![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটাই ফিল্টার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফিল্টার এটা, দেশের উন্নয়নে মানবিকতার ও মুক্ত চিন্তার আদর্শের সৈনিক।
একাত্তরে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড
পুরো একাত্তর জুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালী জাতিকে মেধাশূণ্য করার জন্য বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। এই অপকর্মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সরাসরি সাহায্য করে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী।
পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালী-বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আল-শামস, আল-বদর, রাজাকারদের মাধ্যমে বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের তথা, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবি, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাংবাদিকদের তালিকা প্রস্তুত করে।
এরপর, শুধুই ইতিহাসের কালো একটি অধ্যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে আরেকটি নির্মম পরিকল্পিত গনহত্যা; একটি জাতি মেধাশূণ্য করার অপচেষ্টা।
বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের উপর চুড়ান্ত আঘাত আনা হয় ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ রাজাকার-আল বদর-আল শামস বাহিনীর পূর্ণ সহযোগীতায় পনেরোশ’র অধিক বুদ্ধিজীবিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।
স্বাধীনতার পর ঢাকার মিরপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ, মুহাম্মাদপুর, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, লালখান বাজার, স্টেশন-কলোনী, গুডস হিলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায় বুদ্ধিজীবিদের পঁচিত-বিকৃত মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতদেহগুলোতে ছিল অকল্পনীয় নির্যাতনের চিহ্ন। অনেক বুদ্ধিজীবির মৃতদেহ খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বঙ্গভবন থেকে রাও ফরমান আলীর একটি ডায়রী পাওয়া যায়; যাতে নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবিদের তালিকা ছিল। এই ডায়রীতেই স্পষ্ট উল্লেখ আছে, আল-বদর তথা, জামাত ও ছাত্র-সংঘ বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের তালিকা তৈরী, হত্যার উদ্দেশ্যে ধরে আনা ও হত্যাকান্ডে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে।
রাও ফরমান আলীর ডায়রী থেকে জানা যায়, সিআইএ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড সম্পর্কে জানত। কারণ, ডায়রীতে হেইট ও ডুসপিক নামে দুজন আমেরিকার গোয়েন্দার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার ইঙ্গিত আছে।
পাকিস্তানীরা কতটা অসভ্য-বর্বর জাতি এবং এদেশের পাকি-দালালরা কতটা নিমক হারাম, তা ‘বুদ্ধিজীবি নিধন তদন্ত কমিশন’ কর্তৃক প্রকাশিত কিছু তথ্য দেখলে আরো স্পষ্ট হয়। ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’ তাদের রিপোর্টে বলছে, পাকিস্তানী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী শুধু ডিসেম্বরে বিশ হাজার বাঙালী বুদ্ধিজীবিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। বুদ্ধিজীবিদের তালিকা প্রস্তুতের জন্য রাজাকার-আল বদর-আল শামসকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। বাঙালী এইসব বিশ্বাসঘাতক নরপশুদের নেতৃত্বে ছিল চৌধুরী মইনুদ্দিন (জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য), আশরাফুজ্জামান (ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য/ বর্তমান ছাত্রশিবির)।
চৌধুরী মঈনুদ্দীন শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা প্রস্তুত করে ও তাঁদের বাসার ঠিকানা খুঁজে বের করে এবং মূল এক্সিকিউশান প্ল্যান করে। বুদ্ধিজীবিদের নাম-ঠিকানা পাকিস্তানীর কাছে তথা, রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে সরবরাহ করেছিল এই চৌধুরী মঈনুদ্দীন।
আশরাফুজ্জামান ছিল মূল এক্সিকিউশান কর্মকর্তা। তার নাখালপাড়ার বাড়ি একটি ডায়রী উদ্ধার করা হয়, যাতে বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল এবং এই বুদ্ধিজীবিরা সবাই শহীদ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালে আশরাফুজ্জামানের গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিন বলেন, রায়ের বাজার ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধজীবিকে আশরাফুজ্জামান নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল।
চট্টগ্রামে বুদ্ধিজীবিদের প্রধান হত্যাকারী ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী।
১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ‘দৈনিক আজাদে’ একটি রিপোর্টে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী মনে করত, বাঙালী বুদ্ধিজীবি ও শিক্ষিত সমাজই একাত্তরের যুদ্ধের জন্য দায়ী। তাই, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা বানাতে জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘকে (বর্তমানে শিবির) দায়িত্ব দেয়। পাকিস্তানের এসব বাঙালী দালালরা রাজাকার-আল শামস-আল বদর বাহিনী পরিচয়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। এই তালিকা অনুসারে সারা একাত্তর জুড়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা শুরু করে। দেশ স্বাধীন হতে আর একটি সপ্তাহ দেরী হলে, ওরা বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের সবাইকে মেরে ফেলতো।
ত্রিশ লক্ষ শহীদের মাঝে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কতজন, তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। ব্যাপক গণহত্যা ও দেশান্তরী হওয়া বিধ্বস্ত-বিচ্ছিন্ন জনপদে এবং চরমভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে সে সময় জরিপ চালানো সম্ভব হয়নি।
১৯৯৪ সালে ‘বাংলা একাডেমী’ থেকে প্রকাশিত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ নামে শহীদ বুদ্ধিজীবিদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশিত হয়; যাতে, ২৩২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবির বর্ণনা আছে।
১৯৭২ সালে নিউজ উইকের সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন তার একটি কলামে শুধু ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবির সংখ্যা এক হাজার সত্তর জন বলে জানান।
বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবি ৪২ জন, সাংবাদিক ১৩ জন ও অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) ১৬ জন।
তবে, প্রকৃতপক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যা অনেক বেশি। থানাভিত্তিক জরিপ অনুসারে শিক্ষক, প্রকোশৌলী, চিকিৎসক, আইনজীবি, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক মিলিয়ে মোট শহীদ বুদ্ধিজীবি সংখ্যা এক লক্ষ হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলছে।
০৩ নভেম্বরে, ২০১৩; চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসির রায় হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা এই যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করা।
চট্টগ্রামের ঘাতক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় হয়েছে।
কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০ টা ০১ মিনিটে কার্যকর করা হয়েছে। আবদুল কাদের মোল্লা ফাঁসির রায় কার্যকর করা একাত্তরের প্রথম যুদ্ধাপরাধী গতকাল ছিল ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩ সাল।
শহীদ বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের ৪২ তম দিবস।পরম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে বাঙলার সকল শহীদদের স্মরণ করছি।
জয় বাঙলা…
- সাব্বির হোসাইন
তথ্যসূত্র:
* শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা (১৯৭২), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, সম্পাদনায়: সৈয়দ আলী আহসান।
* শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী।
* বাংলাপিডিয়া।
এরা নির্ভুলভাবে গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে হত্যা করেছিল আজো করছে।
১৯৭১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর “দৈনিক আজাদ”-এর একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল এরকম:
“আর একটা সপ্তাহ গেলেই ওরা বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের সবাইকেই মেরে ফেলত- আল বদর বাহিনীর মাস্টার প্ল্যান”
সেই আল বদর, যাদের জন্মই হয়েছিল সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক হত্যার মাধ্যমে মুক্তকামী বাঙালিদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য। সেই বদর বাহিনী, যারা আজও আমার প্রিয় দেশকে কলঙ্কিত করে চলেছে, যাদের আস্ফালনে আজ আমি নিজের বাঙালি পরিচয় নিয়ে গর্ব করতে পারি না। সেই আল বদরের কথা বলতে আসার আগে অনেক ভেবেছি। “আল-বদর” শব্দ দুটি লিখতে গিয়ে বারবার ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠেছি, বারবার হাত আটকে গেছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, এই ঘৃণা নিয়ে দূরে সরে থাকার কারণেই আজ তারা বাংলার বুকে বসতবাড়ি গড়ে তুলতে পেরেছে, তখন আর হাত আটকালো না। লিখে যেতে থাকলাম, তাদের সে ভিটেমাটি ভেঙে ফেলার স্বপ্ন নিয়ে। মনকে প্রবোধ দিলাম, আল-বদর, রাজাকার, আল-শাম্স সহ পাকিস্তানী হানাদারদের সব দোসরের পদচারণায় কলঙ্কিত স্বদেশকে পবিত্র করতেই আমি কলম ধরেছি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পুনর্জন্ম হবে। তারা যখন স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রাখবে তখন যেন সে মাটি পবিত্র থাকে। কোন অপবিত্র মাটিকে আমি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পা স্পর্শ করতে দেব না।
তাই লিখছি-
১৯৭১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর দৈনিক আজাদের একটা সংবাদ শিরোনাম দিয়েই আমার লেখা শুরু করেছি। এই শিরোনামের লেখাতেই আল-বদরদের পরিচয় ফুটে উঠেছে।সেখানে লেখা হয়েছিল: পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সাহায্যকারী দলগুলির মধ্যে জামাতে ইসলামীর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্য। মওদুদী-গোলাম আযম-আবদুর রহীমের নেতৃত্বে পরিচালিত জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুধু ঘোর বিরোধিতাই করেনি- লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে পাইকারীভাবে হত্যা করার কাজে সক্রিয় সহযোগিতাও করেছে।
আমি জানি, পাকিস্তানের দোসরদের মধ্যে জামাতে ইসলামী ছাড়াও অনেকে ছিল। কিন্তু এদের দাপটই আজ সবচেয়ে বেশী। এখান থেকেই তাই আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার সূচনা। আমার জন্ম হয়েছে এক জামাতপন্থী পরিবারে। আমি যখন নিজের বাবাকে জামাতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেছি তখন তিনি বলেছেন, “জামাত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিল। এজন্য তারা কেবল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়নি। কিন্তু তাদের হাতে কোন নিরীহ বাঙালি নিহত হয়নি, অর্থাৎ তারা কোন অনৈতিক ও মানবতাবিরোধী কাজ করেনি।” ছোট বেলায় আমি এই ব্যাখ্যাই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু বড় হয়ে যখন নিজে সবকিছু পড়তে লাগলাম তখনই আমার চোখ খুলে গেল। আমার সামনে জামাতসহ সব স্বাধীনতাবিরোধীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেল। আমি তাদের পলিসি বুঝতে পারলাম। আমি তাদের পলিসির ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তে এসেছি তা হল:
একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা শুরু থেকেই খুব সুবিধাবাদী ছিল। প্রথমে তারা নিছক সেফ সাইডে থাকার জন্য পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে। কিন্তু যখন তাদের শীর্ষ নেতারা শান্তি কমিটি গঠন করলো, দেশে রাজাকার-আল বদর-আল শাম্স গঠিত হল তখন তারা এক মধ্যযুগীয় পৈশাচিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলো। একাত্তরের জামাতপন্থী পত্রিকা (দৈনিক সংগ্রাম) পড়লেই তা বোঝা যায়। তাদের নষ্ট চেতনায় একীভূত পাকিস্তানের ভূত চেপে বসলো। দেশের ভেতরে থাকায় তারা জানতো, কোন গুটি চাললে কি ফলাফল হবে। সুতরাং এটা ধারণা করে নিতে কোন কষ্টই হয় না যে, ২৫শে মার্চ থেকেই দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের ধরিয়ে দেয়ার কাজটা তারাই করেছে। এই কাজটা একেবারে পরিকল্পিত ছিল। প্রথম দিকে তাদের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধে জয়ী হওয়া। কিন্তু ১৪ই ডিসেম্বর ও তারপরের নিধনযজ্ঞের উদ্দেশ্যটা অন্যরকম। এই সময় তারা অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেছে। এ সময় তাদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের ক্ষেত্র রচনা করা। ব্যাপারটা এরকম-
তারা জানতো বিশ্বাসঘাতকদের পাকিস্তান সরকার নেবে না। সুতরাং তাদের বাংলাদেশেই থাকতে হবে। কিন্তু এদেশে আগের প্রতিপত্তি নিয়ে থাকতে হলে তো রাস্তা পরিষ্কার হবে। এই রাস্তা পরিষ্কারের সর্বোত্তম পন্থা ছিল দেশের বিবেকগুলোকে সরিয়ে দেয়া। এই ভেবেই তারা বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছে। আর পাকিস্তান সরকারের এতে সাহায্য না করার কোন কারণই ছিল না। ১৯৪৭ থেকে পাকিস্তান সরকার যা করে এসেছে তা বিবেচনায় রেখে বলাই যায়, সেদেশের সরকারের মানবতা বলতে কিছু ছিল না। তারা শুরু থেকেই বাংলাদেশের ব্যাপারে সহিংস নীতি অবলম্বন করে এসেছে। তাই যাওয়ার আগে দেশটাকে পঙ্গু করে দেয়ার লোভ সামলানোর প্রশ্নই উঠেনা।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীর যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার সাথে একমাত্র হিটলারের সহিংসতারই তুলনা চলে। এর জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী অবশ্যই পাক-বাহিনীর এদেশীয় দোসরেরা। কিন্তু পাকিস্তান সরকারেরও একটা পূর্বপরিকল্পনা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর “বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি” গঠিত হয়। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা। সুযোগের অভাবে তিনি এটা করতে পারেননি। সেই আফসোসটাই মেটালেন আল-বদরের মাস্টার প্ল্যানে রসদ জুগিয়ে। দুয়ে মিলে পরিকল্পনাটা একেবারে কনক্রিট ছিল।, আরেকটু সময়ে পেলে তারা কাউকেই ছাড়তো না। বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান বলেছিলেন,
এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত গেনেছে।
এই ছিল পরিকল্পনা। ২৫শে মার্চ থেকেই শিক্ষিত সমাজের উপর আক্রমণের সূচনা ঘটে। ২৫শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সবচেয়ে পরিকল্পিত হামলাটি চালানো হয়। প্রাথমিক টার্গেট ছিল হিন্দু শিক্ষক-ছাত্র এবং আওয়ামী পন্থীরা। এদিনই (২৬শে মার্চ) নৃশংসতার শিকার হন দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব।
এরপর গণহত্যার অংশ হিসেবে বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক নিধন চলেছে। সেটা পাকিস্তান সরকারের স্বাভাবিক যুদ্ধ পরিকল্পনারই অংশ ছিল। কিন্তু ডিসেম্বরে যৌথ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। নিজেদের রাস্তা পরিষ্কারের জন্য এদেশীয় দোসরেরা সোচ্চার হয়ে উঠে। ১১ই ডিসেম্বর থেকে আল-বদর বাহিনী ব্যাপকভাবে বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করে। আজ জামাত বলে এ নিধনযজ্ঞে তাদের কোন অংশগ্রহণ ছিল না, পরবর্তীতে এগুলোর সাথে তাদের নাম লাগানো হয়েছে। কিন্তু সে সময়ের পত্রিকাগুলো ভিন্ন কথা বলে। বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের অনেককেই যে “ইসলামী ছাত্র সংঘ”-এর পুরানা পল্টন (১৫ পুরানা পল্টন) অফিসে এবং জামাতের মোহাম্মদপুর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেকথা আমরা ডিসেম্বরের পত্রিকা থেকেই জানতে পারি।
বুদ্ধিজীবী হত্যার ক্ষত কোনদিন শুকোবে না। কারণ, তারা থাকলে আজ আমার দেশের এ অবস্থা থাকতো না। ঢাকার মানুষ সেই দিনের কথা কোনদিনই ভুলতে পারবে না। কারণ তারা সচক্ষে রায়েরবাজারের বধ্যভূমি দেখেছে। নিজ দেশের সেরা সন্তানদের ছিন্নভিন্ন দেহগুলো দেখে তাদের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেটা বোধকরি কেউ বলতে পারবে না। বধ্যভূমিতে গিয়ে কেউ কথা বলার ভাষা খুঁজে পায়নি। ব্রিটিশ সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন বাঙালিদের বধ্যভূমি পরিদর্শন নিয়ে লিখেছিলেন। তার লেখার শিরোনাম ছিল, “বাংলার বুদ্ধিজীবীরা এক খাদে মরে পড়ে আছেন।” এই শিরোনামে তিনি লিখেছিলেন:
বাঙালি জনতা এই ডোবাগুলোতে এক অদ্ভুত শান্ত ভঙ্গিমায় চলাচল করছে। এখানে তাদেরকে ক্রোধান্বিত মনে হয় না। অন্যত্র তারা ক্রোধান্মত্ত। কিন্তু এখানে তারা হাঁটছে, মৃদু ফিসফিস করে কথা বলছে; তারা যেন গীর্জা পরিদর্শনরত পর্যটক।
বধ্যভূমিই কি আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছিল? আমরা কেন আগেই আল-বদর নিধনে সোচ্চার হলাম না? “বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি” কেন কাজ করতে পারল না? তাদের পূর্ণ রিপোর্ট কেন প্রকাশিত হল না? আজ ৩৭ বছর পরেও কের বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হল না? তার মানে কি ধরে নেব, আল-বদরদের পরিকল্পনা সফল হয়েছিল? আমরা কি হেরে গেছি? এই প্রশ্নগুলোর কোন সদুত্তর আমার জানা নেই। আমার মাথায় ঢোকে না, বধ্যভূমির প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ পড়েও কিভাবে আমরা নিশ্চল হয়ে বসে আছি। রায়েরবাজারে “কাটাসুরের বধ্যভূমি” সম্পর্কে অধ্যাপিকা হামিদা রহমান লিখেছেন,
আর একটু যেতেই দেখতে পেলাম, একটি কঙ্কাল, শুধু পা দুটো আর বুকের পাঁজরটিতে তখনও অল্প মাংস আছে। বোধহয় চিল শকুন খেয়ে গেছে। কিন্তু মাথার খুলিটিতে লম্বা লম্বা চুল। চুলগুলো ধুলো কাঁদায় মিলে যেয়ে নারীদেহের সাক্ষ্য বহন করছে।… আরেকটু এগিয়ে যেতেই একটা উঁচু স্থানে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছে। আমি উপরে উঠতেই একজন ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে আমাকে উপরে উঠিয়ে নিলেন। সামনে চেয়ে দেখি নিচু জলাভূমির ভেতর এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য। সেখানে একজন নয়, দুই নয়, একেবারে বারো তেরজন সুস্থ সবল মানুষ। একের পর এক শুয়ে আছে। পাশে দুটো লাশ। তার একটির হৃৎপিণ্ড কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপিণ্ড ছেঁড়া মানুষটি হল ডাঃ রাব্বী।… মাঠের পর মাঠ চলে গিয়েছে প্রতিটি জলার পাশে পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যে মৃত কঙ্কাল সাক্ষ্য দিচ্ছে কত লোককে যে এই মাঠে হত্যা করা হয়েছে।
এই বীভৎসার বর্ণনা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। দেশের অন্যতম সেরা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফজলে রাব্বীর হৃৎপিণ্ডটিই কেন ছিঁড়ে নেয়া হল? তিনি হৃৎপিণ্ড সারানোর কাজ করতেন বলেই কি? হয়তো বা। ওহ্, আবারও সেই বীভৎসতার বিবরণ দিতে শুরু করেছি। শুরু করলে তো আর শেষ হয় না। বিবরণ যত পড়ি, মনের মধ্যে ততই প্রশ্ন জাগতে থাকে। কোন প্রশ্নেরই উত্তর পাই না।
ভুল বলা হল, আসলে আমি এখন সবগুলো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। উত্তর পেয়ে গেছি আল-বদরের চিঠি পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যত বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে তাদের সবাই এই চিঠি পেয়েছিলেন। তারা চিঠি পেয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। আমিও সেই চিঠি পড়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েছি; শপথ করেছি, জীবন দিয়ে হলেও একাত্তরে শহীদ সব বুদ্ধিজীবীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবো। নরপিশাচদের বিচার করবো, জনতার মঞ্চে। তাই আর প্রশ্নের উত্তর খুঁজি না। সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি বলেই বোধহয়। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মৃত্যু পরোয়ানা পড়ার পর, আমার বিশ্বাস, যে কেউ তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। আর যখন শুনবেন, এই মৃত্যু পরোয়ানা দিয়েছে আল-বদরের মত কীটেরা তখন নিজের জীবনটাও বাজি রাখার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবেন:
