![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুনিয়ার যে সব বিষয় আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে সেসবের মধ্যে মৃতব্যক্তির সমাধি অন্যতম। খুব ছোটবেলা যখন থেকে আমি বাড়ির বাইরে কোথাও যাওয়া শুরু করি তখন অনেক সময়ই আমার এ যাওয়াটা হত আমার দাদাজির সাথে। তিনি ছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের একজন খ্যাতনামা আলেম, সামাজিক অভিভাবক ও আধ্যাত্মিক মুরব্বি। জামিয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন প্রিন্সিপাল, শায়খুল হাদীস আল্লামা আহমদ আলী খান রহ. একাধারে একজন বলিষ্ঠ শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, পীর ও মুর্শিদ এবং অভিজাত লোকপ্রিয় মুরব্বি ছিলেন। দাদাজি সাধারণত তাঁর ভক্ত অনুসারী ও সম্পর্কিতজনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তালীম, তারবিয়াত ও ইসলাহী কাজেই কোথাও যেতেন। তাঁর সাথে যাওয়ার সুযোগটি বড় নাতি হিসেবে আমি প্রায় সব সময়ই নিতাম। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্পন্ন গৃহস্থের ঘর-বাড়ি, বাগান, ফসলের ক্ষেত আমাকে টানত। আমার মনে আছে, একদিন রিক্সায় যেতে যেতে শহরতলির দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত ফুঁড়ে যখন সকালের লাল সূর্যটি উদিত হচ্ছিল তখন আমি জীবনের প্রথম ডিমের কুসুমের মত নতুন সূর্যটি উদয় হতে দেখি। সূর্যকে ডিমের কুসুম কথাটি সেদিনই আমি বলেছিলাম আর দাদা খুব হেসেছিলেন। মফস্বল শহরে, গ্রামে যেখানেই যেতাম মসজিদের পাশে বা বাড়ির আশপাশে চিহ্নিত কবর দেখে আমার মনে বিষণ্নতা তৈরি হত। যেসব বাঁধানো কবরে মৃতের নাম, জন্ম, মৃত্যুতারিখ ইত্যাদি লেখা থাকত সেসব আমাকে আরো ভাবিত করত। কিছু কবরে হয়তো এপিটাফ ধরনের কিছু লেখা থাকত সেসব আমাকে আরো বেশি করে ছুঁয়ে যেত।
একবার কোন এক কবরে লেখা দেখতে পেলাম, ‘পথিক ভাই! এখানে একটু দাঁড়াও, ভেবে দেখ আমিও একদিন তোমার মতই ছিলাম।’ আমাদের দেশের বাড়ি কিশোরগঞ্জ এলাকায় কবর পাকা করার নিয়ম পরবর্তীতে আলেমগণ নিরুৎসাহিত করেন। শরীয়তে এটাই নিয়ম। আরব দেশগুলোতে কবরের ক্ষেত্রে প্রকৃত সুন্নাহ অনুসরণ করা হয়। পাকিস্তান ও ভারতের মত সমাধি তৈরির রেওয়াজ সেখানে নেই বললেই চলে। দু-চারটি পাকা কবর যা আমার ছেলেবেলায় নিজ এলাকায় দেখেছি সেসব তুলনামূলক ধনী কৃষক ও ব্যবসায়ী পরিবার তাদের বিশিষ্টতা বোঝানোর জন্য করত। বলা হত, এটি জমিদার বাড়ি, এটি সাহেব বাড়ি, এটি বেপারি বাড়ি ইত্যাদির পূর্বপুরুষের কবর। কিশোরগঞ্জ শহরে আমাদের বাড়ির খুব কাছেই দারোগা বাড়ি। বৃটিশ পিরিয়ডে দারোগা পদে নিযুক্ত একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম ব্যক্তি অবসর জীবনে কিশোরগঞ্জ শহরে একটি সুন্দর বাড়ি করেন। এর দ্বিতল ভবন, বিস্তীর্ণ বাগান ও নানা রকম বাহারি ফুল, পাতা, লতা, ঝাড় ও অর্কিড ছিল স্বপ্নের মত সুন্দর। বাগানের শুরুতে সড়কের পাশেই ছিল বর্ণিত দারোগা সাহেবের কবর। শ্বেত পাথরে ঢাকা ও চারপাশে শ্বেত-শুভ্র দেয়াল, নেটের পেছনে অতিকায় সাদা পাথরে বিবৃত কোন বর্ণনা বা বাণী দারোগা সাহেবের কবরটিকে সমাধিতে রূপান্তরিত করে রেখেছিল। ছোটবেলায় আমি সে বাসায় গিয়েছি, বাগান ও সমাধিটি দেখেছি। ইংরেজিতে লেখা এপিটাফ পড়ার মত বড় তখনও হইনি।
দাদাজির সাথে যখনই আমি কোথাও যেতাম কথা-বার্তা, কর্মসূচী, দোয়া-মোনাজাত, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই বড়রা যখন করতেন আমিও তাদের সাথে যথাসম্ভব যোগ দিতাম। কিন্তু বাড়ির সামনের, মসজিদের পাশের কিংবা বাগানের ধারের কবরটি আমাকে, আমার চিন্তাকে অনেকখানি দখল করে রাখত। মনে হত, এখানে শুয়ে থাকা মানুষটি কতইনা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। হয়তো এ বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, প্রধান ছিলেন। সবচেয়ে প্রভাবশালী ও দাপুটে ছিলেন। নির্ধারিত সময়ে আল্লাহর হুকুমে তিনি চলে গিয়েছেন। এখন তার সম্পদ, সন্তান ও স্মৃতি রয়ে গেলেও গুরুত্বপূর্ণ সে মানুষটি আর নেই। আর এটিই হচ্ছে প্রতিটি মানুষের অবধারিত ভাগ্য। ভাবতাম, এমন অনিবার্য পরিণতি জেনেও মানুষ কী করে দীর্ঘ আশার পথ ধরে লক্ষ্যহীন যাত্রা চালিয়ে যায়। কোথাও এ লাইনটি শুনেছি বলে মনে পড়ে, ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে।’
