![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আসুন সবাই মিলেমিশে আমাদের দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে থাকবে না দরিদ্র, রাজনৈতিক হানাহানি, দুর্ণিতি, পেশীশক্তির শোষন।
মেয়েটির নাম খাদিজা। মাঝারি গড়নের চিকন ও ফর্সা। চোখজোড়া যেন সরলতার প্রতিবিম্ব। মেয়েটার দৃষ্টিই বলে দেয়, তার ভেতরের অফুরান যন্ত্রণার ঢেউ। চুপচাপ বসে আছেন একটি মানবাধিকার সংস্থার আইনি সহায়তা সেলে। আমি অ্যাসাইনমেন্টের কাজে বসে আছি মেয়েটার সামনের চেয়ারে। ওই সংস্থার দুজন আইনজীবী মেয়েটির করা একটা মামলার আরজির খসড়া তৈরিতে ব্যস্ত। আইনজীবীদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলেন, মেয়েটিকে তাঁর স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি এখানে এসেছেন প্রতিকারের জন্য। জানতে চাইলাম, কী মামলা? একজন আইনজীবী উত্তর দিলেন, ভরণপোষণ ও দেনমোহর চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলাটি দায়ের করা হবে সংস্থার পক্ষে। মেয়েটি আমার পরিচয় বুঝতে পেরে ভীরু ও দুর্বল গলায় বলে উঠলেন, ‘ভাই, আমার দুঃখের কাহিনিডা একটু লেইখেন।’ ওই আইনজীবী সায় দিলেন দেখেন, এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেই চলেছে। অথচ এ মেয়েটির মতো অধিকাংশ মেয়েই জানে না, তাঁর কী অধিকার রয়েছে। মেয়েটির সঙ্গে আলাপচারিতা জমে উঠল আমার।
আপনি এখানে কেন এসেছেন? এখানে এলে যে প্রতিকার মেলে জানলেন কীভাবে?
‘আমি এইহানে আইছি আমার স্বামীরে তালাক দেওনের লাইগা। আমি লোকমুখে হুনছি, এইহানে আইলে টাকাপয়সা ছাড়াই কাম হইয়া যাইবে। এই জায়গায় আফারা নাকি অনেক কাজ কইরা দেয়।’
কেন আপনার স্বামীকে তালাক দিতে চান?
‘আমার বিয়া হওয়ার তিন মাস না যাইতেই আমার স্বামী আমার বাপের কাছে এক লাখ টাকা চাইতে শুরু করে। অথচ বিয়ার আগে কোনো কথা বলে নাই। আমার গরিব বাপে কই থাইকা টাকা দিব হেরে? তাই আমি এই কথা বললে হেয় আমারে গালাগাল করতে থাকে মা-বাপরে লইয়া। আমারে কথায় কথায় চইলা আসার জন্য বলে। বলে যে, আমি আমার বাপের বাড়িতেই যেন থাকি। টাকা না লইয়া ওই বাড়িতে ঢুকন যাইব না।’
আপনার স্বামী কি আপনাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন?
‘মাঝে মাঝে চড়-থাপ্পড় দিছে। তবে হে যে মানসিক অত্যাচার করেছে, এইডা মারের চাইতেও অনেক কষ্টের।’
আপনার বিয়ে হয়েছে কবে?
‘২০০৯-এর ১ সেপ্টেম্বর। বিয়া হওনের পর আমি জানতে পারি যে আমার স্বামী আগে আরেকটা বিয়া করছিল। ওই ঘরে একটা পুলাও (ছেলে সন্তান) আছে। আমি এইডা শুনার পর আমার ওপর যেন আকাশ ভাইঙ্গা পড়ে। আমি চিৎকার কইরা কান্না করতে থাকি।’
আপনার বিয়ের আগে কোনো খোঁজখবর নেননি?
