![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসেছিলাম বিরান প্রান্তরে সেখান থেকে চারাগাছ জন্মেছে; কিছু বিষন্ন চারাগাছ
বাসায় একটা অঘটন ঘটে গেছে । ছোট খাটো না । বেশ বড়সড় । এতই বড় যে সবাই ভয়ে কুঁকড়ে আছে । এমনকি ছোটচাচাও নেমে এসেছেন চিলেকোঠা ছেড়ে । বসার ঘরে বসে গম্ভীরমুখে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন । প্রশ্ন করছে পুলিশের এসআই ওবায়দুল হক । ছোটচাচার পাশে বাবা বসে আছেন । একটু পরপর রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছছেন । বাবার পানের নেশা । তিনি যখন পান খান তখন পানের রস ঠোঁটের কোণা বেয়ে থুতনির কাছাকাছি চলে আসে । যে রুমাল দিয়ে তিনি ঘাম মুছছেন সেই রুমাল তিনি থুতনিতে জমে থাকা পানের রস মুছতে ব্যবহার করেন । টেনশনে আজ সব গোলমাল হয়ে গেছে ।
আম্মা তার শোবার ঘরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন । প্রায় দুই ঘন্টা অজ্ঞান হয়ে থাকার পর জ্ঞান ফিরেছে । একটু আগে তার মাথায় পানি ঢালা হয়েছে । অঘটনের খবর পেয়ে পাশের বাসার মিতু আপুও এসেছেন । এখন তিনি আম্মার মাথার কাছে বসে আছেন । ধীরে ধীরে মাথার চুলে বিলি করে দিচ্ছেন ।
আমি আমার ঘরে । পড়ার টেবিলে বসে আছি । সামনে এসএসসি পরীক্ষা । টেস্ট শেষ হয়ে গেলো এই কিছুদিন আগে । এখনো রেজাল্ট হয় নি । রেজাল্ট দিলে বাসায় আরেকটা বড় অঘটন হবে । কারণ আমি দুটো পরীক্ষা দেই নি । রসায়ন আর ম্যাথ । প্রস্তুতি ভালো ছিলো না । যা ছিলো তাতে করে টেনেটুনে পাশ করা যেত কিন্তু ভালো রেজাল্ট হতো না । এরচেয়ে না দেয়াই ভালো হয়েছে ।
***
ঠকঠক শব্দ কানে যেতেই ঘুম চটে গেলো । টেবিলের উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । চোখ কচলে টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত দুটা বাজে । এত রাতে কে জানালায় টোকা দিতে পারে আমি জানি । তারপরও ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম "কে ?"
উত্তরের আশায় কিছুক্ষন কান পেতে রাখার পরও কোন উত্তর পেলাম না । ভয়টা একটু বেড়ে গেলো । জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম । এবার ভারী গলায় উত্তর এলো "আমি !"
গলার স্বর আমার অনেকদিনের পরিচিত । ভয়টা কেটে গেল একমুহুর্তে । জিজ্ঞেস করলাম
"দরজা খুলবো ?"
-"না , দরজা দিয়ে ঢুকতে পারবো না । কেউ দেখে ফেলবে । তুই জানালা খোল ।"
আমার ঘরের জানালাটা দরজার মতোই কাজ করে । অনেকদিন সময় নিয়ে গ্রীলটা এমনভাবে কেটেছি যে এটা খোলা যাবে আবার লাগিয়ে রাখা যাবে । বাবার পকেট থেকে খুচরো টাকা চুরি করে ধরা পড়লে কিংবা কোনদিন বাড়ি ফিরতে খুব রাত হলে এই জানালাটা কাজে দেয় । কিন্তু দাদা কিভাবে এই জানালার রহস্য জেনে ফেললো বুঝতে পারলাম না ।
দাদা খুব সাবধানে জানালা টপকে ঘরে ঢুকলো । শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললো । আমি জানালাটাকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে দাদার দিকে ফিরলাম । বললাম
"দাদা লুঙ্গী নিবি ? আজকেই ধুয়ে রেখেছি । এখনো পড়া হয়নি ।"
-"লুঙ্গী ? হ্যাঁ দে । সাদাটা দিস ।"
আমি আলনা থেকে সাদা লুঙ্গি নিয়ে দাদার পাশে দাড়ালাম । দাদা শার্ট খুলে লুঙ্গী পড়ে নিলো । আমি বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলো সরিয়ে রাখলাম । তারপর ঝাড়ু দিয়ে বিছানাটা ঝেড়ে দিলাম । গায়ে কাঁথা টেনে দাদা শুয়ে পড়লো । আমি চেয়ারে গিয়ে বসে মিছেমিছি বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম । সন্ধ্যেরাতেই ঠিকমতো পড়াশুনা করতে পারিনা আর এখন তো মাঝরাত পার হয়ে গেছে । দাদা বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে লাগলো । জিজ্ঞেস করলাম
"দাদা , সমস্যা হচ্ছে ?"