একসময় আমাদের অঞ্চলে কবর তৈরি হত কেবল সিন্দুকী স্টাইলে। এতে কবর অরক্ষিত থাকত। বর্ষায় কবরে পানি ঢুকত। পাড় ভেঙ্গে নতুন কবর ধ্বংস হয়ে যেত। বাঁশগুলো অনেক উপরে বিছানোয় গোটা কবর খালি পড়ে থাকত, সম্পূর্ণ মাটি ঢিবি হয়ে জমে থাকত উপরে। আর স্তুপীকৃত মাটির চাপে বাঁশ ভেঙ্গে বা পাড় ধসে কবরের বুক দেবে যেত। দীর্ঘদিন ধীরে ধীরে লাশটি নির্বিঘ্নে থেকে মাটিতে মেশার সুযোগ পেত না। দ্রুতই মাটিচাপা পড়ত। তাছাড়া, বগলি স্টাইলের কবর মানুষ চিনতও না। যাতে মাটিচাপা বা ধসের সম্ভাবনা থাকেই না। বিশেষ করে মৃতব্যক্তিকে কিবলামুখী করার কাজটি করা হত না বললেই চলে। মৃত্যুর সময় বা গোসলের সময় যারা নিজ থেকেই কিবলামুখী হয়ে যান তাদের তো কথাই নেই কিন্তু যারা অন্য পজিশনে মৃত্যুবরণ করেন তাদের কিবলামুখী করার ব্যবস্থা কী? এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে, সুন্নত মোতাবেক কবর তৈরি আর মৃতব্যক্তিকে পূর্ণ কিবলামুখী করে শোয়ানো।
ছাত্রজীবনে আমরা কবর তৈরি ও মৃতকে শোয়ানোর সঠিক পদ্ধতি লিখে, নকশা এঁকে লিফলেট বিলি করেছি। অনেক জায়গায় হাতেকলমে মানুষকে কবর তৈরি ও দাফন শিখিয়েছি। আমার দাদীর কবরে (১৯৯০ ঈ.) নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করে হাজারো মানুষকে বিষয়টি বুঝিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ, বর্তমানে অঞ্চলের প্রায় সকল কবর নিরাপদ পদ্ধতিতে খনন করা হচ্ছে, মৃতকেও পূর্ণ কিবলমুখী করার চেষ্টা সফল হয়েছে। আমার আব্বার কবর (২০০৮ ঈ.) সম্পূর্ণ সুন্নত মোতাবেক করা হয়েছে, কিবলার বিষয়টিও ছিল খুবই সন্তোষজনক ও আনন্দকর। গত ত্রিশ বছর আমাদের পরামর্শমতে যত কবর তৈরি হয়েছে সর্বত্রই আমরা কর্মীদের সুন্নতের অনুসরণে আনতে সক্ষম হয়েছি। পাঠকের জানার জন্য এখানেও বিষয়টি সহজ ভাষায় বর্ণনা করতে চাই-
ক. সোজা কবর খুঁড়ে নীচে চলে যাবেন। পরে একপাশে লাশ পরিমাণ আরেকটি গর্ত তৈরি করে মৃত ব্যক্তিকে সেখানে রাখা হবে। গর্তের দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে মৃতের বুক ও মুখ সম্পূর্ণ কেবলামুখী করে দিতে হবে। এরপর লাশের গর্তটির মুখে খাড়া করে বাঁশ রেখে রেখে কোনাকুনি কবরটি ভরে দিতে হবে। এরপর চাটাই ইত্যাদি দিয়ে গোটা কবরটি মাটি দিয়ে ভরাট করে দিলে বহুদিন কবরটি অক্ষত ও লাশ নিরাপদ থাকবে। ধীরে ধীরে লাশ প্রকৃতির নিয়মে মাটিতে মিশে যাবে। কবর ধস, পানি ঢোকা, ভাঙ্গা, চাপামাটি দিয়ে ভরাট করা বা লাশ বিনষ্ট হওয়ার কোন ঘটনা ঘটবে না। এ পদ্ধতির নাম বগলি কবর, আরবীতে যাকে লাহাদ পদ্ধতি বলে।
খ. সোজা সিন্দুকের মত কবর খনন করে (যেমনটি বাংলাদেশে সাধারণত করা হয়) বাঁশের মাথাগুলো রাখার তাকটি লাশের সামান্য উপরে করা, যেন কবরের ভেতরের ফাঁকাটি খুব কম থাকে। অনেকটা লাহাদ কবরের মত। আর কবরের নীচে লাশ পরিমাণ একটি নালার মত খনন করা। এতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মৃতের মুখ ও বুক পূর্ণ কিবলামুখী করে শুইয়ে দেয়া। ফুট-দেড়ফুট উপরের তাকে বাঁশ রাখতে রাখতে কবর ঢেকে দেয়া। এরপর চাটাই ইত্যাদি বিছিয়ে পূর্ণ সিন্দুকটিই মাটি দিয়ে ভরে দেয়া। যাতে খননকৃত কবরের অন্তত ৮০ ভাগ জায়গা মাটিতে পূর্ণ হয়ে যায়। উপরে মাটির বড় স্তুপ থাকবে না বরং কবরের বুক ও মাথার দিকে সামান্য উঁচু করে রাখা যায় কবরটি চিহ্নিত করার জন্যে, যার পরিমাণ উটের শেষ কুঁজটুকুর মত। অনেক সময় সমান কবরের মাথার দিকে একটি পাথর রেখে দিয়েও চিহ্ন দেয়া হয়। বাঁধানো বা পাকা স্থাপনা না করাই শরীয়তের নির্দেশ। প্রয়োজনে অস্থায়ী বেড়া দেয়া যায় তবে না দেয়াই উত্তম।
