নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিজস্ব ভাবনা চিন্তা নিয়ে আমার ভার্চুয়াল জগত!

এস.এম. আজাদ রহমান

মানুষ

এস.এম. আজাদ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

জুলাই সনদ ও অধরা ঐক্য: বাংলাদেশের রাজনীতির সন্ধিক্ষণ

০৭ ই নভেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৬


জুলাই সনদ ও অধরা ঐক্য: বাংলাদেশের রাজনীতির সন্ধিক্ষণ

অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থার এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে আমরা দেখেছি নানা কমিশন, তাদের সুপারিশ, এবং শেষ পর্যন্ত ‘ঐকমত্য কমিশন’-এর জন্ম ও তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন।
কাগজে–কলমে এই কমিশনগুলোর লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা, সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করা এবং দেশের নতুন রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় দিকনির্দেশনা দেওয়া। কিন্তু এক বছর পর প্রশ্ন উঠছে— ঐ ঐক্য কতটা অর্জিত হলো?

অধরা ঐক্য, অপ্রাপ্ত প্রত্যাশা
বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রত্যাশিত ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। তবে পুরোপুরি অগ্রগতিহীনও বলা যাবে না। কিছু ন্যূনতম ঐক্যমতের জায়গা তৈরি হয়েছে, যা সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ক্ষীণ সম্ভাবনার আলো দেখায়।
কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া চলবে না। কারণ, বাংলাদেশ এখন রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক সংবেদনশীল মুহূর্তে— “জুলাই–পরবর্তী বাংলাদেশ” একটি নতুন সামাজিক চুক্তি বা নীতির খোঁজে। এমন সময়ে যদি আমরা আবারও বিভাজিত হয়ে পড়ি, তাহলে সেটি হবে জাতির জন্য এক বড় দুর্ভাগ্য।

জুলাই সনদ: আশা না কি অভিজাত চুক্তি?
‘জুলাই সনদ’ দেশের মানুষের কাছে একসময় আশা ও সুশাসনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এটি আমাদের সামনে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ব্লুপ্রিন্ট হাজির করেছিল।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে— এই সনদটি জনসম্পৃক্ত নয়, বরং অভিজাত রাজনৈতিক ও بيرোক্র্যাটিক গোষ্ঠীর দ্বারা প্রণীত একটি ‘ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া’ দলিল।

রুদ্ধদ্বার বৈঠক, অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত, জনগণের সঙ্গে পরামর্শহীন প্রক্রিয়া— সব মিলিয়ে জুলাই সনদ জনগণকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
গণতন্ত্রে জনগণের অংশগ্রহণ শুধু ভোটের দিন পর্যন্ত সীমিত নয়; নীতি, সংবিধান ও সংস্কার প্রক্রিয়াতেও তাদের কণ্ঠস্বর থাকা উচিত। কিন্তু জুলাই সনদের প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এই নীতি অনুপস্থিত ছিল।

৩০–৪০ শতাংশ মানুষকে বাদ দিলে কোনো সনদ টেকে না
জুলাই সনদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এখানেই— এটি দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক রেখেছে।
দেশের অন্তত ৩০–৪০ শতাংশ মানুষ, যারা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করে, অথবা অতীতের অভিজ্ঞতায় সরকারের প্রতি আস্থাহীন— তাদের কণ্ঠ এই প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিত ছিল।

এই মানুষগুলো কেবল ভোটার নয়, এরা এই দেশের শ্রমিক, কৃষক, তরুণ প্রজন্ম, প্রবাসী, ও সাংস্কৃতিক কর্মী— অর্থাৎ বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার অঙ্গ।
তাদের বাদ দিয়ে গঠিত কোনো ‘সনদ’ কাগজে টিকে থাকলেও বাস্তবে টেকে না।

ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে— যখন রাষ্ট্রের নীতি ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান তৈরি হয়, তখন সেই ব্যবধান একসময় বিস্ফোরিত হয়।
জুলাই সনদ যদি সত্যিকার অর্থে টেকসই হতে চায়, তাহলে সেটিকে এমন অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোয় রূপ দিতে হবে, যেখানে সবাই নিজেদের প্রতিফলন দেখতে পায়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও জুলাই সনদের সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো দলাদলি, পারিবারিক প্রভাব, পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রশাসনিক পক্ষপাতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
এই বাস্তবতায় জুলাই সনদে বর্ণিত রাজনৈতিক শুদ্ধাচার বা সুশাসনের ধারণাগুলো আদর্শিক হলেও বাস্তবায়নযোগ্য কি না, সেটি বড় প্রশ্ন।

শোষণমূলক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের যে দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের আছে, তার সংস্কার একদিনে সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা।
জুলাই সনদে সে ধরনের রোডম্যাপের অভাব প্রকট।

সংস্কারে জনগণের অংশগ্রহণ: অনুপস্থিত কিন্তু অপরিহার্য
গণতন্ত্রের প্রাণ হলো জনগণের অংশগ্রহণ।
যে সংস্কারগুলো জুলাই সনদে অমীমাংসিত থেকে গেছে— যেমন গণভোট, নির্বাচনপদ্ধতি, দলীয় সংস্কার ইত্যাদি— সেগুলোর সমাধান হতে পারে পরবর্তী সংসদীয় প্রক্রিয়ায়, জনপ্রতিনিধিদের বিতর্ক ও জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

এখানেই বিএনপির “নোট অব ডিসেন্ট” একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আপত্তি জানানো মানে রাজনৈতিক ঐক্য ভাঙা নয়— বরং সেটি হতে পারে গণতান্ত্রিক শক্তির প্রকাশ।
যে সমাজে কেউ আপত্তি জানাতে পারে না, সেখানে আসলে ঐক্য নয়, একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

‘নোট অব ডিসেন্ট’— ভিন্নমত না, সম্ভাবনার দিগন্ত
বিএনপির আপত্তি জনগণের অংশগ্রহণের নতুন দরজা খুলে দিতে পারে। এটি যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে জনগণ নিজেই রাজনৈতিক বিতর্কের অংশ হয়ে উঠবে।
এভাবে একটি সত্যিকারের অংশীদারিত্বভিত্তিক গণতন্ত্র গড়ে উঠতে পারে— যেখানে ক্ষমতা কেবল শাসকদের হাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং জনগণও তার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।

অদেখা খাতগুলো: অর্থনীতি, শিক্ষা ও মৌলিক অধিকার[
জুলাই সনদের আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো— এটি কেবল রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়ের মধ্যেই সীমিত থেকেছে।
অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা বা নাগরিক অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর রূপরেখা এতে অনুপস্থিত।
যদিও কিছু কমিশন এসব বিষয়ে সুপারিশ করেছিল, কিন্তু সেগুলো সনদে কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

উপসংহার: অন্তর্ভুক্তিমূলক ঐকমত্যই টেকসই ভবিষ্যৎ
জুলাই সনদকে কেবল সরকারের বা রাজনৈতিক দলের দলিল হিসেবে নয়, বরং জনগণের সামাজিক চুক্তি হিসেবে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই হতে পারে না।
ঐকমত্যের প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব উন্মুক্ত, বিতর্কনির্ভর ও অংশগ্রহণমূলক করতে হবে— তাহলেই বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ নিতে পারবে।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে— জনগণকে উপেক্ষা করলে কিংবা নির্বাচন থেকে কাউকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করলে তারা নিজেরাই ইতিহাস তৈরি করে। এখন প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাবানরা কি সেই শিক্ষা নিতে প্রস্তুত?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.