নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি\nমানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

সূফি বরষণ

ানু মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

সূফি বরষণ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব ছয়... বাংলার মানুষের মুক্তির দূত বখতিয়ার খিলজি সাধারণ সৈনিক থেকে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা ॥

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০২



ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব ছয়...
বাংলার মানুষের মুক্তির দূত বখতিয়ার খিলজি সাধারণ সৈনিক থেকে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা ॥
সূফি বরষণ
ভূমিকা:
বর্তমান বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় তুর্কি মুসলিম অভিযান সফল হওয়ার মাধ্যমে । কারণ ঐ সময় বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম সমাজ রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়॥ এর আগে বঙ্গভূমিতে আরব বনিক, ইসলাম প্রচারক দা,য়ী, সূফি সাধকগণের মাধ্যমে এদেশের জনগণ ব্যাপক ভাবে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে॥ যার ফলে মুসলমানদের বাংলা বিজয় স্থায়ী হয় সাড়ে পাঁচশো বছর ॥
আরব বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই । বাংলাদেশের দু’টি প্রাচীনতম স্থান পাহাড়পুর ও ময়নামতিতে আব্বাসী খলিফাদের মুদ্রা পাওয়া গেছে। এতে প্রমাণিত হয় বঙ্গের সাথে আরবদের যোগাযোগ অনেক প্রাচীন ॥
বাংলায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি মুসলিম বীর সেনানী অভিযান পরিচালনা করেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। এই তুর্কি মুসলমান অভিযান প্রধানত চলেছিল উত্তরবঙ্গে।
উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় তখন ছিল থরু, কোচ, মেচ প্রভৃতি মোঙ্গলধারার মানুষের বাস। তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক লোক প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করে। মেচদের একজন সর্দার ইসলামে দীক্ষিত হয়ে নাম গ্রহণ করেন আলী। এই আলী মেচ ইখতিয়ার উদ্দিনের মৃত্যুর পর গৌড়ের অধিপতি হন। নানা কারণে পরবর্তীকালে বহু তুর্কি মুসলমান বাংলায় আসেন।
বীর বখতিয়ার উদ্দিন খিলজি :
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার উদ্দিন খিলজি ছিলেন জাতিতে তুর্কী এবং বৃত্তিতে ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। তিনি ছিলেন আফগানিস্তানের গরমশির বা আধুনিক দশত-ই মার্গের অধিবাসী। দারিদ্র্য নিপীড়িত বখতিয়ার স্বীয় কর্ম শক্তির উপর নির্ভর করে ভাগ্যান্বেষণে বের হয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি সুলতান ঘোরীর সৈন্য বিভাগে চাকরির জন্য আবেদন করেন কিন্তু তার শারীরিক ত্রুটির কারণে তিনি সেখানে চাকরি লাভে ব্যর্থ হন। গজনীতে ব্যর্থ হয়ে তিনি দিল্লির শাসন কর্তা কুতুবুদ্দীনের দরবারে হাজির হন। এখানেও তিনি চাকরি লাভে ব্যর্থ হন। অতঃপর তিনি বদাউনে যান এবং সেখানকার শাসন কর্তা মালিক হিজবর উদ্দীন বখতিয়ারকে নগদ বেতনে চাকরিতে ভর্তি করেন। কিছুদিন পরে তিনি বদাউন ত্যাগ করে অযোধ্যায় গমন করেন। অযোধ্যার শাসনকর্তা হুশামউদ্দীন তাকে দু’টি পরগণার জায়গীর প্রদান করেন। এখানেই বখতিয়ার তাঁর ভবিষ্যৎ উন্নতির উৎস খুঁজে পান।

বখতিয়ার অল্পসংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে তার পরগণার পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্য আক্রমণ করেন। এ সময় তাঁর বীরত্বের কাহিনী সবদিকে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে ভাগ্যান্বেষী মুসলমান তার সৈন্যদলে যোগদান করেন। ফলে বখতিয়ারের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অতঃপর তিনি বিনা বাধায় এক বৌদ্ধ বিহার জয় করেন। এইটি ছিল ওদন্ত বিহার যা পরে বিহার নামেই পরিচিতি লাভ করে। বিহার জয়ের পরে আরো অধিক সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে বখতিয়ার নদীয়া আক্রমণ করেন। এ সময় বাংলাদেশের রাজা লক্ষণ সেন রাজধানী নদীয়াতে অবস্থান করছিলেন।

