচল রাখে, কিন্তু শ্রমিকদের জীবনে সুখ-শান্তি জুটে না। এটাকে মৌমাছির সাথে তুলনা করা যায়, যারা দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে চাকে সঞ্চয় করে, কিন্তু তার ভাগ্যে একফোঁটা মধুও জোটে না। সুতরাং সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিকের বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা ও শ্রমনীতি বাস্তবায়ন করে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর এজন্য সর্বাগ্রে উচিত ইসলাম প্রদর্শিত মালিক-শ্রমিক নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন।
লেখক: প্রভাষক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠক।
ই-মেইল: [email protected]
©somewhere in net ltd.