![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“এই শালার ক্ষাণকি মাগি, এতো দেরী করছিস ক্যান? তোর ভাতারগে সব রেডী হইয়া গেল। ভুচকি মাগি চাইয়া রইচে ক্যান? তোর মা’র ভাতাররা হাঁটা দেবে।”
“ছেদারির পোলায় কয় কি? আমি কি বসে আছি নাকি? তোর মাইয়ার-ইতো দেহা নাই।”
দবির তার মেয়েকে ডাক ছাড়ে, “ঐ জরিনা-আ কই-রে?”
জরিনা মোরগটাকে ধরার জন্য ছটফট করে। অনেক পরিশ্রম হয়ে ওঠে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ে। তার নতুন বুক নিঃশ্বাসের তালে তালে কাঁপছে। কখন যে ওড়নাটা পড়ে গেছে তা সে খেয়াল করতে পারেনি। সেলিমের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল কেন সে ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জরিনা সেলিমের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে এবং ওড়নার কোণা ধরে টানে। সিল্কের ওড়না বুকে থাকতে চায়না আবার পড়ে। জরিনা এবার শক্ত করে বুকের সাথে বাঁধে। তারপর নিজেই একটু নিজের বুকের দিকে তাকায়।
মোরগটারও পরিশ্রম হয়েছে। ঝোঁপের নিচে মাথা লুকিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছে।
দবির আবার ডাক ছাড়ে, “জরিনা ওইছে? অনেক বেলা হয়ে গেল। সাতগাঁও ম্যালা দূর।”
জরিনা পিছন থেকে মোরগটা ধরে। মোরগটা ক-কক্-কক করে ডাকতে থাকে।
জরিনার বয়স বার কি তের। তিন বছর আগে তারা এখানে এসেছে। ওদের সাথে আরো অনেকে। নজরুল, মেরাজ, গয়া, সেবাত, ফজলু ও কেরামত। গয়া সর্দার। এটা তার পৈত্রিক স্বত্ত্বে পাওয়া। গতকাল দিন ঠিক করেছে ওরা এখানে আর থাকবে না। ফজলু জায়গা দেখে এসেছে সাতগাঁও। এখান হতে আশি কিলোমিটার দূরে।
জরিনার কেরানীগঞ্জের এ ফাঁকা জায়গাটাই ভালো লাগছে। শুধু মাঠ আর মাঠ। বিকেলে লোকের ঢল নামে। চারদিক থেকে লোক আসতে থাকে। এত লোকের ভিতর দিয়ে হাঁটতে জরিনা খুব মজা পায়। সে যৌবনের প্রথম পর্বে পা দিয়েছে অনেক আগেই। ওর যৌবন এখন রসে ভরা আমলকির মত টসটস করছে। পাতার ফাঁকে তাকে আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সামান্য বাতাসেই সে দুলতে চায়। আবেগে জরিনার সারা শরীর কাঁপে। কাউকে দেখলেই ও মিটিমিটি হাসে । কিছু বলতে চায়। বুকের মাংস থর থর করে। চোখের কাজল যেন বার বার মুছে যায়।
কেরামতের ইচ্ছে নেই ওদের সাথে যাবে। ওর বৌ মাজুবিবি মেরাজের সাথে পরকীয়া করে। কয়েকবার হাতে নাতে ধরা ও খেয়েছে। তারপরও তার দেমাগ অনেক। কেরামতকে বলেছে, এরপর তাকে কিছু বললে সে কেরামতকে তালাক দেবে। ভয়ে কেরামত নীরব হয়ে আছে। না পারছে কিছু বলতে না পারছে সহ্য করতে। ওদের দ’ুজনকে একসাথে দেখলে কেরামতের মেজাজ গরম হয়ে ওঠে। তারপর আজ সকাল থেকে দ’ুজনের মুখে অন্য রকম হাসি ফুটছে।
সেলিম মেরাজের পোলা। সাত বছর বয়সের সময় তার মা মারা গেল। বাপ একটা নিকা করেছিল বেশি দিন টেকেনি আরেক জনের সাথে চলে গেল। সেলিমের বয়স এখন আঠার-উনিশ। কেরামতের চার বছরের ছোট। কিন্তু স্বাভাবটা তার বাপেরই মত। বাপের নাম রাখতে পারবে। দুই দিন জরিনার বিছানায় গিয়ে বেশ জড়াকড়ি করেছে। জরিনার বাপ আচ্ছামত ধোলাই দিয়ে বের করেছে।
জরিনা কোন কথা কয় না। ওর পরিশ্রম এখনও কমেনি। বুকের ভিতর থড়ফড় করছে। ও এঁটে দেওয়া ওড়নার একপাশ খুলে দেয়। সেলিমের দিকে কাত হয়ে তাকায়।
“এবার তোগে তাবুর পাশে তাবু বসাব।”
“তাতে কি?”
