![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এ দেশে কোম্পানী শাসনের শেষ এবং ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সূচনা লগ্নে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ইন্টার্ণ বেঙ্গল রেলওয়ে নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করেছিল। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মিঃ ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনশন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে প্রথম রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের নিকট পেশ করেন এবং ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানীর কর্মকর্তাগণ ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানীর সঙ্গে এক মিলিয়ন স্টার্লিং খরচে পরীক্ষামূলক রেলপথ নির্মাণের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। অতঃপর হাওড়া থেকে রাজমহলের দিকে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর জরীপকার্য শুরু হয়। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বর্ধমান-রাজমহল এবং এলাহাবাদ পর্যন্ত রেলপথের জরীপ কাজ শেষ হয়।
১৮৫৬ খ্রিস্টব্দের ৩রা ফেব্রুয়ারি বাংলায় কলিকাতা হতে রাণীগঞ্জ পর্যন্ত ১২০ মাইর দীর্ঘ রেলপথটি চালু হয়। ১৮৬০-৭০ দশকে ইন্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলিকাতা হতে কুষ্টিয়ার মধ্য দিয়ে ফরিদপুরের বিখ্যাত নদী বন্দর গোয়ালন্দ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলে গোয়ালন্দ সোজা পদ্মা নদীর পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত শিবালয় অথবা আরিচা থেকে মানিকগঞ্জের মধ্য দিয়ে ঢাকা পর্যন্ত এবং আরিচা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত এবং আরিচা-মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। মানিকগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতাও পরীক্ষা করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন ঢাকার সেটেলমেন্ট অফিসার Mr. F. D. Ascoli (I.C.S) Final report on the survey and settlement on the District of Dacca (1910-1917) এ লিখেছেন-“Proposal have been made for connecting Dacca, Manikganj and Goaland railway, but engineering obstacles are very great owing to difficulty of bridging the Dhaleswari river and to level of country through which the line most run between that river and Manikganj. Preliminary surveys have been made for railways from Aricha in the west to Tangail in Mymenshing, and from Aricha to Munshiganj, but only the former line is practicable.” কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মানিকগঞ্জের উপর দিয়ে উক্ত রেলপথটির নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকাসহ এতদঞ্চলের সুধীজনের মধ্যে যারা শিবালয়-ঢাকা রেলপথ নির্মাণের গুরুত্ব ও উপযোগিতা অনুধাবনপূর্বক বিষয়টি যত্নসহকারে ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন-বাবু রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জ জেলার তেওতার জমিদার এবং তৎকালীন ঢাকা জেলা বোর্ডের একজন কার্যকরী সদস্য।
রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী শিবালয়-ঢাকা রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগী ও উৎসাহী পুরুষ| ছিলেন। রেলপথ স্থাপনের ব্যাপারে এলাকাবাসীরও জোর সমর্থন ছিল। রায় পার্বতী শংকর চৌধুরীর প্রস্তাবিত রেলপথটি অদ্যাবধি বাস্তবায়িত না হলেও তার প্রশংসনীয় উদ্যোগ ও বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা এতদঞ্চলের জনগণ কখনো ভুলবে না এবং তা মানিকগঞ্জের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
"Notes on a proposal of a Railway from Shivalaya to Dacca নামক ছোট পুস্তিকায় ঢাকা-শিবালয় রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব এবং কার্যকারিতা উল্লেখ করে রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা ও রূপরেখা ভিত্তিক প্রতিবেদন ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ১১ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে তদানীন্তন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মিঃ এইচ. লুথম্যান জনসন সাহেবের নিকট পেশ করেন। কমিশনার শিবালয়-ঢাকা রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাবটি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য করেন এবং তা চূড়ান্ত বিবেচনার জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করেন।
জমিদার রায় পার্বতী শংকর চৌধুরীর প্রস্তাবলীর পুস্তকটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে নিম্নোক্ত উত্তরপত্র দেয়া হয়েছিল :
No. G 2095
From.
H. LUTTMLAN JOHNSON ESQ C. S.
Commissioner of the Dacca Division, Dacca.