শয়তান নির্মূল অভিযান
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের যেসব পাচাটা কুকুর আর ভারতীয় ইন্দিরাবাদের দালাল নানা ছুতানাতায় মুসলমানদের বৃহত্তম আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তুমি তাদের অন্যতম। তোমার মনোভাব, চালচলন ও কাজকর্ম কোনটাই আমাদের অজানা নেই। অবিলম্বে হুশিয়ার হও এবং ভারতের পদলেহন থেকে বিরত হও, নাহয় তোমার নিস্তার নেই। এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।
– শনি
পাঠক, এই চিঠি যারা পড়েছেন তাদের সবাইকে বলছি: আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আসুন প্রতিজ্ঞা করি, স্বদেশের মাটিকে আবার পবিত্র করে তুলবো, আল-বদরদের আর এই মাটিতে সদর্প ঘুরে বেড়াতে দেব না। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আজ মাটির অনেক নিচে। কিন্তু তারা সেখানে থাকবেন না, এদেশের মাটিতে তাদের পুনর্জন্ম হবে, যদি আমরা দেশকে পাকী দালালদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারি। তারা আবার আসবেনই, কোন সন্দেহ নেই। কারণ মুনীর চৌধুরী প্রতিজ্ঞা করে গেছেন,
বৃষ্টিতে ভেঁজা নরম ঘাসের উপর দিয়ে আমি আরও হাঁটব। ঠাণ্ডা রূপোর মত পানি চিড়ে হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটব। আমি বার বার আসব। তুমি যদি আমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়, দরজায় এসে টোকা দেব। চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে তোমায় ইশারা করব। (-কবর)
১৪ই ডিসেম্বরের এই দিনে হে মহামানবেরা, তোমাদের স্মরণ করছি। তোমরা আবার আস। সত্যি বলছি, আমরা তোমাদের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তোমরা এসে দরজায় টোকা দিয়েছ, আমাদের ঘুম ভেঙেছে। এবার তোমাদের হাতছানি দেয়ার পালা। সেই হাতছানিতে সাড়া দিতে আমরা প্রস্তুত…
*****
বাংলা একাডেমী “শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ” নামে একটি বই বের করেছে। এই বইয়ে ২৩২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিস্তারিত পরিচয় সন্নিবেশিত আছে। এছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা এখানে পাওয়া যেতে পারে:
বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার
বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ বক্তৃতা দেন মুজাহিদ
-কুন্তল রায়
আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ঢাকার আরেক প্রান্তে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ আলবদরদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তিনি বদর বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁর রায়ে এসব তথ্য দিয়েছেন। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল গত বুধবার মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ে বলা হয়, একাত্তরে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজ (তৎকালীন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) ছিল আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়। একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় বইটি উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরের ১৭ সেপ্টেম্বর রাজাকার বাহিনীর প্রধান ও শান্তি কমিটির লিয়াজোঁ কর্মকর্তাকে নিয়ে জামায়াতের আমির গোলাম আযম মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে যে রাজাকার ও আলবদর শিবির পরিদর্শন করেছিলেন, সেটিই ছিল আলবদরদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগকে আলবদররা প্রথমে চোখ বেঁধে এখানে নিয়ে আসে। নির্যাতনের পর এখান থেকে তাঁদের রায়েরবাজারে ও মিরপুরের শিয়ালবাড়িসহ অন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। মুজাহিদের বিরুদ্ধে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের জামায়াত নেতা সেলিম মনসুর খালেদের লেখা আল-বদর নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। উর্দু ভাষায় লিখিত ওই বইয়ের ১৭৬-১৭৮ পৃষ্ঠায় সেলিম মনসুর লেখেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্র সংঘের নাজিম (অর্থাৎ সভাপতি) নির্যাতনকেন্দ্র বলে পরিচিত মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত আলবদরের সদর দপ্তরে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে ‘আখেরি খিতাব’ (শেষ বক্তৃতা) দেন। বক্তব্যে তিনি দিনটিকে (বাংলাদেশের বিজয় দিবস) ‘বেদনাদায়ক দিন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণকে বলে ‘ট্র্যাজেডি’। সেদিন মুজাহিদ আরও বলেন, ‘আমরা বিগত দিনগুলোর জন্য লজ্জিত নই। আর সামনের দিনগুলোর জন্য নিরাশও নই।’ শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘বন্ধুরা! আমি বাধ্য হয়ে আদেশ দিচ্ছি, আপনারা হিজরতে বের হয়ে যান।’ এরপর আলবদর সদস্যরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান।
রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী। একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম, টিভি ও রেডিওর প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধ শেষে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের কয়েকটি কক্ষে গিয়ে রক্তের স্রোতধারা দেখতে পান। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্রগুলো। এতে প্রমাণিত হয়, ওই কলেজটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি হত্যাপুরী, আর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আসামি মুজাহিদ সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পুণ্য রক্ত মাড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদরের সদর দপ্তর ও নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে আরও অনেক তথ্য তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনাল। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী ও শারীরিক শিক্ষা কলেজের নিরাপত্তাকর্মী রুস্তম আলী মোল্লা একাত্তরে ওই কলেজ-সংলগ্ন আবাসিক এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। স্বাভাবিকভাবে ওই স্থানে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। তিনি ওই নির্যাতন ক্যাম্পে জামায়াত ও ছাত্র সংঘের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মুজাহিদকে দেখেছেন। এ জন্য তিনি এ বিষয়ে একজন উপযুক্ত সাক্ষী। রুস্তম আলীর দেওয়া সাক্ষ্য উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয়, বিজয়ের সাত-আট দিন আগে আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা ওই ক্যাম্পে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কলেজের পেছনে একটি ইটভাটায় শতাধিক চোখ স্তূপ করা অবস্থায় দেখেন। ১৭ ডিসেম্বর তিনি কলেজের জিমনেসিয়ামে (ব্যায়ামাগার) নয়টি ভাঙাচোরা খুলি দেখতে পান। জেরায় আসামিপক্ষ এসব বিষয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি।
রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় বইতে বলা হয়েছে, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য আলবদররা ব্যাপকভাবে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করা শুরু করে একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর থেকে। কারফিউ এবং ব্ল্যাক আউটের মধ্যে জিপে করে আলবদরা দিন-রাত বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রথমে তাদের কাদামাখানো একটি বাসে তোলে। এরপর বাসবোঝাই বুদ্ধিজীবীসহ নানা স্তরের বন্দীকে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদর সদর দপ্তরে নিয়ে নির্যাতন করে।
রায়ে আরও বলা হয়, ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোলাম আযম ১৭ সেপ্টেম্বর শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে রাজাকারদের উৎসাহ জোগাতে বক্তৃতা করেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওই কলেজটি শুধু রাজাকারদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল না, বরং একাত্তরে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করার স্থান ছিল।
ট্রাইব্যুনাল ২৯ ডিসেম্বর দৈনিক পাকিস্তান-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন উদ্ধৃত করেন। তাতে বলা হয়, বুদ্ধিজীবীদের নির্মূল করার জন্য বাংলার জঘন্যতম শত্রু ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামী যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল এবং ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আলবদর নামে জল্লাদ বাহিনী গঠন করেছিল, তাদের সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া গেছে। ওই জল্লাদদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত লালমাটিয়ার শরীরচর্চাকেন্দ্র থেকে উদ্ধার করা এসব তথ্যে বদর জল্লাদদের আরও কয়েকজনের নাম-পরিচয় ও ঠিকানা পাওয়া গেছে।
ব্লগার হত্যা, ধর্মানুভূতি ও সোজাসাপ্টা কিছু কথা
-শামীমা মিতু॥
কোনও ব্লগার খুন হলেই চারপাশে দুটো কথা বেশি শোনা যায় আজকাল।
এক: যারা ব্লগারদের খুন করছে তারা সত্যিকারের ধার্মিক না, তারা জঙ্গি।
দুই: যুক্তিবাদী হতে হলে অন্যের অনুভূতিতে আঘাত হানতে হবে কেন? কেন ধর্মকে নিয়ে কটাক্ষ করতে হবে?
যারা খুন করছে তাদেরকে সত্যিকারের ধার্মিক ভাবছেন না, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয় গোপন করে রাখা দু-একটি আইডি থেকে ধর্ম বা নবীকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করা হচ্ছে, অথচ তাদেরকেই ভাবা হচ্ছে প্রকৃত ব্লগার বা নাস্তিক। যে আইডিগুলো থেকে নোংরামি করা হয় সেগুলো তো জামায়াত শিবিরেরও হতে পারে। যেভাবে ধর্ম অবমাননার ধোঁয়া তুলে কক্সবাজারের রামুতে হামলা চালিয়ে বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অনেকে প্রশ্ন তোলেন, ধর্ম মানতে নাস্তিকদের তো কেউ বাধ্য করছে না, তাহলে তারা কেন ধর্মের পেছনে লাগে? গ্রামের প্রান্তিক মানুষ যারা জানেই না ব্লগ কাকে বলে, ইন্টারনেট কাকে বলে তারাও এমন প্রশ্ন করে। আবার যাদেরকে আমরা প্রগতিশীল বলে জানি, এমন অনেকেও প্রায় একই রকম প্রশ্ন করেন। অথচ তারা অভিজিৎ রায়ের কিংবা অনন্ত বিজয় দাশের কিংবা ওয়াশিকুর বাবুর কোনও লেখাতে দেখাতে পারেন না যেখানে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে। যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক কিংবা ব্লগ লেখে এমন কেউ খুন হলেই সবাই ভাবছে, নিশ্চয় খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি ধর্ম না হয় নবী-রাসুলকে নিয়ে কোনও কটূক্তি করেছে! সর্বসাধারণের কাছে এমন ভাবমূর্তিই তৈরি করা হচ্ছে।
অথচ একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে জড়ো হওয়া তরুণরা আল্লামা শফীর কাছে খেতাব পেয়েছিল 'শাহবাগি নাস্তিক' হিসেবে। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিল, ওই ১০ লাখ মানুষের সবাই কি নাস্তিক?
প্রতিটি হত্যার বিচার নিয়ে রাষ্ট্র রহস্যময় আচরণ করছে। সরকার শুধু নির্বিকারই থাকছে না, বরং অচেনা বামনের পৈতা দেখানোর মতো নানা কূটকৌশল করছে। তালিকা ধরে একের পর এক হত্যা করা হচ্ছে ব্লগারদের, তাদের নামে বদনাম রটিয়ে খুন করার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করা হচ্ছে এবং হত্যার পর স্বগর্বে দায় স্বীকার করছে আল কায়েদার বাংলা সংগঠন। আল কায়েদার হাত যেখানে পড়ে সেখানকার অবস্থা কী হয়, আমাদের সামনে কি এর উদাহরণ নেই? আমরা কি দেখছি না সিরিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পরিস্থিতি? যারা ভাবছেন এইসব জঙ্গি সংগঠন দেশের কিছু নাস্তিক ব্লগার হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত দেবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন, তারাই দেশের ক্ষতি ডেকে আনছেন।
আনিস আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনে ‘সজীব ওয়াজেদ, জাফর ইকবাল এবং ‘স্পর্শকাতর’ ব্লগার ইস্যু’ শিরোনামে একটা কলাম লিখেছেন। লেখার কিছু জায়গায় কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন,‘কতিপয় ব্লগারের গালাগালি প্রতিহিংসার পরিবেশ তৈরি ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। আমরা সব ধরনের সংস্কার আন্দোলন করতে পারি, যুক্তি দিতে পারি কিন্তু অনুভূতিতে আঘাত কেন? আমাদের দর্শন চিন্তায় যুক্তি প্রদর্শনের চাইতে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতারা, তাদের ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে কটাক্ষটা প্রাধান্য পাচ্ছে কেন? মুক্তচিন্তার কথা বলে আমরা গুটিকয় লোক কি সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের বিশ্বাসে অন্তরায় সৃষ্টি করছি? কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাসে আমাকে আঘাত দেওয়ার আগে তার প্রতিক্রিয়ার কথা কি আমরা ভাবছি?’
তার লেখা পড়ে মনে পড়ে গেল, বুখারী শরিফের অনেক হাদিস বহু বছর ধরে টিকে আছে যেগুলো পাঠ করলে নবীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে। মুসলিম হাদিস বিশারদরা দাবি করেন, এসব হাদিস সবই মিথ্যা বা ফেইক। অথচ এই সকল হাদিস মুসলমানেরাই সংকলন করেছেন, সাহাবি-খলিফাদের বরাত দিয়ে। এটা কি ধর্মানুভূতিতে আঘাত নয়? বুখারী শরিফের এই সংকলনকারীদের কি চাপাতির নিচে পড়তে হয়েছে?
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের দাবি হচ্ছে তারা ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ অনুসরণ করে। অথচ এই সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনের সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত ৭২-এর সংবিধানের মূলনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে এরশাদ আমলে করা 'রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম' বহাল রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। একদিকে হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী শফী হুজুরের পায়ে মাথা ঠোকেন।
এদেশে বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে ইসলামকে দাঁড় করানো হয়েছে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান, গণজাগরণ মঞ্চকেও হেফাজত-জামায়াত নাস্তিক বলে আখ্যা দেয়। অথচ এদের একটা লেখা, একটা বক্তব্য পাওয়া যাবে না যাতে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে।
বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় কিংবা অনন্ত বিজয় দাশের লেখা খুবই পরিচ্ছন্ন, যুক্তিপূর্ণ। তারা তো কাউকে গালিগালাজ করেননি, অশ্লীল উক্তিও করেননি কোনও লেখায়, এমনকি নির্দিষ্ট কোনও ধর্ম নিয়ে ধর্মবিদ্বেষী কোনও মন্তব্য করেননি। তারা খুন হলেন কেন?
যারা ধর্মীয় আচার-রীতি, বিধান প্রচার এবং ধর্ম রক্ষার দাবি করছেন, তারাও কিন্তু অনেক বেশি অশ্লীল, নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করছেন; মূলত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের লোকদের। শিবিরের বাঁশের কেল্লাসহ হেফাজতের নানা ফেসবুক পেজে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিশিষ্টজন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের ব্লগার এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও ভয়াবহ, নোংরা অশ্লীল গালিগালাজ করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, ধর্মীয় চেতনার অধিকারী হলে তারা তাদের মত প্রকাশ করবে, যাকে ইচ্ছা নাস্তিক, মুরতাদ বলবে, অশ্লীলতম ভাষায় গালিগালাজ করার পূর্ণ অধিকার ভোগ করবে, আর বিজ্ঞানমনস্ক কেউ তার যুক্তির বিপরীতে কোনও যুক্তি দিলে বলবে, 'ওই ব্যাটা, চুপ থাক তোরে এসব নিয়ে লেখালোখি করতে কে বলেছে', এরপর যুক্তিতে হেরে গেলে নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে তাকে নৃশংসভাবে খুন করবে!
শুধু ব্লগার নয়, ধর্মীয় চিন্তাবিদদের মধ্যে যারা উদার দৃষ্টিসম্পন্ন, যারা জামায়াত-হেফাজত বিরোধী তাদেরও তো বাসায় ঢুকে নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকাণ্ড তো সেদিনের ঘটনা।
ধর্মানুভূতিই বা কী বস্তু, যাকে অনাহত, অক্ষত রাখার জন্যে রাষ্ট্রসহ নানান গোষ্ঠী এতো তৎপর? ধর্ম কি যুক্তি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? ধার্মিকেরাই বিশ্বাসী হওয়ার কথা বলেন। কিসে বিশ্বাস? সেই বিশ্বাস, যা বহু আগেই বদলে দিয়েছেন কোপারনিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইনরা।
নানান বৈজ্ঞানিক সত্য আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়, পৃথিবী ও গ্রহগুলো ঘোরে সূর্যকে কেন্দ্র করে, মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাগর্জনের ফলে, সেটি হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি, আজ থেকে এক হাজার থেকে দু-হাজার কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে, তারপর থেকে সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে, সূর্য আর গ্রহগুলো উদ্ভূত হয়েছে সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে, বিবর্তনের ফলে মানুষের বিকাশ বিশ থেকে চল্লিশ লাখ বছর আগে, পাহাড়গুলো পেরেক নয় ইত্যাদি।
একথাগুলো তো প্রচণ্ডভাবে আহত করে ধর্মানুভূতি, কেউ যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এ সব সত্যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এগুলো নিষিদ্ধ করার দাবি জানায় তখন রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্র কি নিষিদ্ধ করবে বিজ্ঞান?
রাষ্ট্র যদি সত্যি মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরেপেক্ষ নীতি বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রকে এ ধরনের নৃশংস খুনের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে, খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জামায়াত-হেফাজত তোষণের দ্বৈতনীতি নিয়ে দেশ চালালে এ দেশের পরিণতি পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতোই হবে। আর এমন আশঙ্কাই দিন দিন তীব্র হচ্ছে!
লেখক: সাংবাদিক ও ব্লগার
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
http://www.banglatribune.com
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় ব্লগার হত্যা[/su
একটা গল্প দিয়ে শুরু করছি। গল্পটা এমন, কয়েকজন চোর আসলো নারকেল চুরি করতে। সেই গাছের মালিকানা ছিলো তিন ভাইয়ের। তারা চোরদেরকে দেখে ফেললেন। চোররা চিন্তা করলো, তিন ভাইয়ের সঙ্গেতো পারা যাবে না। যদি তারা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করে, চিৎকার করে তবে তাদেরকে আম, ছালা দু’টোই হারাতে হবে। সঙ্গে মাইর ফ্রি! তাই তারা প্রথমে দুই ভাইকে ডেকে বললো, দেখো তোমাদের দুই ভাইকে তো বড় ভাই ঠকাচ্ছে। এটা সহ্য করতে না পেরেই আমরা তোমাদেরকে সহযোগিতা করতে এসেছি, যাতে তোমরা তোমাদের ভাগ পাও। আমরা এ নারকেল তোমাদেরকে দেবা। এরপর চোররাসহ দুই ভাই মিলে বড় ভাইকে মারধর করে তাকে সরালো।’ চোররা এবার ছোট ভাইকে আলাদা করে বললো, ‘তোমার বড় ভাই যেভাবে তোমাদেরকে ঠকিয়েছিলো, মেঝ ভাইও তোমায় সেভাবে ঠকাবে। কেননা, সে তোমার বড়। তুমি চাইলে সব নারকেলই তোমার হবে।’ এ বুদ্ধি পেয়ে ছোট ভাইসহ চোররা মিলে এবার মেঝ ভাইকে মেরে তাড়ালো। ছোট ভাই এবার সব নারকেল দাবি করলে চোররা মিলে ছোট ভাইকে মেরে তাড়িয়ে সব নারকেল তারা নিয়ে গেলো।
চোররা এবার ছোট ভাইকে আলাদা করে বললো, ‘তোমার বড় ভাই যেভাবে তোমাদেরকে ঠকিয়েছিলো, মেঝ ভাইও তোমায় সেভাবে ঠকাবে। কেননা, সে তোমার বড়। তুমি চাইলে সব নারকেলই তোমার হবে।’ এ বুদ্ধি পেয়ে ছোট ভাইসহ চোররা মিলে এবার মেঝ ভাইকে মেরে তাড়ালো। ছোট ভাই এবার সব নারকেল দাবি করলে চোররা মিলে ছোট ভাইকে মেরে তাড়িয়ে সব নারকেল তারা নিয়ে গেলো।’
এ গল্পটি ইদানিং খুব মনে পড়ছে। কারণ, গত চার মাসে কয়েকজন মানুষ, ব্লগারকে নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে ইচ্ছেমতো খুন করছে। এর সবশেষ শিকার হলেন নিলয় নীল। এর আগে রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, বাবু, অনন্ত বিজয়কে খুন করেছে। খুনিদের কৌশল গল্পটার মতো। তারা এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে বোঝাচ্ছে, আমরা ‘নাস্তিক’ মারছি, ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’তো মারছি না। আর এতে ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’রাও আনন্দিত! কোনো প্রতিবাদ নেই! কারন, যারা মরছে তারা তো তাদের শত্রু, ‘নাস্তিক’, কিন্তু মানুষ না!
