![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রায় পনের দিন পরে তাদের অভিলাষ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সকাল থেকে চলছে গোচগাছের তাড়াহুড়ো। পোশাক পরিচ্ছদের বাছা-বাছি । সব মিলিয়ে সারা বাড়িতে একটা নতুনত্বের ঘ্রাণ।
গাড়ি ছাড়তে নয়টা বাজল। তবু যেন সব কিছু ঠিক-ঠাক আনা হয়নি। গারোয়ান অমর স্যানাল পাকা চালক। পঁচিশ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। অজিতবাবুর তার উপর পুরোপুরি বিশ্বাস আছে। দর্জিলিংএ আসতে রাত দশটা বাজল। হোটেল আগেই বুকিং ছিল। হোটেলে উঠে সব কিছু গোছাতে সময় লাগল। অর্চনা বেলকোণীতে এসে দাঁড়াল। চাঁদ একে বারে প্রস্ফূটিত। আকাশের বুকে আলোর আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এটা যেন ঠিক হানিমূনের চাঁদ। অর্জুন পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, “রাত কিন্তু অনেক হলো।”
“তোমারতো শুধু ঐটাই সার। জগৎ সংসারের আর যেন কিছু নেই।”
“আছে।”
“কি?”
“তোমার.. .. .. ।”
“আমারটা বাদ দিয়ে।”
“তাহলে কিছু নাই।”
“চাঁদ দেখছো কেমন আলো ছড়াচ্ছে।”
“ওটা ঐ শয়তানের ধর্ম। আমি চাঁদও না আলোও নেই।”
“তাতে কি চাঁদের আলো উপভোগ করে।”
অর্জুন অর্চনার দিকে তাকাল। চাঁদের সমস্ত আলো ওর মুখে পড়ে আলো ঝলমল করে উঠছে। ওর সমস্ত মুখমন্ডল একটা গভীর নেশায় নেমেছে। সেখানে কত আনন্দ, কত স^প্ন। আশা আর উচ্ছ্বাস। চাঁদের হালকা আলোয় অর্চনা যেন অচিন নগরীর রাজকুমারী। ওর রূপের দ্যুতি ওকে নতুন করে সাজিয়েছে। চাঁদের এই স্নিগ্ধ ঝিলমিল আলো যেন ওর সমস্ত শরীরের উপর দিয়ে খেলা করছে।
“অর্জুন বলল, “লজ্জা করছেতো।”
“লজ্জা করছে না? আর হানিমূনে আসতে লজ্জা করে নাই? বাবা মার সামনে একটা জলজ্যান্ত যুবতিকে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসতে তোমার লজ্জা করে নাই?”
“বাবা মাতো সব জানে। তারাও এমন করছিল।”
“তোমাকে বলছে না?”
“এ কথা বলতে হয় না। এমনিতে বুঝতে হয়। তাছাড়া ঐ হোটেল থেকেইতো আমি এসেছিলাম। তিন মাসও সময় নেয়নি। মা মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বাবাকে সে কথা বলে।”
“আমাকে এ হোটেলে কি দেবে?”
“এখানে বসে রাত কাটালে কি ভাবে দেব?”
“ফাজিল।”
অর্চনা অর্জুনের পাশ ঘেষে বসল। হাত ধরে বলল,
“আমার দুজন ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে।
অনাদী কালের হৃদয় উৎস হতে।
ভোর হলো। অর্চনা ঘুম থেকে জাগল। অর্জুনকে ডাকল। অর্জুন উঠল না। অর্চনা গোছল করে ব্রাশে পেস্ট নিয়ে এলো। অর্জুনকে টেনে উঠাল। অর্জুন অর্চনার ঠাণ্ডা শরীর পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। অর্চনা ছোটার অনেক চেষ্টা করল। পারল না। নীরবে অর্জুনের বুকে ঢলে পরল। অর্জুন দুই হাত দিয়ে অর্চনার মাথা চেপে ধরলে অর্চনা ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। বলে উঠল, “না না। তোমার বাঁশি ঠোঁট ঠোঁটে মিশাবে না। পিচাশ কোথাকার।”
“বেশি জোরা-জুরি করলে আবার গোছল করতে হবে বলে দিলাম।”
অর্চনা আর কোন বাঁধা দিল না। চোখ বুজে শুধু অনুভব করল। তারপর তির তির করে ওর সারা শরীর কেঁপে উঠল। অর্জুন বলল, “আমাদেরও ছেলে হবে।”
নাস্তার পর অমর ডাকল। বলল, “গাড়ি তৈরি।”
ওরা দুজন মেনে এলো। অমর বলল, “আজ কোথায় যাব?”