কিশোরগঞ্জে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, কবরস্থান ইত্যাদি গণমুখী কাজকর্ম ছিল আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ। ছোটবেলা দেখেছি, হঠাৎ উদ্যোগ নেয়া হল এলাকাবাসীর জন্য একটি কবরস্থান করা হবে। নাম দেয়া হল ‘বাগে জান্নাত’। স্টাডিরুমে বসে আব্বা একটি প্রচারপত্র ড্রাফট করলেন, যার শিরোনাম ছিল ‘অবশেষে কবরেই যেতে হবে’। শোলাকিয়া, পুরানথানা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য একটি কবরস্থানের প্রয়োজনীয়তার কথা বর্ণনা করে মুক্ত হস্তে দান করার আবেদন ছিল প্রচারপত্রে। একটি ফার্সি কবিতা দিয়ে শেষ হয়েছিল সেটি যা এতবছর পরও আমাকে সমানভাবে স্পর্শ করে। আব্বা লিখেছিলেন,
دو چیز آدمی را کشد بزور / یکے آب دانہ دیگر خاک گور
দুটো জিনিষ মানুষকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হয়, এ দুটো মানুষকে অনুসরণ অথবা আকর্ষণ করে, এক. খাদ্য ও পানীয়। দুই. কবরের মাটি।
একটু বড় হয়ে ঢাকায় চলে আসি। কর্মোপলক্ষে কিছুকাল চট্টগ্রামেও কাটাই। নানা অবসরে দুনিয়ার বহু জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়। দেশের ভেতরে বহু শাসক, নবাব, জমিদার, নেতা, সমাজপতি, সওদাগর ও বিখ্যাত ব্যক্তির কবর দেখতে পাই। অনেক আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ ও জ্ঞানতাপসের কবর জিয়ারত করি। সব সময়ই কবর দেখা ও জিয়ারত করার সময় আমার বাল্যবেলার সেই অনুভূতিটুকু আরো প্রগাঢ়, বিস্তারিত ও পল্লবিত হয়ে আমাকে নাড়া দেয়।
ঢাকার বিখ্যাত ব্যক্তি শিফাউল মুলক হাকিম হাবিবুর রহমান খান তার আসুদেগানে ঢাকা গ্রন্থে এমন অনেক বিশিষ্টজনের জীবনী আলোচনা করেছেন যাদের অন্তিম শয়ান ঢাকায় রচিত হয়েছে। মরহুম হাকিম সাহেবের পুত্র হাকিম ইরতিজাউর রহমান খান আখুনযাদাহ থেকে এর এক কপি আমাদের পারিবারিক গ্রন্থাগারে আসে। পরবর্তীতে বইটি হারিয়েও যায়। এর বঙ্গানুবাদ ঢাকায় যারা সমাহিত নামে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকায় সন্তান কর্তৃক মা-বাবার কবর জিয়ারতের রেওয়াজ নেই বললেই চলে। সিলেট ও চট্টগ্রামে এই রীতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। সিলেটে দরগা মাদরাসা ও মসজিদ সংলগ্ন টিলা ও সমতলে বিস্তৃত যে কবরস্থান রয়েছে সেখানে বিশেষ করে জুমার দিন মৃতব্যক্তির সন্তান, আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক জিয়ারত করতে দেখা যায়। চট্টগ্রামেও শহর, শহরতলি ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাদ জুমা লোকেদের দল বেঁধে নিজ নিজ বাবা-মা, দাদা-দাদি ইত্যাদি আত্মীয় স্বজনের কবর জিয়ারত করতে দেখা যায়।
লখনৌ-দিল্লি-আগ্রায় বিখ্যাত লোকেদের কবর ও সমাধিক্ষেত্রে যতবার গিয়েছি আমার মনে তাদের জীবন্ত গাথা, কাহিনী, ভাব, জৌলুস ও চর্চিত ইতিহাস আর বর্তমান অবস্থার বৈপরিত্ব খুবই দাগ কেটেছে। আমি সময়ের বিবর্তন ও অবস্থার পরিবর্তন দেখে গভীর ভাবনায় ডুবে গেছি। রেঙ্গুন থেকে লাহোর পর্যন্ত কত যে রাজা-রাণী, নবাব-বেগম, যোদ্ধা ও সৈনিকের সমাধিপাশে আমার দাঁড়াবার সুযোগ হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল। শেষ মুগলসম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ, নবাব শায়েস্তা খানের কন্যা পরি বিবি, মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবার, কলকাতা-হুগলি-লখনৌর বিশিষ্টজন, নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ, নবাব আসাফুদ্দৌলা, বেগম হযরত মহল, দিল্লি, ফতেহপুর, আগ্রা ও আজমিরের অসংখ্য মাকবারা জিয়ারতের অনুভূতি অবিস্মরণীয়। এসবই যেন পার্থিব জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা ও বাস্তবতা বিবর্জিত মোহ মায়ারই প্রমাণ। বিশিষ্ট কারো কবরে যাওয়া মানে কবির ভাষায়, ‘হৃদয় খুঁড়ে ব্যথা জাগানো।’
