![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চার বছর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কর্পোরেট পরিবেশে কাজ করার পর এক সন্ধ্যায় জাদুর পরিবহনে আড়াই ঘন্টা ধরে জ্যামে আটকে থাকার পর শাওন এমন একটা দুনিয়ায় পৌঁছায় যেখানে মানুষ এখনো যোগাযোগের জন্য দুই ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে।
পরপর দু'টি ঘোড়ার গাড়ি দেখে সে। একটার ঘোড়া দুটো তেজী, উদ্যমী। আর অন্যটার ঘোড়াগুলো কেমন দুর্বল, অলস, উদাসীন। দুর্বলের গাড়ি পিছিয়ে থাকে। সবলেরটা এগিয়ে যায়। দু'টো ঘোড়ার গাড়িরই নিয়তি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের ভুং পয়েন্ট থেকে ভাঙ পয়েন্ট পর্যন্ত আসা-যাওয়া করা। ভুং ও ভাঙ দেশের সম্পদ তৈরীর দু'টো বিখ্যাত কারখানা। তেজী ঘোড়ার গাড়ি যতবার যাতায়াত করতে পারে, অলস ঘোড়ার গাড়িগুলো তার অর্ধেকের একটু বেশী সংখ্যক বার যাতায়াত করতে পারে।
যতদিন শরীরে তাগত থাকে, তেজী ঘোড়াগুলো ভালো দানা-পানি পায়, খাতির যত্ন পায়। আর দুর্বল ঘোড়া গুলো খাবারও পায় দায়সারা, তাদের গোসলও করানো হয় দুই তিন দিন পরপর। একদলের পায়ে দামী খুর - আরেকদলের সস্তা খুর। তাগড়া ঘোড়াগুলো হয়তো একটু বেশীদিন বাঁচে, দুর্বল গুলো কম। কিন্তু, কী আশ্চর্য সুতায় বাঁধা তাদের নিয়তি - প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ভুং থেকে ভাঙ আর ভাঙ থেকে ভুং। নিয়মের ব্যতিক্রম নেই।
এককালে ঘোড়াগুলো চোখ মেলে দেখতো। এখন আর দেখার দরকার পড়ে না। অলি, গলি, খানা-খন্দ সব চেনা। তাই চোখে ঠুলি পড়েই বেশী আরাম পায়। চেনা রাস্তা। তাদের পূর্বপুরুষরাও অনেকদিন এই রাস্তা দিয়ে গেছে। বর্ষায় রাস্তায় নতুন নতুন দুই একটা গর্ত হলে দুই একবার হোঁচট খায় - সেও ভালোই লাগে। অন্তত: চোখে বিচ্ছিরি একরাশ আলো লাগানোর চেয়ে ঢের আরামের।
শাওন চোখ ফিরিয়ে হাঁটা শুরু করে। রাস্তার হলুদ আলো কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলোকে নোংরা করে দেয়। মানুষের বহুদিনের সচেতন চোখ তাড়াহুড়া করে হোয়াইট ব্যালান্স ঠিক করে নিলে আস্তে আস্তে আস্তে ফুলগুলো লাল হয়ে উঠতে শুরু করে। শাওনের চোখ একটু সময়ের জন্য ঝাপসা হয়। চতুর এডিটর কাট করে পরবর্তী দৃশ্যে চলে যান।
পিচঢালা ভেজা রাস্তা। রাস্তায় পড়ে আছে টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া, সবুজ পাতা । ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে।
- কত সাল? ঠিক জিপিএস লোকেশনটা কোথায়?
- নেই। সেটা সাধারন ছাত্রের হাতে স্মার্টফোনের যুগ না।
- সে না থাক। মোবাইল তো হাতে হাতে চলে এসেছে নিশ্চয়ই। অন্তত: নোকিয়া ১২০০। সময় বলা যায় না ঠিক করে?