-"কিসের সমস্যা ?"
-"না এইযে লাইট জ্বালানো ! তোমার তো আলোতে ঘুম হয় না । নিভিয়ে দেই ?"
দাদা উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শুলো । আমিও ভাবলাম এত পড়ে কাজ নেই । টেবিল গুছিয়ে , লাইট নিভিয়ে দাদার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম । কিছুক্ষন চুপচাপ শুয়ে থাকলাম । দাদা আটোসাঁটো হয়ে শুয়ে আছে । একজনের বিছানায় দুজনের ঠিকমতো জায়গা হওয়ার কথা নয় । অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে দাদার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো । আমি খুব আস্তে করে ডাকলাম
"দাদা ! ও দাদা !"
ঘুম জড়ানো গলায় দাদা জবাব দিলো
"হু , কি হয়েছে ?"
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম
"দাদা খুনটা কি সত্যি তুমি করেছো ?"
-"হ্যাঁ করেছি ।"
-"বাসায় আজকে পুলিশ এসেছিলো জানো ?"
-"জানি"
-"মাকে বাদে বাকী সবাইকে প্রশ্ন করেছে ।"
-"হু !"
-"ছোটচাচা বললো অপরাধ প্রমাণ হলে তোমার নাকি ফাঁসিও হতে পারে !"
-"হু !"
-"তুমি ধরা পড়ো না দাদা ! পালিয়ে থাকো । বাসাতেও এসোনা আর । নাহলে হয়তো বাবাকেও ধরে নিয়ে যাবে ।"
দাদা কিছু বললো না । আমিও চুপ করে গেলাম । দাদার হয়তো ঘুম পেয়েছে খুব । দীর্ঘক্ষন চুপ থাকার পর জিজ্ঞেস করলাম
"দাদা ! ও দাদা ! কেন তুমি খুন করলে ? দাদা ? ও দাদা ?"
হঠাত্ রেগে উঠল দাদা । ধমক দিয়ে বললো
"এখন ঘুমা তো ছোটন । জ্বালাতন করিস না ।"
আমি চুপ করে গেলাম । দাদার উল্টোদিকে মুখ ফিরে শুলাম । চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে । আমি কান্না থামাতে পারছি না । দাদা ধমক দিয়েছে এজন্য কাঁদছি না । কাঁদছি কারণ মা দাদাকে অনেক ভালোবাসে । আমার চেয়ে বেশী । দাদার ফাঁসি হয়ে গেলে মা-ও বাঁচবে না । দাদা যে কেন খুন করতে গেলো !
