নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব সাত...
গৌরব উজ্জ্বল সুলতানি আমলের মাধ্যমে বাংলাদেশে মুসলিম শাসন শুরু ॥
সূফি বরষণ
বাংলার মুসলিম শাসনের স্থপতি বখতিয়ার উদ্দিন খলজীর মাধ্যমে বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়॥ যা স্থায়ী হয় সুদীর্ঘ সাড়ে পাঁচশো বছর ॥ আর তাঁর হাত ধরেই স্বাধীন সুলতানি আমলে শুরু হয়॥ তের শতকের প্রথম দিক থেকে চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশ দিল্লী সালতানাতের অধীনে ছিল। চৌদ্দ শতের মাঝামাঝি নাগাদ আফগান (পাঠান) সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারব শাহ্ বাংলার প্রায় সমস্ত অঞ্চল জয় করে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং বাংলাদেশে স্বাধীন সুলতানী যুগের সূচনা করেন। বাংলার স্বাধীন সুলতান “শাহী বাঙ্গালা” উপাধী ধারণ করেন। পরবর্তী প্রায় দুশ বছর বাংলাদেশে স্বাধীন পাঠান সুলতানরাও রাজত্ব করেন। এই সব পাঠান সুলতানরা বহিরাগত হলেও এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হুসেন শাহী আমলে বাংলার ভাবজগতে এক অভুতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো বাংলার গৌরব উজ্জ্বল সুলতানি আমল নিয়ে॥
বাংলার সুলতানি আমলে যুগান্তকারী গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ হয়েছিল যেমন, মুদ্রার প্রচলন, বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক উন্নতি সাধারণ, সরকারি কাজের বিন্যস্তকরণ, ইকতা নামে প্রশাসনিক ইউনিট চালু, এই প্রাদেশিক প্রশাসনিক শানসকর্তাদের মুকতা (গভর্নর বলা হতো ) পদ সৃষ্টি করার মাধ্যমে প্রজাদের প্রতি সুশাসন নিশ্চিত করা হয়॥ ঐ সময়ে বাংলার জনগণ খুব সহজেই সরকারি সাহায্য সহযোগীতা লাভ করতো॥ এসবের পাশাপাশি ব্যাপক ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় মসজিদ, মাদ্রাসা এবং খানকাহ ॥ এখানে উল্লেখ যে বর্তমান বাংলাদেশে যে প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছে, তা আজ থেকে ৮শত বছর পূর্বে সুলতানি আমলে মুসলিম শাসকগণ মসজিদ ভিত্তিক মক্তবের মাধ্যমে চালু করেছিলেন ॥ সুলতানি আমলে বাংলাদেশের মসজিদের স্থাপত্যরীতির আবির্ভাব ঘটেছে বৈচিত্র নির্মাণ রীতি॥ সেই সময় নির্মিত কয়েকটি ইমারতে অবশ্য এর নিদর্শন রয়েছে। যেমন , ত্রিবেণীর (হুগলী জেলা) জাফর খাঁ গাজীর মসজিদ ও মাজার (১২৯৮), ছোট পাণ্ডুয়ার (হুগলী জেলা) বড়ি মসজিদ (১৩০০) এবং হজরত পাণ্ডুয়ার (মালদহ জেলা) আদিনা মসজিদ (১৩৭৫) নির্মাণকৌশল ও পরিকল্পনায় উত্তর ভারতের মসজিদগুলো থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে পৃথক। এই ইমারতগুলোতে পাথরের ব্যবহার ও অলঙ্করণে প্রাচীন আর্টের ছাপ রয়েছে।
এখানে একটি বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যে,
বাংলার মুসলিম সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া তের শতকে শাসন দণ্ড নিয়ে এ ভূখণ্ডে মুসলমানদের প্রবেশের মধ্য দিয়েই সূচিত হয়নি। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অনেক আগ থেকেই। বাংলার অভ্যন্তরে মুসলিম সমাজ গঠনের একটি প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া তের শতক থেকেই শুরু হয়েছিল। এগার, বারো শতকে সেন রাজাদের মাধ্যমে শুধু যে হিন্দু সমাজ কাঠামোর পুনর্গঠন ও ব্যাপক বিস্তার হয়েছে তাই নয়, ক্রমে বর্ণবাদের কঠোরতা নিয়ে বর্ণবিভক্ত সমাজের নতুন দর্শনে বাংলায় একটি মিশ্র সমাজের সৃষ্টি হয় যা স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক ঐক্য বলিষ্ঠভাবে ধরে রাখতে পারেনি। এই ধর্মের অধিবাসীদের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি ধর্মীয় বৈষম্য থাকায় অনিবার্যভাবে বাংলার সমাজ কিছুটা অসংবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে সেন যুগের কঠোর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবেশেই মুসলমান সুফি সাধক শ্রেণীর আগমন ঘটতে থাকে। প্রথম পর্বের সুফিদের মধ্যে তিনজনকে নির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা যায়। এরা হচ্ছেন শাহ সুলতান রুমী, বাবা আদম শহীদ এবং শাহ সুলতান বলখি মাহিসওয়ার। একটি ফার্সি সূত্র অনুযায়ী শাহ সুলতান রুমী ৪৪৫ হিজরি অর্থাৎ ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহে আসেন।