নদীয়া অভিযানকালে বখতিয়ার ঝাড়খণ্ড অরণ্য অঞ্চলের মধ্যদিয়ে এত দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে, যখন তিনি নদীয়ায় পৌঁছেন তখন মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী তাঁর সঙ্গে ছিলেন, বাকি মূল বাহিনী পশ্চাতে ছিল। বখতিয়ার সরাসরি লক্ষণ সেনের প্রাসাদদ্বারে হাজির হন এবং রক্ষীদের হত্যা করেন। তাঁর আগমনে শহরে সোরগোল পড়ে যায়। এ সময় মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত রাজা লক্ষণ সেন মুসলমান অভিযানের খবর পেয়ে পশ্চাৎ দ্বার দিয়ে পালিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় নেন। পূর্বেই দৈবজ্ঞ, পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণগণ লক্ষণ সেনকে এই বলে রাজধানী ত্যাগ করতে অনুরোধ করেছিল যে তাদের শাস্ত্রে তুরস্ক সেনা কর্তৃক বঙ্গ জয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে এবং বিজয়ের বর্ণনা শাস্ত্রে আছে। কিন্তু রাজা লক্ষণ সেন তাদের কথা আমলে না নিয়ে নদীয়ায় থেকে যান। তিনি নদীয়া আক্রমণের স্বাভাবিক পথগুলো রুদ্ধ করে দিয়ে মোটামুটি নিশ্চিন্তায় নদীয়ায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু বখতিয়ার স্বাভাবিক পথে আক্রমণ না করে দুর্গম অরণ্যাঞ্চলের মধ্যদিয়ে আক্রমণ চালিয়ে লক্ষণ সেনকে পালাতে বাধ্য করেন।

বখতিয়ার তিনদিন ধরে নদীয়া লুট করেন এবং প্রচুর ধনসম্পদ হস্তগত করেন। অতঃপর তিনি নদীয়া ত্যাগ করে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে যান। তিনি লক্ষণাবতী অধিকার করে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। গৌড় জয়ের পর তিনি আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার বিস্তার করেন। বখতিয়ার নব প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। তিনি অধিকৃত এলাকাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগে একজন সেনাপতিকে শাসনভার অর্পণ করেন।

তুর্কিস্তানের সাথে সোজা যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি তিব্বত আক্রমণ করতে প্রয়াসী হন এবং আক্রমণের সমস্ত পথঘাটের খোঁজ-খবর সংগ্রহ করেন।

বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া চক্রান্ত:
১২০৪ সালের মার্চ মাসে বাংলায় কায়েম হয় মুসলিম শাসন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী সতেরজন ঘোড়সওয়ার সৈনিক নিয়ে আসেন বাংলায়। অত্যাচারী শাসক লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করেন। মুসলমানগণ প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর এ দেশ শাসন করেন। শান্তি, সৌহার্দ, উন্নয়ন-অগ্রগতি ও আদর্শের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা সমাজে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য রচিত হয় শান্তির নীড়।

বিশ্ব দরবারে বাংলার পরিচিতি ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ‘জান্নাতুল বালাদ’ ‘প্রাচ্যের স্বর্গ’ ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত হয় এ ভূখণ্ডটি। মুসলিম শাসনের প্রথম কয়েক শতাব্দী কাটে মোটামুটি নির্বিঘ ও স্বচ্ছন্দে। পর্যায়ক্রমে মুসলিম রাজা-বাদশাদের হেয়ালীপনা ও আয়েশী জীবনের ঘোরে ডুবে যাবার ফলে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জালের বুনন শুরু হয়। সে সময়ের সাহসী আলেম নূর কুতবুল আলমের প্রতিরোধের মুখে রাজা গণেশের চক্রান্তও বেশিদিন টিকেনি। ১৫০৬ সালে শ্রী চৈতন্যও মুসলিম শাসন ধ্বংসের জন্য হিন্দুদেরকে ক্ষেপিয়ে তোলার যথেষ্ট চেষ্টা চালায়। কিন্তু মুসলিম শাহ এর দূরদর্শিতা এবং তৎকালীন সময়ের দেশপ্রেমিক সচেতন আলেমসমাজের ভূমিকার কারণে সব চক্রান্তই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

হিন্দু কল্কি অবতার:
হিন্দু কল্কি অবতারে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৮ জন সেনা যার মধ্যে বখতিয়ার খলজিও একজন তাঁরাই বিজয় সম্পন্ন করেছিলেন। ইতিহাসের নানা বই ঘাটতে ঘাটতে এটা আবিষ্কার করেছি যে লক্ষণ সেনের সৈন্যরা কোন বাধাই দেয়নি বখতিয়ার খলজিকে। কিন্তু কেন?

