![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসেছিলাম বিরান প্রান্তরে সেখান থেকে চারাগাছ জন্মেছে; কিছু বিষন্ন চারাগাছ
১.....
আমার সামনের চেয়ারে যে ছেলেটা বসে আছে তার বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে । গায়ের রং ফর্সা , উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি হবে । ছেলেটা গত সপ্তাহেও এসেছিল । রাতে নাকি ঘুমাতে পারেনা । অস্থির অস্থির লাগে বলেছিল । এই বয়সে এরকম হয়ে থাকে ভেবে কিছু ঘুমের ঔষধ দিয়ে দিয়েছিলাম । টেনশন করাও বারণ ছিল । ভেবেছিলাম ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু আজ আবার এসে যাওয়ায় আমার ধারণা মিথ্যে প্রমাণীত হলো । চেম্বারে ঢোকার পরবর্তী প্রথম ৫ মিনিট একটা কথাও বলেনি ছেলেটা । চোখের অবস্থা দেখে মনে হয় এখনো রাতে ঘুমাতে পারেনা । বারবার ঢোক গিলছিল দেখে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম । ভেবেছিলাম গলা শুকিয়ে গেছে এক চুমুকে শেষ করে ফেলবে । কিন্তু ছেলেটা ছোট্ট একটা চুমুক দিয়েই রেখে দিল । আবারো ভুল প্রমানীত হলাম ।
মাথা নিচু করে বসে আছে ছেলেটা । কোন ভণিতা না করে সরাসরি প্রশ্নে গেলাম ।
-"কি খবর ? এখনো রাতে ঘুম হয়না ?"
এক মুহুর্তের জন্য ছেলেটা আমার চোখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল ।আমি আঁতকে উঠলাম , যদিও বাইরে প্রকাশ পেল না । লাল টকটকা চোখ দুটো । মনে হচ্ছে শরীরের সব রক্ত এসে চোখে জমা হয়েছে । ধীরে ধীরে ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় জবাব দিল ছেলেটি । তার চোখ দুটোতে কিছু একটা ছিল । এমন কিছু যা আমাকে রীতিমতো ভীত করে তুললো । আমি স্বল্প সময়ে ঠিক ধরতে পারলাম না । আরেকবার দেখব বলে ছেলেটিকে আমার দিকে তাকাতে বললাম ।আগের মতোই মাথা নেড়ে না বলল ছেলেটি । আর জোর করলাম না । এবার কড়া কিছু ঘুমের ঔষধ লিখে দিলাম । বলে দিলাম যদি তারপরেও ঘুম না হয় তাহলে এক সপ্তাহ পর আবার আসতে ।
ছেলেটি চলে গেল । যাওয়ার আগে তার নাম , ঠিকানা , টেলিফোন নাম্বার লিখে নিলাম একটা কাগজে । কাগজটাতে দেখলাম ছেলেটার নাম সংশয় । সংশয় রহমান ।
২....ঠিক এক সপ্তাহ পর
- 'তুমি বলছ যে তুমি তোমার বড় বোন কে খুন করেছ ?'
উপরের নিচে মাথা দুলিয়ে সায় জানালো সংশয় । আজ আসার আগে ফোন করে জানিয়েছিল সংশয় । জানিয়েছিল যে কোন এক কারনে সে রাতে ঘুমাতে পারেনা । যে কারনে রাতে ঘুমাতে পারেনা সেই কারনটা আমাকে বলতে চায় । আমি ভাবলাম কথাগুলো শেয়ার করার পর ছেলেটা মানসিক ভাবে হালকা হয়ে যাবে । তখন হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে । ওকে দেখা করার সময়টা জানিয়ে দিলাম । ঠিক সময়েই আসলো । হালকা কথাবার্তার পর তার ঘটনাটা বলতে বললাম । ছেলেটা বলতে শুরু করল । টানা আধাঘন্টা বলে গেল ছেলেটা । মধ্যেখানে একবার পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়েছিলাম । এছাড়া আর কোন ব্যাঘাত হয়নি । ছেলেটা মনে হয় প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল । কোথাও না থেমে একটানা বলে শেষ করল ।
- 'তুমি তোমার বড় বোনকে খুব ভালোবাসতে , তাইনা ?'