তবে তাদের জানা উচিৎ, ‘নাস্তিক’ ট্যাগ খাওয়া এ ব্লগার নামের তরুণ বুদ্ধিজীবিদের হত্যা শেষ হলে এখনকার ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানদেরকে ‘সহি মুসলমান’ না বলে ফতোয়া দিয়ে কতল করা হবে। আর তখন তাদের বিরুদ্ধে বলা বা যৌক্তিক কোনো লেখার লোক থাকবে না। এখন এ কৌশল প্রয়োগের কারণ হলো, সাধারণ মানুষ যদি এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, তবে তাদের স্বপ্নের ‘বাঙ্গিস্তান’ প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হবে।
রাজীব হায়দারকে হত্যার পরে প্রধানমন্ত্রী তাকে দেখতে গিয়েছেন। বিবৃতি দিয়েছেন। জনমতের বিপক্ষে যাওয়ার ভয়ে ‘বাঙ্গিস্তান’র স্বপ্নদ্রষ্টাদের মুখপত্র দৈনিক আমার দেশ বিষয়টি নিয়ে নোংরামি শুরু করে। পত্রিকায় সিরিজ আকারে ব্লগারদের বিষয়ে নাস্তিকতার কলিমা লেপার চেষ্টা করে। এতে ‘বাঙ্গিস্তানের অন্ধ মুজাহিদ’রা ব্লগার শব্দটাকে নাস্তিকতার সমার্থক হিসেবে ধরে নেয়! তালিকা করে তাদেরকে মারার জন্য ঝাপিয়ে পড়ে! আর দেশের অনেক মানুষ তাদের এ অপপ্রচারের শিকার হয়ে তাদেরকে নাস্তিক ভাবতে শুরু করে! যদিও ব্লগিংয়ের সঙ্গে নাস্তিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। আর হ্যাঁ, কোনো ব্লগার নাস্তিক হলেও তাদের লেখা, কথা, আর যুক্তির জবাব লেখা, কথা, বা যুক্তি দিয়েই দিতে হবে। চাপাতি দিয়ে না।
এখানে দেখতে হবে, বেশীরভাগ ব্লগার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কাজ করায় স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভক্ত। আজ থেকে সাত, আট বছর আগেও অনলাইনে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ‘একচেটিয়া রাজত্ব’ ছিলো। বিভিন্ন বিষয়ে গুজব ছড়াতো। এখন কিন্তু তেমনটা নেই। আওয়ামী লীগের পক্ষের শক্তিকে কিন্তু এই ব্লগাররাই অনলাইনে নিয়ে এসেছিলেন। তাও আবার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। রাতের পর রাত নির্ঘুম থেকে, দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে প্রচারণা চালিয়ে এ ব্লগাররাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকদেরকে এ বিষয়ে সচেতন করেছিলেন। ব্লগারদের ওপরে এ খুনি চক্রটির টার্গেট’র মূল কারণটি কিন্তু এখানেই। কেননা, তাদের কারণেই অনলাইনে একচেটিয়া রাজত্ব হারাতে হয়েছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে।
উল্লেখযোগ্য আরেকটি বিষয় হলো, যারা নাস্তিকতার অভিযোগে লিস্ট করে ব্লগারদেরকে হত্যা করছে তাদের দৃষ্টিতে কিন্তু আওয়ামী লীগও নাস্তিক। তারা এর আগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ তুলেছিলো। এখনো তারা আওয়ামী লীগকে নাস্তিকদের দল মনে করে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে তারা এখনো সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মহীনতা বলে প্রচার করে। এ নাস্তিকতার প্রচারণা চালিয়েই তারা মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করেছিলো।
‘গণীমতের মাল’ মনে করে ‘নাস্তিক মহিলা’দেরকে তারা ধর্ষণ করে ‘পুরুষ নাস্তিক’দের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে! মুক্তিযুদ্ধে তারা ফতোয়াও দিয়েছিলো, ‘যারা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায় হিন্দুরাষ্ট্র ভারতের সহায়তায়, তারা কাফের, বিধর্মী, নাস্তিক।’ এজন্যই তারা এ বিধর্মী, আর নাস্তিকদের সঙ্গে ‘জিহাদ’ করার জন্য আল বদর বাহিনী তৈরি করেছিলো! আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল অনেক সংগঠনের নেতা কর্মীও এসব খুনিদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। নিজেদের পরাজয় ত্বরান্বিত জেনে সবশেষে তারা বুদ্ধিজীবিদের হত্যায় মেতে ওঠেছিলো।
১৯৭১’র বুদ্ধিজীবি হত্যার পর মেধার সেই ঘাটতি এখনো পূরণ হয়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে আস্তে আস্তে এই তরুণ সমাজ সেই ঘাটতি পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে একাত্তরের পরাজিত শক্তি আবার রক্তের সেই হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। ৭১’র মতো এবারো তারা ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে! তরুণ বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে খুনিচক্র প্রথমে মুক্তচিন্তার লেখকদেরকে নাস্তিক হিসেবে ফতোয়া দিচ্ছে। ফতোয়ার স্পর্শকাতর দিক, ভোটের চিন্তা করে আওয়ামী লীগ এসব লেখকদের কাছ থেকে প্রকাশ্যেই দূরে থাকছে। আর আমরাও এ ফতোয়া বিনা বাক্যে বিশ্বাস করে যাচ্ছি!
কিন্তু ওপরের গল্পের মতো এসব হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুক্তমনের এ তরুণ লেখক ও আওয়ামী লীগকে এভাবে আলাদা করতে পারলে তাতে সাফল্য খুনিচক্রেরই হয়। আর এতে সাফল্য আসলেই শুরু হবে আওয়ামী লীগ নিধন। তখন তারা আওয়ামী লীগকে আবার নাস্তিকদের দল হিসেবে আখ্যায়িত করার পাশাপাশি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী, জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী ফতোয়া দিয়ে ‘জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা’য় আওয়ামী লীগের নেতাদেরকে একের পর এক হত্যার মিশনে নামলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। তখন তাদেরকে নিয়ে অনলাইনে জনমত গড়ার মতো কেউ থাকবে না। কারণ, তরুণ এ ব্লগারদের হত্যার মাধ্যমে শেষ করতে পারলেই অনলাইন জগতটা খুনিদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। বর্তমান বাস্তবতায় অনলাইনের দখল ছাড়া অফলাইনের বিজয় একপ্রকার অসম্ভব। সুতরাং এমন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির জন্য আমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে দায়ী করতে পারবো না।
নিলয়কে হত্যার পরে দেখেছি, আওয়ামী লীগের অনেক ‘সেলিব্রেটি ফেসবুকার’ নিলয়ের লেখার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, ‘মুসলমানদের পবিত্র স্থান মসজিদকে অবমাননা করে নিলয় কেনো লিখেছেন?’ তাদের এমন গুরুতর অভিযোগের পরে নিলয়ের টাইমলাইন আমি চেক করি। সেখানে লেখা ছিলো, ‘মসজিদ আল্লাহর ঘর, এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে সাধারণ মানুষ। মসজিদ কোনো আরাম, আয়েশের বা এলাকার গৌরবের স্থাপনা নয়। মসজিদ প্রয়োজন অনুযায়ি নির্মিত হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, মসজিদকে আলিশান হতে হবে কেনো?’
‘একটি মসজিদ স্থাপিত হবে, সেখানে ইবাদতের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু তাকে সুসজ্জিত করতে হবে কেনো? আপনি আল্লাহর কাছে হাজিরা দিতে মসজিদে উপস্থিত হচ্ছেন। দীনহীন, অসহায়, পাপী একজন বান্দা। সেখানে আপনাকে এত আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ রাখতে হবে কেনো? আল্লাহ কি তাগিদ দিয়েছেন মসজিদকে সুসসজ্জিত করার?’…এই কথাগুলো এজন্যেই বলছি, যখন দেখি একটি আলিশান মসজিদের পাশের ফুটপাতেই গৃহহীন মানুষ খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে, তখন মনে হয় ধর্মের নামে মানুষ যেন অসহায় মানুষগুলোর সাথে নির্মম উপহাস করছে। মসজিদকে কেন্দ্র করে সারা দেশব্যাপি চাঁদার নামে একধরনের ভিক্ষাবৃত্তি চালু হয়েছে।’
‘যেখানে চাঁদা গ্রহিতারা যদি শতভাগ সততার সাথেও আদায়কৃত চাঁদার টাকা মসজিদের তহবিলে জমা করেন, সে ক্ষেত্রেও মসজিদ পায় ৩০ ভাগ, বাকি ৭০ ভাগ নেয় চাঁদা আদায়কারীরা। অর্থাৎ এটাকেই তারা অবলীলায় পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন। আর যদি চাঁদা গ্রহিতা পুরো টাকাটাই মেরে দেন সে ক্ষেত্রেও তাদের বাধা দেয়ার কেউ নেই। এ সবই সম্ভব হচ্ছে মসজিদকে দৃষ্টিনন্দন আলীশান করে গড়ে তোলার মানসে। এখানে কতটা পার্থিব স্বার্থ জড়িত আর কতটা মহান আল্লাহকে খুশি করতে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।’
এখন প্রশ্ন এটা কি মসজিদকে অবমাননা করে লেখা? নাকি মসজিদকে ঘিরে যে ব্যবসা, লোক দেখানোর সংস্কৃতি তার বিরুদ্ধে লেখা? তর্কের খাতিরে যদি ধরি এটা মসজিদকে অবমাননা করে লেখা, তবে মসজিদকে কেনো দৃষ্টিনন্দন করা প্রয়োজন, কেনো মসজিদে এয়ারকন্ডিশন লাগানো দরকার, তার জবাব লেখার মাধ্যমে দিলেইতো হয়। এ লেখার কারণে তো কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা না? তিনি মসজিদের দৃষ্টিনন্দনের বিরোধিতা করেছেন, মসজিদ নির্মাণের বিরোধিতা করেননি।
সেই ‘সেলিব্রেটি’দের বোঝা উচিত, ব্লগারদের খুন করার জন্য খুনীরা ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু ইসলামের কোথায় ভিন্নমতের মানুষকে খুন করার কথা বলা বা লেখা আছে? ইসলাম ধর্ম এত ঠুনকো নয় যে, কোথায় কোন ব্লগার তার ব্লগে মসজিদের দৃষ্টিনন্দনের বিরোধিতা করে কী লিখলো, আর তাতেই মসজিদের দেয়াল, ইসলাম হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।
ভারতের মতো হিন্দু প্রধান দেশে হিন্দু ধর্মের বাড়াবাড়ি নিয়ে পিকে সিনেমায় হিন্দু ধর্মের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ ভারতের সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে। ইসরাইলের বুদ্ধিজীবীরা গাজায় তাদের সেনা দ্বারা মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করে। রোমের নাস্তিকরা খ্রিষ্টান ধর্মকে তুলোধুনা করে। কারণ, যেখানের যেটা সমস্যা, সেখানকার এক্টিভিস্টরা সেই বিষয় নিয়ে কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। তাই এখানের ব্লগারদের লেখা, সমালোচনাও সেই সাধারণ নীতি অনুসরণ করবে।
সবশেষে বলবো, ব্লগারসহ দেশের সব মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। সেই দায়িত্ব পালনে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে, হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতেও যে সরকার ব্যর্থ হবে, তা বিশ্বাস করতে আমি রাজি না। আমি আশাবাদী থাকতে চাই। আমি এখনো আশা করি, এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়ে সরকারের বোধোদয় হবে। যেসব খুনি ধরা পড়েছে তাদের বিচার হবে।
আহসান কামরুল
১১.০৮.২০১৫ খ্রি.
ঢাকা।
- See more at: Click This Link
বুদ্ধিজীবি হত্যার অন্তর্নিহিত কারন:
-শাহীন
এখন পর্যন্ত বুদ্ধিজীবি হত্যার কারন হিসাবে সবাই বলেন দেশ যেন চলতে না পারে সেজন্য এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। সেটা অবশ্যই ঠিক, তবে এর বাইরে আরো গভীর কিছু বিষয় আছে বলে আমার মনে হয়। প্রথমত: পাকিস্তানি বাহিনী ১০ ডিসেম্বরের পরই আত্মসমপর্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তখন তাদের মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল পাকিস্তানি সামরিক এবং আধাসামরিক (রাজাকার/আলবদর/আল শামস) বাহিনীর সদস্যদের জীবন বাচিয়ে আত্ম সমপর্ন করা। ১৩/১৪ ডিসেম্বরই ইয়াহিয়া নিয়াজীকে সেটা জানিয়ে দেন। তাহলে সেই সময় এই গর্দভদের যখন চাচা আপন প্রান বাচানোই দায়, তখন তাদের পক্ষে একাকি এমন একটা পরিকল্পনা করা কঠিন ছিল। তবে এদের ব্যক্তিগত জিঘাংসার ধরন আজো আমরা যেমনটা দেখছি (প্রায় প্রতিদিন তারা কোন না কোন খানে কোন না কোন আলীগ নেতাকে নিরস্ত্র আবস্থায় কুপিয়ে বা আগুন দিয়ে হত্যা করছেন) সেটা চিন্তা করলে এটা স্বাভাবিকই মনেহয়। একইসাথে তাদেরকে যে কেউ কিছু করতে পারবেনা –এমন একটা আত্মবিশ্বাস তাদের সবসময়ই ছিল। যেমন ইয়াহিয়ার সেই চিঠিতে পাকিস্তানী বাহিনীর যে কিছু হবে না, এইরকম যোগাযোগ উনি জাতিসংঘের সাথে আগেই করে রেখেছেন বলে নিয়াজীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আর ১০ ডিসেম্বর জামাতের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম শিরোনাম করে –‘আমাদের সাথে আমেরিকা আর চিন আছে, ভয় পাবার কিছু নাই’।
তারপরো আমার ধারনা, এই পরিকল্পনার পেছনে আরো শক্তিসালী কেউ ছিল। মনে রাখতে হবে আত্মসমপর্ন ১৬ তারিখ বটে, কিন্তু সিদ্ধান্ত কিন্তু আরো আগের। সম্প্রতি জানা গেছে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের চিঠি আমেরিকা ১৮ ঘন্টা নিজের কাছে আটকে রেখেছিল। (পাকিরা আত্মসমপর্নের চিঠি কিন্তু দিয়েছিল তাদের আব্বাজান আমেরিকাকে !)। আমেরিকা সব সময়ই একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা মাথায় রেখে কাজ করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় যখন অবিসম্ভাবি, তখন তাদের করনীয় কি ? হয় বাস্তবতা মেনে নিয়ে নতুন দেশের সরকারের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন (যেটা প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধু অন্তত সম্ভব ভেবেছিলেন !) অথবা নতুন সরকারকে হঠিয়ে দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। এই পরিকল্পনা তারা আগেই নিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পরে অন্তত নয়।
আমরা আজ জানি বাংলাদেশের জন্মটা ছিল কিসিন্জারের জন্য ব্যক্তিগত পরাজয়। ৩ টি ঘটনা তার রাজনৈতিক ক্যরিয়ারকে বিপযর্স্ত করেছিল, যার পেছনে ছিলেন তিন মহামানব – থিউ, আলেন্দে আর মুজিব। কিন্তু তাদের উপরে প্রতিশোধ কিভাবে নেয়া সম্ভব ? ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত প্রধানন্ত্রী মোসাদ্দেক কে দিয়ে শুরু সিআইএর ষড়যন্ত্র, আর কু্ বাস্তবায়নের দীর্ঘ ইতিহাসের। ইরানের ঘটনায় সিআইএর হাত থাকার কথা সম্প্রতি ওবামা স্বীকারো করেছেন। এরপরে আরো অসংখ্য দেশে বছরের পর বছর সিআইএ এই কাজ করে গেছে সিদ্ধ হস্তে। তাহলে সেটই যে করতে হবে বাংলাদেশে তা নির্ধারিত হয়েছিল নিশ্চয়ই ১৯৭১ সালেই। তাজউদ্দিনের কথা এই ক্ষেত্রে না বললেই নয়। কি আশ্চর্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল তার ! ৭১ সালেই বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রায়ই তিনি একটি কথা বলেতন যে ‘যদি আমরা যুদ্ধে হেরে যাই তাহলে বিদ্রোহী হিসাবে বিচার করে ফাসি দেয়া হবে। যদি জিতি তাহলে আততায়ির হাতে প্রান হারাতে হবে।‘ (সূত্র: সিমিন হোসেন রিমির লেখা আমার বাবার কথা এবং আমার বাবা তাজউদ্দিন)
বাংলাদেশের নতুন সরকারেক যদি একইরকমভাবে কু্ করে সরাতেই হয় তাহলে সেটা কিভাবে করতে হবে ? ১৯৭১ সালেই সিআইএ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তখনকার মেজরদের (শফিউল্লা, জিয়া সবাই তখন মেজর ছিলেন) কয়েক জনকে রিক্রুট করেছিল, তার দলিল আগেই অবমুক্ত হয়ে গেছে, যদি সেই মেজরের নাম এখনো অবমুক্ত হয়নি। কিন্তু শুধু সেরকম ১ জন থাকলেই তো হবেনা। আরো কিছু পরিক্ষিত টেকনিক আছে সিআইএর কু এক্সপোর্ট করার। তাদের ব্রাজিলিয়ান এক ডক্টরেট ভদ্রলোক (ড: কামাল না কিন্তু) যিনি ল্যাটিন আমেরিকায় সিআইএর এই কার্যপ্রনালী প্রথমদিকে প্রয়োগের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি তখন মার্কিন এক পত্রিকায় সগর্বে সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছিলেন ‘কেক তৈরীর প্রনালী রেডি, এখন শুধু ভাজো আর খাও !’।
তো এই ‘কেক তৈরীর প্রনালী’ সম্বন্ধে বিস্তারিত আমরা জানি চার্চ কমিটির প্রতিবেদন নামে বিখ্যাত মার্কিন কংগ্রেসের এক তদন্তে, যেখানে সিআইএ আসলে কি কি করছে বিশ্ব জুড়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার নামে সেটা নিয়ে তদন্ত করা হয়। আর এটার উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ১৯৭২ সালে চিলির নির্বাচিত ক্যারিশমাটিক নেতা সালভাদর আলেন্দে হত্যা এবং ক্যুর ঘটনায় সিআইএর যুক্ত থাকা। এর মাধ্যমে আমরা প্রথম অফিসিয়ালি জানতে পারি তারা বিশ্বজুড়ে এই সব কাজ করছে আর তার জন্য কি কি টেকনিক প্রযোগ করছে।
যদিও আলেন্দে হত্যার পরপরই এক সাক্ষাতকারে আমেরিকার আরেক শত্রু (একমাত্র যাকে তারা হাজার বার মারা চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হয়েছে) ফিডেল ক্যস্ট্রো বলেন, ‘আলেন্দে মারা গেছেন আসলে অতিমাত্রায় গনতন্ত্রের জন্য। তার দেশে সবারই ষড়যন্ত্র করার অধিকার ছিল। বিরোধী প্রেস ষড়যন্ত্র করেছে এবং ক্যু সফল করেছে।‘
একই রকম আরেক নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশে ৭৫এর জুনে ৪টি বাদে বাকি সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার সময় সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিদেশ থেকে টাকা এনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।‘
চার্চ কমিটির রিপোর্ট থেকেও আমরা জানতে পারলাম চিলির নেতা আলেন্দেক হত্যায় এবং তার আগের বারের নির্বাচনে তাকে হারানোতে সিআইএর প্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিল। তারা কি টেকনিক ব্যবহার করেছিল, তার উপর চার্চ কমিটির রিপোর্টে একটা বিস্তারিত অধ্যায়ই আছে। সেটা থেকে জানা যায় তাদের মূল টেকনিক ছিল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রোপাগাণ্ডা চালানো। আর এই কাজে তাদের মূল অস্ত্র ছিল প্রথম আলো ...দু:খিত... এল মারকুরিও নামের একটি দৈনিক পত্রিকার।
এছাড়া ছিল অর্থনীতিকে আক্রমন করা। যেটাও কিনা আমরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখেছি যখন কিনা খাদ্য বোঝাই জাহাজ আমাদের বন্দরের কাছ থেকে ফেরত নিয়া যাওয়া হয়েছিল দূবিক্ষ নিশ্চিত করার জন্য।
তো এই টেকনিক যদি হয় ‘কেক তৈরীর প্রনালী’ যা কিনা ১৯৫৩ সাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর সেই প্রনালী যদি বাংলাদেশে প্রয়োগ করা সিদ্ধান্ত ৭১ সালেই নেয়া হয়ে থাকে (বাজী ধরতে পারেন আমেরিকা ঠিক এতোটাই এডভান্স চিন্তা করে)। তাহলে সেই প্রোপাগাণ্ডা চালানোর জন্য প্রধান বাধা কারা? জাতির সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়, অর্থাত যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মানোর সময়ে যারা অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছিলেন- সেই সব বুদ্ধিজীবিরা নয় কি ? আর তাদের অনেকেই তখন নিরস্ত্র, বেসামরিক মানূষ, কলম যোদ্ধা। তাই ১৪ ডিসেম্বর তাদের হত্যা করা কি অতি-জরুরী নয় ? যে কারনে 'চাচা আপন প্রান বাচাঁ' অবস্থায় থাকা জামাতো তখন প্রভুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। যে তালিকা ধরে হত্যা করা হয়, সেটি আজ এক ঐতিহাসিক দলিল, তা ছিল গোলাম আযমের সই করা। আর তাইতো গোলাম আজো মার্কিনীদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ ।
১৪ ডিসেম্বর যে সুদুর প্রসারী চক্রান্ত্রের সূচনা হয়, তা পরবতিতে ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে গেছে সিআইএর এদেশী দোসররা। যে কারনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরীক্ষিত গুনি শিল্পীদের অনেকেই, যারা বেচে ফিরেছিলেন, তারা পরবর্তিতে দৈন্যদশায় ধুকে ধুকে মরেছেন। আর অব:প্রাপ্ত, আমলা, হঠাৎ গজিয়ে উঠা বুদ্ধিজীবিরা, যাদের ভালো কোন সাহিত্য কর্ম কোনদিন দেখেন নি, তারা সেজেছেন জাতির বিবেক- ‘সুশিল সমাজ’। এমনকি আজো মুনতাসির মামুন, গাফফার চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, ড: মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কিংবা ড: আনোয়ারকে ধীরে ধীরে লেবেল মেরে, প্রান্তিক আর অপ্রাসংগিক করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মুক্ত চিন্তার দৈনিক আর তার সহচর অন্যান্য দৈনিক/টিভি গুলো। তাদের একমাত্র অযোগ্যতা- তারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে কেনা দিন বেইমানি করতে পারেন না। ৭১ সালে যেমন তথাকথিত নিরপেক্ষ হতে পারেন নি, আজো না। আর নতুন প্রজন্মের ইমরান এইচ সরকার, নিঝুম মজুমদার, মারুফ রসুলদেরৃ মিথ্যা নাস্তিক আখ্যা দিয়ে হত্যার সকল আয়োজন করে রাখা হয়েছে।
আজ থেকে ৪২ বছর আগে এই দিনে, বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের মাধ্যমে যে বীষ বৃক্ষের বীজ বোপন করা হয়েছিল, আজ তারই শাখা প্রশাখায় দেশের সব মিডিয়া ছেয়ে গেছে। আর তাতে ভর করে ৭১ এর শকুনেরা আবারো আমাদের মানচিত্র হিংস্র থাবায় রক্তাত্ত করছে প্রতিদিন। ৭১ এ আমরা জিতেছিলাম, ২৯১৪ তে কি হবে ?