চিনের একটি শহরে বিশাল উদ্যান পার হয়ে নীরব বনাঞ্চল ঘেঁষে একই সাথে সাতটি কবর, যেগুলোর পরিচয় স্থানীয় লোকেদের কাছে স্পষ্ট নয়। যে কোন কারণে মনে হয়েছিল এ কবরগুলি মুসলমানদের। হতে পারে মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের। কেননা, গাইড এদেরকে বিদেশ থেকে আগত সাধুসন্ত বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাজমহল যদিও সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম কিন্তু মূলত এটিও একটি কবর। অনেকেই উপরের মর্মরগাঁথা সমাধি দেখে এটিকেই কবর মনে করেন। তবে সিঁড়ি দিয়ে তাজমহলের তেহ্খানা বা ভূগর্ভস্থিত মূল মাটিতে নেমে গেলেই সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের আসল কবর পাওয়া যায়। বর্তমানে সেদিকে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাজমহল দেখতে এসে এক ইংরেজ সাহেবের পত্নী তার স্বামীকে বলেছিলেন, তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাস? জবাবে সাহেব বলেছিলেন, বাদশাহ শাহজাহানের চেয়ে কম নয়। তখন স্ত্রী জানতে চাইলেন, যদি তা-ই হয় তা হলে আমার সমাধির উপর তুমি কি একটি তাজমহল তৈরি করতে রাজি হবে? সাহেব বললেন, এমন একটি কাজ কেবল একজন মুগলসম্রাটের পক্ষেই সম্ভব। স্ত্রী তখন বলেছিলেন, এত বড় সাম্রাজ্যের মালিক হয়েও ইংরেজরা কেন মুগলদের মত একটি প্রাসাদ দুর্গ বা সমাধিও তৈরি করতে পারল না? মুসলিম শাসকরাই কি কেবল এসব করতে সক্ষম? যদি আমার স্বামী আমার সমাধির উপর তাজমহলের মত একটি সমাধি তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দেন তা হলে এই মুহূর্তে আমি মরতে প্রস্তুত। অবশ্য বাদশা শাহজাহান ও মমতাজের পুত্র দরবেশ সম্রাট বাদশা আলমগীর তাজমহলের নির্মাণকে কখনোই ভালো চোখে দেখেননি। তিনি একে একটি অর্থহীন অপব্যয় হিসাবেই মনে করতেন। আধুনিক ভারতের এক কবি বলেছেন,
اک شہنشاہ نے دولت کا سہارا لے کر
ہم غریبوں کی محبت کا اڑایا ہے مذاق
میری محبوب! کہیں اور ملا کر مجھ سے
হে প্রিয়! তাজমহলে নয় তুমি আমার সাথে অন্য কোথাও দেখা করতে এসো। কেননা, এটি সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে একজন দাম্ভিক শাসক জনগণের সম্পদ যথেচ্ছ ব্যয় করে নিজের মৃত স্ত্রীর স্মৃতি সমুজ্জ্বল রাখার চেষ্টা করেছেন বটে তবে তার এ উদ্যোগ মূলত তোমার আমার মত দরিদ্র জনগণের প্রেম ভালোবাসা স্মৃতি ও সান্নিধ্যের প্রতি করুণ উপহাস ছাড়া আর কিছু নয়।
সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের কবরে তার নিজের রচিত ফার্সি কবিতার দুটি পংক্তি লেখা রয়েছে। যার বাংলা তরজমা নীচে দেয়া হল,
بر مزارِ ما غریباں نے چراغے نے گلے
نے پرِ پروانہ یابی نے سراید بلبلے
গরীব গোরে দীপ জ্বেলোনা
ফুল দিওনা কেউ ভুলে
পতঙ্গরা প্রাণ না হারায়
দাগা না খায় বুলবুলে।
আল্লামা ইকবাল তার মায়ের মৃত্যুতে যে শোকগাঁথা কাব্য রচনা করেছিলেন এর একটি লাইন এমন,
آسماں تیری لحد پر شبنم افشانی کرے
سبزہء نورستہ اس گھر کی نگہبانی کرے
আকাশ আমার মায়ের কবরে শিশির বর্ষণ করতে থাকবে, সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি করবে তার সৌন্দর্যের পরিচর্যা।
লখনৌর নবাবদের কবর তো নয় যেন সুরম্যপ্রাসাদ, টিলার সমান উঁচু, মজবুত পাথরে তৈরি নকশা কারুকাজ সম্বলিত প্রাসাদোপম অট্টালিকা। দিল্লি জামে মসজিদের সিঁড়ির পাশে ইমামুল হিন্দ মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কবর। কিছু দূরে উর্দুর প্রখ্যাত কবি মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিবের সমাধি। বাদশা হুমায়ুনের মাকবারা, খাজা নিজামুদ্দীন সুলতানুল আউলিয়ার মাজার, খাজা কুত্বুদ্দীন বখতিয়ার কাকি, খাজা নাসিরুদ্দীন চেরাগ রহ. প্রমুখের মাজার। মৌলানা আজাদ মেডিকেল কলেজের চৌহদ্দিভুক্ত হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ. ও তাঁর খান্দানের কবর। লাহোরে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের কবর ছাড়াও ফোর্ট ও শাহী মসজিদ, মহাকবি আল্লামা ইকবালের কবর বিশেষ আকর্ষণীয়। হাজার বছর আগের দাতা সাহেব আবুল হাসান আলী হুজবিরী তো আছেনই। