![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পরিত্যাক্ত বাড়ি
পর্ব-৮
.
আমি অনুপমকে বললাম, তুই আগে উঠে বস। তারপর বলি। সে আমার কথামতো উঠে বসলো। আমি তাকে বলতে শুরু করলাম।
অনুপম তোর মনে আছে 'ঐযে একদিন তোকে আমার নানীর বাড়িতে আম চোর ধরার ঘটনা বলেছিলাম?'
অনুপম নির্লিপ্ত নয়নে মাথা ঝাকিয়ে 'হ্যাঁ' বললো।
আমি আবার তাকে বলতে শুরু করলাম। যেদিন আমি, সিহাব আর অয়ন ভাইয়া চোরটিকে ধরলাম ঠিক তার কয়েকদিন পরেই আমি শুনতে পেলাম আমার নানীদের গ্রামের মেম্বার সাহেবের মেয়েকে নাকি ভূতে ধরেছে। অস্বাভাবিক সব আচরণ করছে নাকি সে। আমি যতদূর শুনেছিলাম তাতে আমি এটা জানতে পারি যে, মেয়েটা নাকি সব সময় এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে বেড়াতো। বাড়িতে তার এক পাও পরতোনা। খাওয়ার সময় হলে নাকি মেয়েটি বাড়ি এসে শুধু খেয়ে খেয়ে যেতো। তারপর আবার সে তার এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরার কাজে লেগে পড়তো। মেয়েটির যে মাথায় সমস্যা ছিলো তা কিন্তু নয়। মেয়েটি একদম স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু একটা দূর্ঘটনায় মেয়েটি সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে সবার সাথে। অয়ন ভাইকে মেয়েটির ঐ অস্বাভাবিক আচরণ করার কারণ জানতে চাইলে অয়ন ভাই আমাকে যা বলে তাতে আমার শরীরে শিহরণ জেগে ওঠে। শরীরের লোমগুলো সব দাঁড়িয়ে যায়। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি, সামান্য একটা কারণে আজ মেয়েটির এই অবস্থা। অনেক কষ্ট লেগেছিলো মেয়েটির জন্য সেদিন। কিন্তু তার সেই কষ্টের থেকে বেশি ভয় পেয়েছিলাম সেদিন আমি। আমাকে ভয় দিতে পারে, এমন কেউ ছিলোনা কোনো গ্রামে। কিন্তু সেদিন অয়ন ভাইয়ের মুখে ঐ কথাটা শোনার পরে আমার মধ্যে ভয় নামক জিনিসটা ধীরে ধীরে বাসা বাধঁতে শুরু করে।
আমি এটুকু বলতেই অনুপম আমাকে অধীর আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোকে কি এমন বলেছিলো অয়ন ভাই?
আমি অনুপমের দিকে একবার তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম, আমি অয়ন ভাইকে মেয়েটির ঐ অস্বাভাবিক আচরণের কারণ জানতে চাওয়াতে সে আমাকে বললো "সন্ধার সময় তৈরি থাকিস, তোকে আমি এর কারণটা জানিয়ে দেবো।" তবে অয়ন ভাই তখন আমাকে শুধু এটুকু বলেছিলো যে, নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করিস। অদ্ভুত কিছু দেখে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলিস না। আমি তখন ভাইয়ার কথায় একগাল হেসে বললাম, ভাইয়া তুমি আমাকে অন্যসবার মতো ভীতু মনে করো? আমাকে দেখে কি তোমার আমাকে ভীতু মনে হয়? আর কি এমন দেখাবে যে, যার জন্য আমি জ্ঞান হারাবো? আচ্ছা ভাইয়া তুমি কি কুসংস্কারে বিশ্বাসি?
আমার মুখে একের পর এক প্রশ্ন শুনে অয়ন ভাই কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিলোনা। সে শুধু বললো, বেশি বড় হয়ে গেছিস তাইনা? সন্ধার সময়ই দেখবো তোর কতো সাহস? যখন ভয় পেয়ে কিংবা ঐ দুষ্টু জ্বিনের খপ্পড়ে পড়ে আমাকে ডাকবি তখন কিন্তু আমাকে কোথায়ও পাবিনা। আর পেলেও তোকে আমি কোন প্রকার সাহায্য করবোনা। আমি তখন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবো তোর সাহসটা কতটুকু। নিজেকে খুব সাহসী মনে হয়, তাইনা?