বর্তমান নেত্রকোনার মদনপুরে তার সমাধি রয়েছে। সেনদের অন্যতম রাজধানী বিক্রমপুরের রামপালে বাবা আদম শহীদের সমাধি রয়েছে। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী তিনি ওই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন এবং সেন রাজা বল্লাল সেনের হাতে ১১১৯ খ্রিস্টাব্দে শহীদ হন। বগুড়ার মহাস্থানগড়ের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে সমাধি নির্মাণের স্বীকৃতি রয়েছে। জনৈক নমুর খান ৭০০ হিজরি অর্থাৎ ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। শিলালিপি না পাওয়া গেলেও পরবর্তীকালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে শাহ সুলতান বলখি মাহিসওয়ারের সমাধির উত্তর ঢিবিতে একটি মসজিদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অনুমান করা যায় উত্তরবঙ্গে মুসলিম বিজয়ের কিছু আগে অথবা পরপরই সুফি সাধকগণের উপস্থিতির মাধ্যমে মুসলিম সমাজের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল।
তের শতকে দিল্লির অধিভুক্ত বাংলার শাসনকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম সমাজ বিকাশের ধারা অব্যাহত থাকে। জালালউদ্দিন মাসুদ জানীর (১২৪৭-১২৫১ খ্রি.) সময় দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে মসজিদ নির্মাণের স্বাক্ষর রয়েছে একটি শিলালিপিতে। লিপির উৎকীর্ণকাল ৬৪৭ হিজরি অর্থাৎ ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে। মুসলিম বিজয়ের প্রাথমিক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র দেবকোটের তিন মাইল দূরে এই গঙ্গারামপুরের অবস্থান। তিব্বত অভিযান শেষে বখতিয়ার খলজি দেবকোটেই অবস্থান নিয়েছিলেন এবং এখানেই তিনি নিহত হন। সুতরাং সন্দেহ নেই দেবকোট প্রথম থেকে মুসলিম সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়।
লখনৌতিতে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দু’শ বছরের মধ্যে সমগ্র বাংলার ওপর মুসলমান সুলতানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাব্যাপী মুসলিম সমাজ বিকাশের এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষণ ছিল। তের শতকের শেষলগ্নে সাতগাঁও রুকনউদ্দিন কায়কাউস কর্তৃক অধিকৃত হয়।
পরবর্তী সুলতান শামসউদ্দিন ফিরুজ শাহের সময় মুসলিম রাজ্য বিস্তারের প্রক্রিয়া বাংলার অভ্যন্তরে এগিয়ে চলে। তার মুদ্রায় লখনৌতি ছাড়াও ‘হজরত সোনারগাঁ’ এবং ‘বঙ্গ’ টাকশালের নাম যুক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরেও রাজ্য সম্প্রসারিত হয়। শিলালিপির সাক্ষ্য অনুযায়ী সিলেট তার কর্তৃত্বভুক্ত ছিল। সিলেটে হজরত শাহজালালের দরগাকে কেন্দ্র করে একটি শিলালিপি, বিহারে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে মসজিদ নির্মাণের সাক্ষ্য, হুগলীর ত্রিবেনীতে জাফর খাঁর দরগায় প্রাপ্ত শিলালিপিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সাক্ষ্য প্রভৃতি অধিকৃত অঞ্চলে মুসলিম সমাজ বিকাশের স্বপক্ষেই তথ্যসংস্থান করেছে।
দিল্লির সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাকে দিল্লির অধিকারভুক্ত অঞ্চল হিসেবে ধরে রাখার প্রয়াস অব্যাহত ছিল। কিন্তু ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে অবস্থার চূড়ান্ত পরিবর্তন ঘটে এবং শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের মাধ্যমে সমগ্র বাংলায় স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন সুলতানদের সময় বাংলার চারপাশের অঞ্চলগুলো মুসলিম অধিকারে আসতে থাকে। এভাবে মুসলিম রাজ্য ও সমাজ বিকাশ আরও সংহতরূপ লাভ করে। ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ কর্তৃক চট্টগ্রাম অধিকৃত হয়। অবশ্য এ বিজয়কে নিশ্চিত করার জন্য কোনো মুদ্রা বা শিলালিপি প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা যায়নি।
সাহিত্য ও কৃষ্টি:
মুসলিম মরমী সুফী সাধকদের দ্বারা প্রচারিত আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ বাংলার গোটা সমাজ জীবনকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। গোড়াপত্তন হয়েছিল এক নতুন করে ধর্মীয় ও বাঙালীর কৃষ্টির, যার নিদর্শন সমকালীন বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের উন্নতির জন্য তখন এসেছিল স্বর্ণ যুগ। উদার মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মহাভারত’ ও ‘ভগবদ গীতা’ প্রথমবারের মত সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। বস্তুত এই সময়কাল থেকেই বাঙালির জীবনে এই উদার সমন্বয়ধর্মী মানবতাবাদী ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল যার পরিচয় পাওয়া যায় সে কালের কতিপয় হিন্দু মুসলমান কবিদের রচনায়। আর এর পেছনে কাজ করছে মুসলিম শাসকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা ॥ অত্যাচারি হিন্দু সেনদের কুশাসনের হাত হতে বাংলার জনগণকে মুক্তি দিয়ে, আবার অপরদিকে হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মুসলিম শাসকগণ যে উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন; তার দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে বিরল॥ অপরদিকে পূর্বের বহিরাগত শাসক শ্রেণি আর্য (হিন্দু ব্রাহ্মণ ) ও সেনরা কিন্তু বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের অনুসরণকারীদের উপরে চালিয়ে ছিল বর্বর নির্যাতন এবং জোর করে ধর্মান্তরিত করে নিচু জাতের মর্যাদা দিয়েছিল ॥ কিন্তু এর বিপরীতে বাংলার মুসলিম শাসকগণ হিন্দু ব্রাহ্মণ আর্য ও সেনদের জাতপ্রথা বিলুপ্ত করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে দিয়ে মানুষকে ভাই হিসেবে বন্ধু হিসেবে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ছিলেন আর প্রচার করেছিলেন ইসলামের সাম্যের বাণী ॥ মধ্যযুগের কবিদের কবিতার মাধ্যমে তা ফুটে উঠেছে ॥
“শুনহ মানুষ্ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য,
তাহার উপরে নাই”
পনের শতকের বৈষ্ণ কবি চন্ডিদাসের এই অমর বানীতে যেমন আমরা মানবতাবাদের জয়গান শুনতে পাই তেমনি সতের শতকের মুসলিম কবি আবদুল হাকিম রচিত ‘নূরনামা’য় এক উদার সমন্বয়ধর্মী মতাদর্শের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। হিন্দু-ধর্ম ও ইসলামের প্রতি সমানভাবে এই বাঙালি মুসলমান কবি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন এইভাবে:
“য়াল্লা(আল্লাহ) খোদা-গোঁসাই
সকল তান (তাঁর) নাম
সর্বগুনে নিরঞ্জন প্রভু গুনধাম।”
সুলতানি শাসন:
তেরো শতকের সূচনালগ্নে (১২০৪-০৫) বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। তবে এর অনেক আগে থেকেই বাংলার সাথে আরব মুসলমানদের যোগাযোগ ছিল; অবশ্য সে যোগাযোগের স্বরূপ ছিল বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় এবং তা উপকূলীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল।
বখতিয়ার খলজীর সামরিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বখতিয়ার খলজী ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার জয় করার পর ভারতে মুহম্মদ ঘুরীর প্রতিনিধি কুতুবউদ্দীন আইবকের সাথে বদাউনে গিয়ে সৌজন্যমূলক সাক্ষাত করেন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে তিনি তার সৈন্যবাহিনী আরও শক্তিশালী করেন এবং ১২০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে আকস্মিকভাবে বাংলা আক্রমণ করে রাজা লক্ষ্মনসেনের সাময়িক রাজধানী নদীয়া অধিকার করেন। এখানে অগাধ ধনসম্পদ, অগণিত পরিচারক-পরিচারিকা ও বহুসংখ্যক হাতি বখতিয়ারের হস্তগত হয়। অতঃপর তিনি বাংলার ঐতিহ্যবাহী রাজধানী গৌড় দখল করে সেখানে তার রাজধানী স্থাপন করেন এবং প্রায় দু বছরকাল বিজিত রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামো বিন্যাস ও ব্যবস্থাপনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
বখতিয়ার তার রাজ্যে এক ধরনের গোত্রীয় সামন্ততন্ত্রের প্রবর্তন করেন। অধিকৃত এলাকাকে তিনি কয়েকটি প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করে সেগুলির ভার তার বিশ্বস্ত সেনাপতিদের ওপর অর্পণ করেন। এ প্রশাসনিক ইউনিট ইকতা নামে পরিচিত ছিল এবং এ ইকতার শাসনকর্তাকে মুকতা বলা হতো। প্রশাসনিক বিন্যাস ছাড়াও বখতিয়ার বাংলায় মুসলিম সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি নামাযের জন্য মসজিদ, মুসলিম ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য মাদ্রাসা এবং ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে সুফিদের জন্য খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন।
অতপর বখতিয়ার তিববত অভিযানে বের হন। তিববত অভিমুখে রওনা হওয়ার পূর্বে বিজিত অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতিকালের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেন। অবশ্য এ তিববত অভিযানে বখতিয়ারের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। ব্যর্থ অভিযান শেষে চরম হতাশাগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত অবস্থায় দেবকোটএ ফিরে এসে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন অথবা আলী মর্দান খলজী কর্তৃক নিহত হন।