------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র:
চার্চ কমিটির রিপোর্ট (সংক্ষিপ্ত)
বিশ্বব্যাপি সিআইয়ের গোপন ততপরতা- 'যে রাজ্যে আইন নেই .. ' বই থেকে কিছু অংশ
http://www.somewhereinblog.net/blog/sa07shahin/29905887
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা, তাঁদের একটি তালিকা
-আইরিন সুলতানা
পাক-বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস কর্তৃক সংগঠিত তালিকাভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞের স্বরণে বাঙালি জাতি স্বশ্রদ্ধ চিত্তে সেই ১৯৭২ সাল থেকে ১৪ই ডিসেম্বরে শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস পালন করে আসছে । বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, মরহুম তাজউদ্দিন আহমেদ, ১৪ই ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষনা করেছিলেন কারণ, অপহরণ ও পরে নির্বিচারে হত্যা এই ১৪ই ডিসেম্বরেই অর্থ্যাৎ পাক-বাহিনীর আত্ম-সমর্পন এবং বাঙালির বিজয় অর্জন তথা বিজয় দিবসের ঠিক দু’দিন পূর্বে, সংগঠিত হয়েছিল সবচেয়ে বেশী।
২০শে ডিসেম্বর ১৯৭১ –এ, মুজিবনগর সরকারের এক মুখপাত্র জানান, ১৬ই ডিসেম্বরে আত্মসমর্পনের পূর্বে পাক-বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা মিলে ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। ১৯৯৪ সালে পুণ:মুদ্রিত বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবি সম্পর্কিত তথ্যকোষ ”শহীদ বুদ্ধিজীবি কোষগ্রন্থ” এ শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যা ২৩২ জন উল্লেখ আছে এবং এই তালিকাটি সর্বমোট নয় এমনকি সম্পূর্ণ নয় ।
এই তথ্যকোষে শহীদ আখ্যায়িত হয়েছেন তারা যাদের পাক-বাহিনী এবং দোসরেরা (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) বিভিন্ন সময় নির্বিচারে হত্যা করেছিল এবং যারা ২৫শে মার্চ ১৯৭১ থেকে ৩১শে জানুয়ারী ১৯৭২ সময়কাল থেকে নিঁখোজ । লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, সংগীত শিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, উকিল, চিকিৎসক, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মী, নাট্য-কর্মী, জনসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের বুদ্ধিজীবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ”বাংলাদেশ” নামক প্রামান্য চিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ-শিক্ষককে হত্যা করা হয়।
এ ব্যাপারটি পরিস্কার ছিল যে, পরাজয় সন্নিকটে জেনে, পাক-বাহিনী এবং তার দোসরেরা বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং শিক্ষক, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে আসে এবং একজনের পর একজনকে হত্যা করে এবং তা বেশীর ভাগই সংগঠিত হয় এই ১৪ই ডিসেম্বরে। এই হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল মূলত জাতি হিসেবে আমাদের মেধাহীন, পঙ্গু করে দেয়া।
দৈনিক পত্রিকাগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গোপন তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে, ১৮ই ডিসেম্বরে একদল সাংবাদিক ঢাকার পশ্চিমে, রায়ের বাজার এলাকায় পচনশীল, ক্ষত-বিক্ষত লাশের একটি গণ-কবরের সন্ধান লাভ করে। জাতির মেধাবী ব্যক্তিবর্গের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, একে-অন্যের নীচে চাপা পড়ে ছিল । লালমাটিয়ায় শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাংবাদিকরা একটি বন্দীশালা আবিস্কার করে, যা ছিল রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং কামালউদ্দিন, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলিম চৌধুরী, আবুল খায়ের এবং সাংবাদিক মুহাম্মদ আখতার – পচনশীল লাশগুলো পরিবার কর্তৃক সনাক্ত করা হয় সেদিনই । সাংবাদিক সেলিনা পারভিন এর লাশ সনাক্ত করা হয় পরের দিন। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, ফাইজুল মহি এবং চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর ও মনসুর আলী’র লাশ পরবর্তীতে চিহ্নিত করা হয়। লাশ সনাক্তকরণের সময় শহীদ বুদ্ধিজীবিদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছিলেন।
এরকম আরো বধ্যভূমি ছিল মিরপুর এবং রায়ের বাজার এলাকায়, তেঁজগাঁও এর কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টি.বি. হাসপাতাল সহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। অনেক লাশই পরবর্তীতে সনাক্তকরণের পর্যায়ে ছিলনা । এসময় সংবাদপত্রগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবিদের (নভেম্বরের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অপহরণ অথবা গেফতারকৃত) নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছিল।
পাক-বাহিনী এদেশের তরুণ ছেলে-মেয়েদেরকে হত্যা করা শুরু করেছিল সেই ২৫শে মার্চের সময় থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য এবং অনেক প্রফেসরদের হত্যা করা হয় । মূলত যুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়েই চলে বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ড। এমনকি পাক-বাহিনীর দোসরদের (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় ১৯৭২ এর জানুয়ারীতেও।
চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তার অপহরণকৃত ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারকে (পাক-বাহিনীরা তাকেও হত্যা করেছিল বলে ধারনা করা হয়) খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। তাকে শেষ দেখা যায় মিরপুরে বিহারী ও পাক-বাহিনীর দোসরদের ক্যাম্পে। পরবর্তীতে তার সম্পর্কে আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ডা: মনসুর আলীকে ২১শে ডিসেম্বর এবং সাংবাদিক গোলাম রহমানকে ১১ই জানুয়ারী হত্যা করা হয়।
মফিজউদ্দিনের (লাশ বহনকারী বাহনের চালক) স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আশরাফুজ্জামান খান, ইসলামি ছাত্র সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য এবং পাকিস্তান রেডিও’র সাবেক কর্মী, নিজ হাতে সাত জন শিক্ষককে গুলি করেন। মফিজউদ্দনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এমন দূর্ভাগ্যজনক ভাবে মৃত্যুবরণকারী শিক্ষকদের লাশ উদ্ধার করা হয় রায়ের বাজার বধ্যভূমি এবং মিরপুরের শিয়াল বাড়ির গণ কবর থেকে। তার ডায়েরিতে ২০ জন শিক্ষক সহ আরো অনেক বাঙালির তালিকা ছিল। তার ডায়েরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষকের নাম ছিল যারা পাক-বাহিনীকে সহযোগীতা করেছিল।
বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনায় পাক-বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাসেম এবং ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ছিল মূল হোতা । নভেম্বর মাসের কোন এক সময় তারা মওলানা আব্দুল মান্নানের বাসগৃহে মাদ্রাসা শিক্ষক সংঘের প্রেসিডেন্ট সহকারে বৈঠক করে। এই আলোচনাতেই সম্ভবত বুদ্ধিজীবিদের হত্যার মূল পরিকল্পনা করা হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ
* এ.এন.এম. মুনির চৌধুরী
* ডা: জি.সি. দেব
* মুফাজ্জাল হায়দার চৌধুরী
* আনোয়ার পাশা
* জোতীর্ময় গুহ ঠাকুর
* আব্দুল মুক্তাদীর
* এস.এম. রাশিদুল হাসান
* ডা: এ.এন.এম ফাইজুল মাহি
* ফজলুর রহমান খান
* এ.এন.এম মনিরুজ্জামান
* ডা: সেরাজুল হক খান
* ডা: শাহাদাত আলী
* ডা: এম.এ. খায়ের
* এ.আর. খান কাদিম
* মোহাম্মদ সাদিক
* শারাফত আলী
* গিয়াসউদ্দিন আহমেদ
* আনন্দ পবন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ
* প্রফেসর কাইয়ূম
* হাবিবুর রহমান
* শ্রী সুখ রঞ্জন সমদ্দার এম.সি.এ
* মশিউর রহমান
* আমজাদ হোসেন
* আমিনুদ্দিন
* নাজমুল হক সরকার
* আব্দুল হক
* সৈয়দ আনোয়ার আলী
* এ.কে. সর্দার
সাংবাদিক
* সিরাজুদ্দিন হোসেন
* শহীদুল্লাহ কায়সার
* খন্দকার আবু তালেব
* নিজামুদ্দিন আহমেদ
* এ.এন.এম. গোলাম মোস্তফা
* শহীদ সাবের
* সরকার আব্দুল মান্নান (লাদু)
* নাজমুল হক
* এম. আখতার
* আব্দুল বাশার
* চিশতী হেলালুর রহমান
* শিবসাধন চক্রবর্তী
* সেলিনা আখতার
চিকিৎসক
* মো: ফজলে রাব্বী
* আব্দুল আলীম চৌধুরী
* সামসুদ্দিন আহমেদ
* আজহারুল কবীর
* সোলায়মান খান
* কায়সার উদ্দিন
* মনসুর আলী
* গোলাম মর্তোজা
* হাফেজ উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
* আব্দুল জব্বার
* এস.কে. লাল
* হেম চন্দ্র বসাক
* কাজী ওবায়দুল হক
* আল-হাজ্ব মমতাজউদ্দিন
* ঘাশিময় হাযরা
* নড়েন ঘোষ
* জিকরুল হক
* শামসুল হক
* এম. ওহমান
* এ. গফুর
* মনসুর আলী
* এস.কে সেন
* মফিজউদ্দিন
* আমূল কুমার চক্রবর্তী
* আতিকুর রহমান
* গোলাম সারওয়ার
* এর.সি. দাস
* মিহির কুমার সেন
* সালেহ আহমেদ
* অনীল কুমার সিনহা
* গুনীল চন্দ্র শর্মা
* এ.কে.এম. গোলাম মোস্তফা
* মাকবুল আহমেদ
* এনামুল হক
* এনসুর (কানু)
* আশরাফ আলী তালুকদার
* লেফ: জিয়াউর রহমান
* লেফ.ক. জাহাঙ্গীর
* বাদল আলম
* লেফ: ক. হাই
* মেজর রেজাউর রহমান
* মেজর নাজমুল ইসলাম
* আসাদুল হক
* নাজির উদ্দিন
* লেফ: নুরুল ইসলাম
* কাজল ভাদ্র
* মনসুর উদ্দিন
শিক্ষাবিদ
* জহির রায়হান
* পূর্নেন্দু দস্তিদর
* ফেরদৌস দৌলা
* ইন্দু সাহা
* মেহেরুন্নিসা
শিল্পী ও পেশাজীবি
* আলতাফ মাহমুদ
* দানবীর রানাদা প্রসাদ সাহা
* জোগেষ চন্দ্র ঘোষ
* ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত
* সামসুজ্জামান
* মাহবুব আহমেদ
* খুরশিদ আলম
* নজরুল ইসলাম
* মাহফুজুল হক চৌধুরী
* মহসিন আলী
* মুজিবুল হক
তথ্যসূত্র:
১. জেনোসাইড বাংলাদেশ
২. বিদ্রোহী
আনসারুল্লাহর হিটলিস্টে ৮৪ জন ব্লগার, বেঁচে থাকা ব্লগারগণ ওনারা আদৌ নিরাপদে আছে কি?
গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নতুন কৌশলে মাথা চাড়া দিয়েছে। এই উগ্রপন্থী সংগঠনের সদস্যরা ধর্ম অবমাননাকারী ব্লগারদের তালিকা হাতে নিয়ে তাদের হিটলিস্টে রেখেছে। এরা রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে নাশকতার চেষ্টা বা নাশকতা করে থাকে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকা সেই ৮৪ ব্লগারের মধ্যে কয়েকজন এবিটির হত্যা তালিকার অন্যতম। এর মধ্যে অভিজিৎ তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। তালিকায় থাকা ৮৪ ব্লগার হচ্ছে- আরিফুর রহমান, মনির হাসান, বৃত্তবন্ধি, সবাক, শয়তান, মনজুরুল হক, কখগ, রাসেল, নাস্তিকের ধর্মকতা, দূরের পাখি, আরিফুল হক তুইন, তিতি আনা, নাজিম উদ্দিন, আলমগীর কুমকুম, ফরহাদ উদদিন স্বপন, দুস্যবনহুর, ফারহানা আহমেদ, ঘনাদা, রাহান, অন্যকেউ, পাপী ০০৭, হোরাস, প্রশ্নোত্তর, ভালমানুষ, ভন্ডপীর, বৈকুণ্ঠ, সত্যান্বেষী, পড়ুয়া, হাল্ক (সানাউল), বিপ্লব ০০৭, রাস্তার ছেলে, ঘাতক, বিশাল বিডি, সাহোশি ৬, লাইট হাউজ, মমতা জাহান, রাতমজুর, কৌশিক, মেঘদূত, স্বপ্নকথক, প্রায়পাস, আহমেদ মোস্তফা কামাল, লুকার, নুহান, সোজাকথা, ট্রানজিস্টার, দিওয়ান, রিসাত, আমি এবং আধার, অরন্যদেব, কেল্টুদা, আমি রোধের ছেলে, ভিন্নচিন্তা, আউটসাইডার, প্রণব আচার্যা, আসিফ মহিউদ্দিন, আবুল কাশেম, আলমগীর হোসেন, অন্যআজাদ, অনন্ত বিজয় দাস, আশীষ চ্যাটানজি, অভিজিত রায়, বিপ্লব কান্তি দে, দাঁড়িপাল্লা ধমা ধম (নিতাই ভট্টাচার্য), ইব্রাহীম খলিল সবাগ, (সুমন সওদাগর) কৈশীক, আহমেদ, নুরনবী দুলাল, পারভেজ আলম, রাজিব হায়দার শোভন (থাবাবাবা), রতন (সন্যাসী), সৈকত চৌধুরী, শর্মী আমিন, সৌমিত্র মজুমদার (সৌম্য), আল্লামা শয়তান (বিপ্লব), শুভজিদ ভৌমিক, সুমিত চৌধুরী, সৈকত বড়ুয়া, সুব্রত শুভ ও সুসান্ত দাস গুপ্ত, সৈয়দ কামরান মির্জা, তাহসিন, তন্ময় এবং তালুকদার ও জোবায়েন সন্ধি। - See more at: Click This Link
১৯ ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দিয়ে গণমাধ্যমে চিঠি, স্বাধীন দেশে ওরা এই সাহস পায় কোথা থেকে?
http://www.deshebideshe.com/news/details/54994
‘নাস্তিক’ অপবাদের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর স্পষ্ট বক্তব্য:
১৯৭০-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে যখন আওয়ামী বিরোধীরা এই দলকে ‘ইসলাম বিরোধী ‘নাস্তিক’ বলে প্রচার করে তখন বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে তাঁর নির্বাচনী ভাষণে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে বলেন :
“আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা নাকি ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হল,
আমরা লেবেল সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রসূল করীম (সা.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বরাবর যারা অন্যায়, অত্যাচার শোষণ বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদের বিরুদ্ধে।”
মুসলিম রাষ্ট্রে হত্যার নৃশংসতা একই প্রকৃতির রহস্য কোথায়!
মুহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন ইবনে মঈন চৌধুরী
এখন সত্য বলার মধ্যে আইনী বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশ্ব জুড়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকার যেখানে নাই (!) সেখানেই জঙ্গী বা সন্ত্রাসীদের উত্থান আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানেই রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত সেবকদের মধ্যে যারা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার সাহায্য করতে পারে তাদের পিছনে জনগণের কষ্টার্জিত সম্পদ ব্যয় করা হয়। আর এই অনির্বাচিত শাসক চক্রকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিতে থাকে পশ্চিমা বিশ্ব, হিন্দুস্থান, রাশিয়াসহ মুসলিম জাতী বিদ্বেষী গোষ্ঠী। এক পক্ষ সন্ত্রাসী সৃষ্টি করছেঅস্ত্র বিক্রী ও সরবরাহ করছে অপর পক্ষ নির্বিচারে নিরীহ মানুষের উপর হামলা চালাচ্ছে । আর পানি ঘোলা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কূর্দী তথা শিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালানোর মধ্যেদিয়ে। বাংলাদেশে ৪০০শত বসৎর এর ঐতিজ্য ভেঙ্গে হোসনী দালানী বোমা হামলা করা হয়েছে। বিশেষ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো গুলোতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। (সংক্ষিপ্ত)
প্রবীন শিক্ষাবিদ ড.আবুল কাশেম ফজলুল হক দুঃখ কষ্ট বুকে চাপা রেখে বলেন রাজনৈতিক সমাধানের কথাটাই সঠিক। দেশের মানুষ কে তাদের রাজনৈতিক, নাগরিক ভোটের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করলে ক্ষমতালোভীর খূন্যতম চক্রান্ত করতে সাহস পাবে না। আর বিদেশীরা ও মোড়লি পনার নামে আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্রের সমর্থন হারাবে। দেশে সামরাজ্যবাদও আধিপত্যবাদ বিস্তারের চক্রান্ত চলছে তখনই স্পষ্ট হয় যুক্তরাষ্ট্র যখন সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে সহযোগীতা কথা বলে। এ থেকে বাংলাদেশের জনগনের কাছে পরিস্কার হতে শুরু করেছে অনন্য মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকদের মত ভাগ্য বরনের চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। (সংক্ষিপ্ত)
- See more at: Click This Link
জাতিকে ভবিষ্যৎ মেধাশুণ্যতার হাত থেকে বাঁচান:
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের নিকট আমার আকূল আবেদন, জাতিকে এই ভয়াবহ সর্বনাশা থেকে রক্ষা কল্পে, বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসাবে, বিষয়টি একটু বিশেষভাবে বিবেচনা ক’রে দেখবেন এবং যথাশীঘ্র এর সমাধানের ব্যাবস্থা নিবেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখহাসিনার দীর্ঘায়ূ এবং বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের মঙ্গল কামনা করছি।
-ইজাজ আহমেদ।
সীতারামপুর, কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।
- See more at: Click This Link
একাত্তরে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড
পুরো একাত্তর জুড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালী জাতিকে মেধাশূণ্য করার জন্য বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। এই অপকর্মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সরাসরি সাহায্য করে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী।
পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালী-বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আল-শামস, আল-বদর, রাজাকারদের মাধ্যমে বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের তথা, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবি, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাংবাদিকদের তালিকা প্রস্তুত করে।
এরপর, শুধুই ইতিহাসের কালো একটি অধ্যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে আরেকটি নির্মম পরিকল্পিত গনহত্যা; একটি জাতি মেধাশূণ্য করার অপচেষ্টা।
বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের উপর চুড়ান্ত আঘাত আনা হয় ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ রাজাকার-আল বদর-আল শামস বাহিনীর পূর্ণ সহযোগীতায় পনেরোশ’র অধিক বুদ্ধিজীবিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে।
স্বাধীনতার পর ঢাকার মিরপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ, মুহাম্মাদপুর, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, লালখান বাজার, স্টেশন-কলোনী, গুডস হিলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হাত-পা-চোখ বাঁধা অবস্থায় বুদ্ধিজীবিদের পঁচিত-বিকৃত মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতদেহগুলোতে ছিল অকল্পনীয় নির্যাতনের চিহ্ন। অনেক বুদ্ধিজীবির মৃতদেহ খুঁজেও পাওয়া যায়নি।
বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বঙ্গভবন থেকে রাও ফরমান আলীর একটি ডায়রী পাওয়া যায়; যাতে নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবিদের তালিকা ছিল। এই ডায়রীতেই স্পষ্ট উল্লেখ আছে, আল-বদর তথা, জামাত ও ছাত্র-সংঘ বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের তালিকা তৈরী, হত্যার উদ্দেশ্যে ধরে আনা ও হত্যাকান্ডে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে।
রাও ফরমান আলীর ডায়রী থেকে জানা যায়, সিআইএ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড সম্পর্কে জানত। কারণ, ডায়রীতে হেইট ও ডুসপিক নামে দুজন আমেরিকার গোয়েন্দার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার ইঙ্গিত আছে।
পাকিস্তানীরা কতটা অসভ্য-বর্বর জাতি এবং এদেশের পাকি-দালালরা কতটা নিমক হারাম, তা ‘বুদ্ধিজীবি নিধন তদন্ত কমিশন’ কর্তৃক প্রকাশিত কিছু তথ্য দেখলে আরো স্পষ্ট হয়। ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’ তাদের রিপোর্টে বলছে, পাকিস্তানী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী শুধু ডিসেম্বরে বিশ হাজার বাঙালী বুদ্ধিজীবিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। বুদ্ধিজীবিদের তালিকা প্রস্তুতের জন্য রাজাকার-আল বদর-আল শামসকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। বাঙালী এইসব বিশ্বাসঘাতক নরপশুদের নেতৃত্বে ছিল চৌধুরী মইনুদ্দিন (জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য), আশরাফুজ্জামান (ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য/ বর্তমান ছাত্রশিবির)।
চৌধুরী মঈনুদ্দীন শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা প্রস্তুত করে ও তাঁদের বাসার ঠিকানা খুঁজে বের করে এবং মূল এক্সিকিউশান প্ল্যান করে। বুদ্ধিজীবিদের নাম-ঠিকানা পাকিস্তানীর কাছে তথা, রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে সরবরাহ করেছিল এই চৌধুরী মঈনুদ্দীন।
আশরাফুজ্জামান ছিল মূল এক্সিকিউশান কর্মকর্তা। তার নাখালপাড়ার বাড়ি একটি ডায়রী উদ্ধার করা হয়, যাতে বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল এবং এই বুদ্ধিজীবিরা সবাই শহীদ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালে আশরাফুজ্জামানের গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিন বলেন, রায়ের বাজার ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধজীবিকে আশরাফুজ্জামান নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল।
চট্টগ্রামে বুদ্ধিজীবিদের প্রধান হত্যাকারী ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী।
১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ‘দৈনিক আজাদে’ একটি রিপোর্টে বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী মনে করত, বাঙালী বুদ্ধিজীবি ও শিক্ষিত সমাজই একাত্তরের যুদ্ধের জন্য দায়ী। তাই, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা বানাতে জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘকে (বর্তমানে শিবির) দায়িত্ব দেয়। পাকিস্তানের এসব বাঙালী দালালরা রাজাকার-আল শামস-আল বদর বাহিনী পরিচয়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। এই তালিকা অনুসারে সারা একাত্তর জুড়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা শুরু করে। দেশ স্বাধীন হতে আর একটি সপ্তাহ দেরী হলে, ওরা বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের সবাইকে মেরে ফেলতো।
ত্রিশ লক্ষ শহীদের মাঝে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কতজন, তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। ব্যাপক গণহত্যা ও দেশান্তরী হওয়া বিধ্বস্ত-বিচ্ছিন্ন জনপদে এবং চরমভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে সে সময় জরিপ চালানো সম্ভব হয়নি।
১৯৯৪ সালে ‘বাংলা একাডেমী’ থেকে প্রকাশিত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ নামে শহীদ বুদ্ধিজীবিদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশিত হয়; যাতে, ২৩২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবির বর্ণনা আছে।
১৯৭২ সালে নিউজ উইকের সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন তার একটি কলামে শুধু ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবির সংখ্যা এক হাজার সত্তর জন বলে জানান।
বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবি ৪২ জন, সাংবাদিক ১৩ জন ও অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) ১৬ জন।
তবে, প্রকৃতপক্ষে শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যা অনেক বেশি। থানাভিত্তিক জরিপ অনুসারে শিক্ষক, প্রকোশৌলী, চিকিৎসক, আইনজীবি, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক মিলিয়ে মোট শহীদ বুদ্ধিজীবি সংখ্যা এক লক্ষ হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলছে।
০৩ নভেম্বরে, ২০১৩; চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসির রায় হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা এই যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করা।
চট্টগ্রামের ঘাতক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় হয়েছে।
কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০ টা ০১ মিনিটে কার্যকর করা হয়েছে। আবদুল কাদের মোল্লা ফাঁসির রায় কার্যকর করা একাত্তরের প্রথম যুদ্ধাপরাধী গতকাল ছিল ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩ সাল।
শহীদ বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের ৪২ তম দিবস।পরম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে বাঙলার সকল শহীদদের স্মরণ করছি।
জয় বাঙলা…
- সাব্বির হোসাইন
তথ্যসূত্র:
* শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা (১৯৭২), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, সম্পাদনায়: সৈয়দ আলী আহসান।
* শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী।
* বাংলাপিডিয়া।
এরা নির্ভুলভাবে গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে হত্যা করেছিল আজো করছে।
১৯৭১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর “দৈনিক আজাদ”-এর একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল এরকম:
“আর একটা সপ্তাহ গেলেই ওরা বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের সবাইকেই মেরে ফেলত- আল বদর বাহিনীর মাস্টার প্ল্যান”
সেই আল বদর, যাদের জন্মই হয়েছিল সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক হত্যার মাধ্যমে মুক্তকামী বাঙালিদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য। সেই বদর বাহিনী, যারা আজও আমার প্রিয় দেশকে কলঙ্কিত করে চলেছে, যাদের আস্ফালনে আজ আমি নিজের বাঙালি পরিচয় নিয়ে গর্ব করতে পারি না। সেই আল বদরের কথা বলতে আসার আগে অনেক ভেবেছি। “আল-বদর” শব্দ দুটি লিখতে গিয়ে বারবার ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠেছি, বারবার হাত আটকে গেছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, এই ঘৃণা নিয়ে দূরে সরে থাকার কারণেই আজ তারা বাংলার বুকে বসতবাড়ি গড়ে তুলতে পেরেছে, তখন আর হাত আটকালো না। লিখে যেতে থাকলাম, তাদের সে ভিটেমাটি ভেঙে ফেলার স্বপ্ন নিয়ে। মনকে প্রবোধ দিলাম, আল-বদর, রাজাকার, আল-শাম্স সহ পাকিস্তানী হানাদারদের সব দোসরের পদচারণায় কলঙ্কিত স্বদেশকে পবিত্র করতেই আমি কলম ধরেছি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পুনর্জন্ম হবে। তারা যখন স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রাখবে তখন যেন সে মাটি পবিত্র থাকে। কোন অপবিত্র মাটিকে আমি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পা স্পর্শ করতে দেব না।
তাই লিখছি-
১৯৭১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর দৈনিক আজাদের একটা সংবাদ শিরোনাম দিয়েই আমার লেখা শুরু করেছি। এই শিরোনামের লেখাতেই আল-বদরদের পরিচয় ফুটে উঠেছে।সেখানে লেখা হয়েছিল: পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সাহায্যকারী দলগুলির মধ্যে জামাতে ইসলামীর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্য। মওদুদী-গোলাম আযম-আবদুর রহীমের নেতৃত্বে পরিচালিত জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুধু ঘোর বিরোধিতাই করেনি- লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে পাইকারীভাবে হত্যা করার কাজে সক্রিয় সহযোগিতাও করেছে।
আমি জানি, পাকিস্তানের দোসরদের মধ্যে জামাতে ইসলামী ছাড়াও অনেকে ছিল। কিন্তু এদের দাপটই আজ সবচেয়ে বেশী। এখান থেকেই তাই আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার সূচনা। আমার জন্ম হয়েছে এক জামাতপন্থী পরিবারে। আমি যখন নিজের বাবাকে জামাতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেছি তখন তিনি বলেছেন, “জামাত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিল। এজন্য তারা কেবল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়নি। কিন্তু তাদের হাতে কোন নিরীহ বাঙালি নিহত হয়নি, অর্থাৎ তারা কোন অনৈতিক ও মানবতাবিরোধী কাজ করেনি।” ছোট বেলায় আমি এই ব্যাখ্যাই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু বড় হয়ে যখন নিজে সবকিছু পড়তে লাগলাম তখনই আমার চোখ খুলে গেল। আমার সামনে জামাতসহ সব স্বাধীনতাবিরোধীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেল। আমি তাদের পলিসি বুঝতে পারলাম। আমি তাদের পলিসির ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তে এসেছি তা হল:
একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা শুরু থেকেই খুব সুবিধাবাদী ছিল। প্রথমে তারা নিছক সেফ সাইডে থাকার জন্য পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে। কিন্তু যখন তাদের শীর্ষ নেতারা শান্তি কমিটি গঠন করলো, দেশে রাজাকার-আল বদর-আল শাম্স গঠিত হল তখন তারা এক মধ্যযুগীয় পৈশাচিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলো। একাত্তরের জামাতপন্থী পত্রিকা (দৈনিক সংগ্রাম) পড়লেই তা বোঝা যায়। তাদের নষ্ট চেতনায় একীভূত পাকিস্তানের ভূত চেপে বসলো। দেশের ভেতরে থাকায় তারা জানতো, কোন গুটি চাললে কি ফলাফল হবে। সুতরাং এটা ধারণা করে নিতে কোন কষ্টই হয় না যে, ২৫শে মার্চ থেকেই দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের ধরিয়ে দেয়ার কাজটা তারাই করেছে। এই কাজটা একেবারে পরিকল্পিত ছিল। প্রথম দিকে তাদের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধে জয়ী হওয়া। কিন্তু ১৪ই ডিসেম্বর ও তারপরের নিধনযজ্ঞের উদ্দেশ্যটা অন্যরকম। এই সময় তারা অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেছে। এ সময় তাদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের ক্ষেত্র রচনা করা। ব্যাপারটা এরকম-
তারা জানতো বিশ্বাসঘাতকদের পাকিস্তান সরকার নেবে না। সুতরাং তাদের বাংলাদেশেই থাকতে হবে। কিন্তু এদেশে আগের প্রতিপত্তি নিয়ে থাকতে হলে তো রাস্তা পরিষ্কার হবে। এই রাস্তা পরিষ্কারের সর্বোত্তম পন্থা ছিল দেশের বিবেকগুলোকে সরিয়ে দেয়া। এই ভেবেই তারা বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছে। আর পাকিস্তান সরকারের এতে সাহায্য না করার কোন কারণই ছিল না। ১৯৪৭ থেকে পাকিস্তান সরকার যা করে এসেছে তা বিবেচনায় রেখে বলাই যায়, সেদেশের সরকারের মানবতা বলতে কিছু ছিল না। তারা শুরু থেকেই বাংলাদেশের ব্যাপারে সহিংস নীতি অবলম্বন করে এসেছে। তাই যাওয়ার আগে দেশটাকে পঙ্গু করে দেয়ার লোভ সামলানোর প্রশ্নই উঠেনা।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীর যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার সাথে একমাত্র হিটলারের সহিংসতারই তুলনা চলে। এর জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী অবশ্যই পাক-বাহিনীর এদেশীয় দোসরেরা। কিন্তু পাকিস্তান সরকারেরও একটা পূর্বপরিকল্পনা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর “বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি” গঠিত হয়। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা। সুযোগের অভাবে তিনি এটা করতে পারেননি। সেই আফসোসটাই মেটালেন আল-বদরের মাস্টার প্ল্যানে রসদ জুগিয়ে। দুয়ে মিলে পরিকল্পনাটা একেবারে কনক্রিট ছিল।, আরেকটু সময়ে পেলে তারা কাউকেই ছাড়তো না। বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান বলেছিলেন,
এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত গেনেছে।
এই ছিল পরিকল্পনা। ২৫শে মার্চ থেকেই শিক্ষিত সমাজের উপর আক্রমণের সূচনা ঘটে। ২৫শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সবচেয়ে পরিকল্পিত হামলাটি চালানো হয়। প্রাথমিক টার্গেট ছিল হিন্দু শিক্ষক-ছাত্র এবং আওয়ামী পন্থীরা। এদিনই (২৬শে মার্চ) নৃশংসতার শিকার হন দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব।
এরপর গণহত্যার অংশ হিসেবে বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক নিধন চলেছে। সেটা পাকিস্তান সরকারের স্বাভাবিক যুদ্ধ পরিকল্পনারই অংশ ছিল। কিন্তু ডিসেম্বরে যৌথ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। নিজেদের রাস্তা পরিষ্কারের জন্য এদেশীয় দোসরেরা সোচ্চার হয়ে উঠে। ১১ই ডিসেম্বর থেকে আল-বদর বাহিনী ব্যাপকভাবে বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করে। আজ জামাত বলে এ নিধনযজ্ঞে তাদের কোন অংশগ্রহণ ছিল না, পরবর্তীতে এগুলোর সাথে তাদের নাম লাগানো হয়েছে। কিন্তু সে সময়ের পত্রিকাগুলো ভিন্ন কথা বলে। বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের অনেককেই যে “ইসলামী ছাত্র সংঘ”-এর পুরানা পল্টন (১৫ পুরানা পল্টন) অফিসে এবং জামাতের মোহাম্মদপুর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেকথা আমরা ডিসেম্বরের পত্রিকা থেকেই জানতে পারি।
বুদ্ধিজীবী হত্যার ক্ষত কোনদিন শুকোবে না। কারণ, তারা থাকলে আজ আমার দেশের এ অবস্থা থাকতো না। ঢাকার মানুষ সেই দিনের কথা কোনদিনই ভুলতে পারবে না। কারণ তারা সচক্ষে রায়েরবাজারের বধ্যভূমি দেখেছে। নিজ দেশের সেরা সন্তানদের ছিন্নভিন্ন দেহগুলো দেখে তাদের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেটা বোধকরি কেউ বলতে পারবে না। বধ্যভূমিতে গিয়ে কেউ কথা বলার ভাষা খুঁজে পায়নি। ব্রিটিশ সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন বাঙালিদের বধ্যভূমি পরিদর্শন নিয়ে লিখেছিলেন। তার লেখার শিরোনাম ছিল, “বাংলার বুদ্ধিজীবীরা এক খাদে মরে পড়ে আছেন।” এই শিরোনামে তিনি লিখেছিলেন:
বাঙালি জনতা এই ডোবাগুলোতে এক অদ্ভুত শান্ত ভঙ্গিমায় চলাচল করছে। এখানে তাদেরকে ক্রোধান্বিত মনে হয় না। অন্যত্র তারা ক্রোধান্মত্ত। কিন্তু এখানে তারা হাঁটছে, মৃদু ফিসফিস করে কথা বলছে; তারা যেন গীর্জা পরিদর্শনরত পর্যটক।
বধ্যভূমিই কি আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছিল? আমরা কেন আগেই আল-বদর নিধনে সোচ্চার হলাম না? “বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি” কেন কাজ করতে পারল না? তাদের পূর্ণ রিপোর্ট কেন প্রকাশিত হল না? আজ ৩৭ বছর পরেও কের বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হল না? তার মানে কি ধরে নেব, আল-বদরদের পরিকল্পনা সফল হয়েছিল? আমরা কি হেরে গেছি? এই প্রশ্নগুলোর কোন সদুত্তর আমার জানা নেই। আমার মাথায় ঢোকে না, বধ্যভূমির প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ পড়েও কিভাবে আমরা নিশ্চল হয়ে বসে আছি। রায়েরবাজারে “কাটাসুরের বধ্যভূমি” সম্পর্কে অধ্যাপিকা হামিদা রহমান লিখেছেন,
আর একটু যেতেই দেখতে পেলাম, একটি কঙ্কাল, শুধু পা দুটো আর বুকের পাঁজরটিতে তখনও অল্প মাংস আছে। বোধহয় চিল শকুন খেয়ে গেছে। কিন্তু মাথার খুলিটিতে লম্বা লম্বা চুল। চুলগুলো ধুলো কাঁদায় মিলে যেয়ে নারীদেহের সাক্ষ্য বহন করছে।… আরেকটু এগিয়ে যেতেই একটা উঁচু স্থানে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছে। আমি উপরে উঠতেই একজন ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে আমাকে উপরে উঠিয়ে নিলেন। সামনে চেয়ে দেখি নিচু জলাভূমির ভেতর এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য। সেখানে একজন নয়, দুই নয়, একেবারে বারো তেরজন সুস্থ সবল মানুষ। একের পর এক শুয়ে আছে। পাশে দুটো লাশ। তার একটির হৃৎপিণ্ড কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপিণ্ড ছেঁড়া মানুষটি হল ডাঃ রাব্বী।… মাঠের পর মাঠ চলে গিয়েছে প্রতিটি জলার পাশে পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যে মৃত কঙ্কাল সাক্ষ্য দিচ্ছে কত লোককে যে এই মাঠে হত্যা করা হয়েছে।