শ্রাবণ তুই একটা পিচ্চি ছেলে, সেদিন ঐ আমচোরকে ধরিয়ে দিয়ে তুই আবার এটা ভেবে বসিস না যেন, তুই সবসময়ই সবকিছুর সমাধান করতে পারবি! আমি জানি তোর অনুমাণ ৯০% সত্য হয়। তাই বলে যে সবসময়ই সত্যি হবে এটা তো নয়। আর জ্বিনের কাছে তোর এসব অনুমাণের কোন দাম নেই। এসব অনুমাণ কাজে লাগে গোয়েন্দাগিরি করতে। তবে হ্যাঁ, তুই চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারিস। মন দিয়ে লেখাপড়াটা করিস। দেখবি একসময় তুই অনেক বড় একজন গোয়েন্দা হয়ে গেছিস। তবে কখনো গোয়েন্দার কাজ ছাড়া ভূত প্রেতের কেসে নামবিনা। আমি জানি তুই এসব ভূত প্রেত বিশ্বাস করিস না। আমিও করতাম না। কিন্তু ঐ মেয়েটির সাথে যা ঘটেছে তা নিজের চোখে দেখার পর কিভাবে ভূত প্রেতকে অবিশ্বাস করতে পারি? আচ্ছা যাইহোক, সন্ধার সময় তৈরি হয়ে থাকিস।
.
এইটুকু বলে আমি চুপ করে রইলাম। দেখলাম অনুপম এখন একটু সুস্থ। সুস্থ বলতে এখন আর তার মধ্যে কোন অস্থিরতা নেই। তার শরীরটাও ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। আমি তার শরীরে হাত দিয়েই চমকে যাই। শার্ট ভেজা অথচ তার শরীরটা অনেক ঠান্ডা। মনে হচ্ছে যেন কোনো মরা মানুষের শরীর এটা। আমি অনুপমকে শার্ট খুলতে বললাম। শার্ট টা খুলে একটু সোজা হয়ে বসে কৌতুহলী চোখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, দোস্ত তারপর কি হলো? তুই কি গিয়েছিলি অয়ন ভাইয়ের সাথে?
আমি তাকে তার প্রশ্নের তৎক্ষণাত উত্তর না দিয়ে বললাম, উঠে পড়। চল আমার সাথে। রাতে অনেক হয়েছে। বাড়ির দিকে ফিরতে হবে। ম্যাডাম বোধ হয় চিন্তা করছেন।
অনুপম আমার কথা শুনে একবার তার হাত ঘড়িটার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। দেখলো ক'টা বাজে! কিন্তু এতো দ্রুত যে এগারোটা বেজে যাবে এটা সে কখনো ভাবতেই পারেনি। সে বললো, তুই কিভাবে জানলি অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি মুখে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম, এটা আবার এমন কি কাজ! চল বাড়ির দিকে।
.
অনুপম আর আমি হাঁটছি বাড়ির দিকে। দুজনই চুপচাপ, কোন কথা বলছিনা কেউ। আমি হাঁটছি আর ভাবছি সত্যিই কি ঐ জামিদার বাড়িতে কোন ভূত ছিলো? আর ঐ কালো কোট পড়া লোকটিই বা কে? যাকে তার সাথে আসা মানুষটি 'স্যাার' বলে সম্বোধন করলো! আর যদি ঐ পোড়া বাড়িতে কোন ভূত প্রেত বা আত্মা নাই থাকবে, তাহলে তখন ওসব কি দেখলাম আমি? যদি সত্যি সত্যিই ঐ বাড়িটিতে কোন আত্মা থেকে থাকে, তাহলে তো আমাদের অন্য একটা উপায়ে সেখানে ঢুকতে হবে। আর সেই ঢোকার কাজটা অতি সতর্কতার সাথে করতে হবে। যাতে করে আমরা ঐ অভিশপ্ত আত্মার শিকার না হই। কিন্তু সতর্কতার সাথে ঢুকবোই বা কিভাবে? যদি কোনভাবে একবার সেই আত্মা দুটোর শিকার হই, তবে তো আমরাও অন্যসবার মতো আঁটকে যাবো ঐ বাড়িতে। আমরাও আর কোনদিন ফিরে যেতে পারবোনা আমাদের নিজ গ্রামে, ফিরে যেতে পারবোনা আমরা আমাদের মায়ের কোলে।
আমি অনুপমকে জিজ্ঞেস করলাম, দোস্ত ঐ বাড়িতে ঢোকার একটা উপায় বল। সেখানে কিভাবে ঢুকবো? আর আশিক, ফাহিম, সোমা, এদেরকেই বা কিভাবে উদ্ধার করবো? আমি অনুপমকে প্রশ্নটা করে তার একটা সুন্দর উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে চেয়ে আছি। কিন্তু সে আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে উল্টো আমাকে প্রশ্ন করে বসলো। সে বললো, তারপর কি হলো? তুই কি সন্ধার সময় অয়ন ভাইয়ের সাথে সেখানে গিয়েছিলি? আমি তার প্রশ্ন শুনে পুরো অবাক হয়ে গেলাম। এখনো তার মধ্যে ঐ কথাগুলো বিচরণ করছে? আমি তাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বললাম, অনুপম তোকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি। ধাক্কার ঝাকুনিতে সে খানিকটা নড়েচড়ে উঠে বললো, হ্যাঁ? কি বলেছিস?
