নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলা স্যার

সুব্রত বৈরাগী

সুব্রত বৈরাগী › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাম না জানা কবি

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:২৬


জানালার গ্রীলে মরীচা ধরছে। কিছু মাকড়সার জাল ঘিরে আছে প্রায় পুরো জানালাটা। রেখা ঝাড়ু ধরে আবার থেমে গেল। রাজের প্রিয় জানালা। এখানে ঝাড়ু মারা যাবে না। একটুকরো কাপড় নিল। ঘষে ঘষে সব পরিষ্কার করল। জানালা ধরে একটু দাঁড়াল। জানালা দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়। পলাশ বনের পাগলা হাওয়া এখানে এসে ধরা দেয়।
রাজ চলে যাওয়ার অনেক দিন পরে রেখা এ বাড়িতে এসেছে। রাজের মাও কােন দিন রাজের এ জানালা বন্ধ করেনি। বলেছে, “আমার রাজ এ জানালায় দাঁড়িয়ে কথা বলে।” বৃষ্টি বাদলে বিছানার চাঁদরের অনেকাংশ রঙ চটে গেছে। এ চাঁদরটির বয়সও অনেক। প্রায় তাদের ছেলে রাজুর বয়সী। আর কত দিন টিকবে। কেবল রাজের হাতে কেনা বলে আজও আছে। বিছানা ঠিক করতে রাজের কথাটা মনে পড়ল। জানালা ঘেষে আবার দাঁড়াল। মনে পড়ল-
আসবে যখন ভােরের হাওয়া
জাগবে মনের সকল চাওয়া
সকল প্রেমের এমনি পাওয়া
আরো কত দেওয়া নেওয়া
বিজন বনের কােণে,
তুমি আমি দু’জনে দু’জন মিলছি সঙ্গোপনে।

