নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুখীমানুষ

সুখী মানুষ

সত্যিকারের সুখীমানুষের সাথে আমার একটাই পার্থক্য, সুখীমানুষের গায়ের জামা ছিলো না, আমার আছে।

সুখী মানুষ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমি একা :(

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৩১

আব্বা মারা গেলেন। অফিস শেষে বের হয়েছি, শশাঙ্ক দা'র ফোন
- খালু হার্ট এটাক করেছেন, আপনি দ্রুত কুমিল্লা আসেন।
ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ী ঘুরান। বাড়ী যাচ্ছি। ভাবছি, আব্বার জায়গায় আমি। আর আমার জায়গায় প্রিয়। আমি যেন আব্বাকে দেখতে যাচ্ছি না, প্রিয় যেন আমাকে দেখতে ছুটছে। মেজো ভাই আমজাদ প্রায়ই বলেন
- তোরে আব্বা যে আদর করতেন! আমরা বাকী চার ভাই বোনকে আব্বা এর কোটি ভাগের এক ভাগও আদর করেন নাই।

তখন ইন্টারে পড়ি। বড় খালা ঢাকায় আসলেন বেড়াতে। কথায় কথায় বললেন
- তোর তো হবা'র কথা ছিলো না আব্বা। জেসমিনই শেষ ছিলো। তার সাত আট বছর পর তুই হইয়া গেলি। তখন তোর মা বাপের মধ্যে অনেক ঝগড়া। তুই হওয়নের পর, কী যে হইলো! কই যে ঝগড়া ঝাটি গেলো! সংসারে তুই সুখ নিয়া আসলি।

সেই থেকে নিজেকে হাতের এগারোতম আঙ্গুল মনে হইতো। বৃদ্ধাঙ্গুলের পাশে যে আরেকটা আঙ্গুল থাকে, যে আঙ্গুল কোন কাজে লাগে না, সেই আঙ্গুলের মত।

ছোট বেলার স্মৃতি হচ্ছে অনেকটা সেই গানের মত, যে গান মনে পড়ে পড়েও পড়েনা। তেমন করেই হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, আব্বা আদর করতে আসলে দাড়ির খোঁচা লাগতো। খুব বিরক্ত হইতাম, তবু আব্বা আদর করা থামাতেন না। গাড়ী চলছে সামনের দিকে, আর স্মৃতি খুঁজে ফিরছি পিছনের, আরো পিছনের। কৈশরের, শৈশবের, আতুর ঘড়ের স্মৃতি। আব্বা সহ যে স্মৃতি।

বাড়ী থেকে ময়নামতি আসার রাস্তাটা সবচেয়ে কাছের। তাই আব্বাকে দ্রুত ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ঢাকার চিকিৎসায় মা বিরক্ত হয়ে বাড়ী গিয়ে যে ডাক্তারের সেবায় খুশি হয়ে আরো বছর পাঁচেক বেঁচে ছিলেন। এখনো সেই একই ডাক্তার, শশাঙ্ক দা। মা তার স্বভাবসুলভ ভালোবাসায় যাকে এরই মধ্যে ছেলে বানিয়ে ফেলেছেন। শশাঙ্ক দা সন্তানের মতই আব্বার যাবতীয় চিকিৎসা করে চলেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম
- দাদা, ঢাকা নিয়ে যাওয়া যাবে?
দাদা বললেন
- সিভিয়ার এটাক করেছেন। মুভমেন্ট করলে এখন হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। কমপ্লিট রেষ্ট দরকার। আগে অবস্থাটা দেখি।

পরের দিন আব্বা বেশ সুস্থ। ঢাকা থেকে সকাল বেলা ভাগ্নি ঝুমুকে নিয়ে প্রিয়'র মা গেলেন। আব্বা বিকালের দিকে ঘুম থেকে উঠে বললেন
- বুকে ব্যথাটা নাই। পেটটা একটু ব্যথা করছে।
বললাম
- আব্বা পেট ব্যথাতো আপনার প্রায়ই থাকে, হয়ত গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা।