- না, বলা যায় না। ওরা বৃষ্টিতে ভিজবে বলে সব রেখে এসেছে। ওদের এমন কোন অনিশ্চয়তার তাড়া নেই।
- সাথে সাইকেল তো ঠিকই আছে।
- হ্যাঁ, ওরা বাইসাইকেলে করে ঘুরবে। মেয়েটা সাইকেলের রডের উপর কষ্ট করে বসে ভিজবে। আনন্দে হুল্লোড় করবে। ছেলেটা পা দু'টো যথাসম্ভব প্রসারিত করে সাবধানে ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল চালাবে।
বৃষ্টি হবে। অনেক বৃষ্টি।
অনেকগুলো তরুণ তরুণী নেমে আসবে রাস্তায়।
অনেকে তৃতীয় বিশ্বের অনুভূতিপ্রবণ একটি দেশের রাস্তায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একে অপরকে চুমু খাবে। কোনো কোনো ওড়না শুধু দু'টো মাথা ঢাকবে।
ওদেরকে কেউ বেশীক্ষণ দেখতে পারবে না। বৃষ্টি এসে চোখের পাতায় পড়ে দর্শক চোখগুলোকে ঘুরিয়ে দেবে অন্যপাশে।
- চলো আমরাও ...
- পাগল, সবাই দেখবে না? ওই দেখো কতগুলা পুলিশ সামনের রাস্তায় ...
- তার সামনের রাস্তায় ওই দু'জনকে দেখেছো? আর দেখো ছয়টা পুলিশের মাঝে চারজনের হাতে ফোন । আর আমাদের দিকে তাকানোর জন্য কোনো চোখ ফাঁকা নেই।
- তবুও, থাক।
- থাক।
- তোমার ভালো লাগছে তো?
- অনেক। তুমি মন খারাপ করলে না তো?
- আরে না।
- গান শুনবে?
- শোনাও।
- ৫ মিনিটে রাজনীতি?
- হোক।
- বান্ধবীর প্রেম?
- হোক।
- শেষ পড়া বই?
- হোক।
- সিনেমার ঝোঁক?
- হোক।
- মিথ্যে আশা?
- হোক।
- হিসাব-নিকাশ? মাস তো এখন শেষের দিকে।
- থাক।
- ভবিষ্যত?
- ভূতের মতো চুলোয় যাক।
- সাইকেলের চাকার পাম্প চলে গেছে। এখন হাঁটতে হবে।
- হাঁটব। বৃষ্টিতে ছপছপ শব্দে হাঁটতে অনেক ভালো লাগবে।
- সাইকেলে ভিজতে ভালো লাগছিলো না?
- অনেক ভালো লাগছিলো।
- আমরা কি তাহলে অনেক ভালো থেকে অনেক ভালোর মাঝেই এসে পড়লাম?
- আমরা আসলে এক সুন্দর থেকে আরেক সুন্দরে এসে পড়লাম।
খুব জোরে নীল রঙের একটা ক্যাব ওদের পাশ দিয়ে চলে যায়। দু'জনের গায়ে পানি ছেটে। তারপর আবার বৃষ্টি নামে হয়তো।
কিন্তু এডিটর দৃশ্য বদল করে নীল ক্যাবের ভেতরে চলে যান।
খটখটে রাস্তা। তপ্ত বিকেল।
- জানো, প্রেম ব্যাপারটা আমি এখন আর বুঝি না। পুরো ব্যাপারটাই একটা সূক্ষ হিসাব-নিকাশ মনে হয়। এই প্রেম-ভালোবাসা বেঁচে কত কোম্পানী কত ব্যবসা করছে দেখো।
- হুমম, এসবের তৈরী হলো তো শিল্প বিপ্লবের পর। সব মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনযাত্রাকে সহনীয় করার জন্য এক একটা মিষ্টি প্রোডাক্ট।
- সুতরাং, প্রেম-ভালোবাসার গল্প নিয়ে সময় নষ্ট না করাই ভালো। সময়ও নেই। আর ওসব থাকলেই ঝগড়াঝাটি, অশান্তি বাড়ে।
- তাহলে পত্রিকার পাতাই ওল্টানো যাক। মানুষ পোড়ানো, মানুষ গুম, সমুদ্রে মানুষের জ্যান্ত কবর, মুক্তমনা মানুষ হত্যা, খাবারে বিষ, ওষুধে ওষুধে বাজার সয়লাব।
- আমাদের কিচ্ছু করার নেই। সব পচে গেছে। ওসব নিয়ে কথা বলে কী লাভ?