To
BABU PARBATI SANKAR RAY CHAUDHURRI
ZEMINDAR, TEOTA Dacca
dated 21st November 1895.
Sir.
I have the honor to acknowledge with thanks the receipts of your letter of August 11th 1895 submitting a proposal of a Railway from Shivalaya to Dacca. I take great interest in the matter and an asking government to have survey made. I have the honour to be
Sir
Your most obedient Servant
(Sd.) H. L. Jonson
Commissioner.
উনিশ শতকের শেষ দশকের কথা। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ এল. হেয়ার তখন ঢাকা জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান। ১৮৯০ খ্রি : বাবু মাধব চন্দ্র রায় জেলা বাবোর্ডের রাস্তার উপর দিয়ে স্টিম ট্রামওয়ে নির্মাণের একটা খসড়া প্রস্তাব জেলা বোর্ডের বিবেচনার জন্য উত্থাপন করেন। বাবু মাধব চন্দ্র রায়ের পরিকল্পিত স্টিম ট্রামওয়ে শিবালয় থেকে সিংগাইর উপজেলার ধল্লা এবং ধলেশ্বরী নদীর অপরপ্রান্ত ফুলবাড়িয়া হতে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যাত্রী সাধারণের পারাপারের জন্য ধল্লা ও ফুলবাড়িয়ার মধ্যে ধলেশ্বরী এবং গোয়ালন্দ, শিবালয়ের মধ্যে পদ্মা নদীতে দুটি স্টিমার কার্যরত থাকবে। মূলত এ প্রস্তাবনার পরপরই ট্রামরাস্তার পরিবর্তে রাস্তাতেই রেলপথ স্থাপনের পরিকল্পনা এসে যায়। ট্রামরাস্তা নির্মাণের বিষয়টি জেলা বোর্ডে বিস্তর আলোচিত হয় এবং নির্দেশ মোতাবেক জেলা প্রকৌশলী বাবু শশী ভূষণ মিত্র এর পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ পরিকল্পনাসহ ১৫,০৪,৪২৭ টাকার এক বাজেট তৈরি করেন। বাবু রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী প্রস্তাবিত ট্রামরাস্তা নির্মাণের বিপক্ষে এবং ট্রামরাস্তার পরিবর্তে ঐ পথে রেলপথ স্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন। প্রস্তাবিত ট্রামরাস্তা নির্মাণের সমর্থক এল. হেয়ার হঠাৎ অন্যত্র বদলী হওয়ার প্রেক্ষিতে ট্রামরাস্তা বাস্তবায়নের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী এ অবকাশে শিবালয়-ঢাকা রেলপথ স্থাপনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে সবার দৃষ্টিতে আনয়ন করেন।
উলেখ্য যে, উনিশ শতকের শেষের দিকে ধলেশ্বরী, বুড়ীগঙ্গা, ইছামতি (মতান্তরে হিলসামারী), যমুনা প্রভৃতি নাব্য নদ-নদী পলিস্তর দ্বারা ভরাট হয়ে উঠেছিল এবং পদ্মার প্রবাহ শুষ্ক মৌসুমে স্থানে স্থানে এত ক্ষীণরূপ ধারণ করে যে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গোয়ালন্দগামী স্টীমারসমূহ বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হতো। শুধু তাই নয় অনেকটা অনিশ্চিত ও বিপদজনক এ স্টীমার পথে যাতায়াতের জন্য চারদিন সময় ব্যয় হতো। এ ক্ষেত্রে শিবালয়-ঢাকা রেলপথ স্থাপিত হলে জনসাধারণ সংক্ষিপ্ত রাস্তায় অল্প খরচে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ যাতায়াত করতে পারবে।
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঐ ট্রামরাস্তা নির্মাণের যৌক্তিকতা বিদ্যমান থাকলেও চাঁদপুর থেকে চিটাগাং পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং নারায়ণগঞ্জের বাণিজ্যিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন রূপ লাভ করে। কারণ চিটাগাং রেলওয়ে অদূর ভবিষ্যতে বার্মা রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এবং সেক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে (ঢাকা-চিটাগাং, ঢাকা ময়মনসিং, ঢাকা গোয়ালন্দ কলিকাতা) সংক্ষিপ্ত শিবালয়-ঢাকা রেল লাইন সংযোগ রক্ষাকারী পথ হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী তার প্রস্তাবনায় নিম্নোক্ত তিনটি সম্ভাব্য রেলপথের নীলনকশার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করেছিলেন।