আমি আবার তাকে পুনরায় কথাগুলো বললাম। সে আমাকে খুব সহজেই উত্তর দিলো, দিনের আলোতে ঢোকাটাই সবচেয়ে ভালো হবে।
আমিও ভেবে রেখেছিলাম দিনের আলোতেই ঢুকবো। কিন্তু আজ পর্যন্ত যারা ওখান থেকে উধাঁও হয়েছে, তারা সবাই কিন্তু দিনের বেলাতেই উধাঁও হয়েছে। শুধু হাতে গোনা কয়েকজন বাদে।
আমি মনে মনে ভাবছি এই বাড়িটির আসল রহস্য তো আমাকে জানতেই হবে, সাথে আশিক, সোমা আর ফাহিমকেও উদ্ধার করতে হবে। আর তাদের উদ্ধার না করা পর্যন্ত আমরা আমাদের নিজ গ্রামে ফিরে যেতে পারবোনা।
যখন আমার বন্ধুরা ঐ পোড়া, পরিত্যাক্ত বাড়িটি থেকে উধাঁও হয়ে যায়, তখন আমরা আকবর সাহেবকে ঘটনাটা জানালে উনি আমাদের কাছে শুধু সমবেদনা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি কোন প্রকার সাহায্য করতে পারবেন না বলে জানান আমাদের। আর তখন থেকেই ম্যাডাম দুঃচিন্তায় পড়ে যান। কিন্তু ম্যাডামের অমন দুঃচিন্তাগ্রস্ত চেহারা দেখলে আমার মনটা কেঁদে কেঁদে ওঠে। ম্যাডামের মধ্যে আর কোন উচ্ছ্বলতা নেই, নেই কোন হাসি আনন্দ। সব সময় তিনি চুপচাপ থাকেন। আমাদের সাথেও তেমন একটা কথা বলেন না। তবে আমার সাথে মাঝে মাঝে বলেন। আর যখন বলেন, তখন তিনি শুধু এটুকুই বলেন যে, শ্রাবণ তুই কিছু একটা কর। আশিক, সোমা, ফাহিম, এদের না ফিরিয়ে আমরা কিভাবে আমাদের গ্রামে ফিরে যাবো? ম্যাডামের চোকে পানি দেখে আমি পুলিশের কাছেও যাই। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়না। পুলিশও নাকি ঐ বাড়িটির ভূত প্রেত সম্বন্ধে অবগত। সেও জানে যে, ওখানে যে একবার যায় সে আর কখনো সেখান থেকে ফিরে আসেনা। পুলিশের থেকে না সূচক উত্তর শুনে আমি নিজেই সেখানে যাওয়ার পণ করি। সাথে অনুপমও আমার সাথে যেতে চায়। আমাদেরকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো কাউকে দরকার ছিলো তখন। কিন্তু এই গ্রামে এমন কেউ ছিলোনা যে আমাদের ঐ বাড়িটি থেকে আমার বন্ধুদের উদ্ধার করতে সাহায্য করবে। গ্রামের প্রায় অধিকাংশ লোকের ছেলেমেয়েরা সেখানে রয়ে গেছে। তারা তাদের নিজ ছেলেমেয়েদেরই সেখান থেকে উদ্ধার করতে পারছে না। আর তারা আমাদের সাহায্য করবে কিভাবে?
মনে মনে ভাবছিলাম এই কথাগুলো আমি। আর এই গ্রামে যদি আকবর সাহেব আমাদের সাহায্য না করেন, তবে কে সাহায্য করবে আমাদের!
.
