![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সবুজ শস্যের ভা-ার হিসেবে খ্যাত উত্তর জনপদের জেলা গাইবান্ধা। জেলা শহরের বর্তমান অবস্থানের গাইবান্ধা নামকরণ ঠিক কবে নাগাদ হয়েছে তার সঠিক তথ্য এখনও পাওয়া যায় নি। তবে রংপুরের কালেক্টর ই. জি. গ্লেজিয়ার ১৮৭৩ সালে যে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিলেন সেই রিপোর্ট গাইবান্ধা নামটি ইংরেজিতে লেখা হয়েছে GYEBANDA এবং সেই GYEBANDA এর অবস্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ঘাঘট পাড়ের কথা। এই ঘাটটই যে ঘাঘট নদী সেটা বলা যায়। সম্ভবত ১৭৯৩ সালের আগে ঘাঘট নদীর তীরবতী এই স্থানটি একটি পতিত ভূখ- এবং গোচারণ ভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। জনবসতি ছিল না বলেই রংপুরের কালেক্টরদের রিপোর্টে গাইবান্ধা নামটি ১৮৭৩ সালের আগে উল্লিখিত হয়নি।
গাইবান্ধার নামকরণ সম্পর্কে দু’টি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে, একটি কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে, প্রায় পাঁচহাজার বছর আগে মৎস্যদেশের রাজা বিরাটের রাজধানী ছিল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানা এলাকায়। মহাভারতের কাহিনীতে বলা হয়েছে, এই রাজা বিরাটের রাজসভায় পঞ্চ পা-বেরা দ্রৌপদীসহ ছদ্মবেশে তাদের ১২ বছর নির্বাসনের পরবর্তী একবছর অজ্ঞাত বাস করেছেন। অজ্ঞাতবাস কালে যুধিষ্ঠির কঙক নামে বিরাট রাজের পাশা খেলার সাথী হয়েছিলেন। আর ভীমের দায়িত্ব ছিল পাঁচকের কাজ করা এবং তার ছদ্মনাম ছিল বল্লভ। বিরাট রাজার কন্যা উত্তমার নাচ, গান ও বাদ্য যন্ত্র শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অর্জুন, বৃহন্নলা নামে। গো-শালার দায়িত্বে ছিলেন সহদেব, তন্তীপাল নামে এবং অশ্বশালার দায়িত্বে ছিলেন নকুল। তার ছদ্মনাম ছিল গ্রন্থিক। আর বিরাট রাজার রাজার রানী সুদেষ্ণার গৃহপরিচারিকা হয়েছিলেন দ্রৌপদী। বলা হয়ে থাকে, এই বিরাট রাজার গো ধনের তুলনা ছিল না। তার গাভীর সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার। মাঝে মাঝে ডাকাতরা এসে বিরাট রাজার গাভী লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো। সেজন্য রাজা একটি বিশাল পতিত প্রান্তরে গো-শালা স্থাপন করেন। গো-শালাটি ছিল সুরক্ষিত এবং গাভীর খাদ্য ও পানীয় সংস্থান নিশ্চিত করতে তা নদী তীরবর্তী ঘেসো জমিতে স্থাপন করা হয়। সেই নির্দিষ্ট স্থানে গাভীগুলো বেঁধে রাখা হতো। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে, এই গাভী বেঁধে রাখার স্থান থেকে এই অঞ্চলের কথ্য ভাষা অনুসারে এলাকার নাম হয়েছে গাইবাঁধা এবং কালক্রমে তা গাইবান্ধা নামে পরিচিতি লাভ করে।
গাইবান্ধা নামকরণ সম্পর্কে ভিন্ন মতও রয়েছে। কারণ গাইবান্ধা জেলার সাথে রাজা বিরাটের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে আজও প্রমাণিত হয়নি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান যেমন হাতিবান্ধা, বগবান্ধা, চেংড়াবান্ধা, মহিষবান্ধা ইত্যাদি নামে জায়গা থাকায় মনে হয় গাইবান্ধা নামটি খুব বেশি পুরানো নয়। রাজা বিরাটের সাথে সম্পর্ক থাক বা না থাক গাইবান্ধা নামটি যে গাভীর প্রাচুর্য এবং গাভী বেঁধে রাখার ব্যাপার থেকে এসেছে সে কথা ধারণা করা যায়। তবে মহাভারতের সেই রাজা বিরাট যে গাইবান্ধার রাজা বিরাট তার পক্ষেও উল্লেখযোগ্য কিছু যুক্তি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মনুসংহিতার সংস্কৃত শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘কুরুক্ষেত্রাংসচ মৎস্যাংসচ পঞ্চামান, শুরেসেন