নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি \'\'মুক্তি\'\' কামী.....

আমি মুক্তি কামী

আমি একজন ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ....।

আমি মুক্তি কামী › বিস্তারিত পোস্টঃ

দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট...

২৬ শে মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৫:৪২

দারুল উলূম দেওবন্দ একটি খোদাপ্রদত্ত মাকতাবে ফিকির বা চিন্তাশিবিরের নাম। অর্থাৎ দারুল উলূম দেওবন্দ শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং সময় ও যুগের চাহিদা-উপযোগী করে ইসলামকে সমাজে একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীনরূপে উপস্থাপন করার চিন্তা, গবেষণার লালনকেন্দ্র, যার অবিচ্ছিন্ন সূত্র শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. থেকে চালু হয়েছে। আর শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. থেকে উপরের দিকে অবিচ্ছিন্ন সূত্রধারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে।
হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর ইলম, ফিকির ও জওক বা মানসিকতা শাহ আব্দুল আযীয রহ., অতঃপর শাহ মুহাম্মদ ইসহাক রহ. ও শাহ আব্দুল গনী রহ. এর মাধ্যমে হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিম নানুতবী রহ. ও হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই দুই মনীষী দারুল উলূম দেওবন্দের মাধ্যমে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কোরআন-সুন্নাহর শিক্ষা-দীক্ষা এবং তাওহীদ ও রিসালাতের বর্ণনা ও উপস্থাপনায় হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর অভিনব শৈলী রয়েছে যা সর্বযুগের দাবী ও চাহিদার সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। এই চিন্তাধারা ও অভিনব শৈলী তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, বরং পুরোপুরি খোদাপ্রদত্ত।
হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় এ প্রসঙ্গে যে বক্তব্য পেশ করেছেন তার সারকথা হল, তিনি ইলহামের আলোকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হলেন যে, এখন শুধু কুরআন-হাদীসের বর্ণনার আলোকে দ্বীনকে ভক্তিমূলক বোঝা ও উপলব্ধি করার যুগ রয়নি। এ যুগে যুক্তি, বুদ্ধি ও দলীল-প্রমাণ দিয়ে বোঝার মানসিকতার জন্ম নিয়েছে। যুক্তি ও বুদ্ধির দাবী অগ্রাধিকার লাভ করতে শুরু করেছে। এমনকি লোকজন গায়েবী বিষয়সমূহকে যুক্তি ও বুদ্ধির নিক্তিতে মাপতে শুরু করেছে। তাই কুরআন-হাদীসের বর্ণনাকে যুক্তির মোড়কে উপস্থাপন করা না হলে এ যুগের বুদ্ধিপূজারী মানসিকতা আশ্বস্ত হবে না। তারা দ্বীনকে اِنْ هٰذَاۤ اِلَّاۤ اَسَاطِیْرُ الْاَوَّلِیْنَ অর্থাৎ এতো পূর্ববর্তীদের কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়-বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। ফলে দ্বীন থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে যাবে। এজন্য শাহ সাহেব রহ. ঐশী নির্দেশনার আলোকে এমন একটি চিন্তা-শিবিরের মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের সিদ্ধান্ত নিলেন, যারা রেওয়ায়েত ও বর্ণনা এবং যুক্তি ও বুদ্ধির সুসমন্বয়ের অধিকারী হবে। যাতে রেওয়ায়েত ও বর্ণনার আলোকে দ্বীন যেমন পূর্ণাঙ্গ প্রমাণিত হয় তদ্রুপ যুক্তি ও