“কার লেখা?”
“জানি নাতো।”
“তিনি কি নাম না জানা কবি?”
“এক সময় সবাই কবি হয়ে ওঠে। মানুষ তার কত জনের নাম জানে?”
জানালা ছেড়ে বিছানায় বসল। নজর পড়ল তাকটার দিকে। কখন যেন বাতাসে তার সব বইগুলো পড়ে গেছে। রাজ বই পড়তে পছন্দ করতো। অনেক বই কিনেছিল। এ আড়াই বছরের ঝড় বৃষ্টিতে তার অনেকগুলি নষ্ট হয়ে গেছে। ইঁদুর বসে বসে কেটেছে।
রেখা তাক মুছতে দেখলো এখনও সেখানে একটা বই রয়েছে। মুছার জন্য সেটা নিল। মলাট ফুলে উঠছে। ঘষতে ঘষতে একটা পাতা উল্টে গেল। এটা বই নয় ডায়েরি। পাতা উল্টাতে উল্টাতে রেখা অবাক হলো। আবার মলাট দেখল। নাম ধাম কিছুই বােঝা যায় না ঝলসে গেছে।
হে পথিক তুমি ভুল পথে চললেও এটা একটা পথ ছিল। সে পথ একদিন তােমারও হতে পারতো। নিচেরটুকু ঝলসে গেছে। যে অক্ষরগুলি দেখা যায় তা দিয়ে বাক্য তৈরি করা যাচ্ছে না।
ইঁদুরে কাটা বইগুলি নেড়ে দেখল তার একটাও বই না ডায়েরি। কাটার ফাঁকে ফাঁকে অক্ষরগুলি এখনও উঁকি দিচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে রাজ পড়তো না লিখতো। কাটা টুকরোগুলো এক জায়গায় করতে দেখল তার নিচে আরেকটা ডায়েরি পড়ে আছে। ইঁদুর তার কেবল মলাট কেটেছে।
মানুষের জীবনে অনেক বার ভালোবাসা আসে কিন্তু সত্যিকারে ভালোবাসা আসে একবার। সত্যিকার ভালোবাসা কখনও বদলায় না। সত্যিকার ভালোবাসা না এলে বােঝা যায় না অন্য ভালোবাসাগুলো কত নেহাৎ ছিল।
চলে যাওয়ার পথ ধরে আর ফিরে এসো না। পরে এসে এ পথ পাবে না ঘাসে ঢেকে যাবে।
কাজের উপর বিশ্বাস রেখো, মনের উপর নয়। কর্মের ফল ভােগ করতেই হয়। আর কােন কিছু পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠনা। তবে সে জিনিসটা পেতে অনেক দেরী হবে। মনটাকে বড় করো। সকল কিছুকে আগে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখ। আবার দেখ। সে বারও ভুল হতে পারে। সকল কিছুর জন্য নিজে অনুসন্ধান করো। পরের কথা ভুলও হতে পারে। নিজের কাজ পরে করলে কাজ হয় কিন্তু নিজের মত হয় না।
যদি কখনও মনে পড়ে তােমার খােলা জানালায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশ থেকে আমায় চিনে নিও। ঝরা পাতার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মনে রেখ, আমি তখনও তােমার পাশে আছি।
পড়বে মনে সেই সকালে
ছিলাম আমি তােমার কােলে
তুমি- মুছতে অশ্রু মুচবে কাজল, কাঁদবে মায়ার ছলে
আমার খণ্ড প্রেমের পূর্ণ মিলন সে-
তোমার চােখের জলে।
রেখা ধীরে ধীরে ডায়েরিটা বন্ধ করল। চােখে জল এসে গেছে কাজল নেই। একসময় সে অনেক সুন্দর করে কাজল পরতো। রাজ বলতো, কাজলে তােমাকে আরো সুন্দর দেখায়। রাজকে সে খুব একটা পছন্দ করতো না। তবু সুন্দর করে সাজতো, কাজল পরতো। রাজের কথা রাখতে নয় রূপের প্রশংসায়। রেখার রূপ আজও ঝলসে যায়নি। রাজ তাকে বড় একটা আয়না কিনে দিয়েছিল। রেখা আয়নার সামনে দাঁড়াল। আয়না আবছা হয়ে গেছে। কাপড়ের আঁচল টেনে তা পরিষ্কার করলো।
রাতের চাঁদ উঁকি দিয়েছে। পলাশ বনের পাখিরা ঘুমে পড়ছে। রাজুও ঘুমন্ত। রেখা বিছানা ছেড়ে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়াল। রাজের দেওয়া ছােট খাটো আঘাতগুলি মনে পড়ল। ধীরে ধীরে সেগুলো ভালোবাসার রূপ নিল। একটা অজানা অনুভূতি তার সমস্ত শরীরকে কাঁপিয়ে তুলল।
রাজের টেবিলের সামনে বসল। প্রথম ডায়েরিটা আবার খুলল। বিয়ের দশ দিন পরে লেখা।
তোমাকে নিয়ে লিখতে ভালো লাগে তাই লিখি। পলাশ বনের পাগলা হাওয়া আমাকে কবি বানিয়ে দেয়। মিথ্যা লিখব না। যুক্তিও দেখাব না। যুক্তি তর্কে যৎ কিঞ্চিৎ জয় করা গেলেও সে জয় চিরদিনের হয় না। তােমাকে নিয়ে গল্পও লিখব না। গল্প মিথ্যা। কবিরা মিথ্যুক। তবু কবিতা আর দেবতা সাধনার বস্তু। তুমি আমার কবিতা আমি তােমার দেবতা নয় কবি। বাইরের কেউ না জানলেও।