এই বীভৎসার বর্ণনা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। দেশের অন্যতম সেরা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফজলে রাব্বীর হৃৎপিণ্ডটিই কেন ছিঁড়ে নেয়া হল? তিনি হৃৎপিণ্ড সারানোর কাজ করতেন বলেই কি? হয়তো বা। ওহ্, আবারও সেই বীভৎসতার বিবরণ দিতে শুরু করেছি। শুরু করলে তো আর শেষ হয় না। বিবরণ যত পড়ি, মনের মধ্যে ততই প্রশ্ন জাগতে থাকে। কোন প্রশ্নেরই উত্তর পাই না।
ভুল বলা হল, আসলে আমি এখন সবগুলো প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। উত্তর পেয়ে গেছি আল-বদরের চিঠি পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যত বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে তাদের সবাই এই চিঠি পেয়েছিলেন। তারা চিঠি পেয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। আমিও সেই চিঠি পড়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েছি; শপথ করেছি, জীবন দিয়ে হলেও একাত্তরে শহীদ সব বুদ্ধিজীবীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবো। নরপিশাচদের বিচার করবো, জনতার মঞ্চে। তাই আর প্রশ্নের উত্তর খুঁজি না। সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি বলেই বোধহয়। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মৃত্যু পরোয়ানা পড়ার পর, আমার বিশ্বাস, যে কেউ তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। আর যখন শুনবেন, এই মৃত্যু পরোয়ানা দিয়েছে আল-বদরের মত কীটেরা তখন নিজের জীবনটাও বাজি রাখার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবেন:
শয়তান নির্মূল অভিযান
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের যেসব পাচাটা কুকুর আর ভারতীয় ইন্দিরাবাদের দালাল নানা ছুতানাতায় মুসলমানদের বৃহত্তম আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তুমি তাদের অন্যতম। তোমার মনোভাব, চালচলন ও কাজকর্ম কোনটাই আমাদের অজানা নেই। অবিলম্বে হুশিয়ার হও এবং ভারতের পদলেহন থেকে বিরত হও, নাহয় তোমার নিস্তার নেই। এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।
– শনি
পাঠক, এই চিঠি যারা পড়েছেন তাদের সবাইকে বলছি: আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আসুন প্রতিজ্ঞা করি, স্বদেশের মাটিকে আবার পবিত্র করে তুলবো, আল-বদরদের আর এই মাটিতে সদর্প ঘুরে বেড়াতে দেব না। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আজ মাটির অনেক নিচে। কিন্তু তারা সেখানে থাকবেন না, এদেশের মাটিতে তাদের পুনর্জন্ম হবে, যদি আমরা দেশকে পাকী দালালদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারি। তারা আবার আসবেনই, কোন সন্দেহ নেই। কারণ মুনীর চৌধুরী প্রতিজ্ঞা করে গেছেন,
বৃষ্টিতে ভেঁজা নরম ঘাসের উপর দিয়ে আমি আরও হাঁটব। ঠাণ্ডা রূপোর মত পানি চিড়ে হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটব। আমি বার বার আসব। তুমি যদি আমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়, দরজায় এসে টোকা দেব। চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে তোমায় ইশারা করব। (-কবর)
১৪ই ডিসেম্বরের এই দিনে হে মহামানবেরা, তোমাদের স্মরণ করছি। তোমরা আবার আস। সত্যি বলছি, আমরা তোমাদের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তোমরা এসে দরজায় টোকা দিয়েছ, আমাদের ঘুম ভেঙেছে। এবার তোমাদের হাতছানি দেয়ার পালা। সেই হাতছানিতে সাড়া দিতে আমরা প্রস্তুত…
*****
বাংলা একাডেমী “শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ” নামে একটি বই বের করেছে। এই বইয়ে ২৩২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিস্তারিত পরিচয় সন্নিবেশিত আছে। এছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা এখানে পাওয়া যেতে পারে:
বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার
বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ বক্তৃতা দেন মুজাহিদ
-কুন্তল রায়
আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ঢাকার আরেক প্রান্তে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ আলবদরদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তিনি বদর বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁর রায়ে এসব তথ্য দিয়েছেন। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল গত বুধবার মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ে বলা হয়, একাত্তরে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজ (তৎকালীন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) ছিল আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়। একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় বইটি উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরের ১৭ সেপ্টেম্বর রাজাকার বাহিনীর প্রধান ও শান্তি কমিটির লিয়াজোঁ কর্মকর্তাকে নিয়ে জামায়াতের আমির গোলাম আযম মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে যে রাজাকার ও আলবদর শিবির পরিদর্শন করেছিলেন, সেটিই ছিল আলবদরদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগকে আলবদররা প্রথমে চোখ বেঁধে এখানে নিয়ে আসে। নির্যাতনের পর এখান থেকে তাঁদের রায়েরবাজারে ও মিরপুরের শিয়ালবাড়িসহ অন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। মুজাহিদের বিরুদ্ধে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের জামায়াত নেতা সেলিম মনসুর খালেদের লেখা আল-বদর নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। উর্দু ভাষায় লিখিত ওই বইয়ের ১৭৬-১৭৮ পৃষ্ঠায় সেলিম মনসুর লেখেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্র সংঘের নাজিম (অর্থাৎ সভাপতি) নির্যাতনকেন্দ্র বলে পরিচিত মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত আলবদরের সদর দপ্তরে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে ‘আখেরি খিতাব’ (শেষ বক্তৃতা) দেন। বক্তব্যে তিনি দিনটিকে (বাংলাদেশের বিজয় দিবস) ‘বেদনাদায়ক দিন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণকে বলে ‘ট্র্যাজেডি’। সেদিন মুজাহিদ আরও বলেন, ‘আমরা বিগত দিনগুলোর জন্য লজ্জিত নই। আর সামনের দিনগুলোর জন্য নিরাশও নই।’ শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘বন্ধুরা! আমি বাধ্য হয়ে আদেশ দিচ্ছি, আপনারা হিজরতে বের হয়ে যান।’ এরপর আলবদর সদস্যরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান।
রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী। একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম, টিভি ও রেডিওর প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধ শেষে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের কয়েকটি কক্ষে গিয়ে রক্তের স্রোতধারা দেখতে পান। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্রগুলো। এতে প্রমাণিত হয়, ওই কলেজটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি হত্যাপুরী, আর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আসামি মুজাহিদ সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পুণ্য রক্ত মাড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদরের সদর দপ্তর ও নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে আরও অনেক তথ্য তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনাল। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী ও শারীরিক শিক্ষা কলেজের নিরাপত্তাকর্মী রুস্তম আলী মোল্লা একাত্তরে ওই কলেজ-সংলগ্ন আবাসিক এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। স্বাভাবিকভাবে ওই স্থানে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। তিনি ওই নির্যাতন ক্যাম্পে জামায়াত ও ছাত্র সংঘের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মুজাহিদকে দেখেছেন। এ জন্য তিনি এ বিষয়ে একজন উপযুক্ত সাক্ষী। রুস্তম আলীর দেওয়া সাক্ষ্য উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয়, বিজয়ের সাত-আট দিন আগে আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা ওই ক্যাম্পে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কলেজের পেছনে একটি ইটভাটায় শতাধিক চোখ স্তূপ করা অবস্থায় দেখেন। ১৭ ডিসেম্বর তিনি কলেজের জিমনেসিয়ামে (ব্যায়ামাগার) নয়টি ভাঙাচোরা খুলি দেখতে পান। জেরায় আসামিপক্ষ এসব বিষয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি।
রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় বইতে বলা হয়েছে, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য আলবদররা ব্যাপকভাবে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করা শুরু করে একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর থেকে। কারফিউ এবং ব্ল্যাক আউটের মধ্যে জিপে করে আলবদরা দিন-রাত বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রথমে তাদের কাদামাখানো একটি বাসে তোলে। এরপর বাসবোঝাই বুদ্ধিজীবীসহ নানা স্তরের বন্দীকে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদর সদর দপ্তরে নিয়ে নির্যাতন করে।
রায়ে আরও বলা হয়, ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোলাম আযম ১৭ সেপ্টেম্বর শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে রাজাকারদের উৎসাহ জোগাতে বক্তৃতা করেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওই কলেজটি শুধু রাজাকারদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল না, বরং একাত্তরে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করার স্থান ছিল।
ট্রাইব্যুনাল ২৯ ডিসেম্বর দৈনিক পাকিস্তান-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন উদ্ধৃত করেন। তাতে বলা হয়, বুদ্ধিজীবীদের নির্মূল করার জন্য বাংলার জঘন্যতম শত্রু ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামী যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল এবং ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আলবদর নামে জল্লাদ বাহিনী গঠন করেছিল, তাদের সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া গেছে। ওই জল্লাদদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত লালমাটিয়ার শরীরচর্চাকেন্দ্র থেকে উদ্ধার করা এসব তথ্যে বদর জল্লাদদের আরও কয়েকজনের নাম-পরিচয় ও ঠিকানা পাওয়া গেছে।
ব্লগার হত্যা, ধর্মানুভূতি ও সোজাসাপ্টা কিছু কথা
-শামীমা মিতু॥
কোনও ব্লগার খুন হলেই চারপাশে দুটো কথা বেশি শোনা যায় আজকাল।
এক: যারা ব্লগারদের খুন করছে তারা সত্যিকারের ধার্মিক না, তারা জঙ্গি।
দুই: যুক্তিবাদী হতে হলে অন্যের অনুভূতিতে আঘাত হানতে হবে কেন? কেন ধর্মকে নিয়ে কটাক্ষ করতে হবে?
যারা খুন করছে তাদেরকে সত্যিকারের ধার্মিক ভাবছেন না, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয় গোপন করে রাখা দু-একটি আইডি থেকে ধর্ম বা নবীকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করা হচ্ছে, অথচ তাদেরকেই ভাবা হচ্ছে প্রকৃত ব্লগার বা নাস্তিক। যে আইডিগুলো থেকে নোংরামি করা হয় সেগুলো তো জামায়াত শিবিরেরও হতে পারে। যেভাবে ধর্ম অবমাননার ধোঁয়া তুলে কক্সবাজারের রামুতে হামলা চালিয়ে বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অনেকে প্রশ্ন তোলেন, ধর্ম মানতে নাস্তিকদের তো কেউ বাধ্য করছে না, তাহলে তারা কেন ধর্মের পেছনে লাগে? গ্রামের প্রান্তিক মানুষ যারা জানেই না ব্লগ কাকে বলে, ইন্টারনেট কাকে বলে তারাও এমন প্রশ্ন করে। আবার যাদেরকে আমরা প্রগতিশীল বলে জানি, এমন অনেকেও প্রায় একই রকম প্রশ্ন করেন। অথচ তারা অভিজিৎ রায়ের কিংবা অনন্ত বিজয় দাশের কিংবা ওয়াশিকুর বাবুর কোনও লেখাতে দেখাতে পারেন না যেখানে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে। যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক কিংবা ব্লগ লেখে এমন কেউ খুন হলেই সবাই ভাবছে, নিশ্চয় খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি ধর্ম না হয় নবী-রাসুলকে নিয়ে কোনও কটূক্তি করেছে! সর্বসাধারণের কাছে এমন ভাবমূর্তিই তৈরি করা হচ্ছে।
অথচ একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে জড়ো হওয়া তরুণরা আল্লামা শফীর কাছে খেতাব পেয়েছিল 'শাহবাগি নাস্তিক' হিসেবে। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিল, ওই ১০ লাখ মানুষের সবাই কি নাস্তিক?
প্রতিটি হত্যার বিচার নিয়ে রাষ্ট্র রহস্যময় আচরণ করছে। সরকার শুধু নির্বিকারই থাকছে না, বরং অচেনা বামনের পৈতা দেখানোর মতো নানা কূটকৌশল করছে। তালিকা ধরে একের পর এক হত্যা করা হচ্ছে ব্লগারদের, তাদের নামে বদনাম রটিয়ে খুন করার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করা হচ্ছে এবং হত্যার পর স্বগর্বে দায় স্বীকার করছে আল কায়েদার বাংলা সংগঠন। আল কায়েদার হাত যেখানে পড়ে সেখানকার অবস্থা কী হয়, আমাদের সামনে কি এর উদাহরণ নেই? আমরা কি দেখছি না সিরিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পরিস্থিতি? যারা ভাবছেন এইসব জঙ্গি সংগঠন দেশের কিছু নাস্তিক ব্লগার হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত দেবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন, তারাই দেশের ক্ষতি ডেকে আনছেন।
আনিস আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনে ‘সজীব ওয়াজেদ, জাফর ইকবাল এবং ‘স্পর্শকাতর’ ব্লগার ইস্যু’ শিরোনামে একটা কলাম লিখেছেন। লেখার কিছু জায়গায় কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন,‘কতিপয় ব্লগারের গালাগালি প্রতিহিংসার পরিবেশ তৈরি ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। আমরা সব ধরনের সংস্কার আন্দোলন করতে পারি, যুক্তি দিতে পারি কিন্তু অনুভূতিতে আঘাত কেন? আমাদের দর্শন চিন্তায় যুক্তি প্রদর্শনের চাইতে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতারা, তাদের ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে কটাক্ষটা প্রাধান্য পাচ্ছে কেন? মুক্তচিন্তার কথা বলে আমরা গুটিকয় লোক কি সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের বিশ্বাসে অন্তরায় সৃষ্টি করছি? কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাসে আমাকে আঘাত দেওয়ার আগে তার প্রতিক্রিয়ার কথা কি আমরা ভাবছি?’
তার লেখা পড়ে মনে পড়ে গেল, বুখারী শরিফের অনেক হাদিস বহু বছর ধরে টিকে আছে যেগুলো পাঠ করলে নবীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে। মুসলিম হাদিস বিশারদরা দাবি করেন, এসব হাদিস সবই মিথ্যা বা ফেইক। অথচ এই সকল হাদিস মুসলমানেরাই সংকলন করেছেন, সাহাবি-খলিফাদের বরাত দিয়ে। এটা কি ধর্মানুভূতিতে আঘাত নয়? বুখারী শরিফের এই সংকলনকারীদের কি চাপাতির নিচে পড়তে হয়েছে?
বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের দাবি হচ্ছে তারা ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ অনুসরণ করে। অথচ এই সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনের সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত ৭২-এর সংবিধানের মূলনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে এরশাদ আমলে করা 'রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম' বহাল রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। একদিকে হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী শফী হুজুরের পায়ে মাথা ঠোকেন।
এদেশে বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে ইসলামকে দাঁড় করানো হয়েছে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান, গণজাগরণ মঞ্চকেও হেফাজত-জামায়াত নাস্তিক বলে আখ্যা দেয়। অথচ এদের একটা লেখা, একটা বক্তব্য পাওয়া যাবে না যাতে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে।
বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় কিংবা অনন্ত বিজয় দাশের লেখা খুবই পরিচ্ছন্ন, যুক্তিপূর্ণ। তারা তো কাউকে গালিগালাজ করেননি, অশ্লীল উক্তিও করেননি কোনও লেখায়, এমনকি নির্দিষ্ট কোনও ধর্ম নিয়ে ধর্মবিদ্বেষী কোনও মন্তব্য করেননি। তারা খুন হলেন কেন?
যারা ধর্মীয় আচার-রীতি, বিধান প্রচার এবং ধর্ম রক্ষার দাবি করছেন, তারাও কিন্তু অনেক বেশি অশ্লীল, নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করছেন; মূলত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের লোকদের। শিবিরের বাঁশের কেল্লাসহ হেফাজতের নানা ফেসবুক পেজে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিশিষ্টজন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের ব্লগার এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও ভয়াবহ, নোংরা অশ্লীল গালিগালাজ করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, ধর্মীয় চেতনার অধিকারী হলে তারা তাদের মত প্রকাশ করবে, যাকে ইচ্ছা নাস্তিক, মুরতাদ বলবে, অশ্লীলতম ভাষায় গালিগালাজ করার পূর্ণ অধিকার ভোগ করবে, আর বিজ্ঞানমনস্ক কেউ তার যুক্তির বিপরীতে কোনও যুক্তি দিলে বলবে, 'ওই ব্যাটা, চুপ থাক তোরে এসব নিয়ে লেখালোখি করতে কে বলেছে', এরপর যুক্তিতে হেরে গেলে নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে তাকে নৃশংসভাবে খুন করবে!
শুধু ব্লগার নয়, ধর্মীয় চিন্তাবিদদের মধ্যে যারা উদার দৃষ্টিসম্পন্ন, যারা জামায়াত-হেফাজত বিরোধী তাদেরও তো বাসায় ঢুকে নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকাণ্ড তো সেদিনের ঘটনা।
ধর্মানুভূতিই বা কী বস্তু, যাকে অনাহত, অক্ষত রাখার জন্যে রাষ্ট্রসহ নানান গোষ্ঠী এতো তৎপর? ধর্ম কি যুক্তি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? ধার্মিকেরাই বিশ্বাসী হওয়ার কথা বলেন। কিসে বিশ্বাস? সেই বিশ্বাস, যা বহু আগেই বদলে দিয়েছেন কোপারনিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইনরা।
নানান বৈজ্ঞানিক সত্য আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়, পৃথিবী ও গ্রহগুলো ঘোরে সূর্যকে কেন্দ্র করে, মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাগর্জনের ফলে, সেটি হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি, আজ থেকে এক হাজার থেকে দু-হাজার কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে, তারপর থেকে সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে, সূর্য আর গ্রহগুলো উদ্ভূত হয়েছে সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে, বিবর্তনের ফলে মানুষের বিকাশ বিশ থেকে চল্লিশ লাখ বছর আগে, পাহাড়গুলো পেরেক নয় ইত্যাদি।
একথাগুলো তো প্রচণ্ডভাবে আহত করে ধর্মানুভূতি, কেউ যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এ সব সত্যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এগুলো নিষিদ্ধ করার দাবি জানায় তখন রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্র কি নিষিদ্ধ করবে বিজ্ঞান?
রাষ্ট্র যদি সত্যি মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরেপেক্ষ নীতি বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রকে এ ধরনের নৃশংস খুনের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে, খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জামায়াত-হেফাজত তোষণের দ্বৈতনীতি নিয়ে দেশ চালালে এ দেশের পরিণতি পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতোই হবে। আর এমন আশঙ্কাই দিন দিন তীব্র হচ্ছে!
লেখক: সাংবাদিক ও ব্লগার
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
http://www.banglatribune.com
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় ব্লগার হত্যা
একটা গল্প দিয়ে শুরু করছি। গল্পটা এমন, কয়েকজন চোর আসলো নারকেল চুরি করতে। সেই গাছের মালিকানা ছিলো তিন ভাইয়ের। তারা চোরদেরকে দেখে ফেললেন। চোররা চিন্তা করলো, তিন ভাইয়ের সঙ্গেতো পারা যাবে না। যদি তারা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করে, চিৎকার করে তবে তাদেরকে আম, ছালা দু’টোই হারাতে হবে। সঙ্গে মাইর ফ্রি! তাই তারা প্রথমে দুই ভাইকে ডেকে বললো, দেখো তোমাদের দুই ভাইকে তো বড় ভাই ঠকাচ্ছে। এটা সহ্য করতে না পেরেই আমরা তোমাদেরকে সহযোগিতা করতে এসেছি, যাতে তোমরা তোমাদের ভাগ পাও। আমরা এ নারকেল তোমাদেরকে দেবা। এরপর চোররাসহ দুই ভাই মিলে বড় ভাইকে মারধর করে তাকে সরালো।’ চোররা এবার ছোট ভাইকে আলাদা করে বললো, ‘তোমার বড় ভাই যেভাবে তোমাদেরকে ঠকিয়েছিলো, মেঝ ভাইও তোমায় সেভাবে ঠকাবে। কেননা, সে তোমার বড়। তুমি চাইলে সব নারকেলই তোমার হবে।’ এ বুদ্ধি পেয়ে ছোট ভাইসহ চোররা মিলে এবার মেঝ ভাইকে মেরে তাড়ালো। ছোট ভাই এবার সব নারকেল দাবি করলে চোররা মিলে ছোট ভাইকে মেরে তাড়িয়ে সব নারকেল তারা নিয়ে গেলো।
চোররা এবার ছোট ভাইকে আলাদা করে বললো, ‘তোমার বড় ভাই যেভাবে তোমাদেরকে ঠকিয়েছিলো, মেঝ ভাইও তোমায় সেভাবে ঠকাবে। কেননা, সে তোমার বড়। তুমি চাইলে সব নারকেলই তোমার হবে।’ এ বুদ্ধি পেয়ে ছোট ভাইসহ চোররা মিলে এবার মেঝ ভাইকে মেরে তাড়ালো। ছোট ভাই এবার সব নারকেল দাবি করলে চোররা মিলে ছোট ভাইকে মেরে তাড়িয়ে সব নারকেল তারা নিয়ে গেলো।’
এ গল্পটি ইদানিং খুব মনে পড়ছে। কারণ, গত চার মাসে কয়েকজন মানুষ, ব্লগারকে নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে ইচ্ছেমতো খুন করছে। এর সবশেষ শিকার হলেন নিলয় নীল। এর আগে রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, বাবু, অনন্ত বিজয়কে খুন করেছে। খুনিদের কৌশল গল্পটার মতো। তারা এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে বোঝাচ্ছে, আমরা ‘নাস্তিক’ মারছি, ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’তো মারছি না। আর এতে ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’রাও আনন্দিত! কোনো প্রতিবাদ নেই! কারন, যারা মরছে তারা তো তাদের শত্রু, ‘নাস্তিক’, কিন্তু মানুষ না!
