নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফিরে দেখা বাংলার ইতিহাস পর্ব আট...
ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন ছিল সর্বকালের সেরা শাসন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ॥
সূফি বরষণ
ইলিয়াস শাহী শাসন :
ভূমিকা:
বাংলার সমগ্র ভূখণ্ড ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিম সুলতানদের দ্বারা অধিকৃত হয়। ১৫৭৬ সালে এটি মোগলদের নিয়ন্ত্রণে আসে। মুসলমান শাসনামলেই বাংলা ভাষার সত্যিকারের বিকাশ ঘটে। মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের মূলে মুসলিম সুলতানদের সমর্থন ও সহায়তা ছিল। প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীর ‘ইউছুফ-জুলেখা’ কাব্য রচনা করেন ইলিয়াস শাহী শাসন আমলে ॥ ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠা সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহী মাধ্যমে আমাদের আত্মা পরিচয়ের সূচনা হয়॥ কারণ এর আ গে বাঙালি বা বাঙলা নামে কোনো জাতি বা দেশের নাম পরিচয় ছিলনা ॥
বাংলা ভাষার ইতিহাস লিখতে হলে মধ্যযুগের এই সুলতানদের ভূমিকার কথাও লিখতে হবে। এ যুগের বিখ্যাত কবি চণ্ডীদাস, শাহ মোহাম্মদ সগীর, কৃত্তিবাস, মালাধর বসু, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, আবদুল হাকিম, সৈয়দ সুলতান প্রমুখ বিভিন্ন সুলতান ও অমাত্যদের সমর্থন ও আশ্রয়ে কাব্যচর্চা করেছেন। এসব নিদর্শন উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, মুসলমানদের শাসনামলেই এদেশের আপামর মানুষের ভাষা ও কৃষ্টির(সংস্কৃতি) নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়।
মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা হচ্ছে আরবি। রাজদরবারের ভাষা ছিল ফারসি। তুর্কি মুসলিম সুলতানরা ঘরে তুর্কি ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু এরা আবার করেছেন বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা। ভাষা একটা জাতিসত্তাকে গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা পালন করে। বাংলা ভাষা হয়েছে বাংলাদেশী জাতিসত্তার বিশেষ উপাদান। কিন্তু এই উপাদানটি যুক্ত হয়েছে মুসলিম সুলতানি আমলে, বৌদ্ধ বা হিন্দু আমলে নয়। কারণ তখন পালী ও সংস্কৃত ভাষার চর্চা করা হতো এবং বাংলার জনগণের উপরে সংস্কৃত ভাষা চাপিয়ে দেয়॥ কিন্তু একমাত্র মুসলিম শাসকগণই বাংলা ভাষার উন্নতি সাধনে যথাযোগ্য সহায়তা করেন ॥
মুসলমানরা আসার আগে এখানে কোনো বাংলা ভাষায় পুথি লেখা হয়নি। যে বাংলা ভাষা পড়ে আমরা বুঝতে পারি, তার উদ্ভব হয়েছে মুসলমান সুলতানদের শাসনামলে, তার আগে নয়। চর্যাপদের ভাষা আমরা বুঝতে পারি না। হিন্দু আমলে বাংলা সাহিত্য চর্চাই ছিল না। রাজনৈতিক জাতিসত্তা হিসেবে আজকে যে বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছে, তার গুুরুত্বকে বুঝতে হলে এই মুসলিম সুলতানদের শাসনামলকে আমাদের যথেষ্ট মূল্য দিতে হবে। মুসলিম সুলতানদের সময় বাংলাভাষীদের যেমন ভাষিক সত্তা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তেমনি তাদের রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ও মূর্ত হয়েছে।
মুসলমানরা আসার আগে বঙ্গ বা বাংলা নামে অখণ্ড কোনো দেশ বা রাজ্য ছিল না। আজকের বাংলা বা বাংলাদেশ সেই কালে রাঢ়, বরেন্দ্র, পুণ্ড্র, গৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল নামে বিচ্ছিন্ন জনপদ ও রাজ্য হিসেবে অবস্থিত ছিল। মুসলমানরা এসেই এই বিচ্ছিন্ন জনপদকে গ্রথিত করে একত্রে বাংলা নাম দেন। বাংলাভাষীরা তখন থেকেই রাষ্ট্রীয় নামে বা জাতি হিসেবে বাঙালি শব্দটার সত্যিকার তাৎপর্য অনুধাবন করে। সেই হিসেবে রাষ্ট্রীয় নামে এবং জাতিগতভাবে বাঙালিদের বয়সকাল সাড়ে ছয়শ’ বছর। স্বাধীন সুলতানি আমলে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ সালে বাংলার পৃথক পৃথক জনপদ ও স্বাধীন অঞ্চলকে একীভূত করে মুলুক-এ-বাঙ্গালাহর উদ্ভব ঘটান।