“কিছুতো একটা আছেই।”
“তুই কি করবি?”
“এবার আর ছাড়ব না।”
“পিঠের ছাল থাকবে না।”
“না থাকলেও।”
“আইসা দেহিস।”
জরিনা চলে যায়।
যাওয়ার জন্য জরিনা একটু সাজে। মুখে সাবান দেয়, স্নো দেয়, পায় আলতা মাখে। আয়নায় মুখ রেখে একটু হাসে। ওকে কেমন যেন একটু কোমল কোমল দেখায়। ওর ঠোঁট বাঁকা হয়ে ওঠে। ওর দেবাশীষের কথা মনে পড়ে। প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার সময় ওর দিকে নীরবে তাকাত। জরিনাই একদিন ওকে বলেছিল, “তোর নাম কি?”
“দেবাশীষ।”
“স্কুলে যাও?”
“না, কলেজে।”
“তোগে বাড়ি বড়ই আছে?”
“আছে। টক।”
দেবাশীষ ওকে অনেকগুলি বরই দিয়েছিল। দুটি পেয়ারাও দিয়েছিল। একদিন একটা চিঠিও দিয়েছিল। কিন্তু, জরিনা জানে না তাতে ছাই-ভশ্ব কি লেখা আছে। দেবাশীষ একদিন ওদের তাবুর কাছে এসেছিল। জরিনা হাতধরে ওকে রাস্তায় নিয়ে আসছিল। দেবাশীষ বার বার হাত ছাড়তে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। দোকানের কাছে এসে বলেছিল, “তোর পকেটে ট্যাকা আছে? লাল চুড়ি কিনে দে।”
দেবাশীষ পকেটে হাত দিতে জরিনা এক ডজন চুড়ি দাম বলে হাতে ঢুকাতে থাকে। ওর চোখে মুখে সাতরাজ্যের হাসি।
ভ্যানের উপর বসে ভাবে দেবাশীষের সাথে দেখা হলে ভালো হতো। একপাতা লাল টিপ চেয়ে নিতাম। বড় বড় লাল টিপ। মুরগির ঝুপড়িটা ওর মা’র কাছে। বাবার কছে সাপের ঝুড়ি আর জরিনার কাছে রান্নার হাঁড়ি পাতিল। কাঁথা-কাপড় সেবাতের নৌকায় পাঠিয়েছে। হঠাৎ ঝাঁকিতে জরিনার হাত থেকে একটা পাতিল পড়ে যায়। গোটা দশেক দাগ পড়ে। ভ্যানওয়ালা নেমে পাতিলটা ধরে দেয়। দবির গর্জন ছাড়ে, “এই শালী, ক্ষাণকি মাগি; বারাণির হাতে জোর নাই? সকালে সেটা ভইরা ভাত গিলছিস, অহনে ক্যান পারবিনা?