আব্বাকে দেখতে যাওয়া আত্মীয়দের বিদায় দিতে নিচে গেলাম। এমনি প্রিয়'র মা'র ফোন
- তারাতারি আসো, আব্বা যেন কেমন কেমন করতেছে।

চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলেন। কাত হয়ে শু'তে গিয়েই নাকি চিল্লান দিয়ে উঠলেন, বুকে পিঠে ঘাই দিয়ে ধরছে গো বলে। দুই মিনিটের মাথায়, নাই।

বড় ভাই বাড়ীতে ছিলেন, মেজো ভাই আমেরিকায়। ফোন করে জানালাম, আব্বা নাই। ফোনটা হাতে নিয়ে বসে আছি, সামনে আব্বা'র নিথর দেহ। ভাবছি, এই মুহূর্তে ফেসবুকে কি দিবো যে আব্বা মারা গেছেন! দিলে কি খারাপ দেখায়? এ এক অদ্ভুৎ ফিলিংস। মা ছিলো না, এখন আব্বাও নাই। আমি এখন এতিম। গ্রামের ভাষায় বলে, ছেওইরা। সবাইকে ফোন দিয়ে জানানোর মত মনে বল পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম, ফেসবুকে দিয়ে দেই, বন্ধুদের জানার অধিকার আছে।

মেজো ভাই মা'র মৃত্যুও দেখেন নাই, আব্বারও না। ফোনে কথা হচ্ছে। খুব দৃঢ় কণ্ঠে বললেন
- শোন অরুণ, মনযোগ দিয়ে শোন। এখন তোর উপর অনেক দায়িত্ব। বড় ভাই শরীফ অনেকটা সহজ মানুষ। আমিও দেশে নাই। তুইই এখন একমাত্র গার্ডিয়ান পরিবারের। আব্বার মৃত্যু মানে, আমাদের উপর আর কোন ছায়া নাই। প্রখর রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে তোকে সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই মুহূর্ত থেকেই। কোন রাগারাগি করবি না। ঠান্ডা মাথায় সব হেন্ডেল কর।

আমি হাতের এগারোতম আঙ্গুল, ঠান্ডা মাথায় সব হেন্ডেল করলাম। আব্বার হাত ধরে গুটিগুটি করে হাটতে শিখেছি। হাসপাতালের বিল যখন দিতে যাচ্ছি। তখন মনে হচ্ছে আমি এখনো হাটা শিখি নাই। আমি গুটিগুটি করেই যেন হাটছি। আব্বা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছেন আমি একা একটা কতটা স্টেপ দিতে পারি। প্রতি মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, আমি আর পারছি না, আমি পড়ে যাচ্ছি। হাতড়ে খুঁজছি, কোথায় আব্বার হাত।

বিল দিলাম, এম্বুলেন্স ঠিক করলাম। আব্বার লাশটা যে এম্বুলেন্সে তুলে দিলো তারে একশো টাকা বখশিশ দিলাম। পরক্ষণেই মনে হইলো, এত মায়া করে আব্বাকে রাখলো! তারে ডেকে আরো একশো টাকা বখশিশ দিলাম।