আর তিনি অভিহিত হন শাহ-ই-বাঙ্গালাহ বলে। মোগল আমলে এ ভূখণ্ড অভিহিত হতো সুবে বাঙ্গালাহ বলে। সুতরাং একদিক দিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের আজকের যে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সত্তা, তার পেছনে মুসলিম আমলের অবদানই প্রবল ও প্রধান। বর্তমান আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা দাবি করেন, বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। তাদের এ দাবি পুরোপুরি ইতিহাসসম্মত নয়। আবার তারা হাজার বছরের বাঙালিত্বের দাবিদার হলেও তারা মুসলিম আমলের গৌরবময় ইতিহাসের কথা বলেন না। বলেন নীহার রঞ্জন বর্ণিত ইতিহাস এবং ১৯৪৭-৭১-এর কালপ্রবাহের ভেতরকার ইতিহাস। তারা যেভাবে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ইতিহাসকে তুলে ধরতে চাচ্ছেন, তাতে মূলত ইতিহাসেরই বিকৃতি ঘটছে।
মুসলিম সুলতানদের সময়ে গঠিত হয়েছে বাংলাভাষী মানুষের জাতিসত্তা। এই সময়কেই ধরতে হবে বাঙালি জাতির উদ্ভবের কালমাত্রা। আজকের বাংলাদেশীরা সেই কালমাত্রার ধারাবাহিকতা মাত্র। বাংলাদেশে মুসলমান শাসন ছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে ছিল স্বাধীন সুলতানি আমল ও মোগল আমল। এ সময়ের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ, জীবনচেতনা, সামাজিক ব্যবহারবিধি, রাজনৈতিক প্রশাসন, বিশিষ্ট ধরনের শিল্প ও সাহিত্যচর্চা এদেশের সামাজিক জীবনে রূপলাভ করে, বাংলা ভাষার পরিবর্তন ঘটে এবং শেষমেশ ইসলাম এদেশের গণজীবনে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ইলিয়াস শাহী শাসনের কথা :
ইলিয়াসশাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলার স্বাধীন সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হাজী ইলিয়াস ছিলেন সিজিস্তানের একজন অভিজাত। প্রথমে তিনি দিল্লির মালিক ফিরুজের অধীনে চাকুরিতে নিয়োজিত ছিলেন। পরে
তিনি সাতগাঁওএর শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি মালিক পদে উন্নীত হন এবং ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার মৃত্যুর পর তিনি সাতগাঁয়ের অধিকর্তা হন। অতঃপর হাজী ইলিয়াস আলী মুবারকের সঙ্গে দীর্ঘ সংঘর্ষে (১৩৩৯-১৩৪২ খ্রি.) অবতীর্ণ হয়ে অবশেষে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণ করে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং বাংলায় ইলিয়াস শাহী সালতানাতের ভিত্তি স্থাপন করেন। এ সালতানাত প্রায় দেড় শত বছর স্থায়ী হয়েছিল (১৩৪২-১৪৮৭ খ্রি.)। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ ফকরউদ্দীন মুবারক শাহের পুত্র ও উত্তরাধিকারী ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহকে পরাজিত করে সোনারগাঁও দখল করতে সক্ষম হন। ফলে সমগ্র বাংলা তাঁর কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে। ইলিয়াস শাহ একজন দৃঢ়চেতা ও দক্ষ শাসক ছিলেন এবং তার বিচক্ষণতা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির বলে তিনি শাহ-ই-বাঙ্গালাহ, শাহ-ই-বাঙালিয়ান ও সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ উপাধিতে ভূষিত হন। প্রায় ষোলো বছর রাজত্ব করার পর ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর সম্পর্কে আরও একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, তা হলো এমন
