নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুখীমানুষ

সুখী মানুষ

সত্যিকারের সুখীমানুষের সাথে আমার একটাই পার্থক্য, সুখীমানুষের গায়ের জামা ছিলো না, আমার আছে।

সুখী মানুষ › বিস্তারিত পোস্টঃ

যাই, বাপকে নিয়ে সাগর দেখে আসি।

০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:০১

আব্বাকে নিয়ে আগামী দিন কক্সবাজার যাচ্ছি।

যারা একটু বেশী পড়তে আগ্রহী, তাদের জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড হিষ্টোরিটাও বলি।
আমার মা ঘুরাঘুরি পছন্দ করতেন, ঢাকায় থাকা পছন্দ করতেন। কিন্তু কোনটাই ঐ অর্থে তিনি করে যেতে পারেন নাই। ঘুরাঘুরি বলতে তিনি দায়িত্বের ঘুরাঘুরিগুলা করতেন। খালাদের বাড়ী গিয়ে তার বোনদের খবর নিতেন। কিছুদিন পর আপাদের বিয়ে হবার পর মেয়েদের বাড়ীতে গিয়ে দেখে আসতেন।

ছোটবেলা থেকেই আমি বাসে চড়তে পারতাম না, বমি হইতো। এমনকি দূর থেকে বাসের হর্ণ শোনলেও বমি করে দেওয়ার সুখ্যাতি আমার ছিলো। তখন এক টাকায় পাঁচটা হরিণের ছবি থাকতো। মা কোথাও গেলে আমি সাথে যাওযার বায়না ধরতাম না, বমির ভয়ে। আমি বায়না ধরতাম পাঁচটা হরিণের। ঐ পাঁচ হরিণ দিয়ে কী কেনা যায় তা বুঝতাম না। বুঝতাম, মা প্রতিবার বাইরে কোথাও যাওয়া মানে আমার হরিণের সংখ্যা আর পাঁচটা বেড়ে যাওয়া।

ঢাকা পড়তে চলে আসলাম ১৯৯৭ সালে। মা একটা যৌথ পরিবারের কেন্দ্রীয় মানুষ ছিলেন। তিনি বাড়ীতে না থাকা মানে সব কিছু আটকে যাওয়া। তবু তিনি ঢাকা আসতেন তার বাবুকে দেখতে। সাথে করে নিয়ে আসতেন কত্ত ফল, কত্ত বিস্কিট, আরো কত্ত কিছু। এইসব বয়ে নিয়ে আসতো হয়ত আশেপাশেরই মা'র কোন একজন ভক্ত। মাষ্টার জ্যাডি'র ভক্তের কোনদিনও কমতি ছিলো না। তাড়াহুড়া করে সব কিছু গুছায়ে আবার দিনেদিনে চলে যেতেন গ্রামের বাড়ী। কারন বাড়ীতে হাল ধরার কেউ নাই।

দায়িত্বের ঘুরাঘুরি মা খুব মমতা নিয়েই করতেন। আর সখ ছিলো একটু আয়েশের ঘুরাঘুরির। ব্যস্ততা, দায়িত্ব, সামর্থ, পরিস্থিতি এমন নানাবিধ অযুহাতে তা হয়ে উঠে নাই। আমরা বড় হইলাম, ইনকাম শুরু করলাম। কিন্তু এরও আগে ১৯৯৮ সাল থেকেই মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেলেন। এই প্রথম তিনি ঢাকায় এসে মাস খানেক থাকলেন। কিন্তু তা উত্তরা মহিলা হাসপাতালের বেডে। ধরা পড়লো তিনি ডায়বেটিক পেসেন্ট। তার হার্টে সমস্যা আছে, তার ফুসফুসে সমস্যা আছে। তার হাপানি আছে, তার হাড্ডি ক্ষয় হয়ে যাওয়ার অসহ্য ব্যথা আছে। যা এত এত বছর চুপচাপ সহ্য করে গেছেন। কেবলমাত্র ছেলেমেয়েদের একটা পর্যায়ে আনার জন্য। একেবারে অসম্ভবের শেষ মাথায় এসেই বিছানায় পড়ে গেলেন।