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই । ভোর বেলা ঘুম ভাঙার পর পাশে তাকিয়ে দেখি বিছানা খালি । দাদা নেই । ভোর বেলাতেই হয়তো চলে গেছে । আমি বিছানা ছাড়লাম । ফ্রেশ হয়ে বই নিয়ে বসবো কিনা ভাবছি এমন সময় রান্নাঘর থেকে মা চেঁচিয়ে ডাকলেন
"খোকন , এদিকে একটু শুনে যা তো"
রান্নাঘরে যেতেই মা হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলেন । বললেন ,
"তোর বড়মামা এসেছে । যা চা দিয়ে বসতে বস গিয়ে ।"
***
আমার বড়মামার নাম আজীজ মোল্লা । কাশিপুর জজকোর্টের মোক্তার । বেশ শক্ত মানুষ । শুনেছি নানা যখন মারা যান তখন তার বয়স ছিলো সতেরো । ঐ সময় থেকে আজ পর্যন্ত শক্ত হাতে সংসার চালাচ্ছেন । দুটো বোনের (আমার মা সহ) বিয়ে দিয়েছেন আর ছোট ভাই অর্থাত্ আমার ছোটমামাকে মাস্টার্স পড়াচ্ছেন ।আমি বড় মামার দিকে চা এগিয়ে দিয়ে বললাম
-"মামা আপনার চা !"
বড়মামা চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন
-"আদব কায়দা সব পানিতে গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছিস তাই না ? গুরুজনদের সালাম দিতে হয় না ? বেয়াদব ছেলে !"
আমি মাথা নিচু করে সালাম দিলাম । বড়মামা উচ্চস্বরে সালামের উত্তর দিলেন । এতই উচ্চস্বরে যে আমি চমকে উঠলাম । ছোটচাচা চিলেকোঠা থেকে "কে ? কে ?" বলে চিত্কার করতে লাগলেন । আগেই বলেছি বড়মামা শক্ত মানুষ । অপ্রস্তুত বলে যে শব্দ আছে সেটা বড়মামা জানেন না । জানলেও মানেন না । চা শেষ করে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ক্ষুদ্রাকারের পানের বাটা বের করে একটা পান মুখে দিলেন । আমার উঁকি মেরে দেখতে ইচ্ছে হলো ভেতরে কয়টা পান আছে । কারণ পান শেষ হয়ে গেলে আমাকেই দৌড়াতে হবে পান আনতে । বড়মামা পান চিবোতে চিবোতে বললেন
"সালাম এবং সালামের উত্তর দুটোই উচ্চস্বরে দিতে হয় । যারা যারা শুনবে তারা সবাই সওয়াব পাবে ।"
আমি ঘাড় বাঁকা করে নিজের ঘরে ফিরে এলাম । গত তিনদিন থেকে ম্যাথ করা হয়নি । আজকে একটুখানি চেষ্টা করা যায় । অন্তত ম্যাকলরিন এর উপপাদ্য পর্যন্ত চোখবুলানো যায় ।
***
আমার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে । বাংলা , ইংরেজী হয়ে গেছে । সামনে ম্যাথ । নাকমুখ গুঁজে তিনবেলা ম্যাথ করছি । একটার পর একটা খাতা ভরাচ্ছি । অনেক রাত করে ঘুমাতে যাচ্ছি আবার খুব সকালে উঠে পড়তে বসছি । এমনই এক সকালে বড়মামা আসলেন বাসায় । দরজা খুলে বড়মামাকে দেখে আমি চিত্কার করে সালাম দিলাম । বড়মামার হাতে মিষ্টির প্যাকেট ছিলো , ওটা ঠাস করে নিচে পড়ে গেলো । মুখে সামান্য খুশীর আভা ছিলো সেটা মুছে গিয়ে শুকনো শুকনো ভাব চলে এলো । আমি বোকা বোকা মুখ করে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম । বড়মামা বিড়বিড় করে সালামের উত্তর নিলেন । সেটা ভালো করে আমার কান অবধি পৌঁছালো না । বসার ঘরে বড়মামাকে বসিয়ে রেখে আমি আমার ঘরে ফিরে ম্যাথ করতে বসে পড়লাম । নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই একদম ।
সেদিনই খবর পেলাম কোর্টে নাকি দাদা নির্দোষ প্রমাণীত হয়েছে । যেসব সাক্ষী দাদার বিপরীতে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলো তারা সাক্ষ্য দিয়েছে দাদার পক্ষেই । এছাড়াও কিছু মেডিকেল রিপোর্ট , আবাসিক হোটেলের কাস্টমার হিসাব খাতা ইত্যাদি দাখিল করতে হয়েছে । আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম এ সব কিছু হবে । যেদিন বড়মামা এসেছিলো সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম । শুনেছি মামলা মোকদ্দমায় আজ পর্যন্ত কেউই বড়মামাকে হারাতে পারে নি । আমি ম্যাথ করতে করতেই অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন দাদা বাড়ি ফিরবে । রোদে পোড়া তামাটে চেহারা নিয়ে বোকার মতো হাসবে । চোখ ভরা দুষ্টুমি নিয়ে জিজ্ঞেস করবে
"কি রে ছোটন সেদিন রাতে বিছানা ভিজিয়েছিলি ক্যানো ?"