বুদ্ধির নিরিখেও পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিভাত হয়। আর এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিনি হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার মতো তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকরী গ্রন্থ রচনা করেন। যা দ্বারা এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, দ্বীন ও শরীয়তের এই অভিনব বর্ণনা ও উপস্থাপনা একান্ত ঐশী নির্দেশনা-প্রসূত ছিল, যা হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর হৃদয়ে প্রদত্ত হয়।
পাশাপাশি হযরত শাহ সাহেব রহ. দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন, দ্বীন বোঝানোর জন্য কোরআন-সুন্নাহর বর্ণনার পাশাপাশি যে সকল যুক্তি, রহস্য ও তাৎপর্যের উল্লেখ করা হয় সেগুলোর উপর দ্বীনের ভিত্তি নয়; দ্বীনের ভিত্তি হল শুধু আসমানী ওহী এবং বিশুদ্ধসূত্রে বর্ণিত হাদীস। আর এসব তাত্তি¡ক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল-প্রমাণ এবং যৌক্তিক উপকারিতা ও উপযোগিতা কেবল প্রতিপক্ষের দাবীকে খণ্ডন করা কিংবা বিরোধীপক্ষকে তার ভাষায় দ্বীন বোঝানো বা নিজের ব্যক্তিগত আশ্বস্তি লাভের জন্য; বিশ্বাস স্থাপন ও দ্বীনের মৌলিক উপস্থাপনার জন্য নয়।
উক্ত আলোচনা দ্বারা এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, রেওয়ায়েত ও বর্ণনানির্ভর দ্বীনকে যৌক্তিক দলীল-প্রমাণের মোড়কে পরিবেশন করা, আর তাকে এ যুগের যুক্তিপূজারী প্রজন্মের কাছে মানুষের স্বভাবজাত বিষয়রূপে পেশ করা এই ইলহামী চিন্তাশিবিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু হযরত শাহ সাহেব রহ. যেহেতু এসব হেকমত ও তাৎপর্যের স্বপক্ষে আয়াত ও হাদীস উপস্থাপন করেছেন সেহেতু এর দ্বারা কেবল ঐসব যুক্তিপূজারী ব্যক্তিই আশ্বস্ত হতে পারেন যারা কোরআন ও হাদীসের প্রতি ন্যূনতম আস্থা রাখেন, এ ধরনের হেকমত ও রহস্যের গুরুত্ব কিছুটা হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের ঈমানী-চেতনা এখনও বিলুপ্ত হয়নি। পক্ষান্তরে যার ঈমানীচেতনার মৃত্যু ঘটেছে তার জন্য বর্ণনা ও উপস্থাপনার এই শৈলী ও পদ্ধতি একেবারেই নিরর্থক। তাই যুক্তিপূজার সেই সূচনা-যুগে (যা ইংরেজদের ধর্মদ্রোহী ধ্যান-ধারণার সূচনা-যুগ ছিল) এই চিন্তাধারা ও উপস্থাপন-শৈলী কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু যুক্তিপূজার এ মানসিকতার শৈশব অতিক্রান্ত হয়ে যখন বুদ্ধিবৃত্তির ভরা যৌবন-যুগের সূচনা হল এবং ইংরেজরা গোপন ষড়যন্ত্র এবং ছল ও কৌশলের অবস্থান ছেড়ে খোলাখুলি প্রকাশ্য ময়দানে নেমে এল আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই প্রজন্মের রুচি ও মানসিকতার অধঃপতন হতে লাগল, দর্শনের সঙ্গে বিজ্ঞানের নবসংযোগের ফলে তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে রূপায়নের পথে ধাবিত হল; তখন নিছক যৌক্তিকতা ও তাত্তি¡কতাও উপেক্ষিত হতে শুরু করল। এমতাবস্থায় কোন বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত ও বর্ণনাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে তুলে না ধরে নিছক যৌক্তিক ও তাত্তি¡ক আঙ্গিকে উপস্থাপন করাটা তার গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদর হারিয়ে ফেলল। একে অন্য শব্দে এভাবেও ব্যক্ত করা যায়, প্রাচীন ইহুদী-মানসিকতা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, যা ইহুদীদের ঈমান ও আকীদাকে সম্পূর্ণ বিনাশ করে দিয়েছিল। আর ঐ মানসিকতার ¯েøাগান ছিল-‘যে বস্তু দৃষ্টিগ্রাহ্য নয় তার কোন অস্তিত্ব নেই।’ তাই তো ইহুদীরা নবী মূসা আ.কে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছিল-