১৯৯৮ সালে মা যখন হাসপাতালে তখন আমি ইন্টারে পড়ি। আমাদের মধ্যে যিনি মেজো, আমজাদ ভাই তিনি সংসারের দায়িত্বে। তিনি তখনো ছাত্র। আমজাদ ভাইই ছোটাছুটি করে মা'র চিকিৎসার সব টাকা পয়সা ধার দেনা করে ম্যনেজ করছেন। আব্বাকে ছোট বেলা থেকেই আমরা সবই ভয় পাই। সব আব্দার মায়ের কাছেই ছিলো। হাসপাতাল বেডে মা'কে বললাম
- মা তুমি না থাকলে আমার হাত খরচের টাকা কে দিবো?
মা বেডে বসা ছিলেন। আমার মাথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন
- বাবু তুমি বড় না হইলে মা'য় মরতাম না।

আরো ষোলো বছর মা বেঁচে ছিলেন। কিন্তু একান্তই ভঙ্গুর অবস্থায়। খুব বেশী অসুস্থ হয়ে গেলে বিছানাতেই বাথরুম করে ফেলতেন। আমি চেষ্টার কোন ত্রুটি করি নাই মাকে ঢাকা এনে রাখার জন্য। কিন্তু তিনি কেন জানি খুব অনড় ছিলেন। বলতেন, বাবা আমি গ্রামেই ভালো আছি। মা সারা জীবন স্বপ্ন দেখতেন শহরে থাকার। অথচ শরীর ভালো ছিলোনা বলে কিছুতেই শহুরে ব্যস্ততায় আমাকে তার নিজের ঝামেলা দিতে চান নাই। বড় ভাই বাড়ীতে থাকেন, তিনিই মায়ের সেবা করেন। আমি মাঝেমাঝে মজা করে বলতাম
- মা তুমিতো দেখি বড় ভাইয়ের বেহেস্তই নিশ্চিৎ করতেছো। আমার কি বেহেস্তে যাওয়ার সুযোগের দরকার নাই?
মা খুব বিব্রত হয়ে বলতেন
- বাবু তুমি না টাকা দাও!
মাকে বহুভাবে বুঝায়েছি যে মা আমি তো তোমাকে কয়েকটা কাগজের টুকরা দেই। আর এইগুলা দিয়ে কাড়ি কাড়ি ঔষধই খাও। আমার তো ইচ্ছা করে মা তোমারে একটু সেবা করার। কিন্তু সেই সৌভাগ্য আমার কোনদিনই আর হয় নাই। মা ২০১৪ এর ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ রাতে মারা গেলেন। সামর্থ, সময়, সুযোগ সবই ছিলো মাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর। শুধু মা'র শরীরটাই ভালো ছিলো না।

আব্বা তো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। তিনি সারাদিন স্কুল করে এসে মেজাজ ঠান্ডা রাখতে পারতেন না। আদর করতেন, আবার ধৈর্য্য হারায়ে মাইরও দিতেন। মনে থাকতো শুধু মাইরের স্মৃতিগুলাই। তাই সদা সর্বদা নিরাপদ দূরত্বে আমরা থাকতাম। আব্বা বাড়ীতে থাকা মানে তরকারীতে লবন না হইলেও মাথা নত করে খেয়ে উঠে যাওয়া। আর আব্বা বাড়ীতে না থাকলে চৌদ্দটা তরকারী থাকার পরেও মা'র সাথে দূর্ব্যবহার, মা কী রানছো এইসব মজা হয় নাই, ডিম ভাইজা দাও।

জীবন ভর মায়ের সাথে দূর্ব্যবহারটা এত বেশী করছি যে, এর কোটিভাগও যদি অন্য কারো সাথে করি, সে আমার মুখও কোন দিন দেখবে না। মা মরার কিছুদিন আগে এমনিই বললাম, মা এতো যে খারাপ ব্যবহার তোমার সাথে করি, তুমি কি রাগ করো না? মা কী মনে করে যেন একটা মুচকি হাসি দিয়া বলছিলেন
- সন্তানতো পেটের ভীতর থাকা অবস্থাতেই মায়েরে কত লাত্থিগুতা দেয়। এইসব কি বাবা তারা বুঝে দেয়? সন্তানের কোনকিছুই মা'র কাছে খারাপ লাগে না।