এই ধাঁধাঁ বুঝতে হলে ইতিহাসের আরো বিষয় জানতে হবে। প্রয়োজন হবে ঘটনাটিকে হিন্দু ধর্মের আর সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে পাঠ করার।

হিন্দুদের দশ অবতারের শেষ অবতার কল্কি অবতার “কল্কিন” শব্দটা এসেছে “কর্কিন” থেকে, মানে “কর্ক” (সাদা ঘোড়া চড়েন যিনি)। তাহলে কল্কি শব্দটার মানে হচ্ছে “সাদা ঘোড়ায় আরোহী বীর”। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে এই “কল্কিন” ধর্মঠাকুরের এক বিশেষ প্রকাশ বলে গণ্য হয়েছে। ধর্মঠাকুরের গাজন- অনুষ্ঠানের ছড়ায় আছে।

“হাঁসা ঘোড়া খাসা জোড়া পায়ে দিয়া মোজা
অবশেষে বোলইলে গৌড়ের রাজা।“

সেই সময় ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধার বেশে বিষ্ণুর গল্প খুব ছড়িয়ে পড়েছিল। বখতিয়ার জামানার অনেক পরের একটি লৌকিক ধর্মানুষ্ঠানের ছড়ায় আছে যে, “ব্রাহ্মণদের অত্যাচার দেখে স্বয়ং পরমেশ্বর তাঁর দলবল নিয়ে মুসলমান সেজে হানা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।“

বখতিয়ার এসেছিলেন সাদা ঘোড়ায় চেপে; তাই বখতিয়ারের অশ্বারোহী বাহিনীকে সাক্ষাৎ অবতার মনে করেই লক্ষণ সেনের সেনারা বাধা দেয়নি, এটা নিশ্চিত। বখতিয়ারের নদিয়া বিজয়ের পরেও হিন্দু কবিরাও বখতিয়ারের প্রশস্তি গেয়েছেন। উমাপতিধরের এই কবিতায় ম্লেচ্ছ যোদ্ধার শৌর্য প্রশংসা দেখতে পাই।

“সাধু ম্লেচ্ছনরেন্দ্র সাধু মাতৈব বীরপ্রসুর
নীচেনাপি ভবদবিধেন বসুধা সুক্ষত্রিয়া বর্ততে।“

এর অর্থ হচ্ছে“সাধু ম্লেচ্ছরাজ সাধু! আপনার মাতাই যথার্থ বীর প্রসবিনী। পতিত হলেও আপনার মতো লোকের জন্য পৃথিবী সুক্ষত্রিয়া রয়েছে।“
উমাপতিধর রাজকবি ছিলেন না যে কিছু নগদ নারায়ণের জন্য এই কবিতা লিখেছেন। লৌকিক ধর্মানুষ্ঠানে বখতিয়ারকে মুসলমানের বেশে পরমেশ্বর বলায় ইতিহাসের সব গোমর খুলে যায়। বখতিয়ারের বিজয় বাঙলার মানুষের কাম্য ছিল। এই বিজয় অভিনন্দিত হয়েছিল। লক্ষণ সেনের রাজত্বের অনাচার থেকে রক্ষা পেতে বঙ্গ উন্মুখ ছিল। তাই বখতিয়ারের বিজয় হিন্দু শক্তির পরাজয়ের প্রতীক নয়। বরং মানুষের মুক্তির প্রতীক। হিন্দুদের পূর্বপুরুষরা যাকে বন্দনা করে গেছেন তাঁকে কলঙ্কিত করলে অপমান কার হয়?

পশ্চিমবঙ্গ বাঙলা আকাদেমী প্রকাশিত সুকুমার সেনের বঙ্গ ভুমিকা বইটির ৯৩,৯৪, ৯৯, ১৪০ ও ১৪১ নম্বর পৃষ্ঠা পড়ে বিস্তারিত জানতে পারেন॥

তিব্বত আক্রমণের পরিকল্পনা:
১২০৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তাঁর রাজ্যের সীমা দাঁড়ায়- পূর্বে তিস্তা নদী ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে পূর্বে অধিকৃত বিহার। তিনি দেবকোট-এ তাঁর রাজ্যের রাজধানী করেন। যদিও সে সময়ে বাংলাদেশের বেশিরভাগ অংশই তিনি দখলে আনতে পারেন নি। তারপরেও এই সব অঞ্চল বাদ দিয়ে তিনি তিব্বত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।
এই সময় হিমালয়ের পাদদেশে কোচ, মেচ এবং ধারু নামক তিনটি উপজাতি বাস করতো। বখতিয়ার এই অঞ্চলে প্রবেশ করে মেচ উপজাতির সর্দারকে বন্দি করেন এবং তাঁকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি এই সর্দারের নাম রাখেন আলীমেচ। এই সর্দারের কাছ থেকে তিব্বতে যাওয়ার খুঁটিনাটি জেনে নেন।