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মাইনর থেকে ভারতবর্ষে আগমনের দিকনির্দেশক লাহোরের ঐতিহাসিক চৌবুর্জি থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত বিশাল কবরস্থানের কথা কি ভোলা যায়? শত শত বছরের জানা-অজানা মুসলিম নারী-পুরুষের শেষ আরামগাহ এই বিশাল গোরস্তান যেন দর্শনার্থীদের বুকে শান্তির শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। মাওলানা আহমদ আলী লাহোরী, মাওলানা উবায়দুল্লাহ আনোয়ার ও তাঁদের পরিবারবর্গের কবর জিয়ারত স্মরণীয়।
ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, জর্দান ও মিশরে কবরস্থান হয় খুবই সাদামাটা। কোন কোন কবর পাথুরে জায়গায় হয় বলে লাশ নষ্ট হয় না। মরুর উত্তাপেও লাশ শুকিয়ে যায়। ক’বছর পর আলাদা বালি দিয়ে ঢেকে পুনরায় ওখানে নতুন করে কবর দেয়া হয়। সিরিয়ার একটি কবরে লেখা, ভাই! তুমি আজ যেখানে গতকাল আমি ছিলাম সেখানে, আগামী দিন আমার মত তুমিও চলে আসবে এ জায়গায়। সময় কাজে লাগাও, আল্লাহর ইবাদত কর, পরকালের সম্বল সংগ্রহ কর।
আমার জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক নূর মন্জিলের সামনে দাদা, দাদি ও আব্বাজির কবর। মন আমার ওখানেই পড়ে থাকে সারাক্ষণ। কিন্তু যাওয়া হয় অনেক কম। দুনিয়া জুড়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। তন্মধ্যে যেমন, সরহিন্দে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমদ সরহিন্দীর কবর জিয়ারত আধ্যাত্মিক সচেতন মানুষের জন্য নেয়ামতস্বরূপ। দেওবন্দের মাকবারায়ে কাসেমী জিয়ারতে যে আবেগ সঞ্চারিত হয় তা অভিজ্ঞরাই বুঝবেন। শ্রীলঙ্কার শায়খ খামিস সোহাইল সালেহের কবর, যিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমার মেজবান হতেন। আবুধাবিতে জিয়ারত করেছি তাবলীগের মুরব্বী মাওলানা লুৎফুর রহমান সাহেবের কবর। ঢাকার লালবাগ শাহী মসজিদের মাকবারায় বড় বড় আলেম। চকবাজার শাহী মসজিদ সংলগ্ন কবর হযরত হাফেজ আহমদ রহ.-এর, যিনি হাদিয়ে বাংলা মাওলানা কারামত আলী জওনপুরীর পুত্র। মাওলানা কারামত আলী জওনপুরীর কবর রংপুরে। ঢাকার যাত্রাবাড়ি মাদরাসায় কিছু বুযুর্গ শায়িত রয়েছেন, যারা ইলম ও কামালে অবিস্মরণীয়। কামরাঙ্গীরচরের নূরিয়া মাদরাসায় হাফেজ্জী হুজুরের কবর দর্শনীয়। হাটহাজারিতে মূল কবরের পাশে মসজিদ সংলগ্ন কবরগাহে বড় বড় বুযুর্গরা শুয়ে আছেন। পটিয়ার মাকবারায়ে আজিজি আমার প্রিয় একটি জিয়ারতগাহ। বিন্নুরী টাউনে যেমন মসজিদের পাশে শায়খ ইউসুফ বিন্নুরী, পুত্র মুহাম্মদ বিন্নুরী, হাবীবুল্লাহ মুখতার রহ. এর কবর। দারুল উলূমে মুফতী শফী রহ.। মুলতানে খায়রুল মাদারিসে মাওলানা খায়র মুহাম্মদ জালন্ধরীসহ অন্যান্য বুযুর্গ। দীনপুর শরীফে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি, মাওলানা গোলাম মুহাম্মদ, মাওলানা আব্দুল্লাহ দরখাস্তির কবর। ময়মনসিংহে জামিয়া ইসলামিয়ায় মাওলানা আতহার আলী রহ. এর কবর। এ সবই আমার প্রিয় জিয়ারতগাহ। শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. শুয়ে আছেন ঢাকার অদূরে কলাতিয়ায়।
পল্লীকবি জসিমুদ্দীনের ‘কবর’ কবিতা আর মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক বাংলাভাষায় অমর হয়ে থাকবে। আরো বেশি প্রভাব নিয়ে অক্ষয় জীবন্ত হয়ে থাকবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’ কবিতাটি। আমি কবি কাজীর এ কবিতাটির খুবই ভক্ত। কবির জানাযায় শরিক হতে না পারলেও যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তার কবর জিয়ারত করেছি। তিনি কত সুন্দর করেই না বলে গেছেন,
মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।।
কত দরবেশ ফকির রে ভাই, মসজিদের আঙ্গিনাতে