‘আমার বাপ তো অনেক গরিব। বিয়ার আগে এত কিছু খোঁজখবর নিতে পারেন নাই। আমার শ্বশুরের পীড়াপীড়িতে আমার বাপে বাধ্য হইছিল বিয়া দিতে।’
বিয়ের ঘটনাটা বলেন। কীভাবে বিয়ে হলো?
‘আমার শ্বশুর রিকশা চালাইত মানিকনগর এলাকায়। এক দিন আমি আমার বাপের সঙ্গে ওনার রিকশায় কইরা আমাদের বাসায় আইছিলাম। রিকশার মধ্যেই আমার শ্বশুর বইলা ওঠে আমারে উনার অনেক পছন্দ হইছে। তার পুলার বউ কইরা আমারে নিয়া যাইব। আমার বাপরে ঠিকানা দিতে কয়। অনেক জোরাজুরির পর শ্বশুরকে ঠিকানা দেয়। কয়েক দিন পর উনি গিয়া হাজির হন বাসায়। এভাবে অনেক দিন আমাদের বাসায় গিয়া ধরনা দিত। এভাবে পীড়াপীড়ি করার পর আমার বাবা রাজি না হইয়া থাকতে পারেন নাই।’
আপনার স্বামী তখন কী করত?
‘ভ্যানগাড়ি চালাইত। ’
এখন কি যোগাযোগ হয় আপনার সঙ্গে?
‘না, আমি চইলা আসনের পর থাইকা আর যোগাযোগ হয় না। হুনছি হেই নাকি ঠিকানা বদলাইছে। তয় কই গেছে, কইতে পারুম না।’
আপনার স্বামীর আগের কথা আপনার শ্বশুরও বলেননি!
‘এইডা তো আমারও কথা। শ্বশুর কেমনি বিয়া করায় পুলার আরেকটা বউ থাকতে!’
আপনার স্বামী কি আপনাকে তালাক দিতে চায়?
‘না, তালাক দিতে চায় না, আবার ঘরে তুইলা নিতেও চায় না। ওর ধান্ধা, আমার বাপের কাছ থাইকা টাকা লইব। আমিও আর হের ঘরে ফিরা যামু না। এমন যন্ত্রণার থাইকা একা থাকন অনেক ভালো।’
আপনি পড়াশোনা করেছেন?
‘ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি। চার বছর আগে পড়াশোনা ছাইড়া দিছি। বাপে পড়াশোনা করার টাকা জুগাইতে পারে না।’
আপনার কাবিনে দেনমোহর কত টাকা ছিল?
‘২৫ হাজার টাকা।’
কাবিনের ঘরে যে স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা আছে, এটা কি জানেন?
‘না, আমি জানি না। বিয়ার সময় আমারে একটা সই করতে কইছিল একটা কাগজে। আর কিছু জানি না।’
আপনি এ সংস্থায় আসার পর কী জানতে পারলেন।
‘এইহানে আসার পর জানতে পারি, আমি নাকি দেনমোহরের ২৫ হাজার টাকা পামু আমার স্বামীর থাইকা। আর আফারা কইছে, আমি নাকি আমার ভরণপোষণের টাকাও পামু।’
আগে জানতেন না যে এগুলো পাবেন?
‘না, আগে আমি জানতাম না। আমার মা-বাপও জানেন না। জানলে তো হ্যারা আমারে কইত। আমি শুধু আমার স্বামীর ঘরে যামু না, এইডাই চাইছিলাম।’
এখন মামলা করা হবে, আদালতে আপনাকে যেতে হবে। এতে আপনার খরচপাতি, ভোগান্তি হবে না?
‘কিছু তো কষ্ট হবেই। তবে এইহানে তো টাকাপয়সা ছাড়াই মামলা কইরা দিতাছে। আমি আমার প্রাপ্য যেইটুকু, সেইটা হতে কেন বঞ্চিত হমু।’
আপনিই কি বলছেন মামলা করতে?