তবে তাদের জানা উচিৎ, ‘নাস্তিক’ ট্যাগ খাওয়া এ ব্লগার নামের তরুণ বুদ্ধিজীবিদের হত্যা শেষ হলে এখনকার ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমানদেরকে ‘সহি মুসলমান’ না বলে ফতোয়া দিয়ে কতল করা হবে। আর তখন তাদের বিরুদ্ধে বলা বা যৌক্তিক কোনো লেখার লোক থাকবে না। এখন এ কৌশল প্রয়োগের কারণ হলো, সাধারণ মানুষ যদি এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, তবে তাদের স্বপ্নের ‘বাঙ্গিস্তান’ প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হবে।
রাজীব হায়দারকে হত্যার পরে প্রধানমন্ত্রী তাকে দেখতে গিয়েছেন। বিবৃতি দিয়েছেন। জনমতের বিপক্ষে যাওয়ার ভয়ে ‘বাঙ্গিস্তান’র স্বপ্নদ্রষ্টাদের মুখপত্র দৈনিক আমার দেশ বিষয়টি নিয়ে নোংরামি শুরু করে। পত্রিকায় সিরিজ আকারে ব্লগারদের বিষয়ে নাস্তিকতার কলিমা লেপার চেষ্টা করে। এতে ‘বাঙ্গিস্তানের অন্ধ মুজাহিদ’রা ব্লগার শব্দটাকে নাস্তিকতার সমার্থক হিসেবে ধরে নেয়! তালিকা করে তাদেরকে মারার জন্য ঝাপিয়ে পড়ে! আর দেশের অনেক মানুষ তাদের এ অপপ্রচারের শিকার হয়ে তাদেরকে নাস্তিক ভাবতে শুরু করে! যদিও ব্লগিংয়ের সঙ্গে নাস্তিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। আর হ্যাঁ, কোনো ব্লগার নাস্তিক হলেও তাদের লেখা, কথা, আর যুক্তির জবাব লেখা, কথা, বা যুক্তি দিয়েই দিতে হবে। চাপাতি দিয়ে না।
এখানে দেখতে হবে, বেশীরভাগ ব্লগার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কাজ করায় স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভক্ত। আজ থেকে সাত, আট বছর আগেও অনলাইনে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ‘একচেটিয়া রাজত্ব’ ছিলো। বিভিন্ন বিষয়ে গুজব ছড়াতো। এখন কিন্তু তেমনটা নেই। আওয়ামী লীগের পক্ষের শক্তিকে কিন্তু এই ব্লগাররাই অনলাইনে নিয়ে এসেছিলেন। তাও আবার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। রাতের পর রাত নির্ঘুম থেকে, দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে প্রচারণা চালিয়ে এ ব্লগাররাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকদেরকে এ বিষয়ে সচেতন করেছিলেন। ব্লগারদের ওপরে এ খুনি চক্রটির টার্গেট’র মূল কারণটি কিন্তু এখানেই। কেননা, তাদের কারণেই অনলাইনে একচেটিয়া রাজত্ব হারাতে হয়েছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে।
উল্লেখযোগ্য আরেকটি বিষয় হলো, যারা নাস্তিকতার অভিযোগে লিস্ট করে ব্লগারদেরকে হত্যা করছে তাদের দৃষ্টিতে কিন্তু আওয়ামী লীগও নাস্তিক। তারা এর আগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ তুলেছিলো। এখনো তারা আওয়ামী লীগকে নাস্তিকদের দল মনে করে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে তারা এখনো সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মহীনতা বলে প্রচার করে। এ নাস্তিকতার প্রচারণা চালিয়েই তারা মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করেছিলো।
‘গণীমতের মাল’ মনে করে ‘নাস্তিক মহিলা’দেরকে তারা ধর্ষণ করে ‘পুরুষ নাস্তিক’দের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে! মুক্তিযুদ্ধে তারা ফতোয়াও দিয়েছিলো, ‘যারা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায় হিন্দুরাষ্ট্র ভারতের সহায়তায়, তারা কাফের, বিধর্মী, নাস্তিক।’ এজন্যই তারা এ বিধর্মী, আর নাস্তিকদের সঙ্গে ‘জিহাদ’ করার জন্য আল বদর বাহিনী তৈরি করেছিলো! আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল অনেক সংগঠনের নেতা কর্মীও এসব খুনিদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। নিজেদের পরাজয় ত্বরান্বিত জেনে সবশেষে তারা বুদ্ধিজীবিদের হত্যায় মেতে ওঠেছিলো।
১৯৭১’র বুদ্ধিজীবি হত্যার পর মেধার সেই ঘাটতি এখনো পূরণ হয়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে আস্তে আস্তে এই তরুণ সমাজ সেই ঘাটতি পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে একাত্তরের পরাজিত শক্তি আবার রক্তের সেই হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। ৭১’র মতো এবারো তারা ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে! তরুণ বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে খুনিচক্র প্রথমে মুক্তচিন্তার লেখকদেরকে নাস্তিক হিসেবে ফতোয়া দিচ্ছে। ফতোয়ার স্পর্শকাতর দিক, ভোটের চিন্তা করে আওয়ামী লীগ এসব লেখকদের কাছ থেকে প্রকাশ্যেই দূরে থাকছে। আর আমরাও এ ফতোয়া বিনা বাক্যে বিশ্বাস করে যাচ্ছি!
কিন্তু ওপরের গল্পের মতো এসব হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুক্তমনের এ তরুণ লেখক ও আওয়ামী লীগকে এভাবে আলাদা করতে পারলে তাতে সাফল্য খুনিচক্রেরই হয়। আর এতে সাফল্য আসলেই শুরু হবে আওয়ামী লীগ নিধন। তখন তারা আওয়ামী লীগকে আবার নাস্তিকদের দল হিসেবে আখ্যায়িত করার পাশাপাশি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী, জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী ফতোয়া দিয়ে ‘জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা’য় আওয়ামী লীগের নেতাদেরকে একের পর এক হত্যার মিশনে নামলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। তখন তাদেরকে নিয়ে অনলাইনে জনমত গড়ার মতো কেউ থাকবে না। কারণ, তরুণ এ ব্লগারদের হত্যার মাধ্যমে শেষ করতে পারলেই অনলাইন জগতটা খুনিদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। বর্তমান বাস্তবতায় অনলাইনের দখল ছাড়া অফলাইনের বিজয় একপ্রকার অসম্ভব। সুতরাং এমন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির জন্য আমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে দায়ী করতে পারবো না।
নিলয়কে হত্যার পরে দেখেছি, আওয়ামী লীগের অনেক ‘সেলিব্রেটি ফেসবুকার’ নিলয়ের লেখার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, ‘মুসলমানদের পবিত্র স্থান মসজিদকে অবমাননা করে নিলয় কেনো লিখেছেন?’ তাদের এমন গুরুতর অভিযোগের পরে নিলয়ের টাইমলাইন আমি চেক করি। সেখানে লেখা ছিলো, ‘মসজিদ আল্লাহর ঘর, এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে সাধারণ মানুষ। মসজিদ কোনো আরাম, আয়েশের বা এলাকার গৌরবের স্থাপনা নয়। মসজিদ প্রয়োজন অনুযায়ি নির্মিত হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, মসজিদকে আলিশান হতে হবে কেনো?’
‘একটি মসজিদ স্থাপিত হবে, সেখানে ইবাদতের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু তাকে সুসজ্জিত করতে হবে কেনো? আপনি আল্লাহর কাছে হাজিরা দিতে মসজিদে উপস্থিত হচ্ছেন। দীনহীন, অসহায়, পাপী একজন বান্দা। সেখানে আপনাকে এত আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ রাখতে হবে কেনো? আল্লাহ কি তাগিদ দিয়েছেন মসজিদকে সুসসজ্জিত করার?’…এই কথাগুলো এজন্যেই বলছি, যখন দেখি একটি আলিশান মসজিদের পাশের ফুটপাতেই গৃহহীন মানুষ খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে, তখন মনে হয় ধর্মের নামে মানুষ যেন অসহায় মানুষগুলোর সাথে নির্মম উপহাস করছে। মসজিদকে কেন্দ্র করে সারা দেশব্যাপি চাঁদার নামে একধরনের ভিক্ষাবৃত্তি চালু হয়েছে।’
‘যেখানে চাঁদা গ্রহিতারা যদি শতভাগ সততার সাথেও আদায়কৃত চাঁদার টাকা মসজিদের তহবিলে জমা করেন, সে ক্ষেত্রেও মসজিদ পায় ৩০ ভাগ, বাকি ৭০ ভাগ নেয় চাঁদা আদায়কারীরা। অর্থাৎ এটাকেই তারা অবলীলায় পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন। আর যদি চাঁদা গ্রহিতা পুরো টাকাটাই মেরে দেন সে ক্ষেত্রেও তাদের বাধা দেয়ার কেউ নেই। এ সবই সম্ভব হচ্ছে মসজিদকে দৃষ্টিনন্দন আলীশান করে গড়ে তোলার মানসে। এখানে কতটা পার্থিব স্বার্থ জড়িত আর কতটা মহান আল্লাহকে খুশি করতে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।’
এখন প্রশ্ন এটা কি মসজিদকে অবমাননা করে লেখা? নাকি মসজিদকে ঘিরে যে ব্যবসা, লোক দেখানোর সংস্কৃতি তার বিরুদ্ধে লেখা? তর্কের খাতিরে যদি ধরি এটা মসজিদকে অবমাননা করে লেখা, তবে মসজিদকে কেনো দৃষ্টিনন্দন করা প্রয়োজন, কেনো মসজিদে এয়ারকন্ডিশন লাগানো দরকার, তার জবাব লেখার মাধ্যমে দিলেইতো হয়। এ লেখার কারণে তো কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা না? তিনি মসজিদের দৃষ্টিনন্দনের বিরোধিতা করেছেন, মসজিদ নির্মাণের বিরোধিতা করেননি।
সেই ‘সেলিব্রেটি’দের বোঝা উচিত, ব্লগারদের খুন করার জন্য খুনীরা ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু ইসলামের কোথায় ভিন্নমতের মানুষকে খুন করার কথা বলা বা লেখা আছে? ইসলাম ধর্ম এত ঠুনকো নয় যে, কোথায় কোন ব্লগার তার ব্লগে মসজিদের দৃষ্টিনন্দনের বিরোধিতা করে কী লিখলো, আর তাতেই মসজিদের দেয়াল, ইসলাম হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।
ভারতের মতো হিন্দু প্রধান দেশে হিন্দু ধর্মের বাড়াবাড়ি নিয়ে পিকে সিনেমায় হিন্দু ধর্মের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ ভারতের সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে। ইসরাইলের বুদ্ধিজীবীরা গাজায় তাদের সেনা দ্বারা মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করে। রোমের নাস্তিকরা খ্রিষ্টান ধর্মকে তুলোধুনা করে। কারণ, যেখানের যেটা সমস্যা, সেখানকার এক্টিভিস্টরা সেই বিষয় নিয়ে কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। তাই এখানের ব্লগারদের লেখা, সমালোচনাও সেই সাধারণ নীতি অনুসরণ করবে।
সবশেষে বলবো, ব্লগারসহ দেশের সব মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। সেই দায়িত্ব পালনে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে, হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতেও যে সরকার ব্যর্থ হবে, তা বিশ্বাস করতে আমি রাজি না। আমি আশাবাদী থাকতে চাই। আমি এখনো আশা করি, এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়ে সরকারের বোধোদয় হবে। যেসব খুনি ধরা পড়েছে তাদের বিচার হবে।
আহসান কামরুল
১১.০৮.২০১৫ খ্রি.
ঢাকা।
- See more at: Click This Link
বুদ্ধিজীবি হত্যার অন্তর্নিহিত কারন:
-শাহীন
এখন পর্যন্ত বুদ্ধিজীবি হত্যার কারন হিসাবে সবাই বলেন দেশ যেন চলতে না পারে সেজন্য এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। সেটা অবশ্যই ঠিক, তবে এর বাইরে আরো গভীর কিছু বিষয় আছে বলে আমার মনে হয়। প্রথমত: পাকিস্তানি বাহিনী ১০ ডিসেম্বরের পরই আত্মসমপর্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তখন তাদের মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল পাকিস্তানি সামরিক এবং আধাসামরিক (রাজাকার/আলবদর/আল শামস) বাহিনীর সদস্যদের জীবন বাচিয়ে আত্ম সমপর্ন করা। ১৩/১৪ ডিসেম্বরই ইয়াহিয়া নিয়াজীকে সেটা জানিয়ে দেন। তাহলে সেই সময় এই গর্দভদের যখন চাচা আপন প্রান বাচানোই দায়, তখন তাদের পক্ষে একাকি এমন একটা পরিকল্পনা করা কঠিন ছিল। তবে এদের ব্যক্তিগত জিঘাংসার ধরন আজো আমরা যেমনটা দেখছি (প্রায় প্রতিদিন তারা কোন না কোন খানে কোন না কোন আলীগ নেতাকে নিরস্ত্র আবস্থায় কুপিয়ে বা আগুন দিয়ে হত্যা করছেন) সেটা চিন্তা করলে এটা স্বাভাবিকই মনেহয়। একইসাথে তাদেরকে যে কেউ কিছু করতে পারবেনা –এমন একটা আত্মবিশ্বাস তাদের সবসময়ই ছিল। যেমন ইয়াহিয়ার সেই চিঠিতে পাকিস্তানী বাহিনীর যে কিছু হবে না, এইরকম যোগাযোগ উনি জাতিসংঘের সাথে আগেই করে রেখেছেন বলে নিয়াজীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আর ১০ ডিসেম্বর জামাতের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রাম শিরোনাম করে –‘আমাদের সাথে আমেরিকা আর চিন আছে, ভয় পাবার কিছু নাই’।
তারপরো আমার ধারনা, এই পরিকল্পনার পেছনে আরো শক্তিসালী কেউ ছিল। মনে রাখতে হবে আত্মসমপর্ন ১৬ তারিখ বটে, কিন্তু সিদ্ধান্ত কিন্তু আরো আগের। সম্প্রতি জানা গেছে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের চিঠি আমেরিকা ১৮ ঘন্টা নিজের কাছে আটকে রেখেছিল। (পাকিরা আত্মসমপর্নের চিঠি কিন্তু দিয়েছিল তাদের আব্বাজান আমেরিকাকে !)। আমেরিকা সব সময়ই একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা মাথায় রেখে কাজ করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় যখন অবিসম্ভাবি, তখন তাদের করনীয় কি ? হয় বাস্তবতা মেনে নিয়ে নতুন দেশের সরকারের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন (যেটা প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধু অন্তত সম্ভব ভেবেছিলেন !) অথবা নতুন সরকারকে হঠিয়ে দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। এই পরিকল্পনা তারা আগেই নিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পরে অন্তত নয়।
আমরা আজ জানি বাংলাদেশের জন্মটা ছিল কিসিন্জারের জন্য ব্যক্তিগত পরাজয়। ৩ টি ঘটনা তার রাজনৈতিক ক্যরিয়ারকে বিপযর্স্ত করেছিল, যার পেছনে ছিলেন তিন মহামানব – থিউ, আলেন্দে আর মুজিব। কিন্তু তাদের উপরে প্রতিশোধ কিভাবে নেয়া সম্ভব ? ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত প্রধানন্ত্রী মোসাদ্দেক কে দিয়ে শুরু সিআইএর ষড়যন্ত্র, আর কু্ বাস্তবায়নের দীর্ঘ ইতিহাসের। ইরানের ঘটনায় সিআইএর হাত থাকার কথা সম্প্রতি ওবামা স্বীকারো করেছেন। এরপরে আরো অসংখ্য দেশে বছরের পর বছর সিআইএ এই কাজ করে গেছে সিদ্ধ হস্তে। তাহলে সেটই যে করতে হবে বাংলাদেশে তা নির্ধারিত হয়েছিল নিশ্চয়ই ১৯৭১ সালেই। তাজউদ্দিনের কথা এই ক্ষেত্রে না বললেই নয়। কি আশ্চর্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল তার ! ৭১ সালেই বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রায়ই তিনি একটি কথা বলেতন যে ‘যদি আমরা যুদ্ধে হেরে যাই তাহলে বিদ্রোহী হিসাবে বিচার করে ফাসি দেয়া হবে। যদি জিতি তাহলে আততায়ির হাতে প্রান হারাতে হবে।‘ (সূত্র: সিমিন হোসেন রিমির লেখা আমার বাবার কথা এবং আমার বাবা তাজউদ্দিন)
বাংলাদেশের নতুন সরকারেক যদি একইরকমভাবে কু্ করে সরাতেই হয় তাহলে সেটা কিভাবে করতে হবে ? ১৯৭১ সালেই সিআইএ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তখনকার মেজরদের (শফিউল্লা, জিয়া সবাই তখন মেজর ছিলেন) কয়েক জনকে রিক্রুট করেছিল, তার দলিল আগেই অবমুক্ত হয়ে গেছে, যদি সেই মেজরের নাম এখনো অবমুক্ত হয়নি। কিন্তু শুধু সেরকম ১ জন থাকলেই তো হবেনা। আরো কিছু পরিক্ষিত টেকনিক আছে সিআইএর কু এক্সপোর্ট করার। তাদের ব্রাজিলিয়ান এক ডক্টরেট ভদ্রলোক (ড: কামাল না কিন্তু) যিনি ল্যাটিন আমেরিকায় সিআইএর এই কার্যপ্রনালী প্রথমদিকে প্রয়োগের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি তখন মার্কিন এক পত্রিকায় সগর্বে সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছিলেন ‘কেক তৈরীর প্রনালী রেডি, এখন শুধু ভাজো আর খাও !’।
তো এই ‘কেক তৈরীর প্রনালী’ সম্বন্ধে বিস্তারিত আমরা জানি চার্চ কমিটির প্রতিবেদন নামে বিখ্যাত মার্কিন কংগ্রেসের এক তদন্তে, যেখানে সিআইএ আসলে কি কি করছে বিশ্ব জুড়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার নামে সেটা নিয়ে তদন্ত করা হয়। আর এটার উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ১৯৭২ সালে চিলির নির্বাচিত ক্যারিশমাটিক নেতা সালভাদর আলেন্দে হত্যা এবং ক্যুর ঘটনায় সিআইএর যুক্ত থাকা। এর মাধ্যমে আমরা প্রথম অফিসিয়ালি জানতে পারি তারা বিশ্বজুড়ে এই সব কাজ করছে আর তার জন্য কি কি টেকনিক প্রযোগ করছে।
যদিও আলেন্দে হত্যার পরপরই এক সাক্ষাতকারে আমেরিকার আরেক শত্রু (একমাত্র যাকে তারা হাজার বার মারা চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হয়েছে) ফিডেল ক্যস্ট্রো বলেন, ‘আলেন্দে মারা গেছেন আসলে অতিমাত্রায় গনতন্ত্রের জন্য। তার দেশে সবারই ষড়যন্ত্র করার অধিকার ছিল। বিরোধী প্রেস ষড়যন্ত্র করেছে এবং ক্যু সফল করেছে।‘
একই রকম আরেক নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশে ৭৫এর জুনে ৪টি বাদে বাকি সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করার সময় সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিদেশ থেকে টাকা এনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।‘
চার্চ কমিটির রিপোর্ট থেকেও আমরা জানতে পারলাম চিলির নেতা আলেন্দেক হত্যায় এবং তার আগের বারের নির্বাচনে তাকে হারানোতে সিআইএর প্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিল। তারা কি টেকনিক ব্যবহার করেছিল, তার উপর চার্চ কমিটির রিপোর্টে একটা বিস্তারিত অধ্যায়ই আছে। সেটা থেকে জানা যায় তাদের মূল টেকনিক ছিল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রোপাগাণ্ডা চালানো। আর এই কাজে তাদের মূল অস্ত্র ছিল প্রথম আলো ...দু:খিত... এল মারকুরিও নামের একটি দৈনিক পত্রিকার।
এছাড়া ছিল অর্থনীতিকে আক্রমন করা। যেটাও কিনা আমরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখেছি যখন কিনা খাদ্য বোঝাই জাহাজ আমাদের বন্দরের কাছ থেকে ফেরত নিয়া যাওয়া হয়েছিল দূবিক্ষ নিশ্চিত করার জন্য।
তো এই টেকনিক যদি হয় ‘কেক তৈরীর প্রনালী’ যা কিনা ১৯৫৩ সাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর সেই প্রনালী যদি বাংলাদেশে প্রয়োগ করা সিদ্ধান্ত ৭১ সালেই নেয়া হয়ে থাকে (বাজী ধরতে পারেন আমেরিকা ঠিক এতোটাই এডভান্স চিন্তা করে)। তাহলে সেই প্রোপাগাণ্ডা চালানোর জন্য প্রধান বাধা কারা? জাতির সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়, অর্থাত যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্মানোর সময়ে যারা অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছিলেন- সেই সব বুদ্ধিজীবিরা নয় কি ? আর তাদের অনেকেই তখন নিরস্ত্র, বেসামরিক মানূষ, কলম যোদ্ধা। তাই ১৪ ডিসেম্বর তাদের হত্যা করা কি অতি-জরুরী নয় ? যে কারনে 'চাচা আপন প্রান বাচাঁ' অবস্থায় থাকা জামাতো তখন প্রভুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। যে তালিকা ধরে হত্যা করা হয়, সেটি আজ এক ঐতিহাসিক দলিল, তা ছিল গোলাম আযমের সই করা। আর তাইতো গোলাম আজো মার্কিনীদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ ।
১৪ ডিসেম্বর যে সুদুর প্রসারী চক্রান্ত্রের সূচনা হয়, তা পরবতিতে ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে গেছে সিআইএর এদেশী দোসররা। যে কারনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরীক্ষিত গুনি শিল্পীদের অনেকেই, যারা বেচে ফিরেছিলেন, তারা পরবর্তিতে দৈন্যদশায় ধুকে ধুকে মরেছেন। আর অব:প্রাপ্ত, আমলা, হঠাৎ গজিয়ে উঠা বুদ্ধিজীবিরা, যাদের ভালো কোন সাহিত্য কর্ম কোনদিন দেখেন নি, তারা সেজেছেন জাতির বিবেক- ‘সুশিল সমাজ’। এমনকি আজো মুনতাসির মামুন, গাফফার চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, ড: মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কিংবা ড: আনোয়ারকে ধীরে ধীরে লেবেল মেরে, প্রান্তিক আর অপ্রাসংগিক করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মুক্ত চিন্তার দৈনিক আর তার সহচর অন্যান্য দৈনিক/টিভি গুলো। তাদের একমাত্র অযোগ্যতা- তারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে কেনা দিন বেইমানি করতে পারেন না। ৭১ সালে যেমন তথাকথিত নিরপেক্ষ হতে পারেন নি, আজো না। আর নতুন প্রজন্মের ইমরান এইচ সরকার, নিঝুম মজুমদার, মারুফ রসুলদেরৃ মিথ্যা নাস্তিক আখ্যা দিয়ে হত্যার সকল আয়োজন করে রাখা হয়েছে।
আজ থেকে ৪২ বছর আগে এই দিনে, বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের মাধ্যমে যে বীষ বৃক্ষের বীজ বোপন করা হয়েছিল, আজ তারই শাখা প্রশাখায় দেশের সব মিডিয়া ছেয়ে গেছে। আর তাতে ভর করে ৭১ এর শকুনেরা আবারো আমাদের মানচিত্র হিংস্র থাবায় রক্তাত্ত করছে প্রতিদিন। ৭১ এ আমরা জিতেছিলাম, ২৯১৪ তে কি হবে ?