অনুপম আমাকে বললো, দোস্ত একমাত্র দিনের বেলা ছাড়া আমাদের সেখানে যাওয়াটি ঠিক হবেনা। আমি তাকে আমার মনে মনে ভাবা কথাগুলো বললাম। তাকে বললাম, অনুপম আমাদের এ বিষয়ে কে সাহায্য করতে পারে একটু বলতে পারবি? সে খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে উত্তর দিলো, আরে রহমান সাহেব তো আছে, উনিই হয়তো সাহায্য করতে পারবেন। আর ঐ রহমান সাহেব লোকটিই তো তোকে একদিন বলেছিলো, তোর কোন সাহায্য লাগলে তাকে জানাতে। সেটা টাকা পয়সা হোক কিংবা বুদ্ধি কিংবা শারীরিক!
অনুপমের কথা শুনে আমি বললাম, হ্যাঁ তাইতো? লোকটি আমাকে বলেছিলো, আমাদের যেকোনো সাহায্য লাগলে তাকে জানাতে। আর আমরা লোকটির কথাকে কোন গ্রাহ্যই করিনি। নাহ, লোকটির সাথে এ বিষয়ে একটু কথা বলতে হবে। অনুপম তুই একটা কাজ করতে পারবি?
- হ্যাঁ বল।
- ঐ যে কালো কোট পড়া যে লোকটিকে আমরা ভূতুরে বাড়িটির সামনে দেখলাম, তার খোঁজ নিতে পারবি?
- হুম চেষ্টা করবো।
- আচ্ছা অনুপম, তুই কি একটা বিষয় লক্ষ করেছিস?
- কোন বিষয়?
- মুন্সি এবং ঐ কালো কোট পড়া আর তার সাথে থাকা দ্বিতীয় লোকটির কথাগুলো?
- হ্যাঁ শুনেছি তো!
- বলতো তারা কি বিষয়ে আলোচনা করছিলো তখন?
- আমি তো আর তোর মতো তেমন একটা অনুমাণ করতে পারিনা। তবে যতটুকু পারি তাতে আমার মনে হয় তারা কোন গোপন কাজ, অর্থ্যাৎ যেই কাজ নৈতিকতা বিবর্জিত কোন কাজ হবে। সেই কাজের বিষয়েই কথা বলছিলো।
- হ্যাঁ, তোর অনুমাণটা ঠিক আছে। আমিও এটাই ভেবেছিলাম। আর কাজটা কি ছিলো সেটাও আমি অনুমাণ করেছিলাম। কিন্তু মাঝখানে ঐ বাড়ি থেকে ভয়ংকর আওয়াজ আর বাড়িটির ছাঁদে দুটো ছায়া মূর্তি দেখে আমার সব ধারণা, অনুমাণ মিথ্যে হয়ে গেলো। সাথে ঐ কোট পড়া লোকটির ভূত ভূত বলে চিৎকারটা শুনে আমার মধ্যে ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করলো। এই ভয়ের কাছে সবার সব অনুমাণই মৃত। তবে এই ভয়টা আমার আগে কখনো ছিলোনা। ঐ সেদিন অয়ন ভাইয়ের সাথে সন্ধাবেলা তার কথামতো তার সাথে একটা জায়গায় গেলাম। আর ওখানে যা দেখলাম তার পর থেকেই আমার মধ্যে এই ভয়টা বাসা বেঁধে নিয়েছে।
আমার এই কথাটা শুনে অনুপম আমাকে জিজ্ঞেস করলো
- দোস্ত তুই কিন্তু তোর এই ভয়ের ঘটনাটা বললিনা।
- আরে তেমন কিছুনা। দ্রুত পা চালা, বাড়িতে ফিরতে হবে। ম্যাডাম বেশ চিন্তাতে আছে।
- যেতে যেতে বল ঘটনাটা।
- আরে বললাম তো তেমন কিছুনা।
আমি খেয়াল করে দেখলাম অনুপম মন খারাপ করে আছে। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটা। আমি ওকে বললাম
- তাহলে শোন ঘটনাটা। সেদিন অয়ন ভাই আমাকে সন্ধাবেলা তাদের গ্রামের পাশে থাকা শশ্মান ঘাটের কাছে নিয়ে যায়। জায়গাটা অনেক পরিষ্কার, তবে অদ্ভুত। কেমন যেন গা ছিমছিমে একটা পরিবেশ। চারিদিক থেকে নানান রকম পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। যখন আমি আর অয়ন ভাই শশ্মান ঘাটের গেটে প্রবেশ করলাম, তখন সেখানকার একটা লোক আমাদের পথ আটকে দাঁড়ালো। লোকটি সম্ভবত সেখানকার কেয়ারটেকার হবে। দাঁড়ি