আল্লার নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে,
আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে নাম জপতে চাই
আল্লার নাম জপতে চাই।।
পল্লীকবি জসিমুদ্দীন বলেছেন,
এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
কবিতার দু’টি লাইন এমন,
হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা দয়াময়!।
আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত (বেহেশত) নসিব হয়।
আধুনিক বাংলার কিংবদন্তী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কবরে লেখার জন্য তিনি নিজেই এ দুটি লাইন রচনা করে যান,
চরণ ধরিতে দিওগো আমায়
নিওনা নিওনা সরায়ে
হুমায়ূন পরকালের নাজাতের জন্য তার বিশ্বাসের আশ্রয়রূপে যে ‘চরণ’ ধরতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, মালিক যেন সে চরণ সরিয়ে না নেন। বৃথা যেন না যায় তার আকুতি।
আমার দাদাজির কবরে তার ভক্ত এক প্রবীণ কবি এমন কিছু কথা লিখে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন,
‘পথিকবন্ধু পথিকবন্ধু একটু থেমে যান
এই খানেতে ঘুমিয়ে আছেন আহমদ আলী খান
সত্য ন্যায়ের প্রতীক আলেম, শিক্ষা-দীক্ষায় গুরু
মর্যাদা ও সুনাম তাহার পর্বত সমান
আল্লাহর ওলী ছিলেন তিনি কিশোরগঞ্জের প্রাণ’
আমরা কবরের এপিটাফ লেখাকে প্রশ্রয় দেইনি। কারণ, এসব সুন্নতের ভেতর পড়ে না।
পাক-ভারত-বাংলাদেশে প্রথমদিকে মুসলমানরা যখন যুদ্ধ জয় করেন তখন শুরুতেই মুহাম্মদ বিন কাসিম রহ. দেবল বন্দর আক্রমণ করেছিলেন। তদানিন্তন সিন্ধুর শাসকের নাম ছিল রাজা দাহির। বিন কাসিমের অভিযানে যেসব আরব মুসলমান শহীদ হন তাদের দাফনের মধ্য দিয়েই রচিত হয় উপমহাদেশের প্রথম কবরস্থান। বর্তমানে পাকিস্তানের টাঠ্ঠা এলাকায় সেটি অবস্থিত। অরোর এলাকায় প্রথম নির্মিত মসজিদ ও কিছু কবরও আছে। অন্তত তেরশ বছর আগের কবর থেকে শুরু করে সম্প্রতি দাফন করা হয়েছে এমন নতুন কবরও সেখানে বিদ্যমান। কল্পনার চেয়েও বিশাল সেই গোরস্তান। শত শত বছর আগের শাসক, সেনাপতি ও বিশিষ্টজনের কবরে ভর্তি। চারপাশ ঘিরে পর্যটকদের ভিড়, নানা খাদ্য-পানীয় ও উপহার সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসে আছে শত শত দোকানি। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, ঠিক তাজমহলের মত দেখতে একটি ছোটখাট সমাধি ওখানেও একটি কবরের উপর রয়েছে। বেলে মাটির তৈরি এ সমাধির বয়স তাজমহলের দ্বিগুণ। পার্থক্য কেবল এতে পাশের মিনারগুলো নেই। আর এটি শ্বেতপাথরের নয়। বলা হয়, তাজমহলের নকশাবিদ তুরস্ক ও ইরানের অভিজ্ঞতা নিয়ে সিন্ধুর এই বেলে মাটির সমাধি অনুসরণ করেই নির্মাণ করেছেন আগ্রার তাজমহল। সিন্ধুর অববাহিকায়, থাড় মরুভূমিতে, হিন্দুকুশ থেকে ভূস্বর্গ কাশ্মির, কাবুল-কান্দাহার জুড়ে আরো বহু প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র রয়েছে।
করাচি ও হায়দারাবাদের পথে প্রসিদ্ধ শহর সখ্খর। সেখানকার এক মুগল সেনাপতির সমাধি দুর্গ অভাবনীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। মাটি থেকে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে অন্তত তিরিশ ফুট উঠার পর দুর্ভেদ্য কেল্লার ভারী দরোজা খুলতে হবে। এরপর প্রবেশ সম্পূর্ণ প্রস্তরনির্মিত বিশাল সমাধিদুর্গে। চারপাশে হেঁটে বেড়াবার মত করিডোর, দুর্গের ভেতরের অংশটি বেলকনির মত ঝুলে আছে সগর্জনে বয়ে চলা রুদ্র বিশাল সিন্ধু নদের উপর। ফুঁসে উঠা সিন্ধুর উত্তাল ঢেউ ও পাক খাওয়া স্রোত দুর্গের দেয়ালে আঘাত করে করে ফিরে যাচ্ছে নদীর বুকে। আরো কয়েক ধাপ উপরে উঠে প্রায় দূরের রেলের ব্রিজ সমান উঠার পর দেখা যাবে ছোট-বড় অন্তত পঁচিশ-তিরিশটি কবরের। কঠিন পাথরে তৈরি পাটাতন ও সুচারু প্রস্তরনির্মিত কফিনসদৃশ সারি সারি কবর। দেখে মনে হবে বহু শত বছর আগে মরে যাওয়া এসব প্রশাসক, সেনাপতি ও সৈনিক এখনও সিন্ধুপারের এই অঞ্চলের প্রহরায় নিয়োজিত। মনে যা-ই