নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

সুফিয়া

পৃথিবী আমাকে শূণ্যতায় বাঁধতে পারেনা অস্তিত্বে মাকে আগলে রেখেছি বলে।

সুফিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি সকালের গল্প

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:০৮

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পূব দিকের বারান্দায় দাঁড়ানোটা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। আমার নয়তলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়াই আমি আরও একটা সুবিধা ভোগের লোভে। বারান্দার উত্তর দিকে রাস্তার ওপাড়েই লাগোয়া কলেজ চত্বর। সেখানে রয়েছে গাছপালার জড়াজড়ি অবস্থান। তাই এই সময়টা আমাকে প্রকৃতি প্রেমিক করে তোলে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতির দুয়ার খোলে দিয়ে গাছের পাতার গায়ে মৃদুমন্দ বাতাসের নাচন দোলা দেখি।



সকাল বেলার এই এক বাড়তি সুবিধা। কোথাও বাতাসের অস্তিত্ব চোখে না পড়লেও গাছপালার দিকে তাকালে মনে হয় সর্বত্র নির্মলতার ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ সমীরণ। আমি সেই ছোঁয়া গায়ে মাখতে মাখতে তাকাই মাথার উপর উন্মুক্ত আকাশের দিকে। সেখানে সূর্য উঠার প্রস্তুতি। আমার কাছে মনে হয় এটা হচ্ছে আকাশের নিজস্ব গর্বিত আয়োজন। তাই এই সময়ে আকাশের সাজ ভিন্ন, একেবারে অন্য রকম। আমার দৃষ্টি চলে যায় সামনের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর দিকে। এখনও যেন জেগে উঠেনি ওরা। ওদের দিকে তাকালে মনে হয় শহরটা শুধুই ইট-পাথরের ঠাস বুনন। এখানে কোন সবুজ নেই, নির্মল হাওয়া নেই, বুক ভরে শ্বাস নেয়ার কোন সুযোগ নেই।



কিন্তু আছে। কারণ, আমি পারছি। ঢাকা শহরের অসংখ্য উঁচু দালানের একটির বাসিন্দা আমি। আমার সামনে খোলা আকাশ, বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর আর বুক ভরে শ্বাস নেয়ার জন্য চারপাশে বাতাসের হুটোপুটি খেলা। জনাকীর্ণ ঢাকা শহরে এর চেয়ে বেশী কিছু বোধহয় আশা করা যায় না। কিন্তু আশা না করেও আরও একটা কিছু পেয়েছি আমি। সেটা হলো একটি রাস্তা। আমার ফ্ল্যাটের উত্তর দিক দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে চলে গেছে রাস্তাটা। আমি প্রতি সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকি। লোকজনের চলাচল দেখি। রিকশা-কাভার্ড ভ্যান-প্রাইভেট কার-টেম্পু-ট্রাক - কত কি ছুটে যাচ্ছে এই রাস্তা ধরে ! কিন্তু আমার দৃষ্টি ওদের পিছু ধায় না। বরং স্থির হয়ে যায় রাস্তার পাশের ফুটপাতে, কলেজের বাউন্ডারী দেয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠা সংসারের দিকে।



প্লাষ্টিক কাগজে মোড়া ও ছাউনি দেয়া একখানা ঘর। এখানেই এদের রান্না-বাড়া, শোয়া। আমি আন্দাজ করতে চেস্টা করি কয়জন মানুষ শুতে পারে এই ঘুপচি ঘরে। একজন কিংবা বড়জোড় দুই জন ? তাও পা মুড়ে গুজে হয়ে। কিন্তু আমার অনুমান মিছে হয়ে যায়। কারণ, আমার চোখের সামনে ঘর থেকে একে এক চার/পাঁচ জন বের হয়ে আসে রাতের সুখনিদ্রা সেরে। বের হয়ে আসে স্ত্রী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী হবে নিশ্চয়ই। এরপর তাদের অনুমানিক পাঁচ বছর বয়সী ও আট বছর বয়সী দুটি সন্তান। সবশেষে কিশোরী মেয়েটিও বের হয়ে আসে। আমি চিন্তত হই এদের কথা ভেবে। পারিবারিক জীবনের স্বাভাবিক আব্রু কি ওরা রক্ষা করতে পারছে ? স্বামী-স্ত্রী কি পারছে এই কিশোরী মেয়েটির কাছ থেকে নিজেদের একান্ত মুহূর্তগুলোকে আড়াল করতে ? তাছাড়া দেহমনে যৌবনের পেলবমাখা এই কিশোরি মেয়েটিরও তো ব্যক্তিগত কিছু আড়াল করার আছে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে।