শিবালয় থেকে মহাদেবপুর হয়ে রাস্তাটি বানিয়াজুরী পর্যন্ত এবং বানিয়াজুরী হতে উত্তর-পূর্ব দিকে বাহিত হয়ে বর্তমান মানিকগঞ্জ টাউনের উত্তর প্রান্ত ঘেষে ধামরাই থানার উত্তর বংগীয় কাশিমপুরের পাশ দিয়ে জয়দেবপুরের নিকট ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনে সংগে সংযুক্ত হয়েছে।
এ রাস্তাটির প্রতিবন্ধকতা ছিল বেশি। ধলেশ্বরী, গাজীখালী এবং বংশী নদীতে পারাপারের বিরাট সমস্যা ছাড়াও এলাকাটি ছিল বিস্তর উচু-নিচু এবং গভীর জঙ্গল ও বনাঞ্চলে পরিপূর্ণ। এ ছাড়া এলাকার জনবসতিও ছিল খুব হালকা। কাজেই এ পথে রেলরাস্তা নির্মাণের কোন উপযোগিতা রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী দেখান নি।
তবে একথা সত্য যে, এ প্রস্তাবিত পথে রেল লাইন নির্মিত না হলেও কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে ঐ পথেই (বংশী নদীর তীর থেকে ফুলবাড়িয়া হয়ে) আজকের ঢাকা আরিচা মহাসড়ক প্রতিষ্ঠিত।
এ রাস্তাটি শিবালয় হতে মহাদেবপুরের কাছ দিয়ে বানিয়াজুরী হয়ে বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলা সদরের সামান্য দক্ষিণে বেউথা কালীগঙ্গার তীর পর্যন্ত এবং কালীগঙ্গার অপর প্রান্ত হতে কিছটা দক্ষিণ-পূর্ব দিয়ে বেতিলা, বায়রা, মির্জাপুরের নিকট দিয়ে সিংগাইর উপজেলা সদরের পাশ ঘেষে ধলেশ্বরীর তীরবর্তী ধল্লী পর্যন্ত বিস্তৃত। আবার ধল্লা সোজা ধলেশ্বরীর প্রান্তে ফুলবাড়িয়া হতে রাস্তাটি সোজা মিরপুরের মধ্য দিয়ে তৎকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় রেল স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে থেমেছে।
প্রস্তাবিত এ রাস্তাটি ছিল সংক্ষিপ্ত এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যদি জেলা বোর্ডের রাস্তার উপর দিয়ে এ প্রস্তাবিত রেলপথটি নেয়া হয়, তবে এর নির্মাণ ব্যয় অনেক কম হবে। এ পথটি চালু হলে স্থানীয় জনসাধারণ ছাড়াও পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ যাত্রী, ব্যবসায়ী সংক্ষিপ্ত সময়ে স্বল্প খরচে যাতায়াত করতে পারবে এবং শিবালয়, তেওতা, বায়রা, সাভার, মানিকগঞ্জ, ফুলবাড়িয়া প্রভৃতি বন্দর এলাকার গুরুত্ব ও কর্মব্যস্ততা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।
তবে দ্বিতীয় রাস্তাটির গুরুত্বপূর্ণ কতকগুলো সমস্যাও ছিল। ধল্লা ও ফুলবাড়িয়ার মধ্যে বৃহৎ ধলেশ্বরী নদীতে পারাপারের সমস্যা ব্যতিরেকেও উথলী, মহাদেবপুর, বেউথা, পায়রা, শুরীপুর, লুসাপুর, তুরাগ, মিরপুর প্রভৃতি স্থানে আটটি বড় ধরনের পুল নির্মাণের প্রয়োজন হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল ধলেশ্বরীর ফুলবাড়িয়ার নিকট ধলেশ্বরীর মূল খাতের দৈর্ঘ্য ছিল এক মাইল। এ থেকে বাবু রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী সুবিধা-অসুবিধা এবং কার্যকারিতা উল্লেখ পূর্বক তিনটি বিকল্প পন্থায় নদী পারাপার সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন :
(ক) পল্টুন ব্রীজ নির্মাণ করা
(খ) স্থায়ী পিয়ার ব্রীজ নির্মাণ
(গ) রোলিং স্টক ফেরীর ব্যবস্থা করা।