সমসাময়িক ও আধুনিক তথ্যাদির ভিত্তিতে বখতিয়ারের অধিকৃত রাজ্যের ভৌগোলিক পরিসীমা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করা যায়। অযোধ্যার মির্জাপুর জেলায় অবস্থিত তাঁর মূল জায়গির ছাড়াও দক্ষিণ বিহার এবং উত্তর বিহারে গঙ্গা নদীর উত্তর তীরবর্তী ভূখন্ড তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। বাংলা অঞ্চলে রাজমহল, মালদহ, দিনাজপুর, রাজশাহী ও রংপুর জেলাগুলি তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র-করতোয়া নদী লখনৌতি রাজ্যের পূর্ব সীমানা নির্দেশ করে।
১২০৬ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ারের মৃত্যুর পর থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে ইওজ খলজীর মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনাপর্ব বলে অভিহিত করা যায়। বখতিয়ারের মৃত্যু এতই আকস্মিক ছিল যে, তিনি এ সময়ে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে কোনো মনোযোগই দিতে পারেননি। ফলে আলী মর্দান, হুসামউদ্দীন ইওয়াজ এবং মুহম্মদ শীরন সিংহাসনের জন্য নিজেরাই কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে প্রথম ছয় বছর বখতিয়ারের সেনাপতিদের মধ্যে উত্তরাধিকার যুদ্ধ চলে।
১২১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর্যন্ত ছিল ইওয়াজ খলজীর শাসনকাল। মুসলিম বাংলার প্রথম উল্লেখযোগ্য শাসক ইওয়াজ খলজী পরিকল্পিতভাবে বাংলায় মুসলিম শাসনের সম্প্রসারণ ও সুসংহত করার চেষ্টা করেন। গিয়াসউদ্দীন ইওয়াজ খলজীর শাসনকাল বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনিই মুসলিম বাংলার প্রথম শাসক যিনি সর্বপ্রথম মুদ্রা প্রবর্তন করেন। তিনিই প্রথম পরিকল্পিতভাবে মুসলিম রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান এবং তিনিই যুদ্ধ ও রণকৌশলের ধরনে নতুন দিকে সূত্রপাত করেন। তার গৃহীত নীতির ফলে বাংলায় মুসলিম রাজ্যের উল্লেখযোগ্য বিস্তৃতি ঘটে এবং মুসলিম শাসন সুসংহত হয়।
ইওয়াজ খলজীর অধীনস্থ মুসলিম রাজ্য দক্ষিণ বিহার ছাড়াও বাংলার এক ব্যাপক অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। উত্তরে মালদহ, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও রাজশাহী জেলা, দক্ষিণে মুর্শিদাবাদ, পাবনা, নদীয়া, ও যশোর জেলার উত্তরাংশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে বীরভূম ও বর্ধমান জেলা তার রাজ্যভুক্ত ছিল।
দিল্লি সালতানাতের অধীনে লখনৌতি রাজ্য (১২২৭-১২৮৮/৮৯) ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে ইওয়াজের মৃত্যু এবং ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াসশাহী বংশের প্রতিষ্ঠার মধ্যবর্তী সময়কে বাংলায় মুসলিম রাজ্যের বিস্তৃতি ও সুসংহত করণের যুগ বলে অভিহিত করা যায়।
শাহজাদা নাসিরউদ্দীন লখনৌতির শাসনকর্তা হিসেবে ইওয়াজের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি বাংলা ও বিহারের সাথে তার অধীনস্থ অযোধ্যা প্রদেশকে সংযুক্ত করেন এবং লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপন করেন। তার অধীনস্থ রাজ্যের বিস্তৃতি এবং নিজে দিল্লি সুলতানের পুত্র বিধায় স্বভাবতই সমসাময়িকদের দৃষ্টিতে তার শাসনাধীন রাজ্যের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ইলতুৎমিশ তাকে ‘মালিক-উস-শরক’ (প্রাচ্যের নৃপতি) উপাধি দেওয়ার ফলে এ গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। দেড় বছর কাল তিনি এ সম্মিলিত রাজ্য শাসন করেন। তাঁর আমলে ইওজ খলজী সূচিত রাজ্য সংহতকরণ নীতি অব্যাহত থাকে।
১২২৯ খ্রিস্টাব্দে নাসিরউদ্দীনের মৃত্যুর পর দওলত শাহ বিন মওদুদ নামক একজন সেনানায়ক ক্ষমতা দখল করেন। তিনি আববাসীয় খলিফা, দিল্লির সুলতান এবং নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। কিন্তু ইখতিয়ারউদ্দীন বলকা খলজী সহকর্মীর এ কর্মকান্ড মেনে না নিয়ে বিদ্রোহী হন এবং দওলত শাহকে হত্যা করে নিজে ক্ষমতা দখল করেন (১২২৯-৩০)। তিনিও ক্ষমতায় বেশি দিন থাকতে পারেননি। ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশ লখনৌতি আক্রমণ করে তাকে দমন করেন। অতঃপর তিনি বিহারের শাসনকর্তা আলাউদ্দীন মাসুদ জানীকে বাংলার শাসন কর্তা নিযুক্ত করেন। মালিক সাইফউদ্দীন আইবককে পৃথকভাবে বিহারে শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
সুলতানি আমলো বাংলার প্রশাসনিক অবস্থা:
সুলতানি আমলকেও বাংলার মধ্যযুগের সূচনা পর্ব বলা চলে॥ এই সমে শাসন প্রণালীর বিশেষত্ব এই যে, শাসককুলের সতত পরিবর্তন সত্ত্বেও তুর্কি-আফগান জাতি যে সকল পুরাতন প্রশাসনিক সংগঠন নিয়ে ভারতে আসে সেগুলি বহু শতাব্দী ধরে তাদের মূল বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমে (আনু. ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে) ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বাংলায় মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ব্যাপক অংশ জুড়ে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত অঞ্চলটি দিল্লি সালতানাতের প্রদেশ হিসেবে শাসিত হয়। বাংলার রাজধানী গৌড় বা লখনৌতি দিল্লি সালতানাতের প্রধান নীতিমালা অনুসরণ করে এবং এখানে যে শাসন কাঠামো গড়ে তোলা হয় তা ছিল ইলতুৎমিশ বংশের শাসকদের প্রচলিত প্রশাসন পদ্ধতির অনুরূপ। বিকেন্দ্রীকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সার্বভৌম শাসকদের সামন্ততান্ত্রিক প্রশাসন অনুসৃত হয় এখানে। অবশ্য ইলিয়াস শাহী (১৩৪২-১৪১৫ এবং ১৪৪২-১৪৮৭) এবং হোসেন শাহী (১৪৯৪-১৫৩৮) বংশের শাসনামলে এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে। বিভিন্ন সময়ে মধ্যযুগে এই শাসন ব্যবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হলেও মোটামুটি সুলতানি আমলের প্রশাসনিক ধারাই অব্যাহত থাকে।
সমসাময়িক ইতিহাস সাহিত্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণের অনুপস্থিতি বাংলার প্রশাসনিক সংগঠনগুলির, বিশেষ করে সুলতানি আমলের প্রথম দিকের, ব্যাপক বর্ণনা তুলে ধরা সুকঠিন। রাজকীয় ঘটনাপঞ্জিতে বাংলার মতো দূরবর্তী প্রদশের প্রশাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে তেমন কোন তথ্য নেই মুঘল রাজপ্রসাধেও । বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ ও অন্যান্য সাহিত্যিক উপকরণ থেকে এই অভাব কিছুটা পূরণ করা যায়। তবে সাহিত্য-উপকরণ দিয়ে শুধু ধর্ম ও ভাবাবেগ সম্পর্কে ধারণা করা যায়, কিন্তু প্রশাসন সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু বলা সম্ভব নয়। সমসাময়িক মুদ্রা ও লেখমালা মধ্যযুগে বাংলার প্রশাসন সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করে। এই সকল বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিন্যস্ত করে বাংলার মধ্যযুগে মুসলিম শাসন কাঠামো সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
বাংলায় মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব বখতিয়ার খলজীর প্রাপ্য, তবে তিনি সুলতান উপাধি ধারণ করেননি বা নিজ নামে মুদ্রা চালু করেননি। এ বিশেষ অধিকারটি তিনি তাঁর অধিরাজ ঘোরের মুইজুদ্দীন মুহম্মদ বিন সামের জন্য নির্দিষ্ট রাখেন। অবশ্য মালিক-উস-শার্ক (পূর্বাঞ্চলের অধিপতি) হিসেবে তিনি তাঁর অধিকৃত এলাকা ইকতায় (প্রদেশ) বিভক্ত করেন এবং এগুলির বেশির ভাগই ভারতে ভাগ্যান্বেষণে আগত তাঁর সহযাত্রী তুর্কি ও খলজীদের নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করেন। এ প্রদেশসমূহের বেশির ভাগ সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত ছিল এবং নিয়োজিত গভর্নরগণ ছিলেন বিশিষ্ট সামরিক ব্যক্তিত্ব। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাদেশিক শানসকর্তাদের মুকতা (গভর্নর) বলা হতো। ফলে প্রথম পর্যায়ের শাসন কাঠামো অনেকটা খলজী গোত্রীয় সামন্ততন্ত্রের রূপ নেয়। ইকতার শাসনকর্তাকে ইকতাদারও বলা হতো। তাঁরা সামরিক দায়িত্ব পালন ছাড়াও ইকতার বেসামরিক শাসন পরিচালনা করতেন।
বখতিয়ারের উত্তরসূরিগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে সুলতান উপাধি ধারণ করেন কিন্তু বেশিদিন তাঁরা এ স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন নি এবং একাধিকবার গৌড়/লখনৌতি রাজ্য দিল্লি সালতানাতের অধীনস্থ প্রদেশে পরিণত হয়। দিল্লি থেকে অঞ্চলটির দূরত্ব, ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং লখনৌতিতে ক্ষমতা লাভের জন্য অব্যাহত দ্বন্দ্ব বা ষড়যন্ত্রের কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে বাংলার উপর বেশিদিন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সহজ ছিল না। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের মৃত্যু হয়। বাহরাম খানের বর্মরক্ষক ছিলেন ‘ফখরা’ নামের একজন রাজকর্মচারী। প্রভুর মৃত্যুর পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ‘ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ’ নাম নিয়ে সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে বসেন। এভাবেই সূচনা হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের। দিল্লির মুহম্মদ-বিন-তুঘলকেরী এ সময় সুদূর বাঙলার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ ছিলনা। তাই সোনারগাঁওয়ে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ধীরে ধীরে স্বাধীন অঞ্চলের সীমা বিসতৃত হতে থাকে। পরবর্তী দুইশত বছর এ স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।