তারপর হো হো করে হাসবে । আমি ম্যাথ করতে পারছি না । মাথা ভার ভার লাগছে । চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে । বাম হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে গিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু পড়ে গেলো অসম্পূর্ণ ম্যাথের উপর ।
***
একদিন খুব সকালে বাবা আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলেন না । কথা বলতে পারলেন না । কথা বলার চেষ্টা করলেই গোঙানির মতো আওয়াজ বের হতে লাগলো । মুখের কোনা দিয়ে লালা পড়তে লাগলো অনবরত । পাড়ার প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার রমেশ কাকু বাবার বন্ধু । কাকু বললেন বাবার প্যারালাইসিস হয়েছে । সেদিন মা অনেক্ষন কাঁদলেন । দুপুরে রান্না হলো না । আমি ছাড়া সেটা কেউ খেয়ালও করলো না । আমার ভীষন ক্ষিধে পেয়েছিলো । ছোটচাচার কাছে কিছু টাকা চাইলাম । দাদা বাসায় নেই । থাকলে কিছু একটা জোগাড় করে ফেলতো । ছোটচাচা খেকিয়ে উঠলো আমার উপর
"টাকা কোথায় পাব আমি ? আমার কি চাকরি আছে ? নাকি ঘরে টাকশাল খুলে বসেছি ? দূর হ সামনে থেকে !"
নন্দুবাবুর দোকান থেকে আলুভাজি আর ছয়টা রুটি নিয়ে এলাম বাকীতে । ডায়নিং টেবিলে বসে খেতে খেতে মা কে ডেকে বললাম
"বাকীতে ক'টা রুটি এনেছি নন্দুবাবুর দোকান থেকে । খেয়ে নাও , বাবাকেও খাইয়ে দাও ।"
মা কিছুক্ষন ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হনহন করে চলে গেলো । দাদা বাড়িতে থাকলে নিজেই কিছু একটা রেধে ফেলতে পারতো । তাহলে অন্তত মায়ের ওরকম দৃষ্টি দেখতে হতো না । দুটো রুটি পেটে চালান করে আর দুটো একটা প্লেটে ঢেকে নিয়ে চিলেকোঠায় এলাম । ছোটচাচা ঘরেই ছিলো । আমি ধপ করে প্লেটটা সামনে রেখে বেরিয়ে এলাম । আমার ভীষণ কান্না পেতে লাগলো । ছাদের এক কোনায় দাড়িয়ে ছোটবাচ্চাদের মতো শব্দ করে কাঁদলাম কতক্ষন । তারপর মনে হলো আমি আর ছোট নেই । সামনের বছর এইচএসসি দেব । এভাবে কাঁদে ক্লাস টুয়ে পড়া ছেলেরা । সহজ অংক ভুল করে স্যারের হাতে শক্ত মার খেয়ে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফেরে ক্লাস টুয়ে পড়া ছেলেরা । এতসব ভেবে চোখ মুছতে গিয়ে আমি আবার হু হু করে কেঁদে ফেললাম ।
***
দাদা হারিয়ে গেছে । মাসতিনেক হলো দাদার সাথে কোন যোগাযোগ নেই । একদিন ভোরবেলা দাদা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো
"ছোটন , দরজাটা লাগিয়ে দে । আমি একটু বাইরে যাচ্ছি । মা কে দেখে রাখিস ।"
আমি ঘুমের ঘোরে দরজা লাগিয়েছিলাম শুধু । কিছু জিজ্ঞেস করা হয় নি । করলেও উত্তর পেতাম কি না সন্দেহ । সেদিন ছোটচাচা নেমে এসেছিলো আমার ঘরে । আমি তখন বসে বসে নিউটন , আইনস্টাইন পড়ছি । পেছনে দাড়িয়েই ছোটচাচা বললো
"তোর দাদা একটা চিঠি পাঠিয়েছে । তোর কথা লিখেছে । ভালো করে পড়াশুনা করতে বলেছে ! আরো কি কি সব যেন । তোর মার কথাও লিখেছে ।"
আমি মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম ছোটচাচার দিকে । ছোটচাচা চোখ ফিরিয়ে নিলো । এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো । বললাম
"নিজের কথা কিছু লিখেছে ?"