لَنْ نُّؤْمِنَ لَکَ حَتّٰی نَرَی اللهَ جَهْرَۃً
আল্লাহকে প্রকাশ্যে না দেখা পর্যন্ত আমরা কিছুতেই তোমার প্রতি ঈমান আনব না।
তাদের এই ধ্যান-ধারণা ও মানসিকতার সারকথা এটাই যে, বুদ্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলোর স্থান ইন্দ্রিয় ও ইন্দিয়গ্রাহ্য বিষয়সমূহ দখল করে নিয়েছিল তাই তারা তাত্তি¡ক ও অতীন্দ্রিয় বিষয়সমূহকে (যা মূলত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অবলোকনের বিষয় এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ, আকৃতি ও অবয়বের ঊর্ধ্বে) চর্মচক্ষু দিয়ে দেখতে উদগ্রীব ছিল। তাদের এ দাবী ছিল সম্পূর্ণ স্বভাব ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ। এই ইহুদী-মানসিকতা মাথাচাড়া দেয়ার ফলে দ্বীন-ধর্মের মতো সূ², তাত্তি¡ক ও অতীন্দ্রিয় বিষয়ের বাস্তবতাকে মানুষের সম্মুখে উপস্থাপনের জন্য নিছক যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আঙ্গিক যথেষ্ট রইল না, বরং দ্বীনকে তাদের সম্মুখে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বসাধারণের বোধগম্য উদাহরণ দিয়ে পরিবেশন ও উপস্থাপন আবশ্যক হয়ে পড়ল।
যুক্তি ও বুদ্ধিপূজার সূচনাকালে যেমন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. খোদায়ী নির্দেশনার আলোকে দ্বীন ও শরীয়তের বর্ণনা ও উপস্থাপনার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল-প্রমাণ পেশকরণ পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেন, তদ্রুপ এই ইন্দ্রিয়পূজার যুগের সূচনাকালে তারই ইলমী চতুর্থ অধঃস্তন পুরুষ হযরত শাহ আব্দুল গনী রহ. যুগ ও সমাজের এই প্রবণতা লক্ষ করে দ্বীন-ধর্মের বর্ণনা ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথা সর্বসাধারণের বোধগম্য উদাহরণ দিয়ে উপস্থাপন করার শৈলী ও ভঙ্গি অবলম্বন করেন। যদিও তার ব্যবহারিক প্রয়োগের সূচনা হয় আরও পরে। দ্বীনের বর্ণনা ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. যৌক্তিক উপকারিতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক তাৎপর্যকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। আর তার ইলমী অধঃস্তন এবং চতুর্থ প্রজন্মের সুযোগ্য উত্তরসূরী ও খাছ শাগরিদ হযরত শাহ আব্দুল গনী রহ. তার সঙ্গে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথা সর্বসাধারণের বোধগম্য উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপনার পদ্ধতিকে শামিল করে নেন, যা সেই একই খোদায়ী নির্দেশনার ফল ও ফসল ছিল।