অবশেষে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইলিয়াস শাহী ও হোসেন শাহী বংশ দুটি (মধ্যখানে ১৪১৫-৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বল্প বিরতিসহ) ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে আফগানদের দ্বারা উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত দুইশত বছর বাংলা শাসন করে। ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ এর আমলে প্রায় সমগ্র বাংলা বিজিত হয় এবং প্রথমবারের মতো এর উপর তাঁর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এজন্য তাঁকে শাহ-ই-বাঙ্গালাহ ও সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ বলা হতো। তখন থেকে অঞ্চলটি ‘বাঙ্গালাহ’ নামে পরিচিত হয়। এই বিষয়ে আমরা আরও বিস্তারিত জানতে পারি নিম্নের উৎস গুলো হতে॥
মধ্যযুগের ঐতিহাসিক উপাদান:[Sources of Medieval Indian History]
সুলতানি যুগ ও মুঘল যুগ মিলে মধ্যযুগ বলা হয় । মধ্যযুগে ইতিহাস গ্রন্থের অভাব নেই । সেজন্য মধ্যযুগে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান অপেক্ষা সাহিত্যিক উপাদান বেশি গুরুত্বপূর্ণ । সুলতানিযুগের ঐতিহাসিক উপাদান দু ধরনের,
ক. সাহিত্যিক উপাদান [The Literary Elements]
খ. প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান [Archaeological Evidence]
সাহিত্যিক উপাদান আবার দুই ধরনের
(ক) সমসাময়িক ইতিহাস গ্রন্থ [Contemporary Historical Literature]: ঐতিহাসিক গ্রন্থের মধ্যে মিনহাজ-উস-সিরাজের ‘তবাকৎ-ই-নাসিরি‘ জিয়াউদ্দিন বরানির ‘তারিখ-ই-ফিরুজশাহী’ সামসউদ্দিন সিরাজ আফিকের ‘তারিখ-ই-ফিরুজশাহী’ প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । আমির খসরু. ইসামি প্রভৃতি ঐতিহাসিকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে । ‘সিকান্দার-বিন-ই-রসিদি’ গোলাম হুসেন সালিম রচিত ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’ ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে প্রাদেশিক ইতিহাস জানা যায় । এইসব গ্রন্থ থেকে তৎকালীন সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মজীবন সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায় ।
(খ) বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ [Accounts of Foreign Travellers] : সুলতানি আমলের পর্যটকদের মধ্যে ইবন বতুতার নাম উল্লেখযোগ্য । তাঁর বিবরণ থেকে সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বহু তথ্য পাওয়া যায় । অন্যান্য পর্যটকদের মধ্যে মার্কো পোলো, নিকলো কন্টি, আবদুর রজ্জাক, নুনিজ পায়েজ প্রভৃতির নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান [Archaeological Evidence] : সুলতানি আমলের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতত্ত্বের গুরুত্ব কিছুটা কম হলেও কোনো কোনো অঞ্চলের যেমন বাংলা, বাহমনি, গুজরাট ইত্যাদির ইতিহাস রচনায় লিপি বিশেষ ভাবে সাহায্য করে । ইলতুৎমিস, বলবন, আলাউদ্দিন খলজি এবং বিশেষভাবে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের মুদ্রা থেকে বহু তথ্য পাওয়া যায় । স্থাপত্য, ভাস্কর্য, শিল্পকলা সুলতানি আমলে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতার পরিচায়ক ।
সুলতানদের মুদ্রা চালু নিয়ে তথ্য:
১২০৫ সালে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলার সেন রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলায় মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মুহম্মদ বিন সামের নামে বাঙলা বিজয়ের স্মরণে স্মারকমুদ্রাও প্রচলন করেন। মুসলিম শাসন-ব্যবস্থায় শুক্রবারে জুম্মার নামাযের ‘খুতবায়’ এবং মুদ্রায় শাসকের নাম উল্লেখ করা সার্বভৌমত্বের প্রকাশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলার ইতিহাসের ক্ষেত্রে সমকালীন লেখকদের যথাযথ বিবরণীর অভাবহেতু ইতিহাসের অনেক ঘটনা, সুলতানদের রাজকীয় উপাধিযুক্ত নাম, তাদের রাজত্বকাল প্রভৃতি বিষয়ে অনেক তথ্য অজ্ঞাত রয়ে গেছে অথবা সুস্পষ্ট ও সম্পূর্ণ তথ্য গোচরে