------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র:
চার্চ কমিটির রিপোর্ট (সংক্ষিপ্ত)
বিশ্বব্যাপি সিআইয়ের গোপন ততপরতা- 'যে রাজ্যে আইন নেই .. ' বই থেকে কিছু অংশ
http://www.somewhereinblog.net/blog/sa07shahin/29905887
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা, তাঁদের একটি তালিকা
-আইরিন সুলতানা
পাক-বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস কর্তৃক সংগঠিত তালিকাভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞের স্বরণে বাঙালি জাতি স্বশ্রদ্ধ চিত্তে সেই ১৯৭২ সাল থেকে ১৪ই ডিসেম্বরে শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস পালন করে আসছে । বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, মরহুম তাজউদ্দিন আহমেদ, ১৪ই ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষনা করেছিলেন কারণ, অপহরণ ও পরে নির্বিচারে হত্যা এই ১৪ই ডিসেম্বরেই অর্থ্যাৎ পাক-বাহিনীর আত্ম-সমর্পন এবং বাঙালির বিজয় অর্জন তথা বিজয় দিবসের ঠিক দু’দিন পূর্বে, সংগঠিত হয়েছিল সবচেয়ে বেশী।
২০শে ডিসেম্বর ১৯৭১ –এ, মুজিবনগর সরকারের এক মুখপাত্র জানান, ১৬ই ডিসেম্বরে আত্মসমর্পনের পূর্বে পাক-বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা মিলে ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। ১৯৯৪ সালে পুণ:মুদ্রিত বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবি সম্পর্কিত তথ্যকোষ ”শহীদ বুদ্ধিজীবি কোষগ্রন্থ” এ শহীদ বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যা ২৩২ জন উল্লেখ আছে এবং এই তালিকাটি সর্বমোট নয় এমনকি সম্পূর্ণ নয় ।
এই তথ্যকোষে শহীদ আখ্যায়িত হয়েছেন তারা যাদের পাক-বাহিনী এবং দোসরেরা (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) বিভিন্ন সময় নির্বিচারে হত্যা করেছিল এবং যারা ২৫শে মার্চ ১৯৭১ থেকে ৩১শে জানুয়ারী ১৯৭২ সময়কাল থেকে নিঁখোজ । লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, সংগীত শিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, উকিল, চিকিৎসক, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি-বেসরকারি কর্মী, নাট্য-কর্মী, জনসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের বুদ্ধিজীবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ”বাংলাদেশ” নামক প্রামান্য চিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুলশিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ-শিক্ষককে হত্যা করা হয়।
এ ব্যাপারটি পরিস্কার ছিল যে, পরাজয় সন্নিকটে জেনে, পাক-বাহিনী এবং তার দোসরেরা বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং শিক্ষক, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে আসে এবং একজনের পর একজনকে হত্যা করে এবং তা বেশীর ভাগই সংগঠিত হয় এই ১৪ই ডিসেম্বরে। এই হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল মূলত জাতি হিসেবে আমাদের মেধাহীন, পঙ্গু করে দেয়া।
দৈনিক পত্রিকাগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গোপন তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে, ১৮ই ডিসেম্বরে একদল সাংবাদিক ঢাকার পশ্চিমে, রায়ের বাজার এলাকায় পচনশীল, ক্ষত-বিক্ষত লাশের একটি গণ-কবরের সন্ধান লাভ করে। জাতির মেধাবী ব্যক্তিবর্গের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, একে-অন্যের নীচে চাপা পড়ে ছিল । লালমাটিয়ায় শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাংবাদিকরা একটি বন্দীশালা আবিস্কার করে, যা ছিল রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং কামালউদ্দিন, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলিম চৌধুরী, আবুল খায়ের এবং সাংবাদিক মুহাম্মদ আখতার – পচনশীল লাশগুলো পরিবার কর্তৃক সনাক্ত করা হয় সেদিনই । সাংবাদিক সেলিনা পারভিন এর লাশ সনাক্ত করা হয় পরের দিন। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, ফাইজুল মহি এবং চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর ও মনসুর আলী’র লাশ পরবর্তীতে চিহ্নিত করা হয়। লাশ সনাক্তকরণের সময় শহীদ বুদ্ধিজীবিদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছিলেন।
এরকম আরো বধ্যভূমি ছিল মিরপুর এবং রায়ের বাজার এলাকায়, তেঁজগাঁও এর কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টি.বি. হাসপাতাল সহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। অনেক লাশই পরবর্তীতে সনাক্তকরণের পর্যায়ে ছিলনা । এসময় সংবাদপত্রগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবিদের (নভেম্বরের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অপহরণ অথবা গেফতারকৃত) নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছিল।
পাক-বাহিনী এদেশের তরুণ ছেলে-মেয়েদেরকে হত্যা করা শুরু করেছিল সেই ২৫শে মার্চের সময় থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য এবং অনেক প্রফেসরদের হত্যা করা হয় । মূলত যুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়েই চলে বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ড। এমনকি পাক-বাহিনীর দোসরদের (রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস) দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় ১৯৭২ এর জানুয়ারীতেও।
চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তার অপহরণকৃত ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারকে (পাক-বাহিনীরা তাকেও হত্যা করেছিল বলে ধারনা করা হয়) খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। তাকে শেষ দেখা যায় মিরপুরে বিহারী ও পাক-বাহিনীর দোসরদের ক্যাম্পে। পরবর্তীতে তার সম্পর্কে আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ডা: মনসুর আলীকে ২১শে ডিসেম্বর এবং সাংবাদিক গোলাম রহমানকে ১১ই জানুয়ারী হত্যা করা হয়।
মফিজউদ্দিনের (লাশ বহনকারী বাহনের চালক) স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আশরাফুজ্জামান খান, ইসলামি ছাত্র সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য এবং পাকিস্তান রেডিও’র সাবেক কর্মী, নিজ হাতে সাত জন শিক্ষককে গুলি করেন। মফিজউদ্দনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এমন দূর্ভাগ্যজনক ভাবে মৃত্যুবরণকারী শিক্ষকদের লাশ উদ্ধার করা হয় রায়ের বাজার বধ্যভূমি এবং মিরপুরের শিয়াল বাড়ির গণ কবর থেকে। তার ডায়েরিতে ২০ জন শিক্ষক সহ আরো অনেক বাঙালির তালিকা ছিল। তার ডায়েরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষকের নাম ছিল যারা পাক-বাহিনীকে সহযোগীতা করেছিল।
বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনায় পাক-বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাসেম এবং ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ছিল মূল হোতা । নভেম্বর মাসের কোন এক সময় তারা মওলানা আব্দুল মান্নানের বাসগৃহে মাদ্রাসা শিক্ষক সংঘের প্রেসিডেন্ট সহকারে বৈঠক করে। এই আলোচনাতেই সম্ভবত বুদ্ধিজীবিদের হত্যার মূল পরিকল্পনা করা হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ
* এ.এন.এম. মুনির চৌধুরী
* ডা: জি.সি. দেব
* মুফাজ্জাল হায়দার চৌধুরী
* আনোয়ার পাশা
* জোতীর্ময় গুহ ঠাকুর
* আব্দুল মুক্তাদীর
* এস.এম. রাশিদুল হাসান
* ডা: এ.এন.এম ফাইজুল মাহি
* ফজলুর রহমান খান
* এ.এন.এম মনিরুজ্জামান
* ডা: সেরাজুল হক খান
* ডা: শাহাদাত আলী
* ডা: এম.এ. খায়ের
* এ.আর. খান কাদিম
* মোহাম্মদ সাদিক
* শারাফত আলী
* গিয়াসউদ্দিন আহমেদ
* আনন্দ পবন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ
* প্রফেসর কাইয়ূম
* হাবিবুর রহমান
* শ্রী সুখ রঞ্জন সমদ্দার এম.সি.এ
* মশিউর রহমান
* আমজাদ হোসেন
* আমিনুদ্দিন
* নাজমুল হক সরকার
* আব্দুল হক
* সৈয়দ আনোয়ার আলী
* এ.কে. সর্দার
সাংবাদিক
* সিরাজুদ্দিন হোসেন
* শহীদুল্লাহ কায়সার
* খন্দকার আবু তালেব
* নিজামুদ্দিন আহমেদ
* এ.এন.এম. গোলাম মোস্তফা
* শহীদ সাবের
* সরকার আব্দুল মান্নান (লাদু)
* নাজমুল হক
* এম. আখতার
* আব্দুল বাশার
* চিশতী হেলালুর রহমান
* শিবসাধন চক্রবর্তী
* সেলিনা আখতার
চিকিৎসক
* মো: ফজলে রাব্বী
* আব্দুল আলীম চৌধুরী
* সামসুদ্দিন আহমেদ
* আজহারুল কবীর
* সোলায়মান খান
* কায়সার উদ্দিন
* মনসুর আলী
* গোলাম মর্তোজা
* হাফেজ উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
* আব্দুল জব্বার
* এস.কে. লাল
* হেম চন্দ্র বসাক
* কাজী ওবায়দুল হক
* আল-হাজ্ব মমতাজউদ্দিন
* ঘাশিময় হাযরা
* নড়েন ঘোষ
* জিকরুল হক
* শামসুল হক
* এম. ওহমান
* এ. গফুর
* মনসুর আলী
* এস.কে সেন
* মফিজউদ্দিন
* আমূল কুমার চক্রবর্তী
* আতিকুর রহমান
* গোলাম সারওয়ার
* এর.সি. দাস
* মিহির কুমার সেন
* সালেহ আহমেদ
* অনীল কুমার সিনহা
* গুনীল চন্দ্র শর্মা
* এ.কে.এম. গোলাম মোস্তফা
* মাকবুল আহমেদ
* এনামুল হক
* এনসুর (কানু)
* আশরাফ আলী তালুকদার
* লেফ: জিয়াউর রহমান
* লেফ.ক. জাহাঙ্গীর
* বাদল আলম
* লেফ: ক. হাই
* মেজর রেজাউর রহমান
* মেজর নাজমুল ইসলাম
* আসাদুল হক
* নাজির উদ্দিন
* লেফ: নুরুল ইসলাম
* কাজল ভাদ্র
* মনসুর উদ্দিন
শিক্ষাবিদ
* জহির রায়হান
* পূর্নেন্দু দস্তিদর
* ফেরদৌস দৌলা
* ইন্দু সাহা
* মেহেরুন্নিসা
শিল্পী ও পেশাজীবি
* আলতাফ মাহমুদ
* দানবীর রানাদা প্রসাদ সাহা
* জোগেষ চন্দ্র ঘোষ
* ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত
* সামসুজ্জামান
* মাহবুব আহমেদ
* খুরশিদ আলম
* নজরুল ইসলাম
* মাহফুজুল হক চৌধুরী
* মহসিন আলী
* মুজিবুল হক
তথ্যসূত্র:
১. জেনোসাইড বাংলাদেশ
২. বিদ্রোহী
আনসারুল্লাহর হিটলিস্টে ৮৪ জন ব্লগার, বেঁচে থাকা ব্লগারগণ ওনারা আদৌ নিরাপদে আছে কি?
গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নতুন কৌশলে মাথা চাড়া দিয়েছে। এই উগ্রপন্থী সংগঠনের সদস্যরা ধর্ম অবমাননাকারী ব্লগারদের তালিকা হাতে নিয়ে তাদের হিটলিস্টে রেখেছে। এরা রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে নাশকতার চেষ্টা বা নাশকতা করে থাকে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকা সেই ৮৪ ব্লগারের মধ্যে কয়েকজন এবিটির হত্যা তালিকার অন্যতম। এর মধ্যে অভিজিৎ তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। তালিকায় থাকা ৮৪ ব্লগার হচ্ছে- আরিফুর রহমান, মনির হাসান, বৃত্তবন্ধি, সবাক, শয়তান, মনজুরুল হক, কখগ, রাসেল, নাস্তিকের ধর্মকতা, দূরের পাখি, আরিফুল হক তুইন, তিতি আনা, নাজিম উদ্দিন, আলমগীর কুমকুম, ফরহাদ উদদিন স্বপন, দুস্যবনহুর, ফারহানা আহমেদ, ঘনাদা, রাহান, অন্যকেউ, পাপী ০০৭, হোরাস, প্রশ্নোত্তর, ভালমানুষ, ভন্ডপীর, বৈকুণ্ঠ, সত্যান্বেষী, পড়ুয়া, হাল্ক (সানাউল), বিপ্লব ০০৭, রাস্তার ছেলে, ঘাতক, বিশাল বিডি, সাহোশি ৬, লাইট হাউজ, মমতা জাহান, রাতমজুর, কৌশিক, মেঘদূত, স্বপ্নকথক, প্রায়পাস, আহমেদ মোস্তফা কামাল, লুকার, নুহান, সোজাকথা, ট্রানজিস্টার, দিওয়ান, রিসাত, আমি এবং আধার, অরন্যদেব, কেল্টুদা, আমি রোধের ছেলে, ভিন্নচিন্তা, আউটসাইডার, প্রণব আচার্যা, আসিফ মহিউদ্দিন, আবুল কাশেম, আলমগীর হোসেন, অন্যআজাদ, অনন্ত বিজয় দাস, আশীষ চ্যাটানজি, অভিজিত রায়, বিপ্লব কান্তি দে, দাঁড়িপাল্লা ধমা ধম (নিতাই ভট্টাচার্য), ইব্রাহীম খলিল সবাগ, (সুমন সওদাগর) কৈশীক, আহমেদ, নুরনবী দুলাল, পারভেজ আলম, রাজিব হায়দার শোভন (থাবাবাবা), রতন (সন্যাসী), সৈকত চৌধুরী, শর্মী আমিন, সৌমিত্র মজুমদার (সৌম্য), আল্লামা শয়তান (বিপ্লব), শুভজিদ ভৌমিক, সুমিত চৌধুরী, সৈকত বড়ুয়া, সুব্রত শুভ ও সুসান্ত দাস গুপ্ত, সৈয়দ কামরান মির্জা, তাহসিন, তন্ময় এবং তালুকদার ও জোবায়েন সন্ধি। - See more at: Click This Link
১৯ ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দিয়ে গণমাধ্যমে চিঠি, স্বাধীন দেশে ওরা এই সাহস পায় কোথা থেকে?
http://www.deshebideshe.com/news/details/54994
‘নাস্তিক’ অপবাদের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর স্পষ্ট বক্তব্য:
১৯৭০-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে যখন আওয়ামী বিরোধীরা এই দলকে ‘ইসলাম বিরোধী ‘নাস্তিক’ বলে প্রচার করে তখন বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে তাঁর নির্বাচনী ভাষণে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে বলেন :
“আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা নাকি ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হল,
আমরা লেবেল সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রসূল করীম (সা.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বরাবর যারা অন্যায়, অত্যাচার শোষণ বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদের বিরুদ্ধে।
”মুসলিম রাষ্ট্রে হত্যার নৃশংসতা একই প্রকৃতির রহস্য কোথায়!
মুহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন ইবনে মঈন চৌধুরী
এখন সত্য বলার মধ্যে আইনী বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিশ্ব জুড়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকার যেখানে নাই (!) সেখানেই জঙ্গী বা সন্ত্রাসীদের উত্থান আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানেই রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত সেবকদের মধ্যে যারা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার সাহায্য করতে পারে তাদের পিছনে জনগণের কষ্টার্জিত সম্পদ ব্যয় করা হয়। আর এই অনির্বাচিত শাসক চক্রকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিতে থাকে পশ্চিমা বিশ্ব, হিন্দুস্থান, রাশিয়াসহ মুসলিম জাতী বিদ্বেষী গোষ্ঠী। এক পক্ষ সন্ত্রাসী সৃষ্টি করছেঅস্ত্র বিক্রী ও সরবরাহ করছে অপর পক্ষ নির্বিচারে নিরীহ মানুষের উপর হামলা চালাচ্ছে । আর পানি ঘোলা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কূর্দী তথা শিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালানোর মধ্যেদিয়ে। বাংলাদেশে ৪০০শত বসৎর এর ঐতিজ্য ভেঙ্গে হোসনী দালানী বোমা হামলা করা হয়েছে। বিশেষ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো গুলোতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। (সংক্ষিপ্ত)
প্রবীন শিক্ষাবিদ ড.আবুল কাশেম ফজলুল হক দুঃখ কষ্ট বুকে চাপা রেখে বলেন রাজনৈতিক সমাধানের কথাটাই সঠিক। দেশের মানুষ কে তাদের রাজনৈতিক, নাগরিক ভোটের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করলে ক্ষমতালোভীর খূন্যতম চক্রান্ত করতে সাহস পাবে না। আর বিদেশীরা ও মোড়লি পনার নামে আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্রের সমর্থন হারাবে। দেশে সামরাজ্যবাদও আধিপত্যবাদ বিস্তারের চক্রান্ত চলছে তখনই স্পষ্ট হয় যুক্তরাষ্ট্র যখন সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে সহযোগীতা কথা বলে। এ থেকে বাংলাদেশের জনগনের কাছে পরিস্কার হতে শুরু করেছে অনন্য মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকদের মত ভাগ্য বরনের চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। (সংক্ষিপ্ত)
- See more at: Click This Link
জাতিকে ভবিষ্যৎ মেধাশুণ্যতার হাত থেকে বাঁচান:
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের নিকট আমার আকূল আবেদন, জাতিকে এই ভয়াবহ সর্বনাশা থেকে রক্ষা কল্পে, বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসাবে, বিষয়টি একটু বিশেষভাবে বিবেচনা ক’রে দেখবেন এবং যথাশীঘ্র এর সমাধানের ব্যাবস্থা নিবেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখহাসিনার দীর্ঘায়ূ এবং বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের মঙ্গল কামনা করছি।
-ইজাজ আহমেদ।
সীতারামপুর, কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।
- See more at: Click This Link
----------------"composition"-----------------
১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:২৪
শেখ মিজান বলেছেন: কৃতজ্ঞ আলী ভাই
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:০৪
ডঃ এম এ আলী বলেছেন: অনেক তথ্যবহুল পরিশ্রমী লিখা । এতে গবেষনার অনেক উপাদান রয়েছে ।
তথ্যবহুল এই মুল্যবান লিখাটির জন্য রইল ধন্যবাদ সাথে শুভেচ্ছা ।