মুচে ছেয়ে গেছে লোকটির মুখ। লোকটি বেশ অদ্ভুত, আমরা ভিতরে ঢোকার সময় বাঁধাও দিলোনা। একবার বললোও না যে, এই সন্ধাবেলা সেখানে আমরা কি করছি! অথচ ঠিকই আমাদের পথ আঁটকে দাঁড়িয়েছিলো। ভেতরে ঢুকে অয়ন ভাই আমাকে দূরের কি যেন একটা দেখিয়ে বললো, ঐ যে একটা মাটির টিলা দেখতে পাচ্ছিস, ওখানেই একদিন ঐ মেম্বারের মেয়েটি খেলাধুলার ছলে এসে বসেছিলো। অবশ্য বেশি সময় থাকতে পারেনি। যেটুকু সময় ছিলো তাতেই তার কাজ হয়ে গিয়েছিলো। অয়ন ভাই আমাকে টিলা টা দেখিয়ে দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছে আর আমি এক দৃষ্টিতে ঐ টিলাটার দিকে তাকিয়ে আছি। টিলাটা দেখতে বেশ সুন্দর, হয়তো সেজন্যই মেয়েটি ওখান গিয়ে বসেছিলো। অয়ন ভাই আমাকে আর কি যেন বলছিলো তখন, কিন্তু আমি ভাইয়ার বলা কথার দিকে মনযোগ হারিয়ে ফেলেছি ততক্ষণে। আমি দেখলাম ঐ টিলাটার চূড়ায় কে যেন বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছিলো ছোট্ট একটা বাচ্চা। আমার মধ্যে তখন কি চলছিলো সেটা আমি নিজেও জানিনা। আমি ধীরে ধীরে ঐ টিলাটার দিকে পা বাড়ালাম। ঐ ছোট্ট বাচ্চাটিকে এই সন্ধাবেলায় ওখানে দেখে খুব মায়া হচ্ছিলো আমার। আমি ক্রমেই টিলাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পেছন থেকে অয়ন ভাইয়া আমাকে অনবরত ডেকেই চলেছে। কিন্তু সেদিকে আমার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
টিলাটা পেতে যখন আর মাত্র কয়েক গজ বাকি। ঠিক তখন পেছন থেকে কেউ আমাকে টেনে ধরলো। আমি পেছনে ঘুরতেই দেখি অয়ন ভাইয়া আমার শার্ট টেনে ধরেছে। আমি ভাইয়াকে বললাম, ছাড়ো আমায়, দেখছোনা ঐ বাচ্চাটি কেমন কান্না করছে। ওকে ওখান থেকে নামাতে হবে। ওকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
আমার এসব আবোল তাবোল কথা শুনে অয়ন ভাই বুঝে গিয়েছিলো আমাকে বস করা হয়েছে। আমার মধ্যে তখন কোন হিতাহিত জ্ঞানটুকুও ছিলোনা। আমার কথা শুনে ভাইয়া আমাকে বললো, কই? কোথায় বাচ্চা? আর কিসের বাচ্চা? আমি তখনও বাচ্চাটিকে দেখতে পাচ্ছি। আমি অয়ন ভাইকে বললাম, তোমার চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে, অতি দ্রুত ডাক্তার দেখাও। ঐযে সামনে জলজ্যান্ত একটা ফুটফুটে বাচ্চা বসে আছে। আর তুমি দেখতে পাচ্ছোনা? আমার কথা বলার ধরণ দেখে ভাইয়া আমাকে খানিকটা ঝাঁকি দিলো। আমি ঝাঁকি খেয়ে নড়েচড়ে উঠলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি অয়ন ভাই আমাকে ধরে রেখেছে। আমি ভাইকে বললাম, কি ব্যাপার আমাকে এভাবে ধরে রেখেছো কেন?
সে রাগি চোখে চেয়ে বললো, কেন ধরে রেখেছি জানিস না? সামনে তাকিয়ে দেখ।
আমি সামনে তাকাতেই বড় ধরনের একটা ধাক্কা খাই। আর কিছুদুর হাঁটলেই আমি ঐ টিলাটার কাছে পৌছে যেতাম। আমার জ্ঞানশক্তি ফিরে পাওয়ার পরেও কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে। আর একটু এগোলেই আমিও ঐ মেম্বারের মেয়ের মতো উপরে চলে যেতাম। উপরে বলতে আমিও তার মতো অস্বাভাবিক আচরণ করতাম হয়তো!
