নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভোরের শরীরে এখনও লেগে আছে রাত্রির দগদগে ক্ষত

শ. ম. দীদার

কার্ণিশ ভাঙ্গা জানালার ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশের যেটুকু অংশ দেখা যায়, অইটাই আমার পৃথিবী।

শ. ম. দীদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশের চিঠি, বাংলা আম্রিকানোস রুনু ভাইকে

২২ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:৫৩

তারিখঃ ট্রান্সপোর্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিষুধবার অগ্রহায়ণ ২২, ১৪১৯



এলাহি ভরসা



প্রিয় বাংলাদেশি আম্রিকানোস রুনু ভাই

সালাম জানবেন। ভাবী সাহেবানকে হাজার হাজার সালাম ও সন্তানের প্রতি অযুত দোয়া রইল। আপনার বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি যোগ্যমত সালাম ও দোওয়া বাদ পরসমাচার এই যে, আশা করি আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের অশেষ মেহেরবানীতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে দিন গুজার করছেন। আমরাও এদিকে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের অশেষ কৃপায় (যদিও আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন এই অভদ্র পল্লীতে খুব একটা আসেন না) এবং আপনাদের দোওয়ায় অত্যন্ত ভালোভাবে দিন গুজার করছি আঁধার আবৃত বিছানায় মৃত্যুর সাথে শালীন জড়াজড়ি করে। অবশ্য আধুনিক পণ্যবাদী বিশ্বের অতীব ক্ষুদ্র আমাদের এই দেশে এখন হায়াত-মউত ভূ-স্বামী, মালিক শ্রেণী, জোতদার, চালক ও ক্ষমতাসীনদের হাতে যতটা না পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর হাতে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় এই ভেবে যে আমরা বেঁচে আছি। সকালে বাড়ি থেকে বের হবার সময় রাম-লক্ষ্মণ, খোদা-ভগবান, ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে বের হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে রুদ্র গন্ধ মুছে শরীর থেকে বিছানায় যাবার আগে পীরানে পীর বড় পীর আব্দুল কাদির জিলানীর নাম, বাবা পরমহংস দেবের নাম, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংসদ সদস্যদের নাম নিয়ে ঘুমাতে যাই, অবশ্যই তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে। তাদেরই কৃপায় তো একটা দিন বেশি বাঁচলাম। যীশু খৃষ্টের নাম ও নিই। কারণ কখন কারে কোন কামে লেগে যায়। আর এমনিতেই তো আপনারা আম্রিকানরা আমরা গরীব ভুখা অধমদের সন্ত্রাস, দালাল আর ধান্দাবাজ বলে গালি দেন। ইদানিং তো জোর চেষ্টাও চালাচ্ছেন সাক্ষাৎ সন্ত্রাস প্রমাণ করার জন্য। সম্প্রতি বাংলাদেশি যে ছেলেটাকে আপনারা যে স্টাইলে ধরলেন, সে স্টাইল নিয়ে খোদ আপনাদের দেশেই সমালোচনা হয়েছে। সেদিকে আমরা যাবো না। ছোট মানুষ। মূখ্য-সুখ্য। বড়দের বিষয়ে আদাব লেহাজ মেনে চলা অতি উত্তম।

আপানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ দিই। সম্প্রতি অন্তু নামের ৩৮তম আবর্তনের ইউআরপি বিভাগের একটা ছাত্র ঢাকার প্ল্যানার্স টাওয়ার থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমার মনে হয় এই আত্মহত্যার পাইপলাইনে আরো কিছু ছেলে মেয়ে আছে। শুনলে অবাক হবেন, আত্মহত্যার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি শ্রদ্ধভাজন শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হাত রয়েছে। সে ব্যাখ্যা অন্য কোনদিন দেব। অন্য একটা খবর দিই। ক্যাম্পাসে এখন খাবারের ব্যবসা রমরমা। এখন দেড় ভাত, পাঙ্গাস মাছের ঝোল, একটা আলু ভর্তা, দেড় গ্লাস পানি, এক চিমটি লবণ দিয়ে ভাত খেলে সত্তর টাকা বিল আসে যেখানে আপনারা থাকতে এমন কী আমরাও দেড় ভাত, পাঙ্গাস মাছের পেটি, একটা মাছ ভর্তা, পুরো আড়াই গ্লাস পানি, তিন চিমটি লবণ দিয়ে দুপুরের খাবারটা খেয়ে বিল্লালের দোকান থেকে এক কাপ গরম চা খেলেও বিল আসত আঠার থেকে বিশ টাকা। দুপুরে খেয়ে যে একটা ভাত ঘুম দিতাম সেটা এখন ক্যাম্পাস থেকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, কারণ সত্তর টাকা দিয়ে অতৃপ্ত খাবারটা খেয়েই দৌড় মারতে হয় ক্ষেপ মারার দিকে দু’পয়সা কামানোর জন্য। কেননা, আজকে যারা সত্তর টাকা দিয়ে খাচ্ছে ভাববেন না, তাঁরা বড়লোকের ছেলে-মেয়ে। তাঁরা ঠিক এখনও বাবা মা’র কাছ থেকে আড়াই-তিন হাজারই পায়, পাঁচশ টাকা বেশি দিলে হয়ত, বাড়িতে দুদিন পান্তা ভাত খেয়ে থাকতে হয়। অথচ প্রতিদিন ঢাকা শহরে দালান ঊঠছে হু হু করে, নিত্য নতুন গাড়ি চলছে শাঁই শাঁই করে। একটা তথ্য দিই। কলাবাগান রোডে প্রতিদিন একটা নয় নম্বর বাসের বিপরীতে এগারটা প্রাইভেট কার চলে।

তাতে কী, এলিফ্যান্ট রোডে বিমান চললেই কী আর মেঘনায় লঞ্চ ডুবে মানুষ মরলেই কী। এদেশে শেয়ার বাজারে সব হারিয়ে আত্মহত্যা করলেও বিরোধীদল হরতাল জ্বালাও পোড়াও অবরোধ ডাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য। সেলুকাস বটে।

তো এবার যাবার বাংলাদেশে এসে আমাকে যে এক ডলারের একটা নোট দিয়েছেন, গতকাল রাতে ঘুমোতে যাবার আগে একবার তার গন্ধ নিয়েছিয়ালাম। ভাবছিলাম এক গ্লাস পানিতে তিনবার চুবায়ে আব্রাহাম লিঙ্কনের নামে তিন ঢুকে গিলে ফেলব। হইলেও তো হতে পারে মনোবাঞ্ছা পূরণ। তয় পরে মনে হইল আগে লেমিনেটিং কইরা লয়। তয় যহন গন্ধ নিছিলাম তহন ক্যান জানি বারুদ আর রক্তের গন্ধ পেলাম ডলারের কচকচে শরীর থেকে।

একটা সুখবর আছে। আমাদের গেরামে এখন টিভি দেখা যায়। শুধু টিভিই দেখা যায় না। এখন কোনটা বাংলাদেশি চ্যানেল আর কোনটা ভারতীয় চ্যানেল এটা বুঝাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন জানেন, ব্রাদার। আমগো দেশি টিভি চ্যানেলে এখন খুললেই শারুখ মিয়া আর কারিনা আপারে দেদারসে পাওয়া যায়। ঐশ্বরিয়া আর আঞ্জেলিনা জুলি তো পুরাই মুফতে মিলে। জাহিদ হাসান বা জাফর ইকবালের কথা যদি আমগো ছোড ভাই-বেরাদরদের জিজ্ঞেস করি, কই এডি কিডা? যেমন করে কলেজে পড়ুয়া সবচে ইশ্মার্ট ছেলেটার টি-শার্টে সেঁটে থাকা চে’র ছবিটার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, আরে ভাই, আপনে কী। কই থাকেন? ডিজিটাল যুগে এসে এই লোককে চিনেন না? অই হইল হলিউডের সবচে জনপ্রিয় নায়ক। এক সময় মডেলিং করতো। গিটার ও বাজাইত। শুনে বাম কান টেনে ধরে ডান গালে কানপট্টি গরম করে একটা কষে চড় লাগাইতে ইচ্ছা করলেও নিজেরে সামলে নিতে হয়। ঠিকই তো বলেছে। পণ্যবাদি আধুনিক অরত্থ-ব্যবস্থার কাছে চে নিছক একজন টি-শার্টের মডেল ছাড়া কিছুই না। নায়কই তো বটে। আম্রিকা তো চে কে পারলে ফিল্মের ভিলেন চরিত্রে রুপ দিতে প্রস্তুত, যেমন করে আজকের আজিজ সুপার মার্কেট পরিণত হয়েছে একটা সমগ্র ফ্যাশন হাউজে।