আসেনি। মুসলিম শাসকদের ‘খুতবা’ ও ‘সিক্কায়’ নিজ নাম প্রচলন এবং পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত তাদের এসব মুদ্রার তথ্যের ভিত্তিতে বাংলার ইতিহাসের অনেক অজ্ঞাত বিষয় যেমন একদিকে জানা সম্ভব হয়েছে তেমনি অন্যদিকে অনেক জানা তথ্যের অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতা দূর হয়েছে। মুদ্রার ভিত্তিতে প্রাপ্ত বাঙলার স্বাধীন সুলতানী আমলের অনুরূপ কিছু তথ্য এবং তার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অতি সংক্ষেপে এই নিবন্ধে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসবের অধিকাংশই সাম্প্রতিককালে মুদ্রাভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত তথ্য; তবে কিছু নতুন তথ্যও এখানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে এবং এসব তথ্যের ভিত্তিতে কিছু জানা বিষয়ের পুনর্মূল্যায়নের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে।
বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের শুরু থেকেই বাংলা দিল্লীর অধীনস্থ প্রদেশ হিসেবে শাসিত হতে থাকে; কিন্তু উচ্চাভিলাষী বাংলার গভর্নরগণ সুযোগ পেলেই স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন এবং নিজ নামে মুদ্রা জারি করতেন। ফলে বখতিয়ারের বাংলা বিজয় থেকে অর্থাৎ ১২০৫ থেকে ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত দিল্লী সালতানাতের অধীন হিসেবে বাংলা বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন গভর্নরদের অধীনে যেমন একাধিকবার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে; তেমনি শক্তিশালী দিল্লী সুলতানদের দ্বারা পুনরায় অধিকৃত হয়ে প্রদেশের মর্যাদাও অবনমিত হয়েছে।
একজন স্বাধীন সুলতান হিসাবে ফখরুদ্দিন নিজ নামে মুদ্রা জারি করেছিলেন। তাঁর মুদ্রায় খোদিত তারিখ দেখে ধারণা করা যায়, তিনি ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন- সোনারগাঁও রাজত্ব করেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তাঁর রাজসীমা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কিছুটা বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করেন। চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন- একটি রাজপথ ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও টাকশাল থেকে ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ নামাঙ্কিত মুদ্রা জারি করা হয়। গাজী শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রায় ১৩৫২ খিস্টাব্দ পর্যন- তারিখ পাওয়া যায়। সুতরাং বোঝা যায়, ফখরুদ্দিন পুত্র গাজী শাহ পিতার মৃত্যুর পর সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান হিসাবে সিংহাসনে বসেন এবং ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন- তিন বছর রাজত্ব করেন।
বাংলায় প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণাকারী গভর্নর ছিলেন আলী মর্দান খলজি। ইতিহাসে তিনি আলাউদ্দীন আলী মর্দান খলজি নামে পরিচিত কিন্তু মুদ্রার সাক্ষ্যে তাকে রুকনুদ্দীন আলী মর্দান হিসেবে চিহ্নিত করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। অথচ তার মুদ্রা আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত তিনি আমাদের কাছে আলাউদ্দীন আলী মর্দান নামেই পরিচিত ছিলেন। তার স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে; স্বর্ণমুদ্রাগুলো পূর্ণ মুদ্রা নয় তবে তার পূর্ণ টাকা মূল্যের রৌপ্যমুদ্রার দু’টি ধরন পাওয়া গেছে। একটি ধরনের ‘রুকন’ শব্দের ‘রা’ অক্ষরটি সোজাভাবে ‘আলিফ’-এর মতো লেখা এবং অসম্পূর্ণ ‘নুন’ সহযোগে এমনভাবে শব্দটি লেখা হয়েছে যা মুদ্রাবিদদের পর্যন্ত বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে এবং তারা ‘আলা’ লিখতে ভুলে ‘আইনের’ স্থলে ‘আলিফ’ লেখা হয়েছে বলে সমন্বয় করতে চেয়েছেন।১ তবে আশার কথা সম্প্রতি সুস্পষ্ট ‘রুকন’ লেখা মুদ্রাপ্রাপ্তির ফরে এই সন্দেহজনক পাঠের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। ফলে আলী মর্দান ‘আলাউদ্দীন’ নয় বরং ‘রুকনুদ্দীন’ উপাধি গ্রহণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এ ধরনের সিদ্ধান্তে এখন আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