আবার মাথা নিচু করে থাকা অবস্থায় মাথা নেড়ে সায় দিল সংশয় ।
-'তাহলে কেন খুন করলে ?'
আবার সেই লাল টকটকে শীতল চোখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল সংশয় । সেবারের মতো এবারো আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল ।
-'কারণটা আমি আপনাকে একবার বলেছি ।'
-'হ্যাঁ বলেছ । আবারো বলো । প্রথমবার যদি কিছু এড়িয়ে যেয়ে থাকো অথবা যদি মিস হয়ে যাওয়া কিছু থেকে থাকে তাহলে এবারে সেটা ধরা পড়বে । তোমার কথা সমস্তটাই এই টেপরেকর্ডারে রেকর্ড হচ্ছে ।' টেবিলের উপর রাখা কলমরূপী টেপরেকর্ডার দেখিয়ে বললাম । টেপরেকর্ডারের দিকে কিছুক্ষন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার শুরু করলো সংশয় ।
-'আপু আর আমি দুই বছরের ছোট বড়ো ছিলাম । পিঠেপিঠি হওয়ায় দুজনেই দুজনের খুব কাছাকাছি ছিলাম অর্থাত্ খুব ভালো বন্ধু ছিলাম । আমি আমার সব কথা আপুকে বলতাম আর আপুও । কিন্তু হঠাত্ করে আপু বলদে যাওয়া শুরু করলো । কেমন যেন নিজের ভেতরে গুটিয়ে যেতে থাকলো । সারাদিন একা একা থাকতো ।
আমি গল্প করতে গেলে চুপচাপ উঠে চলে যেত নাহলে মাথা ব্যাথার অজুহাত করে আমাকে চলে যেতে বলতো । আমার ব্যাপারটা ভালো লাগতো না । মাসখানেক এরকম যাবার পর একদিন সন্ধ্যার দিকে আপু বাড়ি ফিরে সোজা তার রুমে গিয়ে ঢোকে । দরজা খুলে দেয়ার সময় আপুকে দেখে খুব বিধ্বস্ত লাগছিল । কি হয়েছে জানতে আপুর রুমে যাই । আপু আমাকে দেখে ক্ষেপে ওঠে । জানিনা কেন । চিল্লাচিল্লি করে রুম থেকে বের করে দেয় । আমি কথা না বাড়িয়ে চলে আসি । পরদিন আপু হঠাত্ অসুস্থ হয়ে পড়ে । প্রথমে শারীরিক পড়ে মানসিকভাবে । শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতে লাগল । ঘুমাতে পারত না একটুও । সারারাত চিল্লাচিল্লি করতো । ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখত । শেষের দিকে আপুর অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করলো । চিত্কার করার মতো শক্তিও ছিলনা । নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকতো । একদিন সকালে আপুর পাশে বসে ছিলাম । তখন আপু আমার হাতে একটা ডায়রী তুলে দেয় । সেই ডায়রী পড়ে প্রথম জানতে পারি আপুর বয়ফ্রেন্ডের কথা ।
ডায়রীতে তাদের দুজনের সম্পর্কে খুটিনাটি সব লেখা ছিল । লেখা ছিল তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার কথা পর্যন্ত । একদম শেষের দিকে তাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা । ছেলেটা আপুকে ধোঁকা দিয়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে । আমি বুঝতে পারি এজন্যই আপুর আজ এ অবস্থা । ডায়রী পড়া শেষ করে আপুর পাশে গিয়ে বসলাম আবার । আপু শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলল । আমি বুঝতে পারলামনা । কানটা এগিয়ে নিয়ে গেলাম আপুর মুখের কাছে । আপু অনেক কষ্ট করে বলল 'যদি আমাকে ভালোবেসে থাকিস , তাহলে আমাকে মেরে ফেল । এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নাই ।' কথাটা শোনারপর আমার ভেতরে কি জানি হয়ে গেল । আমি আর থাকতে পারলাম না ।দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এলাম । চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছিল । সে অবস্থাতেই বুঝতে পারি আমি আপুকে ভালোবাসি । অনেক বেশী ভালোবাসি ।'