সোনারগাঁওয়ে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ যখন স্বাধীন সুলতান তখন লখনৌতির সিংহাসন দখন করেছিলেন সেখানকার সেনাপতি আলী মুবারক। সিংহাসনে বসে তিনি ‘আলাউদ্দিন আলী শাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। লখনৌতিতে তিনিও স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। পরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন পান্ডুয়ায় (ফিরোজাবাদ)। আলী শাহ ক্ষমতায় ছিলেন ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । তাঁর দুধভাই ছিলেন হাজী ইলিয়াস। তিনি আলী শাহকে পরাজিত ও নিহত করে ‘শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’ নাম নিয়ে বাংলায় একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজবংশের নাম ইলিয়াস শাহী বংশ। এরপর ইলিয়াস শাহের বংশধরগণ অনেক দিন বাংলা শাসন করেন। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য হিন্দু রাজত্বের উত্থান ঘটেছিল।
১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজাবাদের সিংহাসন অধিকারের মাধ্যমে ইলিয়াস শাহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলার অধিপতি হন। সোনারগাঁও ও সাতগাঁও তখনও তাঁর শাসনের বাইরে ছিল। ইলিয়াস শাহের স্বপ্ন ছিল সমগ্র বাংলার অধিপতি হওয়া। তিনি প্রথম দৃষ্টি দেন পশ্চিম বাংলার দিকে। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সাতগাঁও তাঁর অধিকারে আসে। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপাল আক্রমণ করে বহু ধনরত্ন হস্তগত করা হয়। এ সময় তিনি ত্রিহুত বা উত্তর বিহারের কিছু অংশ জয় করে বহু ধনরত্ন হস্তগত করেন। উড়িষ্যাও তাঁর অধিকারে আসে। তবে ইলিয়াস শাহের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল পূর্ব বাংলা অধিকার করা ।
ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও-এ ইলিয়াস শাহের হাতে পরাজিত হন। সোনারগাঁও দখলের মাধ্যমে সমগ্র বাংলার অধিকার সম্পন্ন হয়। তাই বলা হয়, ১৩৩৮ খিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার স্বাধীনতার সূচনা করলেও প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে। বাংলার বাইরেও বিহারের কিছু অংশ- চম্পারণ, গোরক্ষপুর এবং কাশী ইলিয়াস শাহ জয় করেছিলেন। কামরূপের কিছু অংশও তিনি জয় করেন। মোটকথা, তাঁর রাজসীমা আসাম হতে বারানসি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ইলিয়াস শাহ দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজ নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করায় সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।
ফিরুজ শাহ তুঘলকের বাংলার সুলতানের কাছে পরাজয় :
প্রথম দিকে দিল্লির সুলতান বাংলার এ স্বাধীনতা মেনে নেননি। সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাঁর চেষ্টা ছিল বাংলাকে দিল্লির অধিকারে নিয়ে আসা। কিন্তু তিনি সফল হননি। ইলিয়াস শাহ দুর্ভেদ্য একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদিকে বর্ষা এলে জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই ফিরোজ শাহ সন্ধির মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে ইলিয়াস শাহের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিল্লি ফিরে যান।
