![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসেছিলাম বিরান প্রান্তরে সেখান থেকে চারাগাছ জন্মেছে; কিছু বিষন্ন চারাগাছ
আশরাফ সাহেবের দিনশেষে সব ঠিক থাকলে তিনি বলতে পারেন তার সকালটাও ঠিক ছিলো । চায়ে চিনি ঠিক ছিলো , পত্রিকার ভাঁজ উনিই খুলেছেন , ব্রেকফাস্টে বাটারের বয়ামটাও ছিলো ।
আর যদি ঠিক না থাকে তবে কিছুই ঠিক ছিলো না । চা ছলকে পড়েছে পিরিচে , পত্রিকা দেরীতে এসেছে , বাটারের বয়ামও হাতের নাগালের বাইরে ছিলো ।
এরকম হলে তিনি মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেন । মনে মনে চিন্তা করেন ঢাকা শহরে কোন জ্যাম নাই , ফুটপাতে বেআইনি দোকান নাই , পার্কে আবর্জনা নাই , সন্ধ্যা রাতের অন্ধকার গলিতে ছিনতাইকারী নাই , অফিসে দুর্নীতি নাই । আশরাফ সাহেবের মন ভালো হয়ে যায় । ভালো মন নিয়ে আশরাফ সাহেব গায়ে কোট চাপিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হন ।
আশরাফ সাহেব পূবালী ব্যাংকে চাকরী করেন । মতিঝিল শাখার সিনিয়র অফিসার । ১৪ বছর হয়ে গেছে চাকরীর । প্রমোশান পেয়েছেন মাত্র দুটো । এর পিছনে কারণ আছে । আজকাল প্রমোশান পেতে গেলে দুটো জিনিস একসাথে থাকা দরকার । টাকা এবং তেল । আশরাফ সাহেবের কোনটাই নেই । ফাইল ছাড়ানোর জন্য টেবিলের নিচ দিয়ে টাকা নেন না তাই তার খুব একটা টাকা নেই আর তেল দিতে পারেন না কারণ যাদেরকে তেল দিতে হবে তারা সবাই তার জুনিয়র । অনেক পরে জয়েন করেও তারা তরতর করে উপরে উঠে গেছে । আটকে আছেন শুধু আশরাফ সাহেব । তবে যদি টাকা এবং তেল দুটোই আশরাফ সাহেবের থাকতো তাহলেও তিনি তা প্রমোশান পাবার পেছনে ঢালতেন কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে ! *** মতিঝিল শাখার ম্যানেজার আব্দুল লতিফ । বয়স ছাব্বিশ সাতাশ হবে । ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে একাউন্টিং এ অনার্স মাস্টার্স শেষ করে সিনিয়র অফিসার হিসেবে জয়েন করেছিলো । বছর না ঘুরতেই প্রমোশান । দুষ্টু লোকেরা বলে প্রমোশানের পেছনে নাকি সাড়ে সাত কেজি বোয়াল আছে । আশরাফ সাহেব ওসব কথায় কান দেন না । বরফের চাঙে শুইয়ে রাখলেও হিংসুকদের পিঠ জ্বলবেই ।
***
কোন এক অজানা কারণে ম্যানেজার আব্দুল লতিফ , সিনিয়র অফিসার আশরাফ সাহেবকে অনেক শ্রদ্ধা করেন । অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয় । অফিসে একমাত্র আশরাফ সাহেবই কোন ফাইল আটকিয়ে রাখেন না , টেবিলের নিচ দিয়ে টাকা নেন না । এরকম মানুষকে শ্রদ্ধা করা যায় না বরং বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হয়, আড়ালে ছোটখাটো গালি দিতে হয় । অসত্ মানুষের ভীড়ে সত্ মানুষেরা সব সময়ই অপরাধী ।
ম্যানেজার হিসেবে আব্দুল লতিফের জয়েন করার কিছুদিন পর আশরাফ সাহেব একটা মোটা অংকের টিটির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছিলেন তার সাথে । আব্দুল লতিফ তখন টেলিফোন রিসিভার কানে লাগিয়ে খুব সম্ভবত হেড অফিসে কথা বলছিলেন । আশরাফ সাহেবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বসার ইঙ্গিত করলেন । আশরাফ সাহেব বসতেই আব্দুল লতিফ টেলিফোন ছাড়লেন । একটু ইতস্তত করে হাতে ধরে রাখা কাগজ এগিয়ে দিয়ে আশরাফ সাহেব বললেন
-"স্যার এই টিটির ব্যাপারটা যদি একটু দেখতেন !"