-'তারপর ?' পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম আমি ।পানিটুকু ধীর চুমুকে শেষ করে আবার শুরু করলো সংশয় ।
-'পরদিন আপুর অবস্থা আরো খারাপ হলো । শ্বাস নিতে পারছিলনা । হাসপাতালে নেয়া দরকার ছিল । কিন্তু আপু যেতে চাইছিলনা । ইশারায় বারবার অনুরোধ করছিল । অবশেষে বাসাতেই কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হলো । আমি দাড়িয়ে থাকতাম আপুর দরজায় । আর আপু নাকে মুখে অক্সিজেন নল নিয়ে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে । সে দৃষ্টিতে থাকত আকুতি । তাকে সাহায্য করার আকুতি , কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার আকুতি , মের ফেলার আকুতি । সেদিন রাতেই আমি ঠিক করি আপু আমার কাছে যা চেয়েছে তাই হবে । আপুর এ কষ্ট দেখতে আমারো ভালো লাগছিলনা । গভীর রাতে উঠে আপুর রুমে গেলাম । আপুর চোখ বন্ধ । খুব সম্ভবত ঘুমাচ্ছে । শেষবারের মতো দেখে নিলাম জীবিত আপুর মুখ । তারপর মুখ থেকে অক্সিজেন নলটা খুলে দিয়ে চলে আসতে ধরলাম । দরজার কাছে এসে পেছন ফিরে তাকাতে দেখলাম আপু তাকিয়ে আছে প্রশান্ত চোখে । রুমে ফিরে এসে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম । এবং সেটাই আমার শেষ ঘুম । তারপর থেকে আর ঘুমাতে পারিনি ।'
টেপরেকর্ডার বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম সংশয়ের গল্প শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই । চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে রাখা কোটটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে সংশয়কে আগের ঔষধ গুলো কন্টিনিউ করতে বললাম । একসপ্তাহ পর আবার দেখা করতে বলে বিদায় করলাম । সে চলে যাবার কিছুক্ষন পর আমিও বের হলাম । সোজা থানায় যাব । সংশয়ের ব্যাপারটা পুলিশকে জানানো দরকার । ছেলেটা পিশাচ শ্রেনীর । যে নিজের বোনকে খুন করার বর্ননা এত স্বাভাবিকভাবে দিতে পারে সে অবশ্যই পিশাচ শ্রেনীরই । এভিডেন্স হিসেবে টেপরেকর্ডারটা নিয়ে যেতে হবে ।সংশয় প্রথমবার যখন ঘটনাটা বলছিল তখন রেকর্ডার চালু করা ছিলনা । তাই দ্বিতীয় বার টেপরেকর্ডার চালু করে তাকে দিয়ে আবার ঘটনাটা বলাই । গাড়িতে ওঠার আগে পকেট হাতড়ে দেখি টেপরেকর্ডারটা নেই । মনে পড়ল ওটা চেম্বারেই ফেলে এসেছি । আবার চেম্বারে ঢুকলাম । কিন্তু টেবিলের উপর টেপরেকর্ডারটা নেই । বুঝতে পারলাম চলে যাবার আগে টেপরেকর্ডার নিয়ে যেতে ভুল করেনি সংশয়
***
-'দেখুন ! ড. তিয়াস আমরা এভিডেন্স ছাড়া কাউকে এরেস্ট করতে পারিনা । আইনের শেকলে আমাদের হাত বাঁধা । আমরা বড়জোর ব্যাপারটার একটা তদন্ত করতে পারি । তাও গোপনে । এই ধরুন , ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজখবর করার জন্য লোক লাগিয়ে দিলাম । যদি সন্দেহজনক কিছু পেয়ে যাই তাহলে থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে । আর তাতে করে সত্যি ঘটনা বের হয়ে আসবে আশা করছি ।'