কিন্তু এটিও এমন রীতি, যা আয়াত ও রেওয়ায়েতের হেকমত ও রহস্য বুঝতে সহায়ক হিসেবে কাজ করত যাদের ঈমানী চেতনা ও অনুভূতির চূড়ান্তমৃত্যু ঘটেনি, এমন লোকদের জন্য অত্যন্ত কার্যকর ও উপকারী হত। দলীল-প্রমাণ উপস্থাপনের এই রীতি এমন ছিল না, যা চরম বিরোধী ও হঠকারীদের (যারা আয়াত ও হাদীস এমনকি দ্বীন-ধর্মের নাম শুনতেই নাক ছিটকায়) নত করে ফেলতে পারে। এ জন্য দরকার ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে আয়াত ও হাদীসের কথা আলোচনা করা ছাড়াই মানুষের সম্মুখে দ্বীনকে দার্শনিক পদ্ধতিতে সর্বসাধারণের বোধগম্য ইজম বা মতবাদের আঙ্গিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যাতে কোরআন ও হাদীস এবং এর স্বপক্ষে যৌক্তিক দলীল ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণাদি উল্লেখ করা ছাড়াই ইসলাম তাদের সামনে একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন ও মতবাদ আকারে প্রতিভাত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রোতাকে ঘুণাক্ষরেও একথা বুঝতে না দেওয়া যে, তার সম্মুখে কোন আসমানী দ্বীন পেশ করা হচ্ছে, বরং সে যেন একথা ভাবতে বাধ্য হয় যে, এটি একটি প্রাকৃতিক ও স্বভাবজাত দর্শন বা জীবনবিধান। একে গ্রহণ করা ছাড়া মানুষ স্বীয় জীবন ও সমাজকে কখনও সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ করতে পারবে না। আর যখন তার যুক্তি ও বুদ্ধি একে গ্রহণ করে নেবে তখন তার কাছে আসল বিষয় প্রকাশ করা হবে যে, এটিই সেই মহান ধর্ম ইসলাম যার নাম শুনেই তোমরা নাক ছিটকাও। এজন্যই এ যুগের রূহানী ও আত্মিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য এই ওয়ালিউল্লাহী ঘরানার পঞ্চম প্রজন্মের এক সুযোগ্য সদস্য যুগের দাবী ও চাহিদা মেনে নিয়ে ইসলামকে একটি নিখুঁত ও সর্বজনমান্য ইজম ও মতবাদরূপে পেশ করেছেন, যার প্রাথমিক শিরোনাম ধর্মও নয়, গায়েবী বিষয়ও নয়। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে সেই দ্বীন, সেই আকীদায়ে গায়েব; তবে তা উপস্থাপিত হচ্ছে এমন পন্থায় যেন তা এক নিরেট দার্শনিক মতবাদ, যা গ্রহণ করা ছাড়া এখনকার সমাজব্যবস্থা সঠিক পথে চলতে পারে না। রাজনীতি, নাগরিক জীবন, মৃত্যুপরবর্তী জীবন-কোনটাই এছাড়া সফল ও সার্থক হতে পারে না। এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিনি দৈনন্দিন জীবনের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সাধারণ সাধারণ উদাহরণ ও সর্বজনবোধ্য যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা জটিল বুদ্ধিগত বিষয়ের সমাধান প্রদানের এক নতুন দর্শনের গোড়াপত্তন করেন। আমরা সেই মহান ব্যক্তিকে কাসিম নানুতবী নামে স্মরণ করি, যিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ., শাহ আব্দুল আযীয রহ., শাহ মুহাম্মদ ইসহাক রহ. এবং শাহ আব্দুল গনী রহ. এর ইলম ও প্রজ্ঞার সারনির্যাস ছিলেন। যে আমানত তিনি ওয়ালিউল্লাহী ঘরানা থেকে গ্রহণ করেছিলেন তা এই যুগের দাবী অনুযায়ী অত্যন্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ রীতি ও শৈলীতে বিশ্ববাসীর সম্মুখে পেশ করে দিয়েছেন।
যা-ই হোক, একই খোদায়ী নির্দেশনা যখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. লাভ করলেন তখন তিনি দ্বীনের বর্ণনা ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তাত্তি¡ক রীতি গ্রহণ করলেন। যখন শাহ আব্দুল গনী রহ. প্রাপ্ত হলেন তখন তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার রীতি ও আঙ্গিককে গ্রহণ করলেন, যা ঈমানী চেতনার উপর নির্ভরশীল ছিল। যখন কাসেম নানুতবী রহ. প্রাপ্ত হলেন তখন তিনি মানসিকতানির্ভর পন্থার পরিবর্তে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সাধারণ উদহরণ এবং নিরেট যৌক্তিক প্রমাণ উপস্থাপনের রীতি গ্রহণ করলেন। যুগের প্রবণতা ও মন-মানসিকতার পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই ইলহামী বর্ণনা ও উপস্থাপনা-শৈলীতে রূপান্তরের কাজ অব্যাহত রইল। তবে কাসেম নানুতবী রহ. যেহেতু তাঁদের সকলের জ্ঞানের উত্তরসূরি ছিলেন, তাই তিনি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মতাদর্শের অন্যতম বিশ্লেষক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি জায়গায় জায়গায় এই মতাদর্শকে কোথাও তাত্তি¡ক আঙ্গিকে, কোথাও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও সর্বজনবোধ্য রীতিতে, কোথাও স্বতঃসিদ্ধ প্রামাণিক পদ্ধতিতে স্বীয় পাঠন ও অধ্যাপনা এবং রচনা ও বক্তৃতার মাধ্যমে প্রচার করে গেছেন, যার ফলে এই মতাদর্শ বিশ্ববাসীর সম্মুখে অত্যন্ত সারগর্ভ ও সুসমৃদ্ধ আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে।
অপরদিকে ১২৭৪ হিজরী মোতাবেক ১৮৫৭ সনে শামেলীর যুদ্ধে অংশগ্রহণের অপরাধে ইংরেজরা মুসলমানদের উপর যেমন সীমাহীন নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়েছিল তেমনি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং মুসলমানদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ধ্বংসে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। তখনকার আল্লাহওয়ালাগণ, বিশেষত ঐ বুযুর্গগণ, যারা এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বহু মুসলমানের মৃতদেহকে রক্তমাখা অবস্থায় পথে প্রান্তরে গড়াগড়ি খেতে দেখেছিলেন তারা এ ভাবনায় বিচলিত হলেন যে, ইলম ও মা’রেফাতের এই মিশনের ঠিকানা ও স্থায়ী আবাস কোথায় হবে? সহায়-সম্বলহীন ভারতবর্ষের মুসলমানদের দ্বীন ও ঈমানের সুরক্ষার জন্য কী কর্র্মপদ্ধতি অবলম্বন করা যায়? ঘটনাক্রমে তখন এই কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনার জন্য দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে।
আলোচ্য মনীষীদের অধিকাংশ সময় এই আলোচনা ও পর্যালোচনায় অতিবাহিত হতে লাগল। দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনার পর তখন যে মৌলিক সিদ্ধান্ত স্থির হয়েছিল তা হল- মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি চাঙা রাখার জন্য এবং তাদের ধর্মীয় ঐক্য অটুট রাখার লক্ষ্যে একটি খালেছ দ্বীনী-ইলমী প্রতিষ্ঠান কায়েম করা অবশ্যম্ভাবী। এই মৌলিক চিন্তার পর হযরত নানুতবী রহ. ও তাঁর বিশিষ্ট সহচরবৃন্দ অর্থাৎ হযরত মাওলানা যুলফিকার আলী রহ., হযরত মাওলানা ফজলুর রহমান রহ. এবং হাজী আবেদ হুসাইন রহ. সম্মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, এ পরিস্থিতিতে দ্বীনী বিদ্যাপীঠ দিল্লীর পরিবর্তে দেওবন্দে প্রতিষ্ঠা করা উচিত। কারণ, ১২৭৪ হিজরী মোতাবেক ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে শামেলীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পূর্বে যদিও রাজধানী দিল্লীই ইলম ও জ্ঞানের মারকায ও কেন্দ্রভূমি ছিল, কিন্তু বিপ্লবের পর দিল্লী উজাড় হয়ে গিয়েছিল, তার রাজনৈতিক প্লাটফর্ম লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। ফলে রাজধানী দিল্লী তার কেন্দ্রীয় গুরুত্বও হারিয়ে ফেলেছিল। অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে দেওবন্দেই দারুল উলূমের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বলাবাহুল্য, স্বীয় যুগে