লাশের গাড়ী করে বাড়ী ফিরছি। গাড়ীতে ছোট আপা, ঝুমু, প্রিয়'র মা আর আমি। আগে শুনতাম, লাশের গাড়ী নাকি ভারী হয়। লাশের গাড়ীতে নাকি ভয় হয়। অথচ আমার কাছে আরো হালকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আব্বাতো পাশে আছেই! আব্বা নিজেই যে লাশ, এ আমার মনে হচ্ছে না। দোয়া দরূদ সম্ভবত মনে পড়া দরকার। আমার মনে পড়ছে - আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে / তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে...। ছোট বেলায় শোনা অদ্ভুৎ একটা গান মনে পড়লো, ও মাইয়া তোর পঁচা কাঠাল বিক্রি করবি কোন জায়গায়...। আব্বা মরে গিয়ে এখন কি পঁচা কাঠালের মত হয়ে গেলো! কিছুক্ষণ আগেও আব্বা ডাক দিয়ে বলতেছিলেন
- অরুণ, বাম হাতটায় ব্যথা, একটু টিপা দে।
আব্বা'র হাত, পা টিপে দিলাম। এখন মানুষটা মরে গেছে বলে আর হাত, পা টিপে দিবো না! আব্বার উপর কোন দিন জাম্প দিয়ে পড়ে পড়ে খেলেছি কি না মনে পড়ছে না। প্রিয় এখন আমাকে শুইয়ে দিয়ে আমার উপর জাম্প দেয়। বুকে'র ভিতর লুকিয়ে থেকে বলে
- বাবু নাই, ফ্র্যাংকি এখন বাবুকে দেখতে পাবে না।
আমিও নিশ্চয়ই আব্বার সাথে এমন করে খেলেছি। এমন করেই বুকে লুকিয়েছি। আর এই মানুষটাকেই এখন মাটি চাপা দিয়ে আসতে হবে! কারন একটাই, মানুষটা এখন মরে গেছে। "মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে"।

লাশ নিয়ে বাড়ী ঢুকলাম। বাড়ী ভরা মানুষ। কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, মোবাইলে একের পর এক ফোন আসছে। সব বড় অর্থহীন। এরই মধ্যে এক লোক বড় বড় করেই বলা শুরু করলো
- আমার কাছ থেকে যে বিশ হাজার টাকা আনলো জমি বিক্রি'র কথা বলে, এখন এর কী হবে!

আমজাদ ভাইয়ের উপদেশ মনে পড়লো, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, আমাদের মাথার উপরে এখন আর কোন ছায়া নাই। পরের দিন আব্বার লাশ জানাজা দেবার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। পিছন থেকে একজন বলা শুরু করলো
- জেফতে খাওনের আয়োজন কী করবা?

আমার আব্বার জানাজা এখনো হয় নাই। অথচ মানুষ আছে, মিলাদে কী খাওয়ানো হবে, এই নিয়ে! আমি কিচ্ছু বলি নাই। আমার মাথা পুরা ঠান্ডা। আব্বার লাশ দাফন করলাম। বিশ হাজার টাকার কথা আব্বার লাশ নিয়ে ঢুকার সাথে সাথে যে বলেছিলো, তার কাছে গেলাম। গিয়ে বললাম
- আমরা সারা জীবন মানুষকে দিয়েই আসছি। এই পরিবার কোনদিন কাউকে ঠকায় নাই। ঐ মুহূর্তেই আপনার এমন করে কেন কথাটা বলতে হইলো!
বললেন
- ভাতিজা, এইটাই নিয়ম। কোন পানা দেনা থাকলে লাশ সমানে নিয়েই বলতে হয়।

ঠান্ডা মাথায় আমি নিয়ম একে একে শিখা শুরু করলাম। বললাম
- গত শত বছরেওতো এই পরিবার কোনদিন জমি বিক্রি করে নাই। আব্বা কোন জমি বিক্রির কথা আপনারে বলেছিলো?