একসাথে অনেকগুলি ভ্যান ছুটছে। অধিকাংশ ছেলেরা নৌকায় আসছে। নৌকায় সব ধরেনি বলে ভ্যান ঠিক করেছে। তাছাড়া সবার নৌকা নেই।
সামনে দেবাশীষদের বাড়ি। সেই বড় গাছটা দেখা যায়। সেদিন লাড়কি কুড়াতে এখানে এসেছিল। অনেক বৃষ্টি নেমেছিল। জরিনা চুপচাপ গাছের নীচে বসেছিল। হঠাৎ নজরে পড়ল কে যেন ছাতা মাথায় দিয়ে আসছে। জরিনা নির্বাক সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কাছে আসতে দেখল দেবাশীষ। জরিনা হাত তুলে ডাকল, “এ্যাই-ই, এ্যাই-ই।”
দেবাশীষ গাছতলে এলো। দেখল কতগুলি লাঠি-ঠ্যাঙ্গা আর পাতা কুড়িয়ে আঁচলের অর্ধেক দিয়ে তা ঢেকে মেয়েটি বসে আছে। জরিনার কাছে আসতেই মেয়েটি তার দিকে ডাগর চোখে তাকাল। দেবাশীষ ছাতাটা একটু তার দিকে ধরল। জরিনা বলল, “এই, তুই ভিজে যাচ্ছিস। তুই ভিজিস না। আমার ভয় করছে তাই তোরে ডাকছি।”
আকাশ মেঘে পরিপূর্ণ। মাঝে মধ্যে হালাকা বাতাস বইছে। বৃষ্টি নীরবে ঝরছে। শীতে জরিনা কাঁপছে। দেবাশীষ ছাতাটা এবারও ওর দিকে ধরল। জরিনা কোন কথা বলল না। লাড়কি ছেড়ে দেবাশীষের দিকে একটু সরে এলো। দেবাশীষের বই ভিজছে। “তোর ছাতা এতো ছোট ক্যান? বড় ছাতা কিনতে পারলি না।?”
দোবাশীষের মুখে কোন কথা নেই। জরিনা আর একটু কাছে এসে দাঁড়াল। শীতে সে প্রচন্ড কাঁপছে। লাড়কির উপরের কাপড়টুকু চিপড়ে গায়ের খোলা অংশের উপর উঠিয়ে দিল। দুজনের মাঝে আর কোন ফাঁকা নেই। দেবাশাীষ ওর থর থর কাঁপ অনুভব করছে। জরিননা যেন এখন একেবারেই অসহায়।
“তুমি বৃষ্টির আগে চলে গেলে না ক্যান?”
“ভাবিনি এতো বৃষ্টি নামবে। রান্নার কোন কিছু নাই ওপাশের এখন আর কিছুই পাওয়া যায় না।”
দু’জনই পুরোপুরি ভিজে গেছে। ছাতা শুধু সান্ত্বনা। তবু মনে সাহস আছে।
সমস্ত পরিচিত মুখ তলিয়ে যেতে যেতে দুজনের মাঝের জাত ধর্ম তলিয়ে গেল। লেলিহান বাঘ্রের সামনে নিরুপায় হরিণ শাবক যেমন তাকিয়ে থাকে জরিনা তেমনী তাকিয়ে আছে। দেবাশীষের মনে একটু মায়া হলো।
“খুব শীত লাগছে?”