রেখা টেবিলে মাথা রাখল। কখন যেন সে ঘুমিয়ে পড়ল। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলে দেখলো রাজু এখনও ঘুমিয়ে আছে। হাত মুখ ধুয়ে রান্না ঘরে ঢুকল। রান্নায় তার মন বসল না। রাজ তাকে বলতো, তােমার রান্না দারুন। একবার কেউ খেলে আবার খেতে চাবে। রেখা কােনদিন সে কথায় কান দেয়নি।
রেখার বাপ মা জাের করে রেখাকে রাজের সাথে বিয়ে দেয়। রাজ তখন বেকার যুবক। চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ছুটছে। রাজের চাকরি না করলেও চলে। কিন্তু সে একটা কিছু করতে চায়। বাবার সম্পদ নিয়ে তার তেমন গৌরব নেই। রেখার অবশ্য সেদিকে নজর আছে। নইলে কেবল বাবার কথায় সে বিনয়কে ভুলে রাজকে বিয়ে করতো না। প্রায় সব নারীরাই এমন হয়। সামনের দরজায় বিত্তশালী যুবক এলে প্রেম পিছনের দরজা দিয়ে পালায়। কিন্তু সংসারে সম্পদের চেয়ে সম্পর্কের টানই বড় প্রয়োজন।
বেলা পড়ে গেছে। রেখা জানালায় দাঁড়াল। রাজের অনেক কথা মনে করলো। রাজের কথা মনে করতে করতে কখন যেন তার মনের বনে বিনয় এসে ধরা দিল। রেখা নীরবে একটু হেসে পড়ল। আজ অনেক বছর হলো বিনয়ের সাথে দেখা হয় না। মা বােন মারা যাবার পর সে আর কােন দিন ফেরেনি। কােন খবরও মেলেনি।
রেখা বিনয়ের কথা ভুলতে চাইল। রুমে এসে ডায়েরিটা খুলল। দুজনের ভালোবাসা একটু তুলনা করলো। কিন্তু কাউকেই ছােট করতে পারলো না। ডায়েরিটা বন্ধ করে রাজের ছবির কাছে এলো। বলল, “আমি তােমাকে অনেক ছােট করেছি। তুমিই আমার সবচেয়ে সেরা উপহার। তােমার সম্পত্তির লােভে আমি আমার যে সম্পদ ত্যাগ করে ছিলাম তা ছিল একটা মস্ত বড় ভুল। সে ভুল সংশোধন যােগ্য নয়। কিন্তু তােমার সে সম্পত্তির মাঝে একা থেকে বুঝেছি তােমার সাথে যা করেছি তা বড় অন্যায়। তুমি আমাকে এমন ভাবে ভালোবাস তা আমি কল্পনাও করিনি। আরো বুঝলাম যে ভালোবাসায় মানুষ ধরা দেয় না সেটাই তার জীবনের সেরা।
রেখার ঘুম এখন একেবারেই নেই। সারা রাত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ধারনা রাজ একদিন এ জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে। কথা না বলুক একবার তাকাবে। দেখবে আমি তার জানালায় তার অপেক্ষায় আছি।
কেবলই কষ্ট দিয়ে গেলে কষ্টের জ্বালা বােঝা যায় না। আজ রেখা তার অনেক ভুল বুঝতে পারল। রাজ তার যে রূপ দেখে প্রশংসা করেছিল সে রকম সাজল। সুন্দর করে কাজল পরলো। তারপর বেরিয়ে পড়ল পলাশ বনের দিকে। একাকী হাঁটল। রাজ তাকে অনেক বার নিয়ে আসতে চেয়েছে। কখনও আসা হয়নি। এটা যে এতো সুন্দর রেখা তা বুঝতেও পারেনি। তার পা নীরব হয়ে গেল। দেখলো সামনে অনেক লােক এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। একজনের কাছে জানা গেল এখানে একটা সভা হবে। সাহিত্য সভা।

আজকের সভায় অনেক নতুন পুরাতন সাহিত্যিকগণ এসেছেন। প্রথম কবিতা পাঠরে আসর। রেখা এক কােণায় দাঁড়াল। প্রথম যে এলো সে রেখার প্রিয় মানুষটি ‘বিনয়।’ রেখা অবাক হলো। এতোদিন পরে এভাবে দেখা হওয়ার জন্য। সে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে বলল, আমি যে কবিতা আপনাদের মাঝে নিবেদন করব সে কবির নাম আমি জানি না। একদিন এ পলাশ বনে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। কবিতাটি যার নামে উৎসর্গ করা সে নামটি আমার অনেক চেনা, নন্দিতা। নামটি আমিই একদিন দিয়েছিলাম।
পড়বে মনে সেই সকালে
ছিলাম আমি তােমার কােলে
তুমি- মুছতে অশ্রু মুচবে কাজল, কাঁদবে মায়ার ছলে
আমার খন্ড প্রেমের পূর্ণ মিলন সে-
তোমার চােখের জলে।