আব্বারে নিয়া কক্সবাজার যাবার কথা বলতে গিয়ে মা'র কথাই সব বলা হচ্ছে। আসলে আব্বার সাথে ঐরকম স্মৃতি খুব কম। আব্বা ঢাকাও তেমন আসতেন না। এখনো মাঝেমাঝে যদি আসেন, এসেই বলেন - যাই তাইলে? আব্বার সাথে আমার সম্পর্কটা বড় দূরের। শৈশবের সেই ভয় আর নাই। সমস্ত ভয় এখন কেমন যেন একটা অদৃশ্য দূরত্বে রূপান্তর হয়েছে। প্রিয়'র মায়ের সাথে আব্বার সম্পর্কটা বেশ সহজ। নিয়মিত আব্বার খোঁজ রাখার বিষয়টা তিনিই করেন।

বয়স বাড়লে মানুষজন শিশু সুলভ আচরণ করেন। বাস্তবতার যুক্তিতে তখন আর খাটে না। কয়দিন আগে আব্বার গলা ব্যথা। তিনি ডাক্তারের কাছে যাবেন না। কারন তার ধারণা এইটা মরণ ব্যাধি। আমি ফোন দিলাম। আব্বা আমাকে সান্ত্বনা দিয়া বললেন
- শোনো তোমার মা মারা গেছেন না? আমারওতো মারা যাইতে হবে, তাই না? একটা না একটা উছিলায়তো মৃত্যু হয়। গলাব্যাথা হইলো আমার এই মৃত্যু উছিলা।
বলতে যাচ্ছিলাম, আব্বা গলা ব্যথায়তো মৃত্যু হয় না। গলা ভাঙ্গে বড়জোর। আব্বার সাথে সম্পর্কটা আমার অত রসের না। ভাবলাম যদি রাগ করে বসেন! যদি রাগ করে বলে বসেন, যাও ঢাকাও আর আসবো না, তোমার দেওয়া হাত খরচও আর নিবো না, তখন!

প্রিয়'র মা হঠাৎ করে কী মনে করে যেন ফোনে বললেন
- আব্বা আপনি যদি ঢাকা আসেন তাইলে আগে ডাক্তার দেখাবো, পরে আপনারে নিয়া কক্সবাজার যাবো।
ওমা, গত পরশু দিন আব্বা ঢাকা এসে হাজির! মেজাজও বেশ ফুরফুরা। ডাক্তারের কাছেও যাবেন না, তার কথা হইলো
- গো মা, আমারতো গলা ব্যথা ভালো হয়ে গেছে, কোন সমস্যাইতো নাই! দেখো আমি পুরা সুস্থ!

আব্বা ডাক্তারের কাছে গেলেন না। অন্যবার কোন সময়ই সাথে করে জামা কাপর আনেন না। কারন এসেই তিনি চলে যান। অথবা বড়জোর রাতটা কোনভাবে কাটান। এবার দেখা গেলো ব্যাগে আরেকটা এক্সট্রা পাঞ্জাবীও আছে।

গতরাত্রে দেখি তারা বউ শশুর মিলে গল্প করতেছেন। প্রিয়'র মা বলতেছেন
- আব্বা একটা টিশার্ট আর প‌্যান্ট কিনে দেই? সাগরে যদি নামতে ইচ্ছা করে?
আমি প্রশ্ন শোনে বরফ শীতল হয়ে বসে আছি। ভাবতেছি এখনই একটা ঝাড়ি খাবে। ওমা! আমাকে অবাক করে দিয়ে আব্বা শিশু সুলভ হাসলেন। আহ্লাদে গদগদ হয়ে বললেন
- আমার কি বয়স আছে গো ব্যাটি! এরপরেও তোমার যদি সখ করে কিছু পড়াইতে চাও, তোমাদেরকেও না করি কিভাবে!

আমার যে ধরণের কাজ, এখানে হুট করে ছুটি নেওয়াটা প্রায় অসম্ভব। এরপরেও আমি অফিসে এসেই বিমানের টিকেট কনফার্ম করলাম। বসকে ফোন দিয়ে বললাম
- আমি আগামী দিন কক্সবাজার যাচ্ছি।
বছরে কোনদিনইতো ছুটিছাটা কাটাই না। এমন অদ্ভুৎ আব্দারে বস হযত একটু ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু হ্যাঁ করে দিলেন।

যাই, বাপকে নিয়া সাগর দেইখা আসি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:৪৯

মোস্তফা সোহেল বলেছেন: যান ঘুরে আসুন আর অনেক ছবি তুলে আনবেন আামদের সাথে শেয়ার করার জন্য হলেও

০২ রা এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৪:১৯

সুখী মানুষ বলেছেন: ব্যক্তিগত লেখা পড়ার পরেও মন্তব্য করে বাধিত করলেন ভাই। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.