আব্দুল লতিফ হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলেন । অন্য সব কাগজের সাথে আলপিন মেরে টেবিলের এক কোণায় রেখে দিয়ে সরাসরি আশরাফ সাহেবের দিকে তাকালেন । হালকা গলায় বললেন
-"দেখুন, আমি আপনার জুনিয়র । বয়সেও, অভিজ্ঞতাতেও । পোস্টে হয়তো সিনিয়র কিন্তু সেটা কোন ব্যাপার না । আপনি আমাকে স্যার বললে অস্বস্তি হয় । সম্বোধন যদি করতেই হয় লতিফ সাহেব বলে সম্বোধন করলেই হবে ।"
আশরাফ সাহেব চোখ তুলে তাকালেন । একমুহুর্ত তিনি কি বলবেন ভেবে পেলেন না । মাথা ভার হয়ে এলো । কিছুক্ষন ইতস্তত করার পর চেয়ার ছেড়ে "আসি স্যার" বলে উঠে দাড়ালেন । হনহন করে হেটে চলে আসলেন নিজের চেয়ারে । টেবিলের উপর ঢেকে রাখা পানির গ্লাস খালি করে দিলেন একনিমিষেই । এই প্রথমবারের মতো তার নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হতে লাগলো । বিনা কারণে অপমানিত মনে হতে লাগলো । চোখ বন্ধ করে তিনি একাউন্টসের হিসেব করতে লাগলেন । তার মোট ছয়টা একাউন্ট । সবগুলো মিলে লাখ ছয়েক টাকা হয়তো আছে । আশরাফ সাহেব অফিসের পিয়ন মোর্শেদকে ডেকে পাঠালেন । টাকাগুলো তুলতে হবে, একইসাথে কিছুটা তেল মারার ক্ষমতা আয়ত্তে আনতে হবে ।
***
আশরাফ সাহেব এখন মতিঝিল শাখার ম্যানেজার । ম্যানেজারের চেয়ারের পেছন দিকের দেয়ালে একটা বড় কাঠের বোর্ডে তার নাম আর জয়েনিং ডেট লেখা আছে । একটু ফ্রি থাকলে তিনি চেয়ার ঘুরিয়ে সাদা কালিতে লেখা তার নামের দিকে তাকিয়ে থাকেন । তার ঠিক উপরের নামটা আব্দুল লতিফের । কেন জানি হঠাত্ করে ছেলেটার চাকরীটা চলে গেলো । বড় ভালো ছেলে ছিলো । আশরাফ সাহেবের হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো তবে ছেলেটাকে জোর করে একটা বড় চাকরী দিয়ে দিতেন । ঘুষ দিতে হলে দিতেন । তার একাউন্টসে এখনো প্রায় লাখ ছয়েক টাকা আছেই ।
আব্দুল লতিফ একটা কবরের সামনে দাড়িয়ে আছে । এপিটাফে বড় করে একটা নাম লেখা । কবরটা আব্দুল লতিফের বাবার । আব্দুল লতিফ আলতো করে কবরটা স্পর্শ করে । বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে । ভাঙা গলায় বলে "বাবা, তোমার সততা নিয়ে কত কথা বলেছি, কত কথা শুনিয়েছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমার কাছেই হেরে গেলাম । জিতিয়ে দিয়ে গেলাম তোমার মতোই একজনকে ।"
চোখ মুছে উঠে দাড়ালো আব্দুল লতিফ । একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা মোর্শেদের হাত থেকে কোটটা নিয়ে ধীর পায়ে এগোতে লাগতো বড় রাস্তার দিকে । মোর্শেদের চোখদুটোও ভিজে ওঠে । ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে আব্দুল লতিফের গমনপথের দিকে । লোকটাকে যেমন ভেবেছিলো আসলে তেমন নয় । অনুতাপ হচ্ছে মোর্শেদের । অফিসে বোয়াল মাছের গল্পটা মোর্শেদই ছড়িয়েছিল ।
মোর্শেদ ঘুরে দাড়ায় । কবরের দিকে হেটে যায় । সন্তানকে দেখেছে সে, সন্তানের বাবাকেও দেখতে হবে । মোর্শেদ চোখমুছে এপিটাফের দিকে তাকায় । কালো কালিতে বড় করে লেখা একটা নাম দেখা যাচ্ছে
"মরহুম আব্দুল আশরাফ"
©somewhere in net ltd.