তিব্বত অভিযানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর, তিনি ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে, তিনি প্রায় দশ হাজার সৈন্য নিয়েদেবকোট থেকে তিব্বত অভিমুখে রওনা দেন। এই অভিযানে পথ প্রদর্শক হিসেবে আলীমেচ সেনাবাহিনীর অগ্রমুখে ছিলেন। সৈন্যবাহিনী বর্ধনকোট নামক স্থানের কাছে পৌঁছালে, তারা বেগমতী নদী নামক চওড়া একটি নদীর মুখোমুখি হয়। বখতিয়ার এই নদী পার না হয়ে দশ দিন ধরে উত্তরদিক বরাবর নদীর উর্ধ্ব মুখে সৈন্যদের চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর, নদীর সংকীর্ণ একটি স্থানে একটি পাথরের সেঁতু পান। সেখানে তাঁর দুই সেনাপতিকে সেঁতু সুরক্ষায় রেখে নদী পার হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হন। এই সময় তিনি কামরূপের রাজার সাথে যোগাযোগ করেন। কামরূপ-রাজ বখতিয়ারকে পরের বছর তিব্বত আক্রমণের পরামর্শ দেন। কিন্তু বখতিয়ার সে পরামর্শে কর্ণপাত না করে, তিব্বতের পথে রওনা দেন। ষোল দিন পর তিব্বত বাহিনীর সাথে বখতিয়ারের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বখতিয়ার জয়লাভ করলেও, তাঁর সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে তিনি, এখানে বেশিদিন থাকাটা সমীচীন মনে করলেন না। বখতিয়ারের বাহিনী দেবকোটের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা দিলে, তিব্বতি সৈন্যরা এদের আক্রমণ করা শুরু করে। এর ভিতর দিয়ে এরা বেগমতী নদী পর্যন্ত পৌঁছাতে সমর্থ হয়। এই সময় পার্বত্য উপজাতিরাও বখতিয়ারের বাহিনীকে আক্রমণ করা শুরু করে। সেঁতুর কাছে এসে বখতিয়ার দেখেন যে পার্বত্য লোকেরা তার দুই সেনাপতির উপর আক্রমণ করে হত্যা করেছে এবং সেতুটি পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। এরপর তিনি পার্বত্যবাসীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সসৈন্যে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই সময় তাঁর বহু সৈন্য নদীতে ডুবে যায়। শেষ পর্যন্ত অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে তিনি রাজধানী দেবকোটে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
মৃত্যু:
তিব্বত অভিযান বিফলতা এবং সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতির ফলে, তাঁর অনুগত খলজি অভিজাতবৃন্দ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এর ভিতর ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা :
রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূখ্য অধ্যায় হলো প্রশাসনিক বিভাজন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. সর্বপ্রথম মুসলিম রাজ্যকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ৮টি প্রদেশে ভাগ করেন এবং প্রতিটি প্রদেশকে জেলায় বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা ওয়ালী এবং প্রতিটি জেলার জেলাপ্রশাসক বা আমিল নিয়োগ করেন। প্রাদেশিক ও জেলা প্রাশাসনের সাথে পৃথক বিচার ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য উভয় স্তরে কাযী নিয়োগ করেছিলেন। বখতিয়ার খলজী হলেন হযরত উমর ইবনুল খাত্ত্বাবের রাজনীতিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। তাই তিনি তার নব বিজিত অঞ্চলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে কয়েকটি প্রশাসনিক এককে বিভক্ত করেন। তখন সে সময়ে শাসনতান্ত্রিক বিভাগকে ইক্তা এবং ইকতার শাসনকর্তাকে মোক্তা বলা হতো।

মীনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনা গভীরভাবে নীরিক্ষা করলে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে বখতিয়ার খলজীর প্রতিষ্ঠিত লক্ষনৌতি রাজ্য পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে তার পূর্ব অধিকৃত বিহার পর্যন্ত বি¯তৃত ছিল। সম্ভবত: লখনৌতি রাজ্যে তিনটি মুকতা বা প্রদেশ ছিলো
১. ‘বরসৌল’ ইকতা কে বর্তমান দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত ঘোড়াঘাট এলাকাকে নির্দেশ করা যায়, কারণ এটি রংপুর দিনাজপুর ও বগুড়া-এ তিন জিলার মিলনস্থলে অবস্থিত। বখতিয়ার খীলজী তাঁর সেনাপতি মালিক আলী মর্দান খীলজীকে অত্র এলাকার মুকতা নিয়োগ করেন।
২. গঙ্গাতরী ইকতা ড. আবদুল করিম মনে করেন গঙ্গাতরীর নির্দেশকরণ এখনও সম্ভব হয়নি। কিন্তু ড. কালিকারঞ্জন কানুনগোর মতেÑ গঙ্গাতরী আইন-ই-আকবরীর তান্ডা সবকারের ‘গণকরা’ মহলের সঙ্গে অভিন্ন। বখতিয়ার খীলজী তাঁর অপর সেনাপতি মালিক হুসাম উদ্দীন ইওজ খীলজীকে এ ইকতার মুকতা নিয়োগ করেন। ৩. লখনৌরে ইকতা বীরভূম জেলার নাগর অঞ্চল বর্তমানে রাজনগর নামে পরিচিত। বখতিয়ার খলজী তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক মোহাম্মদ শিরীন খলজীকে এ ইকতার মুকতা নিয়োগ করেন।


আনুমানিক ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে) ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বাংলায় মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ব্যাপক অংশ জুড়ে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত অঞ্চলটি দিল্লি সালতানাতের প্রদেশ হিসেবে শাসিত হয়।
এই পর্বের প্রথম পর্যায় ছিল ১২০৪ থেকে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ যুগের শাসনকর্তাদের পুরোপুরি স্বাধীন বলা যাবে না। এঁদের কেউ ছিলেন বখতিয়ারের সহযোদ্ধা খলজী মালিক। আবার কেউ কেউ তুর্কী বংশের শাসক। শাসকদের সকলেই দিলি- সুলতানদের অধীনে বাংলারর শাসনকর্তা হয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে অনেক শাসনকর্তাই দিল্লির - বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হতে চেয়েছেন। তবে এদের বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। দিলি- আক্রমণের মুখে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। মুসলিম শাসনেরর এযুগ ছিল বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ। তাই ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানী বাংলাদেশের নাম দিয়েছিলেন ‘বুলগাকপুর’। এর অর্থ ‘বিদ্রোহের নগরী’।
বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। তাঁর সহযোদ্ধা তিনজন খলজী মালিকের নাম জানা যায়। এরা হচ্ছেন- মুহম্মদ শিরণ খলজি, আলী মর্দান খলজী এবং হুসামউদ্দীন ইওয়াজ খলজি। অনেকেরই ধারণা ছিল আলী মর্দান খলজি বখতিয়ার খলজির হত্যাকারী। এ কারণে খলজি আমীর ও সৈন্যরা তাঁদের নেতা নির্বাচিত করেন মুহম্মদ শিরন খলজিকে। তিনি কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। আলী মদার্ন খলজিকে বন্দী করা হয়। পরে আলী মদার্ন পালিয়ে যান এবং দিলি- সুলতান কুবুতউদ্দিনের সহযোগিতা লাভ করেন। শিরন খলজিরর শাসনকাল মাত্র একবছর স্থায়ী ছিল। এরপর ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে দেবকোটের শাসনকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন হুসামউদ্দিন ইওয়াজ খলজি। দিলি- সহযোগিতায় দুই বছর পর ফিরে আসেন আলী মর্দান খলজি। ইওয়াজ খলজির স্বেচ্ছায় তাঁর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। আলী মর্দান খলজি ১২১০ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজের নাম নেন আলাউদ্দিন আলী মদার্ন খলজী। খুব কঠোর শাসক ছিলেন তিনি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমে বিক্ষোভ বাড়তে থাকে। খলজি মালিকরা এক জোট হয়ে বিদ্রোহ করেন। এদের হাতে নিহত হন আলী মদার্ন খলজি। ইওয়াজ খলজি দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসেন। তিনি এ পর্যায়ে গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজি নাম নিয়ে স্বাধীন সুলতান হিসাবে বাংলা শাসন করেন। ১২১২ থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর তিনি বাংলার সুলতান ছিলেন।