ইলিয়াস শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বংশ ১৪১২ থেকে ১৪৩৫/৩৬ পর্যন্ত তেইশ বছরের বিরতিসহ প্রায় দেড় শ’ বছর (১৩৪২-১৪৮৭) বাংলা শাসন করে। ইলিয়াস শাহী আমল নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ফখরউদ্দীন মুবারক শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সালতানাত সুসংহত হয় এবং এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। এ আমলে মুসলিম শাসনব্যবস্থা একটি রূপ লাভ করে। শিল্প, সাহিত্য, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়। মুসলিম শাসকগণ স্থানীয় জনগণের ওপর আস্থা স্থাপন করে দেশের শাসনব্যবস্থায় তাদের অংশ গ্রহণের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। এভাবে বিদেশি মুসলিম শাসন বাঙালি মুসলিম শাসনে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া এ আমলেই শুরু হয়। সর্বোপরি সমগ্র রাজ্য যা এতদিন একক কোনো নামে পরিচিত না হয়ে বঙ্গ, গৌড় ইত্যাদি বিভিন্ন আঞ্চলিক নামে পরিচিত ছিল তা বাঙ্গালাহ নামে অভিহিত হয়।
জনপ্রিয় শাসক ইলিয়াস শাহ:
শাসক হিসেবে ইলিয়াস শাহ ছিলেন বিচক্ষণ ও জনপ্রিয়। তাঁর শাসনামলে রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজিত ছিল। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। হাজিপুর নামক একটি শহর তিনি নির্মাণ করেছিলেন। ফিরুজাবাদের বিরাট হাম্বামখানা তিনিই নির্মাণ করেন। এ আমলে স্থাপত্য শিল্প ও সংস্কৃতি যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। তিনি ফকির-দরবেশদের খুব শ্রদ্ধা করতেন।
ইলিয়াস শাহ লখনৌতির শাসক হিসেবে বঙ্গ অধিকার করলেও তিনি দুই ভূখণ্ডকে একত্রিত করে বৃহত্তর বাংলার সৃষ্টি করেছিলেন। এ সময় হতেই বাংলার সকল অঞ্চলের অধিবাসী ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত হয়। ইলিয়াস শাহ ‘শাহ-ই বাঙ্গালা’ ও ‘শাহ-ই-বাঙালি’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
পুত্র সিকান্দার শাহের শাসন:
ইলিয়াস শাহের পুত্র ও উত্তরাধিকারী সিকান্দার শাহ প্রায় তেত্রিশ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল গৌরবোজ্জ্বল। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-১৩৯৩ খ্রিঃ) বাংলার সিংহাসনে বসেন। পিতার মতো তিনিও দক্ষ এবং শক্তিশালী শাসক ছিলেন। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫৮ থেকে ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দী পর্যন্ত পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। কিন্তু এবারও ফিরোজ শাহ তুঘলককে ব্যর্থ হতে হয়। পিতার মতো সিকান্দার শাহও একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধির মাধ্যমে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী জাফর খানকে সোনারগাঁওয়ের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
কিন্তু জাফর খান এ পদ গ্রহণে রাজি হলেন না। ফিরোজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে তিনিও দিল্লিতে ফিরে গেলেন। সোনারগাঁও এবং লখনৌতিতে আবার আগের মতোই সিকান্দার শাহের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রইল। ইলিয়াস শাহ যে স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিকান্দার শাহ সেভাবেই একে আরও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করতে সক্ষম হন। তিনিও পিতার মতো বাংলায় অসংখ্য পুকুর ও খাল খনন করেন ॥ মসজিদ মাদ্রাসা খানকাহ মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন॥ এবং জনগণের সুচিকিত্সা জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন সেই সময়কার বিখ্যাত হাকিমদের ( চিকিত্সক ) দিয়ে ॥ বলতে গেলে রাজপ্রসাদের বাহিরে জনগণের জন্য চিকিত্সার দ্ধার উন্মুক্ত করেছেন মুসলিম সুলতানরা॥ আর তখন থেকেই বলতে গেলে বাংলাদেশের জনগণ আধুনিক চিকিত্সার সুযোগ পাই॥ এখানে আর বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় যে, তখন মুসলিম সুলতানগণ অনেক সরাইখানা নির্মাণ করে ছিলেন ॥ বাংলার স্থাপত্য শিল্পের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে মধ্যযুগের মুসলিম শাসন ॥