‘না, প্রথমে তো আমার স্বামীরে আপসের জন্য ডাকছিল। কিন্তু আসে নাই, পরে উপায় না দেইখা আফারা কইল তাহলে আদালতে মামলা করলে লাভ হইতে পারে। আমি রাজি হইলাম।’
আপনার স্বামী বা শ্বশুর কি আপনাকে ফিরিয়ে নিতে কোনো চেষ্টা করেনি?
‘না, এদের কেউই আসে নাই। আমার বাপে আমারে না জানাইয়া ওদের বাড়িতে লোক পাঠাইছিল। কিন্তু ওদের পাওয়া যায় না। হুনছি, জানি না সত্য কি না, আমার স্বামী আমি চইলা আসার পর আরেকটা বিয়া করছে। আসলে এহন বুঝতে পারতাছি, আমার শ্বশুর আর স্বামীর এই সব ধান্ধা ছাড়া আর কিছুই না। ’
আলাপচারিতা শেষে আমি সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর কাছ থেকে মামলার খসড়াটি নিই। দেখি আরজির পাঁচ নম্বর প্যারায় লেখা আছে
‘বিবাদী (মেয়েটির স্বামী) বাদিনীকে (মেয়েটিকে) বিবাহের আগে আরেকটি বিবাহ করেছিল এবং সেখানে এক পুত্রসন্তান আছে। যা বিবাহের সময় বিবাদী, বাদিনী এবং তার পরিবারের সদস্যদের কাছে গোপন রেখেছিল। বর্তমানে বিবাদী আরেকটি বিবাহ করেছে এবং তৃতীয় স্ত্রী নিয়ে সংসার করছে। আর বাদিনী অর্ধাহারে মা-বাবার সংসারে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। বিবাদী গত ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখ থেকে বাদিনীর কোনো ধরনের খোঁজখবর নেন না এবং ভরণপোষণও দেন না।’
পাদটীকা : কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্ত্রী স্বামীকে স্বেচ্ছায় তালাক প্রদান করার ক্ষমতা দেওয়া থাকে। অনেক সময় এ কলামটি পূর্ণ করা হয় না। তাই বিয়ের কাবিননামা সম্পন্ন করার সময় ১৮ নম্বর ঘরটি পূরণ করা উচিত। নইলে স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দিতে চায়, তাহলে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নিতে হবে। তালাক যে পক্ষই আগে দিক না কেন, স্ত্রীর দেন মোহরের টাকা অবশ্য স্ত্রীকে দিতে হবে। তালাক কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত এবং ইদ্দত কাল পর্যন্ত অবশ্যই স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে হবে। ভরণপোষণের দাবি চেয়েও পারিবারিক আদালতে প্রতিকার চাইতে হবে। সহকারী জজ আদালতগুলো পারিবারিক আদালত হিসেবে বিচারকাজ করে থাকেন।
লেখকঃ তানজিম আল ইসলাম, কো-অরডিনেটর, আইন ও অধিকার, দৈনিক প্রথম আলো
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:২১
নতুন বলেছেন: পাদটীকা : কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্ত্রী স্বামীকে স্বেচ্ছায় তালাক প্রদান করার ক্ষমতা দেওয়া থাকে। অনেক সময় এ কলামটি পূর্ণ করা হয় না। তাই বিয়ের কাবিননামা সম্পন্ন করার সময় ১৮ নম্বর ঘরটি পূরণ করা উচিত। নইলে স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দিতে চায়, তাহলে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নিতে হবে।
এটা সাধারন আইনই বানাতে হবে...যে স্বামী বা স্ত্রী স্বেচ্ছায় তালাক দিতে পারবে....
আলাদা করে কাবিন নামায় কেন ১৮ নং ঘরে দিতে হবে? স্বামীর জন্য কি কোন ঘর থাকে? থাকে না... বিয়ের কাবিন নামার অধিকার দুজনেরই সমান হওয়া উচিত নয় কি?