শিবালয় হতে ঢাকা পর্যন্ত ৪৫ মাইল দীর্ঘ দ্বিতীয় পথে একটি মিটার গেজ রেল রাস্তার সামগ্রিক নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছিল ২৬,০১,৭৫০ টাকা।
এ রাস্তাটি প্রস্তাবিত ২ নং পথের সিংগাইর হতে দক্ষিণ-পূর্বে গিয়ে নবাবগঞ্জ থানার উত্তর-পূর্ব প্রান্ত বেয়ে হাশরার নিকট দিয়ে জনবহুল বিক্রমপুর ও রামপালের মধ্য দিয়ে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত প্রসারিত। শিবালয় থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত এ রাস্তার দৈর্ঘ্য ছিল ৬৪ মাইল। এ রাস্তার সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই ছিল বেশি। কারণ ধল্লার নিকট থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত স্থলভাগ অত্যন্ত নিচু। স্বভাবতই রাস্তা হতে হবে অনেক উচু এবং শক্তিশালী পুল বা কালভার্ট এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে যেন পণ্য বোঝাই জলযান নিচ দিয়ে সহজেই যাতায়াত করতে পারে।
ভূমি নিচু হওয়ার প্রেক্ষিতে এ রাস্তার স্থায়িত্ব সম্পর্কেও সন্দেহ থাকবে। এ ছাড়া ধল্লা থেকে ঢাকা অতীব সন্নিকটে বিধায় এ রাস্তার তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীসকল মুন্সিগঞ্জ দিয়ে না গিয়ে শুষ্ক মৌসুমে ধল্লাতে নেমে সোজা জেলা বোর্ডের রাস্তা ধরে ঢাকা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে এ রাস্তার সঙ্গে ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং চাঁদপুর লাইনের কোন সংযোগ থাকবে না। কিন্তু প্রস্তাবিত ২ নং রাস্তা কমপক্ষে দুটি রেলপথের সঙ্গে সংযোগ করতে পারবে। সার্ভে ম্যাপের উপর ভিত্তি করে রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী তিন রাস্তার সামগ্রিক নির্মাণ ব্যয় ধরেছিলেন ২৪,০০,০০০.০০ টাকা।
রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী এমনিভাবে ২ নং এবং ৩ নং রাস্তার সম্ভাব্য কার্যকারিতা উপর তুলনামূলক চিত্র প্রস্তাবনা পুস্তিকায় উল্লেখ করেছিলেন। যদি রাস্তাটি লাভজনক মনে হয় তবে রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারকে প্রেসিডেন্ট করে প্রস্তাবিত রেল লাইন নির্মাণে উৎসাহী ও আগ্রহী ব্যক্তিবর্গ সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনেরও সুপারিশ করেন। প্রস্তাবিত দুই নং এবং তিন নং রাস্তার পৃথক পৃথক সঠিক জরিপ এবং পূর্ণ পরিকল্পনা তৈরির জন্য উৎসাহী ও আগ্রহী ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে দশ হাজার টাকা চাঁদা সংগ্রহ এবং একজন যোগ্য ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী নিয়োগের কথাও তিনি প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেছিলেন।
অধিক জরিপ ও পরিকল্পনা গ্রহণের পর যদি দেখা যায় প্রস্তাবিত রেলপথটি ভালো মুনাফা অর্জন করবে তবে সরকার নিজ অথবা কোন প্রাইভেট কোম্পানীর উপর দায়িত্ব প্রদান করবেন। তবে উভয় ক্ষেত্রই সার্ভে করার জন্য সংগৃহীত টাকা চাঁদা প্রদানকারীদের নগদ টাকায় অথবা যৌথ কোম্পানীর ক্রয়ের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। এর ব্যতিক্রমের ক্ষেত্রে বাবু রায় পার্বতী শংকর চৌধুরী দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় রাখেন যে চাঁদা দাতাগণ অন্তত এই ভেবে আত্মতুষ্টি লাভ করবেন-তাদের টাকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য সপ্তাহে ব্যয় হয়েছে এবং এর চেয়ে মহৎ কোন উদ্দেশ্যে তা আর ব্যয় করা যেত না।