সার্বভৌমত্বের প্রতীক: খোৎবা এবং মুদ্রা:
ইসলামী সালতানাতের সার্বভৌমত্বের প্রতীক রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির মুখ্য উপাদান মূলত দুটো খুৎবা [জুমার নামাজের আগের বক্তৃতা] এবং ছিক্কা [মুদ্রা]। মীনহাজ লিখেছেন- ‘যখন মোহাম্মদ বখতিয়ার ঐ রাজ্য অধিকার করেন [তখন তিনি] নওদীয়াহ নগর ধ্বংস করেন এবং লখনৌতি নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। সিই রাজ্যের [চতুম্পাশ্বস্থান] অঞ্চল তিনি অধিকার করেন এবং সমগ্র অঞ্চলে খুৎবা ও মুদ্রার প্রচলন করেন।’ মীনহাজের বর্ণনা এতই সংক্ষিপ্ত এবং সুস্পষ্ট যে তার থেকে খোৎবা এবং মুদ্রার প্রচলন সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা লাভ করলেও একটি মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং তা হলো বখতিয়ার খীলজী কার নামে খোৎবা পাঠ করেন এবং কার নামে মুদ্রা অঙ্কন করেন? ইতোমধ্যে এসকল প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসবিদদের মধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে বৃটিশ মিউজিয়ামে বখতিয়ার খলজীর একটি স্বর্ণ মুদ্রা সংরক্ষিত আছে। উক্ত মিউজিয়ামের মুদ্রা গবেষক এন এম লওয়ার্ক সে মুদ্রাটি প্রথম প্রকাশ করে এবং তাতে কিছু অস্পষ্টতা থেকে যায়। পরবর্তীকালে ড. পি এল গুপ্ত ১৯৭৫-৭৬ সনে সে মুদ্রাটি Journal of the Varenda Research Museum vol. 4. pp.29-34 প্রকাশ করেন। প্রখ্যাত মুদ্রা বিশেজ্ঞ ড. পি এল গুপ্ত মুদ্রাটির নিম্নরূপ বিবরণ প্রদান করেছেন-
প্রথম পিঠ: একটি বৃত্তের ভিতর বল্লম হাতে একজন অশ্বারোহী এবং বৃত্তের বাইরে চারদিকে প্রথমে আরবী অক্ষরে ‘১৯শে রমজান ৬০১ হিজরী’ এবং পরে নাগরী অক্ষরে ‘গৌড় বিজয়ে’ লিখা।
অন্যপিঠে: আরবী অক্ষরে ‘সুলতান উল-মুয়াজ্জম মুঈজ উদ্-দ্বীন মোহাম্মদ বিন সাম’ লিখা।
মুদ্রায় সুলতান মুঈজ উদ-দীন মোহাম্মদ বিন সাম অর্থাৎ মোহাম্মদ ঘুরীর নামাঙ্কিত কিন্তু ‘গৌড় বিজয়ে’ কথাগুলি লিখিত আছে সেহেতু ড. পি এল গুপ্ত মনে করেন যে মুদ্রাটি মুহাম্মদ বখতিয়ার খীলজী গৌড় বিজয়ের পরে তার প্রভুর নামে গৌড় বা লৌখনতি হতে জারি করেন; মুঈজ উদ্দীন মোহাম্মদ বিন সাম কখনও গৌড়ে আসেননি। অতএব মীনহাজের বর্ণিত মুদ্রার প্রচলন সম্পর্কিত জটিলতার অবসান হল।

এখন প্রশ্ন হলো মোহাম্মদ বখতিয়ার কার নামে খোৎবা পাঠ করতেন? খুব সহজ সরল উত্তর হচ্ছে সর্বভৌমত্বের সংস্কৃতিতে যার নামে মুদ্রা অঙ্কন করা হয়েছে তার নামেই খোৎবা পাঠ করা স্বাভাবিক সমীকরণ। কিন্তু মুসলিম জগতের খলিফা আব্বাসীয় খলিফার নামে, সুলতান কুতুব উদ্দিনের আইবকের নামে অথবা বখতিয়ার খীলজী নিজের নামে খোৎবা পাঠ করার সম্ভাব্যতা ইতিহাসবিদেরা তাদের ধারনা থেকে সম্পূর্ন বাদ দেননি।