হোক আসলে এদের শেষ শয্যার এ আয়োজন আমার ভাবনাকে গভীর ভাবালুতায় পরিণত করে। আমার কাছে এই সমাধিদুর্গ একটি স্বহস্ত নির্মিত নির্মম পরিহাস বলেই মনে হয়। শক্তিশালী মানুষ আসলে যে কত অসহায়, একদার প্রতিপত্তিশালী মানুষ আসলে যে কত অক্ষম তা এ ধরনের সমাধি, স্মৃতিসৌধ বা আজিমুশ্শান মাজার দেখে স্পষ্টই বুঝে আসে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিত সহধর্মিনী হযরত বিবি খাদিজার কবর মক্কা শরীফের উঁচু এলাকা মুআল্লায়। হযরত নিজে এই মহীয়সী নারীকে সমাহিত করেছেন। মুআল্লায় আগে-পরে তাঁর আরো কিছু আত্মীয় ও সহচরকেও সমাহিত করা হয়েছে। দেড় হাজার বছরে জানা-অজানা অংসখ্য হজযাত্রী বা মক্কায় অভিবাসী ভিনদেশী মুসলিম নারী-পুরুষেরও এ ঐতিহাসিক কবরস্থানে সমাহিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। পরাধীন ভারতের শ্রেষ্ঠ স্বাধীনসত্তা সায়্যিদুত তায়েফা হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ. মা খাদীজার প্রতিবেশী হয়ে জান্নাতুল মুআল্লাতেই শায়িত। শৈশবে আমার অনানুষ্ঠানিক উস্তাদ মাওলানা আব্দুল হান্নান সাহেব (জন্ম সিলেটে) মুআল্লাতে সমাহিত। বর্তমানে মক্কা শরীফে ইন্তেকাল হওয়া হজযাত্রী বা প্রবাসী মুসলমানদের হারাম শরীফ থেকে বিশ-বাইশ কিলোমিটার দূরে নবনির্মিত আধুনিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। শুরাই নামক মহল্লার এ কবরস্থানে বাংলাদেশী একজন মহিলা হজযাত্রীর দাফন উপলক্ষে যাওয়ার সুযোগ হয়। এরপরের বছর মহিলার আত্মীয়-স্বজন আবার তার কবর জিয়ারতে গেলে আমাকেও সাথে নেন। সম্পূর্ণ ডিজিটাল ডাটাসমৃদ্ধ এ কবরস্থানে নাম-পরিচয় বলার সাথে সাথে অফিসের লোকেরা কবরের নাম্বার ও অবস্থান বলে দেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় ও পবিত্র অন্তিমশয্যা হচ্ছে পাক মদীনায়। মসজিদে নববীর সম্মুখভাগে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাসস্থানের একটি কক্ষে, যে স্থানটিতে তার ওফাত হয় নবী-রাসূলদের জন্য আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী, আমাদের প্রাণের নবীকে সেখানেই দাফন করা হয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অপার্থিব জীবন নিয়ে পবিত্র রওজা শরীফের যে জায়গাটিতে অবস্থান করছেন সেটি আল্লাহ তাআলার নিকট তার আরশের চেয়েও অধিক গুরুত্ববহ। আধ্যাত্মবাদী মহাকবির ভাষায়,
ادب گاہیست زیر آسماں از عرش نازک تر نفس گم کردہ می آید جنید و بایزید اینجا
আকাশের নীচে সম্মানিত এমন এক জায়গা, আল্লাহর নিকট যার গুরুত্ব ও নাজুকতা আরশের চেয়েও বেশি। যেখানে হাজিরা দিতে এসে সবকিছু আমি ভুলে যাই। আর ভুলবই না বা কেন এখানে এসে তো জুনায়েদ বাগদাদী আর বায়েযিদ বোস্তামীরই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত।
এ রওজা পাকের স্থান আমার অন্তরের অন্তঃস্তলে, চোখের পুত্তুলিতে এবং হৃদয়ের মণিকোঠায়।
এর পাশেই একটু দূরে হযরত আবু বকর রাযি. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বুক বরাবর মাথা রেখে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। তাঁর বুক থেকে নীচের দিকে একটু দূরে শুয়ে আছেন হযরত উমর রাযি.। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাসস্থানের ভেতর আর মাত্র একটি কবরেরই জায়গা খালি আছে। বলা হয়, শেষ যামানায় হযরত ঈসা আ. দুনিয়ায় অবতীর্ণ হয়ে ইসলাম ও মুসলমানের কল্যাণে নির্ধারিত ভূমিকা রাখার পর স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করলে তাঁকে হযরত উমর রাযি. এর বুক থেকে একটু দূরে নীচের দিকে পার্শ্ববর্তী ও শেষ কবরটিতে দাফন করা হবে।