কথা বলে যা বুঝলাম, আমাদের একটা অনাবাদি জমি আছে। গত তিরিশ, চল্লিশ বছরেও এই জমিতে কোনদিন আমাদের পা পড়ে নাই। আব্বা মাস খানেক আগে বাড়ীর বিল্ডিংএর কাজ ধরেছেন। তাই হয়ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই জমিটা বিক্রি করে দিবেন। এই বিল্ডিংএর কাজে আমাদের কারোরই মত ছিলো না। কত বুঝায়ে বলেছি, আব্বা আমাদের দুই বিল্ডিংয়ে নয়টা রুম। কে থাকবে এত রুমে! তবু একটা বিল্ডিং ভেঙ্গে এখানেই পাঁচতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বিল্ডিং বানানো শুরু করলেন। আব্বার এক কথা, আমার বাপ, দাদার বাড়ী, আমি স্মৃতি হিসাবে এই বিল্ডিং করবোই।

তাদেরকে বললাম
- আব্বা থাকলেতো জমি দিতেন, এতে আমাদের কোন আপত্তি থাকার প্রশ্নই আসে না। যেহেতু আব্বা নাই, তাই এখন সিগনেটরী অনেক। দয়া করে আপনি টাকটা ফেরত নেন।

কিন্তু টাকা এখন তার কথামত হয়ে গেলো, বাইশ হাজার টাকা। তিনজন স্বাক্ষী রেখে, টাকা ফেরত দিয়ে বাড়ী আসলাম। এসে দেখি আব্বার ঘরে একটা ডায়েরী। এতে স্পষ্ট লেখা "৩১/১/২০১৭ ময়নাল থেকে ২০,০০০/-"। মেজো ভাইকে বললাম, ও কেন এমন কাজটা করলো! ভাইয়া বললেন
- ওরা যখন ছোট, তখন ওর বড় ভাই আমাদের বাড়ীতে বছর মুনি (এক বছরের জন্য কাজের লোক) ছিলো। তখন এদের বেশ আনাগোনা ছিলো আমাদের বাড়ীতে। তারা জানে, আমরা ভেজালের মধ্যে নাই। তাই সুযোগে দুই হাজার টাকা বাড়ায়ে নিলো। এদের আত্মা এর চাইতে বড় ভাবতেও পারে না।

বাজারে আব্বার যাতায়ত যত জায়গায় ছিলো, সব ঘরে জিজ্ঞাসা করলাম
- আব্বার কোন বাকী আছে?
মানুষকে প্রথম দিন থেকে নেগেটিভ ভেবেই আগাচ্ছিলাম। কিন্তু প্রতিটা দোকানদার এত দরদ নিয়ে বললেন
- নাহ স্যারের কাছে কোন বাকী নাই।
আমার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। আমার কেবল মনে হচ্ছিলো, হয়ত ফালতু একটা খাতা দেখায়ে বলবে, আব্বার কাছে টাকা পায়। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় নাই। কিছু কিছু দোকানদার অতি আগ্রহী হয়ে বললেন
- স্যাররে তো জোর কইরাও এক কাপ চা খাওয়াইতে পারতাম না।
প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের সম্মান যে ভার্সিটির শিক্ষকদের চেয়েও কত বেশী তা নিজের চোখে দেখে দেখে প্রতিটা ঘর একে একে জিজ্ঞাসা করতে থাকলাম।

বাড়ী আসলাম। রাত হয়ে গেছে। বাড়ী এসে জানলাম - এরই মধ্যে আমার বড় ভুল হয়ে গেছে। আমি কেন গ্রামের মুরব্বীদেরকে নিয়ে মিলাদে খাওয়ার মেন্যু ঠিক করলাম না। এখন নাকি কেউ আমাদের মিলাদে খাবে না। কী বিপদ! মুরব্বীদে বাড়ী বাড়ী গিয়ে অনুরোধ করে আমাদের বাড়ী আনলাম। বললাম, আব্বা তো মঙ্গলবার মারা গেছেন। আজকে মরলে, কালকে দুই দিন। এই হিসাবে শুক্রবার চার দিন হয়। শুক্রবার জুম্মা'র পর একটা মিলাদ পড়ালে কেমন হয়?