রেখার দুই চােখের পানি দুই প্রেমের তরঙ্গোচ্ছ্বাসে ঝলসে উঠে কাজলকে মুছে দিচ্ছে। রেখা সে জল মুছল না।
রেখা এখন নিয়মিত সাহিত্য সভায় আসে। সেদিন হঠাৎ করেই বিনয়ের মুখোমুখী হয়ে পড়ে।
“নন্দিতা।”
“না। আমি রেখা। নন্দিতা হারিয়ে গেছে।”
“আমিতো তাকে কখনও খুঁজিনি।”
“আর খুঁজও না। যা হারায় তা পাবার নয়। তা নিজের বলে ভাবা মিথ্যা । তুমি তােমার আসরে যাও।”
“আমি কবি না। আমি একজন নাম না জানা কবির ভক্ত। তাকেই খুঁজে ফিরছি।”
“সে কবির নাম আমি জানি। তার কবিতা তােমার নন্দিতাকে উৎসর্গ করলেও তার রেখাকে নিয়ে লেখা।”
“তাইতো ভাবী নন্দিতা হবে গল্প কি করে কবিতা হলো। সে কবিকে তােমার ভালোবাসা না দিতে পারলেও আমার ভালোবাসাটুকু দিও।”
“সে এখন আর কারো ভালোবাসার কাঙ্গাল না।”

বিনয় চলে গেল। রেখা আরেকটু সামনে এগিয়ে দাঁড়াল। আজ তেমন কােন কবি আসেনি। রেখা ফেরার জন্য পা বাড়াল। হঠাৎ শুনল, “আমি একজন নাম না জানা কবি। আপনাদের কি কবিতা শােনাই। রেখা ঘুরে দাঁড়াল। লােকটাকে চেনাই যায় না। দাড়িতে মুখ ভর্তি। চুল অনেক লম্বা।
“আমি রাজেশ্বর রায়। সেদিনের বিনয় বিশ্বাসের কবিতার কবি। আজ আমি যে কবিতা শােনাব তার নাম ‘প্রিয়তমা।”
যে বুক তােমার আমার বুকে
সেও দােলে অন্য সুখে
হাস তুমি আমায় দেখে, কাঁদো অন্যের মাঝে
আমার প্রেমের পূণ্যি নিয়ে
যাও অন্যেরে পূজে
যে তােমারে সব দিল নাই তার বাকী
আজও তুমি তারে কেবল দিয়ে যাও ফাঁকি।
রেখার চােখে আজ কাজল নেই শুধু জল। তবু মুখে হাসি। রাজেশ তার পলাশ বনকে ভােলেনি। হয়তো সে জানালায়ও দাঁড়িয়েছে। একটা না পাওয়ার বেদনায় সারা পলাশ বনকে কাঁদিয়েছে।
সভা শেষ। বেলা পাটে বসেছে। চারিদিকে গােধূলির রঙিন আলো। রেখা তার কবির মুখোমুখি হলো।
“রাজ।”
রাজ মাথা ঝাঁকিয়ে, “না। আমি রাজেশ্বর রায়।”
“তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে তােমার ভালোবাসাকে ছােট করবো না। কিন্তু তােমার বুকে জ্বলে ওঠা আগুনকে একটু নিভাতে দাও। কথা দিলাম, তুমি যেভাবে আমাকে সাজাবে আমি সানন্দে সে সাজ মেনে নেব। সে সাজ আমি কােন দিন খুলবো না। আমার সব পূজা সে কেবল তােমার চরনে হবে। তুমি আমার নাম না জানা কবি। সেখানে আমি কবিতা তুমি কবি নয় আমার দেবতা।”

কখন যেন সন্ধ্যা নেমে এলো। চারিদিকে অন্ধকার। সমস্ত লােক নিঃশব্দে চলে গেছে।
২০.০৮.২০১৩ইং
তেঁতুলিয়া, কাশিয়ানী
গোপালগঞ্জ-৮১৩১।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৫১

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: কবিতা ও গল্পের সমন্বয়ে অসাধারণ একটি লেখা! +

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.