উল্লেখযোগ্য যে, বখতিয়ার খলজী গৌড় বিজয়ের স্মরণে ৬০১ হিজরিতে মুহম্মদ বিন সামের নামে যে স্মারকমুদ্রা প্রচলন করেন তার একপিঠ ছিল ঘোড় সওয়ার অঙ্কিত। অনুরূপ ঘোড় সওয়ার আলী মর্দানের মুদ্রায় প্রাপ্তির ফলে এবং পরবর্তীতে সুলতান ইলতুৎমিশের নাম ৬১৬ হিজরি পর্যন্ত প্রচলিত অনুরূপ ঘোড় সওয়ার মুদ্রাগুলো পূর্ববর্তী দু’জন বাংলার শাসকের জারিকৃত মুদ্রার ধারাবাহিকতায় প্রস্তুত বিধায় এখন সন্দেহাতীতভাবে মুদ্রাগুলো বাংলার টাকশালে তৈরি (অর্থাৎ ‘গৌড় বিজয়ে’ মুদ্রা প্রচলনকারী টাকশাল) হিসেবে বিবেচনায় কোন বাধা থাকার কথা নয়। ফলে ইলতুৎমিশের একটি শ্রেণীর মুদ্রায় ‘বাগৌর’ পাঠকে ‘নাগোর’ বা ‘ লাকোর’ ইত্যদি পাটের বাদানুবাদে লিপ্ত হবার অবকাশ শেষ হয়ে গেছে বলে সিদ্ধান্তের সময় এসেছে এবং এসব মুদ্রা ইউয়াজ খলজীর স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বে তার দ্বারাই ইলতুৎমিশের নামে বাংলা থেকে প্রচলন করা হয়েছিল এ সিদ্ধান্তেও কোন বাধা নেই।
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
তথ্য সূত্রঃ
১। নাসির হেলাল, স্মৃতিতে অম্লান যারা। অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি।
২। প্রাগুক্ত
৩। MAJ Baig, Muhammad Mohar Ali http://www.BMRI.org.uk
৪। Ibid
৫। Ibid
৬। Ibid
৭। Asia post, 16th May, 2007.
৮। Jadu Natu Sarkar, History of Bengal, vol: II, Dacca: University of Dacca 1976.
৯। Syed Sajjad Hussain, New light on Muslim Bengal; Impact International Magazine, London, 1989.
১০। Muhammad Mohar Ali, History of the Muslims of Bengal, vol/A. Ryadh: Imam Muhammad Ibn Saud Islamic University, 1985.
১১। Ibid
১২। Muhammad Mohar Ali, History of the Muslims of Bengal, vol/B.
১৩। খন্দকার ফজলে রাব্বী, বাংলার মুসলমান, আব্দুর রাজ্জাক অনূদিত। ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৬।
১৪। Sir Herbert Risley. The Rise of Islam. Calcutta: Thacker, Spirnk and company, 1915. উদ্ধৃতঃ আকবর আলী খান, বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা। ঢাকাঃ বাংলা একাডেমী, ২০০৪।
১৫। Asim Roy, The Islamic Syncretistic Tradition in Bangla. Dhaka: Academic Publishers, 1983.
১৬। Richard M. Eaton, The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760, Delhi: Oxford University Press, 1994.
১৭। রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড ও চতুর্থ খণ্ড। কলিকাতাঃ জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৭৫।
১৮। Muhammad Mohar Ali, The Quran and the Orientalists: An Examination of Theirs Main Theories and Assumptions. Suffolk: Tamiyat Ihyaa Minhaj Ali Sunnalhs, 2004.
১৯. Nicholas W. Lowick, ÔThe Horseman Type of Bengal and the Question of Commemorative Issues’, Journal of the Numismatic Society of India (hereafter JNSI), Varanasi, Vol. XXXV, 1973, 198; M. Nizamuddin, ÔA Rare Coin of Ali Mardan Khalji-A Medieval Muslim Ruler of BengalÕ Ibid., Vol. XLIX, Parts 1 & 11, 1987, 52
২০. Jadu Nath Sarker (ed), history of Bengal, Vol. 11, University of Dhaka. Dhaka, 1976 (Third impression), 58.
২১. সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলায় মুসলিম অধিকারের আদিপর্ব, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ১৯৮৮, চিত্র ৪।
২২. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল), বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৭ (২য় প্রকাশ), ১৫৫।
২৩. N.K. Bhattasali, Coins and Chrnology of the Early Independent Sultans of Bengal, W. Heffer & Sons, Carmbridge,1922, 114.
২৪. Abdul karim, Corpus of the Muslim Coins of Bengal (Down) to A.D. 1538), Asiatic Society of Pakistan, Dhaka, 1960, Type- D. 80; N.K. Bhattasali, Ibid, 127 (Class II [b]).
২৫. N.K. Bhattasali, op. cit., 132.
২৬. GS. Farid, ÔA New and Unique Ten Tanka Commemorative Coin of Jalaluddin Mohammad Shah of Bengal (818-837)Õ, JNSI, Vol. XXXVIII, 1976, 88-95
২৭. Abdul Karim, op. cit., Type-F, 77.
২৮. Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. XLII, No. 3, 233.
২৯. Abdul Karim, op. cit, 119.
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৫:২৪
ম.র.নি বলেছেন: এই পর্বটা বোরিং লাগলো সন,তারিখ,নামের উল্লেখের মাঝে কিছু ইন্টারেস্টিং ঘটনা দিলে পড়ে ভালো লাগে,নইলে শুকনা স্ক্রীনে শুকনা ইতিহাস কাঁহাতক পড়া যায়