জরিনা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ জবাব দিল।
“তুমি ছাতা রাখ আমি একটা ব্যবস্থা করি।”
দেবাশীষ আসতে চাইল। জারিনা হাত টেনে ধরল। সেই চটপটে মেয়েটি হঠাৎ যেন নীরবী হয়ে গেল।
“তুই চলে গেলি আমি একলা হয়ে যাব।” হাতখানা আস্তে ছেড়ে দিল। অনেক আলোকিত করে বিদ্যুৎ চমকালো। জরিনা ভয়ে দেবাশীষকে জড়িয়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে গভীর গর্জনে বজ্রপাত হলো। দেবাশীষ তাকে বাঁধা দিল না। জরিনার বৃষ্টি ভেজা নীরবী মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে আঁখি যেন চিরদিনে তাকিয়ে থাকা নীরবী আঁখি। ও আঁখিতে কোন ভয় নেই, কোন অহংকার নেই। কখন যেন ধীরে ধীরে বৃষ্টি থেমে গেল। জরিনা খুব লজ্জা পেল। ল্যাপটে যাওয়া ভেজা কাপড় জরিনা বুকের উপর উঠিয়ে দিল। তারপর খড়-কুটা মাথায় নিল। জরিনার যেন ধ্যান ভাঙ্গল। দেখল সামনে দেবাশীষদের বাড়ি। ও ভ্যানওয়ালেকে বলল, “থামো, থামো।” ভ্যান থামতে না থামতে জরিনা হাড়ি পাতিল ছেড়ে দৌঁড় মারল। হাড়ি পাতিল সব ছিটকে গেল। সোজা দেবাশীষদের বাড়ি গেল। “দেবাশীষ, দেবাশীষ ” বলে কতগুলো ডাক ছাড়ল। কিন্তু কোন সাড়া পেল না। নীরবে বেড়িয়ে এলো। বাপ চুলের মুঠি ধরে, “ক্ষাণকি মাগির বাচ্চা ক্ষাণকি, তোর এতো সাহস ক্যান? কোন ভাতারের সাথে দেখা করতি গিয়েছিলি?”
অন্যদিন হলে জরিনাও ধমক দিত। কিন্তু আজ একটুও চিৎকার করল না। বাপ অজস্র প্রহার করল। জরিনা সমস্ত আঘাত যেন মনে লেগেছে।
সাতগাঁও এবারের তাবুগুলো সব এলোমেলো। কেরামত এবার মেরাজের পাশে তাবু বসায়নি। সবার তাবু বসানোর পর সে তাবু বসিয়েছে। সবার পশ্চিম পাশে কেরামতের তাবু। তার আগে জরিনাদের। মেরাজের তাবু সবার পুবে।
বাসা দূরে রেখে কখনও মনের বা দেহের টান বন্ধ করা যায় না। পরকীয়ার স্বাদ আলাদা। সে স্বাদে বিচ্ছিরি রকমের আনন্দ, বিচ্ছিরি টান। কেরামতের ঘরে জ্বলছে গৃহদাহের দাবানল। কেরামত মাজুকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু সে ভালোবাসা পরকীয়ার ফাঁদে আটকে খাঁন খাঁন হয়ে যায় । হঠাৎ কোন এক রাত্রে দুজনে পালিয়ে যায়। মাজুর গর্ভে চার মাসের বাচ্চা। কেরামত খানিকটা আনমনা হয়ে পড়ে। তার বাইরের চেয়ে ঘরের আগুন অনেক বেশি। ঘর তাকে কাছে টানে না। বাইরের খোলা হাওয়ায় ওর মনের স্বাদ মেটাতে পারে না। দশদিন পরে দুজনে ফিরে আসে। কেরামত সব কিছু ভুলেও আবার স্ত্রীকে ঘরে নিতে চায়। কিন্তু মাজু তার ঘর করবে না। তাকে মুখে মুখে তিন তালাক দেয়।
রাত্রে সভা বসে । সভায় সকল নারী-পুরুষ উপস্থিত হয়। বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সব শেষ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তা হলো, একশত একটি জুতার বাড়ি দিয়ে এই দল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হবে। এ দলের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না। এবার আলোচনায় এলো কেরামত। সেবাত বলল, “জরিনাকে কেরামতের সাথে সাদি দিলে কেমন হয়?”