জান দীর্ঘণ লঘূংশ্চৈব নরামু গ্রীনীকেষু যোধয়েৎ’ (মনূ ৭/১৯০)। এই শ্লোকটিতে বলা হয়েছে যে মৎস্যাদি দেশের লোকেরাই রণক্ষেত্রে অগ্রগামী হয়ে যুদ্ধ করতো। মহাভারতের বিরাট পর্বে যে মৎস্যদেশের কথা বলা হয়েছে এবং বিশ্বকোষের অষ্টাদশ ভাগের ৬৯০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত মনুর বচন অনুসারে রাজা বিরাটকে মৎস্যদেশ অর্থাৎ মাছ প্রধান এবং নদীমাতৃক দেশ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেদিক থেকে এই উপমহাদেশের নদীমাতৃক এবং মাছ প্রধান এলাকা বলতে বাংলাদেশের এই অঞ্চলকেই বুঝায়। নরেন্দ্র বসু প্রণীত বিশ্বকোষের অষ্টাদশ খ-ে রাজা বিরাট সম্পর্কে উল্লেখ আছে যে, বরেন্দ্র খ-ের মধ্যবতী উক্ত বিরাট নামক প্রাচীন জনপদ গাইবান্ধার অন্তর্গত গোবিন্দগঞ্জ থানার করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে ৬ মাইল দুরে অবস্থিত। উক্ত বিরাট ঘোড়াঘাটের আলীগাঁও পরগনার অন্তর্গত।
রাজা বিরাট প্রসঙ্গে মোশাররফ হোসেন প্রণীত দিনাজপুরের ইতিহাস গ্রন্থের ১০ পৃষ্ঠায় ঐতিহাসিক বুকাননের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৮০৭ সালে করতোয়া নদী রাজা ভাগদত্ত এবং বিরাট রাজার রাজ্যের অভিন্ন সীমানায় ছিল। মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী রাজা ভাগদত্ত কমরূপের রাজা ছিলেন। সে সময় বিরাট রাজার দেশ মৎস্যদেশ নামে পরিচিত ছিল। নদীসমূহ মৎস্যবহুল হওয়ার জন্য এই নামকরণ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়।
উল্লিখিত তথ্য গাইবান্ধার রাজা বিরাটের প্রাচীনত্ব এবং মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং পঞ্চ পা-বদের এখানে অবস্থানের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে। এছাড়া ১২৬৮ সালে প্রকাশিত কালীকমল শর্মা রচিত বগুড়া ইতিহাস বৃত্তান্ত নামক গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়ে মহাভারতের সেই মৎস্যদেশ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ‘বগুড়া হইতে ১৮ ক্রোশ অন্তর ঘোড়াঘাট থানার দক্ষিণে ৩ ক্রোশ দুরে ৫/৬ ক্রোশ বিস্তীর্ণ অতি প্রাচীন অরণ্যানী মধ্যে বিরাট রাজার রাজধানী ছিল। ১১৫৩ অব্দের যে মহাপ্লাবন হয় তাতে বিরাটের বংশ ও কীর্তি একেবারেই ধ্বংস হইয়া যাওয়ার পর ক্রমে ক্রমে ঐ স্থান মহারণ্যে পরিণত। যখন এই দেশের আদ্যপান্ত সকল লোকেই ঐ স্থানকে বিরাটের রাজধানী বলিয়া আসিতেছে। আর কীচক ও ভীমের কীর্তি যখন ঐ স্থানের অনতিদূরেই অবস্থিত এবং মৎস্যদেশ যখন বিরাট রাজার রাজ্য ছিল, ভারতবর্ষ ছাড়া অন্য কোন স্থানকে মৎস্যদেশ বলা হয় না, তখন ঐ স্থানে বিরাট রাজার রাজধানী ছিল তার অন্যথা প্রমাণ করে না’। অতএব একথা বলা যায় বিরাট এলাকাটি অত্যন্ত প্রাচীন। এই প্রাচীন এলাকাটি কালীকমল শর্মার মতে ১১৫৩ অব্দের মহাপ্লাবনে প্লাবিত হয়ে নদীগর্ভে তলিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক কারণে আবার তা নদী তলদেশ থেকে উত্থিত হয়। তবে রাজা বিরাটের গোচারণ ভূমির সাথে গাইবান্ধা নামকরণের সম্পর্ক যদি নাই থাকবে তবে রাজা বিরাটের এই কিংবদন্তিটি লোকমুখে এত ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলই বা কেন? যুক্তিহীন বা ভিত্তিহীন কোন বিষয়ের এত ব্যাপক প্রচার কোনক্রমেই সম্ভব নয় বলে ধারণা করা যায়। সুতরাং আমরা বলতে পারি গাই (গরু/গাভী) বাঁধা থেকে এলাকার নামকরণ হয়েছে গাইবান্ধা। তবে এই গাইবান্ধার ব্যাপারটি রাজা বিরাটের না হয়ে জমিদার ভগদত্তের গোয়ালঘর বা গো-শালার নামানুসারে এলাকার নাম ‘গাইবান্ধা’হয়েছে বলেও মনে করা হয়।
©somewhere in net ltd.