মহানবীর রওজা শরীফের অনতিদূরে মদীনার সাধারণ কবরস্থান জান্নাতুল বাকী অবস্থিত। এখানে নবীপত্নীগণ, কন্যা হযরত ফাতিমা, হযরত উসমান রাযি.সহ বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম এবং প্রায় দশ হাজার সাহাবী শায়িত রয়েছেন। বাকি সকল সাহাবী আরবের দূর দূরান্তে, এমনকি দ্বীন প্রচারে ছড়িয়ে পড়ায় পৃথিবীর নানা প্রান্তে শায়িত রয়েছেন। দীর্ঘ দেড় হাজার বছরে বিশ্বের নানা দেশের শত-সহস্র জিয়ারতকারী ও অভিবাসী মুসলিম নারী-পুরুষও জান্নাতুল বাকীতে শেষ নিদ্রার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। মাওলানা আশেকে এলাহী বুলন্দশহরী আমাদের জানা-শোনার মধ্যে সম্প্রতি কবরস্থ এক উপমহাদেশীয় মুহাজিরে মাদানী আলেম। তাঁর পুত্র মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মাওলানা আব্দুর রহমান কাউসারের সৌজন্যে তাঁর জিয়ারত হয়। কিছুদিন আগে একবার মদীনা শরীফে একটি জানাযা পড়ি। জানাযার পর দেখতে পাই অনেক বাংলাদেশী জান্নাতুল বাকীর সামনে সমবেত। খবর নিয়ে জানতে পারি জানাযাটি একজন বাংলাদেশী শ্রমিকের-যে আট বছর ধরে মদীনায় বসবাস করছিল এবং দুদিন আগে সে ছুটি পেয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আগামীকাল তার ফ্লাইট ছিল। গত রাতে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয় এবং মৃত্যুশয্যায় সে বলে যায় যে, মদীনায় মৃত্যু হলে তাকে যেন এখানেই রেখে দেওয়া হয়। লাশ দেশে পাঠানোর কোন প্রয়োজন নেই। আমি এই শ্রমিকের সৌভাগ্য দেখে মুগ্ধ হই এবং তার দাফনে অংশগ্রহণ করি।
আমার মৃত্যু কবে-কখন-কোথায় কিভাবে হবে তা আমি জানি না। এসব বিষয়ে কেউই কিছু জানে না। তবে আমার পিতৃপুরুষের মৃত্যু ও কবর সম্পর্কে জানা আছে। প্রপিতামহ বৃটিশ ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ ও মুহাদ্দিস হযরতুল আল্লাম আলহাজ মাওলানা ইবারত খান সাহেব (১৮৭৪-১৯৪৮) এর কবর তাঁর জন্মস্থান হাতকবিলায়। পিতামহ মুর্শিদে কামেল আল্লামা আহমদ আলী খান (১৯০৪-১৯৮২) ও পিতা খতীবে মিল্লাত হযরতুল আল্লাম মাওলানা আতাউর রহমান খান (১৯৪৩-২০০৮) এর কবর আমাদের দেশের বাড়ি কিশোরগঞ্জ শহরের জামিয়া রোডস্থ নূর মন্জিল প্রাঙ্গণে।
জীবিত মানুষ জানে না কোথায় তার কবর হবে। মরমী কবি হাসন রাজার ভাষায়,
সেই কথা ভাবিয়া হাসন ঘরবাড়ি না বান্ধে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লাহ তার লাগিয়া কান্দে।
আমরাও না জেনে কেবল কাঁদব, কোথায় নিয়ে রাখবেন আল্লাহ তার লাগিয়াই কাঁদব। তার দরবারে মিনতি করব, যেখানেই নিয়ে রাখেন, যেন শান্তিতে রাখেন। ক্ষমার চাদরে ঢেকে, রহমতের আবহে রেখে আমাদের যেন তিনি শীতল স্বস্তির ঠিকানায় পৌঁছে দেন।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ মৃত্যুপ্রসঙ্গে বলেছেন,
وَمَا تَدْرِیْ نَفْسٌۢ بِاَیِّ اَرْضٍ تَمُوْتُ
ক. কেউই জানে না সে কোথায় গিয়ে মৃত্যুবরণ করবে। সূরা লুকমান : ৩৪
كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَۃُ الْمَوْتِ
খ. প্রাণীমাত্রকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সূরা আম্বি^য়া : ৩৫
اِذَا جَآءَ اَجَلُهُمْ فَلَا یَسْتَاْخِرُوْنَ سَاعَۃً وَّلَا یَسْتَقْدِمُوْنَ
গ. যখন মৃত্যুর সময় আসবে তখন সেটি এক মুহূর্তও অগ্র-পশ্চাৎ করা হবে না। সূরা ইউনুস : ৪৯
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের মদীনা শরীফে মৃত্যুবরণ ও সমাহিত হওয়ার বিষয়টিকে কল্যাণকর বলে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য এটি কারো এখতিয়ারে নেই। আল্লাহ চাইলেই কেবল এই সৌভাগ্য লাভ করা যায়। মানুষের প্রার্থনা কেবল এটিই হওয়া উচিৎ যে, মৃত্যু যেন তওবা ও ঈমানের সাথে হয়। শয়তানের ধোঁকা থেকে নিরাপদ থাকা যায়, মৃত্যুযন্ত্রণা থেকেও আল্লাহ রক্ষা করেন। এরপর কবরের সওয়াল-জওয়াব আল্লাহর বিশেষ দয়ায় অতি সহজে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। কবরের কোন আযাব না হয়। এতে অস্বস্তিকর পরিবেশ না থাকে। কবর যেন হয় জান্নাতের একটি বাগান। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে, আমার পিতা-মাতা এবং সকল বিশ্বাসী নারী-পুরুষকে ক্ষমা করে দিন|
©somewhere in net ltd.