“আগ্রা। তাজমহল দেখব।”
গাড়ি ছুটল আগ্রার পানে। অর্চনার দৃষ্টি বাইরে কিন্তু অর্জুনের দৃষ্টি বাইরে গেল না। ওর দৃষ্টি ভিতরে। কারণ, সকল দর্শনীয় জিনিসের চেয়েও নারী দেহ বেশি সৌন্দর্য প্রিয়। এমন কোন পুরুষ নাই যে, ও দেহের কথা কখনও কল্পনা করেনি। কল্পনার চোখে আরো সুন্দর করে গড়েনি। এমন কোন পুরুষ নেই যে চুপিচুপি তা দেখতে চায়নি। নারীর দেহ সমস্ত আশ্চার্য জিনিসেরও আশ্চার্য। নারীর সৌন্দর্য পোশাকের ফাঁকে-ফোঁকরে উঁকি মারে। নারীর নতুন দেহের রহস্য সকল রহস্যেও রহস্য। তা ভাষাহীন এক ভাবের ভান্ডার। আর যে পুরুষ তা নতুন আবিষ্কার করছে, তার চোখে বর্ণনাতীত।
সারা পথ চলল এক নীরব রেষা-রেষী। অর্চনাকে নীরব থাকতে দিল না। দুজন তাজমহলের সামনে দাঁড়াল। সাহাজাহানের ভালোবাসাকে প্রণাম জানাল। বেদীতে একটৃু বসল। দুজনের মনে কোন কথাই এলো না। খানিক নীরব থেকে অর্জুন বলল, “তাজমহল যতই প্রেমের নিদর্শন হোক না কোন তা বিরহের। সাহাজাহান যখন এ দিকে তাকাত তখন একটা না পাওয়ার বেদনা তার দুচোখে জল ভরে দিত।”
“এমন কয়জন আছে যে মৃত্যুর পরেও প্রিয়জনকে প্রাণে ধারন করে আছে।”
“বিয়ে করার বয়স ছিল না তাই। থাকলে দেখতে তাজমহলের উপর আরেক মহল উঠত। সেখানেও প্রেম থাকতো। প্রেম অফুরান্ত এক সরোবর।”
সন্ধ্যা নেমেছে। আজকের সন্ধ্যা যেন তাড়াতাড়ি নেমে এলো। আবার ফিরতে হবে। গাড়িতে উঠল। অর্চনা আরজি রাখল পাহাড় দেখার। অর্জুন রাজী হলো। বলল, “ফেরার পথে তোমাকে পাহাড় দেখাব।
সুন্দর দিনগুলো সহজেই ফুরিয়ে যায়। আজ ওদের হানিমূনের শেষ রাত। অর্চনা বেলকোণীতে গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাসের চাঁদ আবার ঘুরে সেখানে এসে গেছে। অর্জুন এসে পাশে দাঁড়াল। ওর মন খুবই রাখাপ। অর্চনা কাঁধে হাত দিল। বলল, “মন খারাপ”
অর্জুন মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ জবাব দিল।
“পাগল মন খারাপের কি আছে? আমি থাকতে কি তোমার হানিমূন শেষ হবে? হবে না। আমি তোমার সারা জীবনের হানিমূন হয়ে থাকব। তুমিতো আমার সারা জীবনের চাঁদ। আমার মনের আকাশ তোমার আলোতেই আলোকিত হবে।”
অর্জুন অর্চনার দিকে তাকাল। অর্চনার মায়াময় মুখ জোছনার আলোয় সেদিনের মত ঝিলমিল করছে। সেদিনের অর্চনার চেয়ে আজকের অর্চনা কত চেনা। কত আপন কত কাছের। এ্যাকে বারেই নিজের। জোছনা যেমন চাঁদের রং যেমন রং ধনুকের।
রাত অনেক হলো। আজ অর্চনা অর্জুনকে বিছানায় নিয়ে এলো। অর্জুন কোন প্রতিবাদ করল না।