কাসেম নানুতবী রহ. যখন দারুল উলূম দেওবন্দের মৌলিক চিন্তাধারার রূপকার ছিলেন তখন দারুল উলূমের মতাদর্শের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই সে ইলহামী নির্দেশনার শান ও ছাপ পুরোপুরি প্রতিফলিত ছিল যা হযরত নানুতবী রহ. হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ থেকে আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেওবন্দিয়্যত নিছক পঠন-পাঠন বা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার নাম নয়, বরং একটি স্বতন্ত্র ‘মাকতাবে ফিকির বা চিন্তাশিবির’ এর নাম।
দারুল উলূম দেওবন্দের প্রাতিষ্ঠানিক ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি
হযরত মাওলানা কারী তৈয়ব সাহেব রহ. দারুল উলূম দেওবন্দের প্রাতিষ্ঠানিক ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘তারীখে দারুল উলূম’ গ্রন্থের ভূমিকায় এভাবে উল্লেখ করেছেন-
ক. মাযহাব ও ধর্মপরায়ণতা : দারুল উলূম দেওবন্দ ধর্মীয় শক্তির আকর। আপাদমস্তক ইসলামী আইন ও সংবিধানের অনুগত। এ কারণেই এখানকার প্রতিটি সদস্য ইসলামের আদর্শ নমুনা।
খ. আযাদী ও স্বাধীনতা : যার অর্থ হল, দারুল উলূম বহিরাগত হানাদারদের গোলামী ও পরাধীনতার ঘোরবিরোধী। এর ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা-দীক্ষা, আর্থিক সংস্থান ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ স্বাধীন। এটিই বিশ্বের সর্বপ্রথম বিদ্যাপীঠ যাকে রাষ্ট্র ও হুকুমত বারংবার বড় অঙ্কের আর্থিক অনুদান গ্রহণ করার প্রস্তাব পেশ করেছে কিন্তু সে বারংবারই তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
গ. সরলতা ও কষ্টসহিষ্ণুতা : এর অর্থ হল, এখানকার উলামা-ফুজালা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ জীবন-সংগ্রামে বড় থেকে বড় ও কঠিন থেকে কঠিন পরিস্থিতি ও মসিবত সহ্য করতে অভ্যস্ত।
ঘ. উন্নত স্বভাব-চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা : এখানকার শিক্ষার্থীগণ ঐ উন্নত স্বভাব ও আদর্শের ধারক-বাহক হবে যা তারা বড়দের থেকে প্রাপ্ত হয়েছে। এই উন্নত স্বভাব-চরিত্র আপাদমস্তক রূহানী ও আত্মিক।
ঙ. পঠন-পাঠন ও অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় নিমগ্নতা : এটি দারুল উলূমের এমন এক বৈশিষ্ট্য যা দারুল উলূমের দর্শনার্থীরা প্রথম দৃষ্টিতেই আঁচ করতে পারবে। এটি বলারও বিষয় নয়। শোনারও বিষয় নয়। দারুল উলূমের প্রতিটি গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে তার জীবনের পাতায় সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করা যায়। এ কারণেই দারুল উলূম দেওবন্দে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের শিক্ষার্থী বিদ্যমান। দারুল উলূমের শিক্ষক ও উস্তাদবৃন্দ বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক ও উস্তাদবৃন্দের কাতারে গণ্য। দারুল উলূমের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত কর্মী ও খাদেমগণ ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কোরবানীর জীবন্ত নমুনা। বিশ্বের সমস্ত মুসলমান তাদের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চল থেকে দারুল উলূমের জন্য আর্থিক চাঁদা ও অনুদান গ্রহণ করা হয়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.