জরিনার বাপ কোন কথা বলে না। নীরবতায় অনেক সময় কেটে গেল। তারপর গয়া বলল, “সেবাতের কথাই ঠিক। মা জরিনার সাথেই কেরামতের সাদি দেব। দল নেতার বাইরে কেউ কোন কথা কবলে না। জরিনা একটু আনমনা। ওর বুকের একপাশে আবেগে আন্দোলিত হলেও আরেক পাশ নীরব।
মাজুবিবি একাকী চলে গেল। জরিনার বিয়ের দিন মেরাজকেও পাওয়া গেল না। এদিকে সেলিমের মুখ ভার। জরিনার বাপকে বলল, “আমি জরিনাকে বিয়ে করব।”
“খাড়া, চোদানির পোলা বিয়া তোর মার সেটার ভিতর দেই।” বড় একটা লাঠি নিয়ে দবির এলো। খানিক সময় ধমকা-ধমকি চলল। জরিনার চিৎকারে অনেক লোক এলো। ঘটনা জানাজানি হলে ওকেও তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। সেলিম হাত পা ধরে কোন রকম দলে রইল।
বিয়ের পর জরিনা কাজে বেরিয়েছে। পায়ে গাঘর, মাচায় বিছা, মাথায় সাপের ঝুপড়ি। নাকে অনেক বড় একটা দুল। কাঁধের উপর দিয়ে বড় একটা থলে। খয়েরি শাড়ী নীল ব¬াউচ। কানের দুল দুটিও অনেক বড় বড়। উচ্ছলে পড়া যৌবনে জরিনা যেন কামনার কামিনী। ওর কামনার সরোবরে তলিয়ে যেতে চায় সকল যুবকের ঘুমের নীরবতা। রাস্তার সমস্ত লোক তাকিয়ে থাকে ওর উন্নত যৌবন প্রান্তে। জরিনা সেদিকে খেয়াল রাখে না। আঁকা বাঁকা ভাজ ফেলে সে পথ চলে।
সেদিন রাস্তায় একজনতো বলেই ফেলল, “এই আমার ঘরে যাবি? তোরে পোলা দিয়া দেব।”
“মাগির পো তোর মা আছে না? যা তারে গিয়া সেটা ভইরা দিগা।”
লোকটা শিক্ষা পায় কিন্তু জরিনার মুখ থামে না। ও অনর্গল বোকতে থাকে। ওর সৌন্দর্যের সাথে এই বকাবকি বড় বেমানান। তবু বকে। ওর মনের জ্বালা কমেনা। কিন্তু হঠাৎ থেমে যায়। গাড়িতে বউ আসছে। অনেক ছেলে মেয়ে বউ দেখার জন্য ভীড় জমায়। জরিনা দৌঁড়ে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। কি সুন্দর বৌ! কত সুন্দর সাজছে। বরকে দেখে জরিনার হাসি ফুটল আবার থমকে গেল। দেবাশীষকে আজ বড় সুন্দর লাগছে। জরিনা নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি ছেড়ে দিলে জরিনা গাড়ি পিছনে দৌঁড়াতে আরম্ভ করল। “এই বাবু, আমার লাল টিপ তো দিলি না।”
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে জরিনা হাঁপিয়ে উঠল। গাছতলে একটু দাঁড়াল। জরিনার ঐ রকম বধূ সাজতে ইচ্ছে করল। আঁচলটা মাথার উপর ধরে একটু হাসল। তারপর সেদিনের সে কথা মনে পড়ল। এখন যেন ভালোবাসা ওকে একটু স্পর্শ করে গেল। ও টের পেল সেদিনের সেই তির তির কঁম্পনের নীরব যন্ত্রণা। ওর গা ঝাঁকি দিয়ে উঠল।
জরিনা দ্রুত তাবুতে ফিওে এলে দেবাশীষের দেওয়া চিঠি খানা বের করল। ভাজ খুলে শুধূ নীরবে তাকিয়ে থাকল। বলল, “তুইকি লিখেছিলি বাবু? ভালোবাসার কথা লিখেছিলি? তুইকি আমাকে ওমন বউ সাজাতি।”