বাংলার শ্রেষ্ঠ শাসক গিয়াসউদ্দিন ‘আজম শাহ:
আজম শাহ পিতার মৃত্যুর পর ‘সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ’ উপাধি ধারণ করে ৭৯২ হিজরিতে (১৩৯১-৯২ খ্রি.) সিংহাসনে আরোহন করেন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ একজন দক্ষ শাসক ছিলেন। আইনের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্যও সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ৮১৩ হিজরিতে (১৪১০-১১ খ্রি.) মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পরে তাঁর পুত্র সাইফুদ্দীন হামজাহ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি মাত্র এক বছর কয়েক মাস (৮১৩ হি./১৪১০-১১ খ্রি-৮১৪ হি/১৪১২ খ্রি.) বাংলা শাসন করেন।
ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দার শাহ যুদ্ধ বিগ্রহ ও স্বাধীনতা রক্ষায় নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের কৃতিত্ব ছিল অন্যত্র। তিনি তাঁর প্রজারঞ্জক ব্যক্তিত্বের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি তাঁর রাজত্বকালে আসামে বিফল অভিযান প্রেরণ করেন। জৌনপুরের রাজা খান জাহানের সহিত তিনি বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। চীনা সম্রাট ইয়াংলো তাঁর দরবারে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। তিনিও শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে চীনা সম্রাটের নিকট মূল্যবান উপঢৌকন প্রেরণ করেন। মোটকথা, আযম শাহ কোন যুদ্ধে না জড়ালেও পিতা এবং পিতামহের গড়া বিশাল রাজত্বকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ একজন ন্যায়বিচারক ছিলেন। রিয়াজ-উস-সালাতীন গ্রন্থে তাঁর ন্যায় বিচারের এক অতি উজ্জ্বল কাহিনী বর্ণিত আছে।
সুপণ্ডিত হিসেবে সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। কবি-সাহিত্যিকগণকে তিনি সমাদর ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি কাব্য রসিক ছিলেন এবং নিজেও ফার্সী ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। পারস্যের প্রখ্যাত কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ হতো।
শিক্ষা ও কৃষ্টি এবং সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা:
মুসলমান শিক্ষা ও কৃষ্টি(সংস্কৃতি)বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ বঙ্গের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছেন। তাঁর রাজত্বাকালেই প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীর ‘ইউছুফ-জুলেখা’ কাব্য রচনা করেন। আযম শাহের রাজত্বকালেই বিখ্যাত সুফী সাধক নূর কুতুব-উল-আলম পান্ডুয়ায় আস্তানা গাড়েন। এ স্থান হতেই তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম ধর্মের প্রচার করে বেড়াতেন। ফলে পান্ডুয়া ইসলাম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে ভারতবর্ষে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। ধর্মনিষ্ঠ সুলতানের নিকট হতে তিনি সর্বপ্রকার সাহায্য লাভ করেছিলেন। সুলতান মক্কা ও মদিনাতেও মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ ছিলেন বঙ্গের শ্রেষ্ঠ সুলতানদের অন্যতম এবং ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সুলতান। তাঁর মৃত্যুর পর হতেই এ বংশের পতন শুরু হয়।