আমি ভাবি আর ভাবি। কিন্তু হিসেব মিলে না কিছুতেই। তাই বলে থেমে থাকে না ওদের জীবনাচার। ততক্ষণে সকাল বেলার প্রত্যাহিক ক্রিয়া-কর্ম সেরে ফেলেছে ওরা সবাই। কর্তা ব্যক্তিটির কাজে যাবার তাড়া। তার স্ত্রীও যাবে বাসার কাজে। ফুটপাতের উপর সবাই বসে পড়েছে রাতের রেখে দেওয়া ভাতের হাড়ি ঘিরে। মহিলাটি নিপুন হাতে সবার পাতে তুলে দিচ্ছে এক মুঠো করে পান্থা। কর্তা ব্যক্তিটির পাতে একটু বেশী। সাথে এক চিমটি করে লবণ। মুখে প্রসন্ন ভাব নিয়ে গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছ সবাই। কিন্তু ছোট বাচ্চাটির তারস্বরে চীৎকার থামছে না কিছুতেই। তরকারী ছাড়া শুধু লবণ দিয়ে ভাত খাবে না সে। তার তরকারী চাই। মা তাকে বুঝায়, এখন খেয়ে নে বাপ। আজ বাসা থেকে তোর জন্য মাছের তরকারী এনে দিব। বড় মাছের টুকরা দিয়ে রাতে ভাত খাবি। এখন এই দিয়ে খেয়ে নে বাপ। কিন্তু ছেলেটির এক কথা। লবণ দিয়ে ভাত খেতে ওর ভাল লাগে না। মা প্রতিদিন বলে তরকারী এনে দিবে। কিন্তু নিয়ে আসে পচা তরকারী। মিথ্যা কথা বলে ওর মা প্রতিদিন।



ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়ে গেছে বাকীদের। কিন্তু ছোটটিকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না ওর মা। এদিকে দেরী হয়ে যাচ্ছে বাসার কাজে যেতে। তাই এক ঘা বসিয়ে দেয় ছেলেটির পিঠে। সাথে সাথে থেমে যায় ছেলেটির কান্না। তার মায়ের হাতে লেগে থাকা ভাত ছিটকে পড়ে চারপাশে। কিশোরী মেয়েটি অতি যত্নে সেই ভাত কুড়াতে লেগে যায়। আর আফসোস করে বলতে থাকে, একি করলে তুমি মা ? এক লোকমা ভাত তুমি নষ্ট করলে ? এইটুকু ভাতই আমাদের আসে কোত্থেকে ?



দৃশ্যটা দেখতে দেখতে আমার চিন্তার বাঁক ঘুরে যায়। মনে মনে ভাবি এই কিশোরীর বাড়ন্ত শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার সে পাচ্ছে না বলেই ছিটকে পড়া ভাতগুলোর জন্য ওর এত মায়া। আমরা কেউ কখনও এটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি না। নয়তলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পূবের আকাশে সূর্যোদয় দেখা, সবুজ গাছপালার কাছ থেকে নির্মল হাওয়ার ছোঁয়া নিয়ে গায়ে মাখা ইত্যাদি কোন কিছুই থাকত না যদি এই কিশোরী মেয়েটির মতো রাস্তায় ছিটকে পড়া এক মুঠো ভাত কুড়িয়ে খেতে হতো। আরও ভাবি কিশোরী মেয়েটির ভাত কুড়ানো আর নয় তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখা -- এই দুই দৃশ্যের মাঝে শ্রেণী বৈষম্যের যে অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে তা কি কোনদিনও নিশ্চিহ্ন হবার নয় ?

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:০৩

মাধব বলেছেন: আওসম্ভব ভাল লেগেছে আমার তোমার চিন্তাধারা এবং সেই সঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে শেখাচ্ছে। শুকরিয়া তোমাকে।

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:২৯

সুফিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ পড়ার জন্য। ভাল থাকবেন। আপনাদের ভাল লাগা নিয়ে যেন আরও এগিয়ে যেতে পারি সে সেই দোয়া করবেন।

২| ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:৩৪

মে ঘ দূ ত বলেছেন: আপনার লেখা বোধহয় এই প্রথম পড়ছি। ভালো লাগলো আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর আপনার লেখনী।

সকালের প্রকৃতির এমন রূপের ভক্ত আমিও। আশা করি আজকের সকালটাও দারুণ কেটেছে।

শুভেচ্ছা রইলো।

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:৩২

সুফিয়া বলেছেন: আমার কাছে সকাল মানেই পুত-পবিত্র একটা সময়। প্রকৃতি সেই সময় থাকে স্বচ্ছ, নির্মল ও উদার। তাই সকাল আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি সময়। আপনিও আমার মতো প্রকৃতির রূপের ভক্ত জেনে ভাল লাগল।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার লেখাটা পড়ার জন্য। ভাল থাকবেন।

৩| ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:২২

ফারজুল আরেফিন বলেছেন: ভালোলাগলো লেখা। +++

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:৩২

সুফিয়া বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.