ভাগ্যেস অল্পের জন্য বেঁচে গেছি।
.
অনুপম আমার ভয় পাওয়ার ঘটনা শুনে যেন থমকে গেলো একেবারে। সে ভাবতেও পারেনি এমনটাও হতে পারে কখনো! আমি তাকে বললাম, এটাই ছিলো আমার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রথম একটি ভয় পাওয়ার ঘটনা এবং ভূত প্রেতে বিশ্বাস করা। এই ঘটনার পর থেকে আমি কিছুটা ভূত প্রেতে বিশ্বাস করতে থাকি। কিন্তু যখন এই পরিত্যাক্ত বাড়িটি সম্পর্কে গ্রামের মানুষের থেকে বিভিন্ন কথা শুনলাম, তখন আমার মধ্যে একটুও ভয় কাজ করছিলোনা। বরং আমার মধ্যে আরো কৌতুহল কাজ করছিলো। আজ ঘটে যাওয়া ঐ ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্তও আমি কোন প্রকার ভয় পাইনি। কিন্তু যখন আমার অনুমাণটা মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে ঐ অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটলো আর সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যখন মুন্সি এবং ঐ দুটো লোক ভয়ে দৌড় দিলো। তখনই আমার মধ্যে ভয় ঢুকে গেলো। আর তার সাথে আবার ঐ বাড়িটির উপরে সাদা ছায়ামূর্তি দেখলাম। তাহলে কিভাবে এটাকে ভূত না বলে বিশ্বাস করে থাকি?
অনুপম আমার কথায় খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলো, তার মুখ দেখে আমি অনুমাণ করলাম সে মনে মনে ভাবছে, তাহলে কি আশিক, সোমা আর ফাহিমকে ঐ পোড়া বাড়ি থেকে আমরা উদ্ধার করতে পারবোনা? আমি এটা অনুমাণ করতে করতেই অনুপম আমাকে কথাটা মুখেই বলে দিলো। আমি খানিকটা অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম, কি ব্যাপার! আমার অনুমান তো মিথ্যে হওয়ার কথা না। তবে বাড়িটি সম্পর্কে করা অনুমাণগুলো মিথ্যে হলো কেন?
আমি অনুপমকে বললাম, দোস্ত চিন্তা করিস না। যেভাবেই হোক ওদেরকে আমরা ফিরিয়ে আনবোই। সেটা করতে যতো কষ্টই হোক না কেন, তবু আমরা আমাদের কাজটা চালিয়ে যাবো। আর শোন, রহমান সাহেবের সাথে একটু যোগাযোগ করার ব্যবস্থা কর। একমাত্র সেই আমাদের ভালোমতো সাহায্য করতে পারবে। লোকটির আবার কারো মনের কথা বোঝার অসীম ক্ষমতা আছে।
আমার কথার প্রত্যুত্তরে অনুপম বলে উঠে উঠলো, তাহলে ঐ রহমান সাহেব সবার মনের কথা বুঝতে পারেনা কেন? অনুপমের বলা কথাটি আমার কাছে রহস্যময় মনে হলো। আসলেও তো, সে শুধু আমার মনের কথাটাই বুঝতে পারে। অন্যকারোটা বুঝতে পারেনা কেন?
আমি মনে মনে ভাবছি এই কথাটা। আর বাড়ির দিকে হেঁটে চলেছি। বাড়ি পেতে আর মাত্র এক মিনিটের মতো লাগবে। আমরা পায় চলেই এসেছি বলা যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে অনুপম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ওখানেই দাঁড়িয়ে যা শ্রাবণ। আমি ওর কথায় একটু অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন কি হয়েছে?
তখন ও আমাকে বাড়ির গেটের দিকে তাকাতে বললো। আমি ওর কথা মতো গেটের দিকে তাকলাম। কিন্তু একি? এটা কি করে সম্ভব? আমি ভুল কিছু দেখছিনা তো? আমি চোখ দুটো ডলে আবার তাকালাম। দেখলাম, নাহ! কোনকিছুই তো ভুল নয়। সব সত্যি। তাহলে কি আমার এতোদিনের সব অনুমাণ গুলোই ঠিক ছিলো? হয়তো তাই!
.
অপেক্ষা করুন নবম পর্বের।
©somewhere in net ltd.