চায়ের কাপ ঠোঁট থেকে নামিয়ে একটা বেনসন ধরাতে ধরাতে বললেন অফিসার ইন চার্জ । থানায় এসে সংশয়ের ব্যাপারে পুরোটা জানিয়েছি অফিসার কে । টেপরেকর্ডারের কথাও বলেছি ।
-'কতটুকু কী করা যায় দেখুন অফিসার । এভাবে একটা ঠান্ডা মাথার খুনির বাইরের মুক্ত পরিবেশে থাকাটা সত্যি বিপজ্জনক ।'
-'আমরা দেখছি । কতদূর এগুলো আপনাকে জানানো হবে '
-'থ্যাংক ইউ অফিসার'
উঠে দাড়িয়ে করমর্দন করে বের হয়ে আসলাম থানা থেকে । সংশয়ের ঠিকানা লেখা কাগজটা দিয়ে এসেছি অফিসারকে ।
***
বাসায় ফিরে প্রথমে ফ্রেশ হওয়াটা আমার পুরনো অভ্যাস । আজকে এর ব্যতিক্রম হলো । সোফায় বসে পড়লাম ঝপ করে । শারীরিকভাবে যতটা না ক্লান্ত তারচেয়ে বেশী মানসিকভাবে । বারবার সংশয়ের বলা গল্পটা মাথায় ভিতর উকিঁ দিচ্ছে । ঠিক উঁকি নয় মনে হচ্ছে হাতুড়ি পেটাচ্ছে । গল্পটার সাথে আমার কোথায় যেন একটা সংস্পর্শ আছে । ঠিক ধরতে পারছিনা । মাথার ভেতরটা বারবার ভারী হয়ে আসছে । আজকে আর ফ্রেশ হওয়া হবেনা । কোনমতে বেডরুমে এসে ঢুকলাম । বিছানাতেও ঝপ করে শরীরটা এলিয়ে দিলাম । বেডরুমে এলেই একা একা লাগে । মেঘলা নেই । গত মাসেই ছেড়ে চলে গেছে । ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছিল । সাইন করে দিয়েছি । যে থাকতে চায়না তাকে জোর করে ধরে রাখার কোন মানে হয়না । মেঘলার কথা মনে পড়তেই জোহরার কথাও মনে পড়ে গেল ।না না জোহরা আমার স্ত্রী না । স্ত্রী তো মেঘলা । জোহরা আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল । মেয়েটা অনেক ভালোবাসত আমাকে । অনেকটা বিশ্বাস করতো । কিন্তু কী করবো ?আমার সোসাইটির সাথে ওকে মানায় না । বাবা কোনভাবেই মেনে নিতেন না । তাই যা করার দরকার ছিল তাই করছিলাম । বাবা মার পছন্দে মেঘলাকে বিয়ে করে ফেলি । জোহরার কোন খবর পাইনি আর । হঠাত আমার বুকটা ছ্যাঁত্ করে উঠল । একমুহুর্তে শোয়া থেকে উঠে বসলাম । আচ্ছা , সংশয়ের বোনই জোহরা নয়তো ? ভাবতেই গা শিঁউরে উঠছে । নাহ্ জোহরা হতে যাবে কেন ? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম । সেই কবেই তো তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে । প্রায় বছর পাঁচেক হলো । এতদিন পর তার ভাই আমাকে কেন তার গল্প শোনাতে আসবে ? আর সবচেয়ে বড়ো কথা সংশয়ের কথা অনুযায়ী তার বোনের মৃত্যুর পর সে নাকি আর ঘুমাতে পারেনি । না ঘুমিয়ে সংশয় কেন , কোন মানুষই পাঁচ বছর কখনোই বাঁচতে পারবেনা । নাহ্ জোহরা হতেই পারেনা । কোনভাবেই না । নিজেই আবার উত্তর খুঁজে নিলাম ।
*হঠাত্ মোবাইলের রিংটোনের শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম । পকেট হাতড়ে মোবাইলটা বের করে দেখলাম পুলিশ অফিসারের ফোন ! ঘড়ির দিকে তাকালাম । রাত বাজে সাড়ে বারোটা । এতরাতে অফিসারের ফোন কিছুটা অনাকাংখিত বটে । রিসিভ করলাম ।
-'হ্যালো ? ড.তিয়াস ?'