- খাওয়া দাওয়া? হাজীর বিরিয়ানি? চাইনিজ? বিউটির শরবত? মিষ্টি কোরমা?
- সেদিনই প্রেসার দেখলাম ১০০-১৪০। আবার ওসব? একদম চুপ।
- জানো, তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে আজ। তোমার মুখটাও, পোশাকটাও দারুণ মানিয়েছে তোমাকে।
- আমি কী কেবল আমার শরীর? নারীবাদের লঙ্ঘন।
- আমি তো তোমার চিরকালের স্তাবক।
- চাকরিটা ছেড়ে দিতে চাই অনেকদিন হলো। গরুর শরীর মেপে গরু কেনার মতো সবসময় ওরা মানুষ মাপে।
- সব অফিস এক। ছাড়ো তো।
- ধর্ম? অধর্ম? আস্তিকতা? নাস্তিকতা?
- হয় গালি খাবে, ব্যাকডেটেড ভাববে সবাই অথবা কোপ খাবে। কোনটা চাও?
- থাক, ওসব থাক।
- বই পড়তে নিলে ইদানীং ঘুম পায়। দুই-তিনটা বই শুরু করে শেষ করতে পারলাম না।
- বই পড়ে কী হবে? সামাজিক না অর্থনৈতিক কোন স্কোর বাড়বে? বাদ দাও।
- বদলি কবে হবে?
- কিছুই আমাদের হাতে নেই। ঘুষের টাকা জমাতে হবে। পুরান নেতা, যে এককালে আমার প্রেমিক হতে চেয়েছিলো নির্লজ্জভাবে, প্রেমিক হয়েছিলো আরো অনেকের, তাকে কায়দা করে আবছা পরকীয়া প্রেম নিবেদন করে ..
- থাক, থাক, সব কথা না শোনাই ভালো।
- তাহলে আমরা কী নিয়ে কথা বলবো?
- আমাদের আসলে কিছুই বলার নেই।
- আমাদের মুখ দু'টো শুধু খাওয়ার জন্য ব্যবহার করাই ভালো।
- ঘোড়ার মতো?
- আর চোখ মেলে না দেখাই ভালো। চোখ মেলে দেখলে অনেক বিপদ, অনেক অনিশ্চিত রাস্তা এবং অনেক বিভৎসতা চোখে পড়ে।
- চলো, আমরা চোখে ঠুলি পড়ি। চলো আমরা আশাবাদী হই। আশাবাদই জীবন। নিরাশাই মৃত্যু।
- চলো, আমরা ঘোড়া হই। দু'টো ডেবিট কার্ড দু'জনে চিবিয়ে খেলেই ঘোড়া হয়ে যাওয়া যায়।
- ধীরে ধীরে চিবুতে হবে। তাড়াহুড়া করলে গাধা হয়ে যাওয়ার চান্স আছে।
নীল ক্যাব ঘোড়ার মতো লাফিয়ে একটা নিরীহ রোড ডিভাইডারের উপর উঠে যায়। কাট, কাট। নেক্সট সিন।
শাওন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোণ আইসক্রীম খাচ্ছিলো।
সে আরেকটা নতুন দুই ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পায়। নতুন কেনা খুর, নতুন ঠুলি। পুরাতন পথ, পুরাতন রাস্তা।
সে সহজে মানুষকে মনে রাখতে পারে না, কিন্তু একটা ঘোড়াকে তার খুব চেনা চেনা মনে হয়।
২| ২৭ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৩৫
নারদ মুনি বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে মে, ২০১৫ সকাল ৮:১৮
বটের ফল বলেছেন: পুরো লেখাটি শেষ না করে উঠতে পারলামনা। সত্যি কথা বলতে কি- অনেক দিন পর অনেক বেশি মজা পেলাম আপনার লেখা পড়ে।
একটার পর একটা প্লট সাজিয়েছেন। ধারাবাহিক ভাবে উপস্থাপন করেছেন। সমাপ্তিটা আরো বেশি অসাধারন।
ভেতরের অন্তর্নিহিত কথা গুলো কি চমৎকার ভাবে প্রকাশ করে গেলেন !!!!!!!!! স্যালুট আপনাকে।
ভালো থাকবেন অনেক বেশি। +++++++++++