যে কথা বলতে চেয়েছিলাম, আপনার নিশ্চয় ভুলে যাবার কথা না। আপনাকে প্রায়ই অভিযুক্ত করতাম একজন নষ্ট লেফটিষ্ট হিশেবে। যখনই শুনতাম আপনি চলে যাবেন বিদেশে, তখনই গালি দিতাম। বলতাম, একটা পাবলিক বিশ্ববিব্যালয়ে পড়েছেন আট টাকা মাসিক বেতন আর দশ টাকা রুম ভাড়া সাথে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার গারি ভাড়া দিয়েছেন এক টাকা, মাত্র এক টাকা। ঈশাখাঁ’র আমল বটে। আপনাকে পড়িয়েছে এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, মামা বলে যে লোকটাকে গালি দিই সেই রিক্সাওয়ালাটা, বেশ্যা বলে নাক সিটকাই সেই মাগিটা, মেথর বলে অবজ্ঞা করি সেই লোকটা। হ্যাঁ হ্যাঁ সেই লোকটা। অথচ নেমক হারামির মত এদের ত্যাগ করছেন। এইসব গালিই দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে চলে গিয়ে আপনিই ঠিক কাজটি করেছেন। কেননা বর্তমান বাংলাদেশের বিপ্লবীরা এখন যুদ্ধাপরাধী, মানবতা বিরুধীদের সাথেই চলে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আসলে ছিল ব্যাঙ্ক লুটেরা, সে এখন যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে সাফাই গায়। সুতরাং এই দেশে থেকে কী লাভ??? গায়ে চড়িয়ে থাকি চে’র ছবি আঁকা টি-শার্ট আর চিন্তা ও চেতনায় ধরে রাখি হবস-লক-রুশো’র স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক পৃথিবীকে। যোগ্যতার বলে ঠিকে থাকার নাম করে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছি গরীবের রক্ত পান করে। উপরে উঠার জন্য সচেষ্ট হচ্ছি খেটে খাওয়া মানুষের বুকে পাড়া দিয়ে। বুঝে গেছি ঢের আদর্শ দিয়ে কী হবে। মার্ক্স-লেনিন বইয়ে পড়ি আর সন্ধার আধারে বেনসন এ্যান্ড হেজেসের ধোঁয়ায় আধার নামায়। হাজার কোটি লুপাট করে ফেল্লেও মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেন এতো সমান্য টাকা মাত্র। সন্ত্রাস আর জাতীর ভবিষ্যৎ (?) সোনার ছেলেদের চাপাতিতে খন্ড-বিখন্ড হয় পথচারির শরীর আর সরকার বলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিচ্ছিন্ন ঘটনায়ই বটে। আমরা এখন যুদ্ধাপরাধী-খুনি-ধর্ষককে চাঁদে দেখে রাস্তায় নেমে এসে তান্ডব চালায়। পুড়ে যায় মন্দির-মসজিদ-গির্জা, পুড়ে যায় হরি কাকু’র ভিটে-মাটি টিনের চালা। আর আমরা দুই লাইন ফেইসবুকে লিখে ভেবে নিই যাক মুই হনুডা বাল ছিড়ছি। ওদিকে মাঝ রাতে নিখোঁজ হয়ে গেছে কোন একজন পথচারি সরকারি কালো শকুনের বিস্তৃত থাবায়। দিনশেষে একটা হা পিত্যেশ নিয়ে শরীর থেকে রৌদ্র গন্ধ মুছে এলিয়ে পড়ি আধার আবৃত নীল বিছানায়, মৃত্যুর শালীন জড়াজড়ির সাথে।