-'জ্বি বলছি অফিসার । বলুন ।'
-'এত রাতে ফোন করার জন্য দুঃখিত ! আসলে নাইট ডিউটিতে আছি । বুঝেনই তো !'
-'সমস্যা নেই । জেগেই ছিলাম । আপনি বলুন ।'
-'আপনি যে ঠিকানা দিয়েছিলেন সে ঠিকানায় আমার দুজন লোক পাঠিয়েছিলাম । তারা জানাল যে ওখানে সংশয় নামে বা ঐ বয়সের কেউ থাকে না ।'
-'কি বলছেন আপনি ? কাগজটাতে তো টেলিফোন নাম্বার ছিল । সেটার খোঁজ করেছেন ?'
-'ড.তিয়াস আপনি মনে হয় ঐ নাম্বারটাতে কল করেননি । আপনি চলে যাবার পরই আমি ডায়াল করেছিলাম ঐ নাম্বার । আনরিচেবল !!'
-'আচ্ছা ঠিক আছে অফিসার । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।'
লাইন কেটে দিয়ে আবার বিছানায় বসে পড়লাম । এসবের মানে কি ? কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা । ছেলেটা ভুল ঠিকানা কেন দেবে ? আচ্ছা ছেলেটা পাগল নয়তো ? নাহ্ সে সম্ভাবনা কম । কথা বলে সে রকম মনে হয়নি । মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিন্তু পাগল হতে পারেনা । ধ্যুত ! যাই হোক সে আমার কি ? আমার ঘুমানো দরকার । ঘড়িতে রাত ১টা ১৭ মিনিট । ওই কাপড়েই শুয়ে পড়লাম । ফ্রেশ হতে একদম ইচ্ছে করছে না ।
ঘড়িতে ৪টা ১৩ । বারান্দায় বসে আছি । বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই সময়টা পার করে দিলাম । ঘুম হলোনা । একটা সিগারেট হলে ভালো হতো । অনেকদিন হলো সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি । তবুও ভরসা করে উঠলাম । খুঁজলে পাওয়া যেতেও পারে । প্রথমে বেডরুম তারপর রিডিংরুম খুঁজলাম । নেই । আবার বেডরুমে এসে কাবার্ডের ফাঁকে হাত দিতেই পেয়ে গেলাম । মেঘলার ভয়ে এভাবেই সিগারেট লুকিয়ে রাখতাম । বারান্দায় ফিরে সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিতেই মাথা ধরে উঠলো । বসে পড়লাম চেয়ারে । চোখ বন্ধ করে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম । তখনি চোখের সামনে ভেসে উঠল জোহরার মুখ । চমকে উঠে চোখ খুললাম । ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল চেহারাটা ।
***
-'স্যার কি আজকেও আসবেন না ?'