মুসলিম সমাজের ভিত্তি: মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ প্রতিষ্ঠা:
মীনহাজ-ই- সিরাজ অত্যান্ত সুষ্পষ্ট করে লিখেছেন ‘ঐ অঞ্চল সমুহে [অসংখ্য] মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ তার এবং তার আমিরদের প্রচেষ্টায় দ্রুত ও সুন্দরভাবে নির্মিত হয়।’ বখতিয়ার খীলজী লৌখনতী রাজ্যের রাজধানীতে, তার আমীরগন ইকতার [প্রদেশের] সদর দপ্তরে এবং অন্যান্য খলজী মালিকগন গুরুত্বপূর্ন স্থানে মুসলমানদের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ, মুসলমানদের সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য মাদ্রাসা এবং সূফীদের দ্বারা নওমুসলিমদের ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। শাসনতান্ত্রিক পুন:বিন্যাসের পর তিনি মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করেন। মুসলিম সমাজের নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মসজিদ। মুসলমানেরা যেখানে গিয়েছে সেখানেই প্রথমে মসজিদ প্রতিষ্টা করেছে। যে সকল মুসলমান অভিযান পরিচালনার সময়ে অথবা তার পরে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য লখনৌতে আগমন করে তাদের সুবিধার জন্য তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রসঙ্গে ড. আবদুল করিম লিখেছেন, একজন সৈনিক হইয়াও বখতিয়ার খীলজী বুঝিতে পারেন যে, মুসলমান সমাজ প্রতিষ্ঠা ব্যতিত লখনৌতির মুসলমান রাজ্য শুধু সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করিতে পারে না। সামরিক শক্তির প্রয়োজন একদিন শেষ হইবেই, কিন্ত অতপর, অর্থাৎ শান্তির সময়ে মুসলমান সমাজ- মুসলমান রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধান করিবে’ আমাদের দেশের আবহাওয়া এবং আমাদের ইতিহাস অসচেতনতা ঐতিহাসিক নির্দশন দ্রুত নষ্ট অথবা ধ্বংস হয়ে যায়। যার কারণে বখতিয়ার খীলজির আমলের কোন স্থাপত্য নির্দশন আজও আবিষ্কৃত হয়নি।
দ্বীন প্রচার: মুসলমানদের মৌলিক কাজ:
বখতিয়ার খলজী যখন লখনৌতিতে আসেন তখন আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত ছিল। খিলাফতের প্রান্তিক রাজ্যসমূহের স¤প্রসারনে তখনও মূল কারণ দ্বীন- ই- ইসলাম প্রচার করা। হিন্দু ও ইউরোপীয়রা যতই একে মাল-ই-গনীমতের লোভে পরিচালিত অভিযান বলে আখ্যায়িত করুক না কেন; মুসলিম সেনাপতিরা জিজিয়া দিতে সম্মত হয়েছে অথবা দ্বীন গ্রহণ করেছে এমন কোন রাজা বাদশাহর সাথে যুদ্ধ করেছে এমন প্রমাণ তারা দিতে পারবে না। সে জন্য প্রান্তিক রাজ্য বিজয়কে আব্বাসীয় খলিফা স্বীকৃতি প্রদান করতো; বিজয়ী সেনাপতিকে সনদ ও খিলাত দান করতো; সর্বোপরি বিজিত অঞ্চলকে দ্বার-উল-ইসলামের অংশ হিসেবে গ্রহণ করতো। তাছাড়া বিজয়ী সেনাপতি মাল-ই-গনীমত সংগ্রহ ও বন্টন করতো; জিজিয়া সংগ্রহ করতো; বখতিয়ার খিলজীর ক্ষেত্রে এ নীতির লংঘিত হয়নি।
উল্লেখিত প্রসঙ্গে মীনহাজ-ই-সীরাজ তিনটি তথ্য প্রদান করেছেন- ‘কোচ ও মেচ জাতির প্রধানদের মধ্যে একজন-যিনি আলী মেচ নামে পরিচিত হন- মোহাম্মদ বখতিয়ারের হস্তে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং [তিনি মোহাম্মদ বখতিয়ারকে] পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ে যেতে এবং পদ প্রর্দশক হতে সম্মত হন’।‘মোহাম্মদ বখতিয়ার ঐ নদীর তীরে উপস্থিত হলেন এবং আলী মেচ মুসলিম সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে ছিলেন। তিনি দশ দিন ধরে নদীর উর্ধ্ব মুখে সৈন্যদের চালিয়ে নিয়ে গেলেন।’’ [পৃ.-২৭]
‘মোহাম্মদ বখতিয়ার পানি থেকে বের হয়ে আসলে কোচ এবং মেচদের একদলের নিকট সংবাদ পৌছে গেল। পথ প্রর্দশক আলী মেচ তার আত্মীয় স্বজনদের রেখে গিয়েছিলেন। তারা উপস্থিত হয়ে অনেক সাহায্য ও সেবা করলেন।’