একজন বললেন
- এইটাতো কোন হিসাবেই পড়ে না। নিয়ম হইলো, পাঁচ দিনের দিন মিলাদ পড়াইতে হয়।
হুজুরকে ফোন দেওয়া হইলো, হুজুর স্পষ্ট বলে দিলেন
- পাঁচ দিনের আগে মিলাদ পড়ানোর নিয়ম সুন্নী মুসলিমদের নাই। যদি এরপরেও মিলাদ পড়াতে চাই। তারা মিলাদ পড়বে, কিন্তু আমাদের বাড়ীতে কিছু খাবে না!
বললাম
- নাহ, আপনাদের নিয়ম মতই করেন।

মুরব্বীগোছের একজন বললেন
- তো ভাতিজা খাওনের আইটেম কী কী করবা?

আমি অবাক হয়ে ভাবছি, বাবা'র মৃত্যুশোক নিয়ে ঘুরছি। আর কঠিন দুনিয়া এখন আমাদের কাছে খাবার মেন্যু কী আয়োজন করবো, তা জানতে চাচ্ছে। সিনিয়র একজন বললেন
- বাড়ীতেতো বিল্ডিংএর কাজ ধরছে, রান্নাবান্নার আয়োজন করা কঠিন। বিরিয়ানী করলেই ভালো হয়, ঝামেলা কম।
আমার দিকে তাকায়ে বললেন
- তোমরা কয়জনের আয়োজন করবা?
আমি বললাম
- আমি এইসব বুঝতেছি না। এই আলোচনা করার মত মানসিক পর্যায়েও আমি নাই। আপনারা যা ভালো মনে হয় করেন, টাকা আমি দিয়ে দিবো।

সিদ্ধান্ত হইলো পাঁচ ছয়শো মানুষ খেতে পারবে এমন বিরিয়ানী করা হবে।
ওমা! সকাল বেলা এসে দুই তিন জন হাজির।
- বাজারে সমালোচনা হইতেছে, মাষ্টরের (আব্বা'র) কি টাকা'র অভাব? মাষ্টরের পোলাপানের কি টাকার অভাবা?
অবাক হয়ে বললাম
- এইসব কথার কারন কী!
- সবাই বলতেছে, বিরানী কোন খাওনের আইটেম হইলো! ঝাল গরুর মাংস, মাসকলাইর ডাইল, শব্জি না হইলে এই খাওন কোন খাওনই না!

আবার কতক্ষণ গবেষণা চললো। মাসকলাইর ডাল প‌্যাকেটেরটা ভালো হবে নাকি ডাল কিনে প্রসেস করে নিলে ভালো হবে। আমি সমাজের এই পাষন্ড আচরণে বাকরুদ্ধ। এ এক বর্বর নিয়ম। টাকা খরচে আমার আপত্তি নাই, লোক খাওয়ানোয় আমার কোন আপত্তি নাই। কিন্তু আপনজনের মৃত্যুতে যে পরিবারটা শোকে ভেঙ্গে পড়েছে, তাদেরকে কেন মিলাদের নামে এই বিয়ের আয়োজনের মত উৎসব করতে হবে? সমাজের লোকদের একবেলা খাবারের কি এতই অভাব! এ যদি মিলাদ হয়, তবে এতে খাবারের বিষয়ে এত আলোচনা, সমালোচনা, গবেষণা কেন? কিন্তু আমি একটা শব্দও বলতে পারবো না। আমার কাছে এই বার্তা অলরেডি আছে, কোনকিছুতে কথা কাটাকাটি হলে, গ্রামের মানুষ আমাদের বাড়ীর মিলাদে খাবে না। বললাম
- গরুর ঝাল মাংস, ভাত ইত্যাদি করতে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু মুরব্বীরা নিজেরাইতো সিদ্ধান্ত নিলেন বিরানী করবেন!

ঝাল গরুর মাংস আব্দারকারীদেরকে সাথে নিয়ে আবার গেলাম বাজারে। মুরব্বীদের সাথে বসলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক খাদ্য বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা হবার পর ফাইনাল হইলো, নাহ বিরিয়ানীই ঠিক আছে। সাথে আরেকটা কথা যোগ হইলো
- তোমাদেরতো টাকা কোন সমস্যা না। চল্লিশ দিনের অনুষ্ঠানতো বড় কইরাই করবা। তখন গরুর ঝাল মাংস, মাসকলাইর ডাল, শব্জি এই গুলা করবা। আর স্যারকে তো কয়েক গ্রামের মানুষজনই চিনতো, সবাইরে তখনই দাওয়াত দিয়ো, এখন ছোট কইরাই করো।

সত্যিই এ বড় অদ্ভুৎ সমাজ। আমি পিতৃশোকে কাতর। আর আমার উপর এডভান্স দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছে, কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে কয়েক গ্রামের মানুষ খাওয়ানোর। এখানে মানুষের মৃত্যুর পরে এক বেলা খাওয়া দিয়েই যেন প্রমান হয় - কে মরে গিয়ে কত ভালো সন্তান রেখে গিয়েছে।

আমি পরবর্তী দুই দিন উৎসবের আমেজ নিয়ে ঘুরতে থাকা মানুষজনের সাথে থাকলাম। সামিয়ানা আসলো। পেন্ডেল হলো। বাবুর্চী আসলো। উঠানে গর্ত করে চুলা বানানো হলো। এর উপর জ্বলতে থাকলো বড় বড় পাতিল। আমার ভিতরে জ্বলছে পিতৃশোক।

মিলাদ পড়ালাম শনিবার। বেঁচে থাকা মানুষদেরতো কাজ করতে হয়। এবার আপাতত ঢাকা ফেরার পালা। বাজারের দিকে রওয়ানা হলাম। আব্বা প্রতিবার পাঞ্জাবীটা পড়ে আমার আগে রেডি হয়ে থাকতেন, আমাকে আগায়ে দেওয়ার জন্য। জীবনে এই প্রথম একা একা রওয়ানা দিলাম। বাজারে এসে, আশেপাশে তাকাই। নাহ্ আব্বা আমার পাশে নাই। আমার মা, বাবা কেউ নাই। আমি একা।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৪৩

পলাশমিঞা বলেছেন: দোয়া করি আপনার মন ভালো হোক। আল্লাহ আপনাকে সবরে জামিলা দান করুন। আমিন।

২| ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:০৬

হাতুড়ে লেখক বলেছেন: একাই চলতে হয় সবাইকে।

৩| ১৩ ই মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৯

কাবিল বলেছেন: আপনার আব্বা শান্তিতে থাকুক।

এভাবে প্রত্যেককেই একা হতে হবে।
আপনার আব্বাও এক সময় একা হয়েছিলেন, হয়তো প্রিয়ও এক সময় হবে।

বাজারে আপনার আব্বার সম্পর্কে পজিটিভ কথা শুনে ভাল লাগলো।
কিন্তু সমাজে কিছু মানুষের বারাবারি চিন্তার বিষয়।

প্রিয় কেমন আছে?

১৮ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:১১

সুখী মানুষ বলেছেন: কাবিল ভাই, প্রিয়'র শরীরটা ভালো যাচ্ছে না :(

বিপদ হইলো সাত ভাই
মায়ের কথায় এদের একলা চলতে নাই।

আমার হইলো এই অবস্থা। দোয়া করবেন ভাই।

৪| ১৩ ই মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২১

নীল-দর্পণ বলেছেন: পড়ছিলাম আর মনে হচ্ছিল নিজে খুব কাছ থেকে অনুভব করছি কিছু বিষয় যদিও আমি অনেক ভাগ্যবতী, আব্বা-আম্মা এখনো ছায়ার মত আছেন। আপনার অবস্থা পুরো বুঝতে পারবো না।

আপনার আব্বা-আম্মার জন্যে অনেক দোয়া

১৮ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:১২

সুখী মানুষ বলেছেন: মা বাবা বেঁচে থাকুক অনেক অনেক বছর।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.