সকালে গাড়ি বের হলো। গাড়ি চলল পাহারি এলাকার সন্ধানে। অর্চনাকে পাহাড় দেখাতে হবে। গাড়ি পাহারের পাদ দেশ থেকে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছে। অর্চনার খুব মজা লাগছে। সব কিছু ছেড়ে ওরা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। চারিদিকে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ। অর্চনার আনন্দ দেখে অর্জুন বলল, “বাড়িতে গিয়ে এর সুদাসল তুলব। অর্চনা কোন কথায় কান দিল না। গাড়ি আরো উপরে উঠছে। হঠাৎ গাড়ি গড়িয়ে গেল নিচে। অমর স্যানাল তার বিখ্যাত নামটির মর্যাদা রাখতে পারল না। গাড়ির নিচেই শেষ। হাসপাতালে অর্চনার জ্ঞান ফিরল। যারা তাকে হাসপাতালে এনেছে তারা নাকি কেবল ওকে পেয়েছে। অর্চনা চিৎকার দিয়ে উঠল। সে একা বাঁচতে চায় না। বাঁচবে না। সবাই তাকে বুঝাল, তার স্বামী হয়তো অন্য হাসপাতালে আছে।
অর্চনা আর দেশে ফিরবে না। কি নিয়ে দেশে ফিরবে? ওর ফেরার মত কিছুই নেই। ও এখন নিঃশ্ব। অর্চনা হাসপাতালে একটি চাকরি নিল আর চুপিচুপি স্বামীর খোঁজ নিল। কিন্তু যখন দেখল তার শ্বশুর নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তখন সব আশা ছেড়ে দিল।
চার বছর কেটে গেল। অর্চনা নতুন স্বামীর সংসারে সুখেই আছে। দুই বছরের এক ছেলে। স্বামী অশোক বিরাট ব্যাবসায়ী। অর্চনা অর্জুনকে ভুলে গেছে। ছেলে অভিই তার সব কিছু ভুলতে সাহায্য করছে।
সেদিন অশোক বলল, “দার্জিলিংএ কিছু কাজ আছে। এক মাসের জন্য একটা হোটেল নিয়েছি। সকালে সকালে তৈরি থেকো। অর্চনা না বলতে পারলনা। হোটেলের ফটকের কাছে এসে দেখল ‘অর্চনা আনন্দ হোটেল।’ অশোক এক মাসের জন্য সেই রুমই ভাড়া নিয়েছে। অর্চনার সারা শরীর কেমন যেন নিথর হয়ে আসছে। এই রুম তাকে শান্তি দেবে না। এই রুমের দিন ক্ষণ সম্পূর্ন অন্য চেতনার।
সেদিন অশোক বেরিয়ে গেলে অর্চনা ছেলেকে নিয়ে বেরুল। একটা অটো নিয়ে নদীর ওপারে গেল। আজ এখানে লোকজন কম। ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে হাঁটাল। পায়ের বাঁশি পিই পিই করে বাজছে। অর্চনার নজর কেবল ছেলের দিকে। হঠাৎ একটা ছায়া মূর্তি দেখে অর্চনা মাথা খাড়া করল। ও বিশ্বাস করতে পারল না। মাটির মূর্তিও মত শুধু চেয়ে থাকল। ছেলেটা হাত ছেড়ে হেঁটে চলছে সামনে।
অর্জুন পাশ কেটে দাঁড়াল। অর্চনা এগিয়ে গেল। আবার ফিরে এলো। অর্জুনের মুখোমুখি দাঁড়াল। অর্জুন একটু হাসল। তারপর শুরু করল পথ চলা। অর্চনা আনন্দ হোটেল ভেঙ্গে ফেলার জন্য । অর্চনা আনন্দ হোটেল এক অন্য তাজমহল।
অর্চনা সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো।
১০ সেপ্টেম্বর ২০১২ইং
ওমর আলীর বাড়ি
তেঁতুলিয়া, কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।
©somewhere in net ltd.