"হ্যাঁ ! লিখেছে ইন্ডিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছে । ওখানে নাকি কে আছে ওর । বলেছে চাকরীর ব্যবস্থা করে দেবে ।"
ইন্ডিয়ায় রিপনদা থাকে । দাদার বন্ধু । কি এক ঔষধ কোম্পানিতে চাকরী করে । গত দূর্গাপূজার ছুটিতে এসেছিলো । আমি কিছু বললাম না আর । ছোটচাচা কিছুক্ষন আমতা আমতা করে বললো
"ভাবছি আমিও একটা চাকরী করবো । কি বলিস ছোটন ?"
আমি আর কি বলবো ? কিছু বললাম না । চুপ করে ঠায় বসে রইলাম । উত্তরের আশা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো ছোটচাচা । আমি নিউটন , আইনস্টাইনে মনোনিবেশ করলাম আবার ।
***এক বছর পর
আমার এইচএসসি চলছে । দুটো পরীক্ষা বাকী আছে । তারপর প্র্যাকটিক্যাল । তারপর কি করবো সেটা এখনো চিন্তা করতে পারি না । বাবার প্যারালাইসিস হবার পর সংসারের অবস্থা ভালো না । পেনশনের সামান্য কিছু টাকা পাওয়া যায় সেটা দিয়ে পুরো মাসের শাক ভাতই জোটে না ঠিকমতো । ছয়মাস আগে দুটা টিউশানি শুরু করেছিলাম । ওই টাকাতেই ফরম ফিলাপ করেছি । সংসার চালাতে না পেরে একদিন চোখে আঁচল চাপা দিয়ে মা বলেছিলো
"এত পড়ালেখা করে কি করবি ? তারচেয়ে সংসার দ্যাখ ।"
আমি মুখে কিচ্ছু বলিনি । মনে মনে শক্ত হয়েছি । বিড়বিড় করে বলেছি
"তাই তো করছি মা ! সংসার দেখবো বলেই তো করছি ।"
***দুই বছর পরঃ
ছোটচাচা একটা মুদী দোকান করেছে বছর খানেক আগে । ভালোই চলছে । আমি ভর্তি হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে । শহীদুল্লাহ হলে সিট পেয়েছি । সাথে পেয়েছি তিনটে মহামূল্যবান টিউশানি । কোচিং সেন্টারগুলো যোগাযোগ করছে নিয়মিত । সময় করে উঠতে পারছি না । ওরাও বেশ ভালোই টাকা দেবে । দেখি সামনের মাসে এক্সট্রা কিছু সময় রাখতে হবে হাতে ।
আমি এখন বাসে । বাড়ি ফিরছি শেষবারের মতো । বাবাকে দেখতে আর মাকে আনতে যাচ্ছি । মোহম্মদপুরের দিকে ছোট্ট একটা বাসা নিয়ে মা ছেলে একসাথে থাকবো । বাবাকেও নিয়ে আসা যেত কিন্তু গত রাতে হঠাত্ করে বাবা মারা যাওয়ায় আর সম্ভব হলো না । ছোটচাচা বললো হার্ট এটাক করেছে । আমি তখন ক্লাসে ছিলাম । খবরটা শুনে একটুও কাঁদিনি । কেন জানি কান্না আসেই নি । ধীর পায়ে ক্লাস থেকে বের হতে গিয়েছি । স্যার জিজ্ঞেস করলেন
"সংশয় ! কোথায় যাচ্ছো ?"