বাবু রায় পার্বতী শংকর চৌধুরীর রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাবনা মহৎ ও জনকল্যাণকর হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাটি অজ্ঞাত কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। সম্ভবত স্টামার এ বিরোধী এবং গোপন ষড়যন্ত্রের ফলে শিবালয়-ঢাকা রেলপথ নির্মাণের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তখন পদ্ম ও ধলেশ্বরী নদীপথে স্টীমার ব্যবসা দস্তুরমত জমজমাট ও লাভজনক ছিল। এক পরিসংখ্যান হিসাবে জানা যায় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জ গোয়ালন্দ নদীপথে স্টীমার কোম্পানীর মুনাফা অর্জিত হয়েছিল ৩,৪০,৭৭২ টাকা ২ আনা ১০ পাই। স্বভাবতই বুঝা যায় ঢাকা-শিবালয় রেলপথটি নির্মিত হলে পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদী পথে গোয়ালন্দ-ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের প্রতিষ্ঠিত স্টীমার ব্যবসার অপূরণীয় ক্ষতি করে। কারণ স্থানীয় জনসাধারণ ছাড়াও পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ যাত্রী সাধারণ দীর্ঘস্থায়ী এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্টীমার পথে না গিয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত রেলপথই বেছে নেবে। সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে স্টীমার কোম্পানীর পদস্থ কর্তা ব্যক্তিগণ গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় নির্মাণ পরিকল্পনাটি বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়াও বিশ শতাব্দীর শুরু থেকেই এ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি কারণেও সম্ভবতঃ ব্রিটিশ সরকার অথবা ইস্ট বেঙ্গলের কোম্পানী" নতুন কোন রেলপথ নির্মাণের ঝুঁকি গ্রহণে আগ্রহী হয়নি।
১৯১৮ সনের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার তৎকালীন কালেক্টর Mr. Hart, ESQ. (I. C. s) ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের নিকট পেশকৃত এক প্রতিবেদনে (নং ৭৫৪ ) ঢাকাআরিচা রেলপথ নির্মাণ কার্য স্থগিত হওয়ার প্রসঙ্গে লিখেছেন, “The proposal for a railway from Dacca to Aricha have been definitely abandoned owing to the absence of any line of high land and to the destructive proactivities of the Dhaleswri. The cost of construction and maintenance of such a railway would greatly exceed the profits from local traffic and the line would be useless for through traffic with Calcutta unless waggon ferries were provided over the Ganges at Aricha and the Dhaleswari near Sabhar. By such a route passengers would only arrive at Dacca an hour or too sooner than they down and the freightthat would have to be charged on goods traffic would probably | be not less than the present steamer routes."
রায় পার্বতী শংকর চৌধুরীর পেশকৃত শিবালয়-ঢাকা রেলপথ প্রস্তাবনার পর এক শতাব্দীর অধিক কাল পার হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক উত্থান পতন এবং ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরও ৪৭ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রস্তাবিত জরিপকত শিবালয়-ঢাকা অথবা আরিচা-টাঙ্গাইল অথবা আরিচা-মুন্সিগঞ্জ রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা ও নীল নকশা আজো অন্ধকার প্রকোষ্ঠেই রয়ে গেছে।
©somewhere in net ltd.