উপসংহার:
বখতিয়ারের ঘোড়া, ঢাল, তরবারী, বল্লম, তীর-ধনুসহ সকল অস্ত্র-সস্ত্রের সঠিক নমুনা না থাকলেও মীনহাজ সে সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারনা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন।তাছাড়া ইতোমধ্যে আবিস্কৃত মুদ্রার একপীঠে বৃত্তের মধ্যে বল্লমধারী ঘোড়সওয়ারী সৈন্যর অঙ্কন তার সংস্কৃতিতে উন্নত সৈনিক জীবনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। তিব্বত অভিযান ব্যর্থতার পেছনে সমর নেতা হিসেবে তার কোন অযোগ্যতা প্রকাশ পায়নি বরং পাশ্ববর্তী রাজন্যবর্গের বিশ্বাসঘাতকতাই মূখ্য কারণ হিসেবে বিবেচ্য হয়েছে। এদেশীয় সামরিক কুটকৌশলের নিকট বখতিয়ার পরাজিত হয়ে দেবকোট ফিরে আসেন। এ দেবকোট হচ্ছে প্রাচীন ভারতের বরেন্দ্র অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ও জাকজমকপূর্ণ নগরী। দেবীকোট্ট, দেওকোট, দেবীকোট, উমাবন, উষাবন, কোটীবর্ষ, শোনিতপুর, বানপুর প্রভৃতি নামে এ নগরীর বর্ণনা যাদব প্রকাশের বৈজয়ন্তী, কল্পসূত্র, বিষ্ণুপুরান, শ্রীমৎ ভগবত, বায়ুপুরান এবং বৃহৎ সংহিতার মতো প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। এমন একটি নগরীকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন বখতিয়ারের উচ্চ ঐতিহ্যমন্ডিত সাংস্কৃতিক রুচিবোধ ও জ্ঞানের বহি:প্রকাশ। এখানেই বখতিয়ার ইনতেকাল করেন এবং এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। এখনও তার সমাধিস্থলে দর্শনার্থীদের ভীড় লক্ষনীয়। এ দেবকোটে মাওলানা শাহ আতার সমাধি সৌধ রয়েছে যার দেয়ালে সংযুক্ত ৬৯৭ হিজরী [১২৯৭ঈ.] শিলালিপি বাংলার সুলতানী শাসনের প্রাথমিক যুগের গুরত্ব বহন করে। তাছাড়া সুলতান কায়কাউসের রাজত্বকালে [৬৯১-৭০২ হিজরী] প্রাদেশিক গর্ভনর জাফর খান বাহরাম আইতগীনের সময়ে মুলতানর সালাহউদ্দিন জিওয়ান্দের তত্বাবধানে একটি সমজিদ নির্মিত হয়। এসব তথ্য একথা প্রমাণ করে যে বখতিয়ারের প্রতিষ্ঠিত রাজধানী এবং সমাধিস্থল প্রাথমিক সুলতানী যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী হিসেবে বর্তমান ছিল।

বখতিয়ার খলজী নওদীয়াহ ও লৌখনতি বিজয় করে বাংলার উত্তর প্রান্তে একটি মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। সে রাজ্যে তিনি মসজিদ, মাদরাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম সমাজের ভিত মজবুত করেছিলন; সে রাজ্যে তিনি মুসলিম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক খোৎবা এবং মুদ্রার প্রচলন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে রাজ্যে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করে ওয়ালী, আমীল ও কাযী নিয়োগ দিয়ে একটি উন্নত প্রশাসন প্রবর্তন করেছিলেন। সে রাজ্যে দ্বীন ইসলাম প্রচার করে কোচ- মেচ সহ হাজার ধরণের অমুসলিমকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মুসলিম করেছিলন। এসবের সুফল আজ আমরা শতভাগ ভোগ করছি। অথচ বখতিয়ার খলজী এ প্রজন্মের কাছে অপরিচিত। তাই শুধু সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে নয়; বরং সর্বক্ষেত্রে বখতিয়ার খলজীর চর্চা প্রয়োজন; অতি প্রয়োজন। আগামী প্রজন্ম যেন বখতিয়ার খলজীকে সহজে চিনতে পারে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করার জন্য সচেতন সুধী সমাজকে আহবান জানাই।
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ

তথ্য সূত্র:
মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস- মাওলানা আকরম খাঁ।

বাংলাদেশে ইসলাম- আব্দুল মান্নান তালিব।

বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা- কে.এম. রইসউদ্দীন খান॥

ফিনিসিয়া থেকে ফিলিপাইন- মোহাম্মাদ কাসেম।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা (মুসলিম বিশ্ব সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ১৯৮৪)।

ভারতবর্ষের ইতিহাস- ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান।

ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমদ মর্তুজা।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ- আই. এইচ. কোরেশী।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব- ড. তারা চাঁদ।

বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস- ড. আব্দুল করীম।

বরেন্দ্র অঞ্চলে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য- ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী।
বাংলাদেশের ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।

ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.