আমি কিছু না বলে ঠায় দাড়িয়ে থাকলাম । স্যার মনে হয় আমার চোখে কিছু দেখেছিলো । কাছে এগিয়ে এসে কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো
"এনিথিং রং ?"
হঠাত্ করে মনে হলো ঝড় এসেছে । ভেঙে ফেলছে সবকিছু । উপরে ফেলছে আমার ভেতরের দুইশো বছরের পুরনো শক্ত শেকড়ের বটগাছ । আমি আর ধরে রাখতে পারলাম না । ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম ক্লাসভর্তি ছেলেদের সামনে । চিত্কার করে বললাম
"আমার বাবা মারা গেছে স্যার । বাবা মারা গেছে । বাসায় যাচ্ছি স্যার । বাবাকে শেষবার দেখতে ।"
***
বাবাকে যেদিন দাফন করা হলো সেদিন অনেক আশা করে ছিলাম দাদা আসবে । এবার দাদা আসলে আর কোথাও যেতে দেব না । দরকার হলে সাথে করে ঢাকায় নিয়ে আসবো । কিন্তু দাদা আসেনি । ছোটচাচা বললো বর্ডার পার হতে গিয়ে নাকি ধরা পড়েছে বিএসএফের হাতে । বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে আল্লাহই জানে । ঢাকায় ফিরছি । একা । মাকে বলেছিলাম সাথে আসতে । অনেক জোরও করেছিলাম । কিছুতেই রাজী হলো না । বললো বাবাকে ছেড়ে নাকি কোথাও যাবে না । তারপর আর কথা বাড়াই নি । ছোটচাচাকে বলে এসেছি মাকে দেখে রাখতে । প্রতি মাসে কিছু টাকাও পাঠাতে চেয়েছি কিন্তু ছোটচাচার চিত্কার চেঁচামেচিতে দমে গিয়েছি । বলে
"এখনো কি আমি বেকার আছি যে এখনো তোদের টাকায় চলতে হবে ?"
এরপর আর কিছু বলা যায় না । ছোটচাচা আমাকে বাসে উঠিয়ে দিতে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এসেছিলেন । আমি আমার সিটে বসে ছিলাম । জানলা দিয়ে ছোটচাচাকে দেখা যাচ্ছিলো । বাস ছাড়ার আগে আগে হাত নেড়ে আমাকে ডাক দিলো ছোটচাচা । আমি বাস থেকে নেমে গিয়ে দাঁড়ালাম তার সামনে ।
"ছোটন , আমাকে মাফ করে দিস !"
"কি বলছো এসব ছোটচাচা ? পাগল হয়ে গেলে নাকি.... ?"
ছোটচাচা হাত তুলে থামিয়ে দিলেন আমাকে ।
"বলতে দে ছোটন । তোর মনে আছে ? একদিন তুই আমার কাছে রুটি কেনার জন্য টাকা চেয়েছিলি । টাকা নেই বলে আমি তোকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম । মনে আছে ?"
মাথা নিচু করা ছিলো । আমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলাম । "সেদিন আমার কাছে টাকা ছিলো ।"
আমি মাথা তুলে তাকালাম ছোটচাচার দিকে । ছোটচাচা কাঁদছে । দু চোখ বেয়ে ঝরঝর করে ঝর্ণার মতো নেমে আসছে অশ্রু ।
"আমাকে মাফ করে দিস ছোটন !"
আমি ছোটচাচাকে জড়িয়ে ধরলাম । ছোটচাচা আমার কাধে থুতনি রেখে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো । কান্না সংক্রামক । আমিও ছোটচাচাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে থাকলাম । পুরো বাসস্ট্যান্ডের সমস্ত মানুষ তখন স্তব্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছিলো । শুধু বাসস্ট্যান্ড কেন পুরো পৃথিবী তাকিয়ে থাকলেও আমাদের কারো কিছু এসে যেত না ।
©somewhere in net ltd.