-'না !' বলে লাইন কেটে দিলাম । আমার কম্পাউন্ডারের ফোন ছিল । আজ সাত দিন হয়ে গেলো চেম্বারে যাইনা । শুধু চেম্বারেই নয় , ঘর থেকে বের হইনি । দারোয়ানকে দিয়ে খাবার আর সিগারেট আনিয়ে নিতাম । খাবার একটুও মুখে তুলতে পারছিনা , এদিকে ঘরময় সিগারেটের গন্ধে ভর্তি । নিজে যদিও অভ্যস্থ হয়ে গেছি । এই সাত দিনে এক মিনিটের জন্যও ঘুমাতে পারিনি । আয়নার সামনে দাড়াইনি ভয়ে । লাল রক্তজমা চোখ দেখার ভয়ে । ফোনের রিংটোন বাজছে । রিংটোনের শব্দ শুনে খুঁজে বের করলাম ফোনটা । রিসিভ করে কানে লাগাতেই
-'হ্যালো ডক্টর !'
-'কে ?'
-'চিনতে পারছেন না ? হাঃহাঃহাঃ আমি সংশয়'
একমুহুর্ত আমার গলা দিয়ে কোন স্বর বেরুল না ।
-'সংশয় ? তুমি ?'
-'অবাক হচ্ছেন যে ? আমার সাথে যোগাযোগের অপেক্ষাই তো করছিলেন মনে মনে । ঠিক বলেছি না ডক্টর ? হাঃহাঃহাঃ
-'এসবের মানে কি সংশয় ?'
-'এসবের মানে কি ? আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন এসবের মানে কি ? শুনুন ডক্টর , আমি আপনাকে একবারেই মেরে ফেলতে পারতাম । কিন্তু তাতে করে আপনার শাস্তি অনেক কম হয়ে যেত । আমি নিজেও শান্তি পেতাম না । আপনি যা করেছেন তার জন্য এটাই সর্বোত্কৃষ্ট শাস্তি । আমি বেঁচে আজ মরা । বেঁচে থেকেও আপনি একটু একটু করে পচে যাচ্ছেন । হাঃহাঃহাঃ '
-'কি বলছো এসব সংশয় ? আমি কি করেছি ? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ?' মরিয়া হয়ে গেলাম উত্তরটা জানার জন্য ।
-' বলতে পারেন পাগল হয়ে গেছি । নিজ চোখে নিজের বোনের এত বড়ো কষ্ট দেখতে দেখতে আমি পাগল হয়ে গেছি ডক্টর ! পাগল হয়ে গেছি । আর আপনি বলছেন আপনি কি করেছেন ? আপনার জন্য আজ আমার এই অবস্থা ডক্টর ! এর জন্য শুধুমাত্র আপনি দায়ী । আর এটাই আপনার শাস্তি ডক্টর । বেঁচে থেকেও প্রতিদিন একটু একটু করে পচে যাওয়া ।'
-'তার মানে তুমি জোহরার ভাই ?'
-'এই প্রশ্নের কি আদৌ কোন দরকার আছে ডক্টর ?'
লাইন কেটে গেল । বিছানায় এলিয়ে পড়ল আমার নিস্তেজ শরীর । রক্ত লাল চোখদুটো সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আছে । কানে ফোনটা ধরাই আছে তখনো । ওপাশ থেকে কল কেটে দেওয়ার টুট টুট শব্দ ভেসে আসছে যেন অনন্তকাল ধরে ।
* রাস্তার পাশে খুব সুন্দর একটা বাড়ি । বাড়ির পেছনে লনের একমাথায় একটা বেতের চেয়ার । গায়ে একটা ধূসর রঙের চাদর জড়িয়ে সেই চেয়ারে বসে আছে জোহরা । মোবাইলটা পকেটে রেখে জোহরার দিকে এগিয়ে গেল সংশয় রহমান । মুখোমুখি দাড়িয়ে জোহরার দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে একটা হাসি দিল । জোহরা কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হাসিটার মর্মোদ্ধার করার পর ঠিক একইরকম একটা হাসি ফিরিয়ে দিলো সংশয়ের দিকে । একই রকম অশ্রুসজল চোখে ।
সমাপ্ত
©somewhere in net ltd.