কিন্তু না। যারা একদিন ভোর এনেছিল নিকষ কালো আঁধারের বুক চিরে, আমরা তাদের উত্তরসুরি। যারা একদিন সুর্যোদয় এনেছিল রক্তাক্ত প্রান্তরের মাঠ পেরিয়ে আমরা তাদের সন্তান। যারা একদিন সোনালি সকাল ছিনে এনেছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল, রক্তগঙ্গা সাঁতরে আমরা তাদের রক্ত বয়ে বেড়িয়েছি শরীরে। এবার তাঁরা জেগেছে। আজ শাহবাগ হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ঝাঁঝালো মিছিলের প্রান্তর। আমাদের প্রতিশ্রুতি একটি সবুঝ সময়ের। আমাদের প্রতিশ্রুতি একটি আলোকজ্জ্বল সোনালি সকালের। পাপ ও পঙ্কিলতাকে মুছে ফেলার। এই শাহবাগ, শুধুই শাহবাগ। এর সাথে কেউ তাহরির স্কয়ারকে মিলাবেন না। আমার/আমাদের অক্ষমতা আছে। চেষ্টার কমতি হয়ত থাকছে না। দোয়া করেন।

চিঠির আজকের অংশটা শেষ করতে চাইছি। তবে চিঠি আর একটু দীর্ঘায়িত হবে। পরবর্তী খন্ডে হয়ত শেষ করব। আজকের অংশ শেষ করার আগে মার্ক্সের ধর্ম বিষয়ক আলোচনা থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি। মার্ক্স’র বলেন- ধর্ম হচ্ছে ক্ষমতাশালীদের হাতিয়ার (a tool of the powerful)। ক্ষমতাশালীরা ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রাখে যাতে করে তাঁরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট না হয় (দ্রষ্ঠব্যঃ Robertson; Sociology 1980:373)। আমি নিশ্চিত, মার্ক্স যদি বেঁচে থাকতেন তবে বলতেন ধর্ম মূলত ধর্ম ব্যবসায়ি ও মওদূদীবাদিদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার প্রধান ও একমাত্র হাতিয়ার।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কাব্যনাট্য বিষ বিরিক্ষের বীজ থেকে একটু তুলে দিলাম-



গন আদালত পর্ব



রাখালঃ শেষ আজ গোলামীর হাজার বছর। সেনাদল

পরাজিত, বন্দি আজ সুশিক্ষিত বিপুল বাহিনী।

খাদার ভেতরে হাতি যেরকম ভগ্ন, ম্রিয়মান,

যেরকম পেড়ির ভেতরে আটকে যাওয়া মোষ-



অথচ এরাই কী না করেছে এ্যাদ্দিন। অস্ত্রহীন

হাজার হাজার নিরুপায় মানুষের হৃদপিন্ড

ঝাঁজরা হয়েছে। বেয়োনেটে ছিন্নভিন্ন শিশু। নারী

হয়েছে ধর্ষিত- পিতার সামনে।

উহ্‌ কী বিভৎস সেই সব দিন! সেই সব রাত!



ভয়ঙ্কর বিভীষিকা কালো মৃত্যুর পাখনা মেলে

উড়েছে শহরে, গ্রামে, জীবনের নিবিড় নিসর্গে।



কীভাবে ভেসেছে লাশ দরিয়ার বাঁকে বাঁকে, খালে,

দেখেছো তোমরা সব। দেখেছো গোপন আশনাই

আমাদের কারো কারো- শত্রুর শিবিরে তারা গেছে

লোলুপ লোভের জিভ আহলাদে চাটতে চাটতে।

বিশ্বাসঘাতক তারা, কুলাঙ্গার রাজাকার, শান্তি- (চলবে...)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.