জরিনা চিঠিখানা আবার ভাজ করে রেখে দিল। তারপর উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল। পায়ের কাপড় হাঁটুর উপর উঠে আছে। কোন স্থানেরও কাপরের শ্রী নেই। কেরামত ফিরে এসে বড়শি রাখতে রাখতে বলল, “অনেক মাছ পেয়েছি।” জরিনা একটুও নড়ল না। বালিশটা মাথার উপর উঠিয়ে দিল। কেরামতের কথা সে শুনতে চায় না। কেরামত তাবুর ভিতরে ঢুকে ওর পীঠে হাত দিল। জরিনা বালিশ ফেলে তার দিকে তাকাল। কোন কথা বলল না। কেরামত আবার বলল, “অনেক মাছ পেয়েছি।” জরিনা কেরামতের দিকে গভীর ভাবে তাকাল। কিন্তু না দেবাশীষের মত বর বেশে সাজাতে পারল না। জরিনার দিনগুলো ভালো কাটল না। মন্ত্র আর বীণ যন্ত্রটা তাকে এমন করে দিেেছ। কিন্তু বাঁশিতে ওর দারুণ নাম। যে কোন বীণই সে অনায়াসে বাজাতে পারে।
দিনগত হতে লাগল। জরিনার একটা মেয়ে হলো। তার নাম দিল মর্জিনা। মর্জিনা দেখতে ঠিক জরিনারই মত। সে জরিনার চেয়ে বেশি হাসে, বেশি কথা বলে।
আবার তারা স্থান ত্যাগ করল। পদ্মার পাড়ে কোথায়ও চলে গেল। জায়গাটির মাঝে নাকি বিশ দিন মেলা বসবে। জরিনা গোছগাছ করতে হঠাৎ দেবাশীষের চিঠিটা বেরিয়ে পড়ল। ভাজ খুলে আবার রাখল।
পদ্মার পাড়ে জরিনার ভালোই লাগল। খোলা হাওয়া নতুন নতুন মানুষের সমাগম। ওরা নেচে গেয়ে বেশ ভালোই রোজগার শুরু করছে।
হঠাৎ একদিন সকালে দেখা গেল একটা ভ্যান ভরে কতগুলো লোক বেদের বহরের দিকে আসছে। সেলিমের বউ এসে বলল, “সাপে কাটা রোগী।” বেদের বহরের সবাই বাইরে এসে এক জায়গায় জড় হলো। গয়া বলল, “এ রোগী বাঁচানো অসম্ভব। আমাগো ভিতর এমন কোন বাইদ্যা নাই।” জরিনা তাবুর ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে রোগী দেখতে এলো। রোগী দেখে জরিনার চোখ কপালে উঠল। কাছে এলো। হাত দিয়ে মুখটা নিজের দিকে ঘোরাল। তারপর এক পলক তাকিয়ে থাকল। বলল, “আমি পারব।”
“না না, এ অসম্ভব। রোগী এখান থেকে নিয়ে যাও।” গয়া বলল, “জরিনা তুমি পারবে না। তুমি কেন এই বহরের কেউ পারবে না।”
জরিনা দেবাশীষের কাছে এলো। বলল, “রোগী বাঁচলে আমারে লাল টিপ দিতে হবে। আমি সুন্দর করে আবার বউ সাজব।”
দেবাশীষ জরিনার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই জরিনা, সেই চিরদিনের মত চেয়ে থাকা দুটি চোখ। সেই জরিনা।
“কথা দে। দিবি? নইলে তোর বউ মরবো।”
“কথা দিলাম।”
জরিনা তাবুতে ফিরে মেয়েটার পানে খানিক নীরবে তাকাল। তারপর একটা বাঁশি এনে বাজাতে শুরু করল। দুই ঘণ্টা বাজানোর পর জরিনা পড়ে গেল। মুখ দিয়ে রক্ত পরতে লাগল। সেদিনের মত আজও দেবাশীষের পানে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকল। আজ দেবাশীষের সাহায্যের হাত নেই। ওর কাছে এলো। জরিনা বলল, “তোর বউরে বাঁচাতে পারলাম না। তোর টিপে আমার সাজা হলো না।”
০১ আগস্ট ২০১২ইং
নিজবাড়ি।
©somewhere in net ltd.