১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহী বংশের উত্থানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ মুসলিম শাসনের আওতায় আসে। সুতরাং বখতিয়ারের বিজয় থেকে শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের উত্থানকালকে মুসলিম সমাজ গঠনের প্রস্তুতিপর্ব বলা চলে। তবে মুসলমানদের রাজনৈতিক শক্তি প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সমাজ বিস্তৃতির সম্পর্ক থাকলেও এতে সুফি সাধকদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সুফিগণ তাদের খানকাহ্ স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে লঙ্গরখানা, মক্তব, মাদ্রাসা স্থাপন করতেন। অর্থাৎ এককথায় বলতে গেলে মুসলিম সমাজ বিস্তৃতির উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতেন। উত্তর ভারতের মতো বাংলায় ইসলাম বিস্তার শহরের ভেতরই সর্বাধিক সাফল্য লাভ করেনি বরঞ্চ তা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ধর্ম প্রচারে সুফি সাধকদের স্বাধীনতায় সুলতানদের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এই সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল।
সামাজিক উন্নয়ন:
মুসলিম সমাজ বিকাশে এসব উপাদান সৃষ্টির সঙ্গে মুসলমান সুলতান এবং তাদের নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ভূমিকাও প্রধান ছিল। মুসলমান সমাজের সঙ্গে উপাসনাগৃহ মসজিদের সম্পর্ক ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যেখানেই মুসলমান বসতি গড়ে উঠত সেখানেই ধর্মীয় প্রয়োজনে গড়ে তোলা হতো মসজিদ, মাদ্রাসা আর দরগা। এছাড়াও মুসলমান সুলতান এবং তাদের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে কূপ, জলাধার, পুকুর খনন অথবা সেতু নির্মাণ ইত্যাদি জনহিতকর কাজ করা হতো। এসব স্থাপত্যের গায়ে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্মারক শিলালিপি উৎকীর্ণ হতো। সুতরাং এসব প্রাথমিক সূত্র ধরে তৎকালীন সমাজ ইতিহাসের অন্বেষণ করার সুযোগ রয়েছে।
লখনৌতিতে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দু’শ বছরের মধ্যে সমগ্র বাংলার ওপর মুসলমান সুলতানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাব্যাপী মুসলিম সমাজ বিকাশের এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষণ ছিল। তের শতকের শেষলগ্নে সাতগাঁও রুকনউদ্দিন কায়কাউস কর্তৃক অধিকৃত হয়।
পরবর্তী সুলতান শামসউদ্দিন ফিরুজ শাহের সময় মুসলিম রাজ্য বিস্তারের প্রক্রিয়া বাংলার অভ্যন্তরে এগিয়ে চলে। তার মুদ্রায় লখনৌতি ছাড়াও ‘হজরত সোনারগাঁ’ এবং ‘বঙ্গ’ টাকশালের নাম যুক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরেও রাজ্য সম্প্রসারিত হয়। শিলালিপির সাক্ষ্য অনুযায়ী সিলেট তার কর্তৃত্বভুক্ত ছিল। সিলেটে হজরত শাহজালালের দরগাকে কেন্দ্র করে একটি শিলালিপি, বিহারে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে মসজিদ নির্মাণের সাক্ষ্য, হুগলীর ত্রিবেনীতে জাফর খাঁর দরগায় প্রাপ্ত শিলালিপিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সাক্ষ্য প্রভৃতি অধিকৃত অঞ্চলে মুসলিম সমাজ বিকাশের স্বপক্ষেই তথ্যসংস্থান করেছে।
রাজা গণেশের ষড়যন্ত্র মূলক উত্থান:
তাঁর রাজত্বকালে রাজশাহী জেলার ভাতুরিয়ার জমিদার রাজা গণেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং তারই প্ররোচনায় সুলতানের ক্রীতদাস শিহাবউদ্দীন তার প্রভুকে হত্যা করে নিজেই বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। যখন এ ঘটনা ঘটছিল, তখন সম্ভবত মুহম্মদ শাহ বিন হামজাহ শাহ বাংলার কোনো এক অঞ্চলে নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন এবং নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। সম্ভবত তিনি তাঁর অবস্থান রক্ষা করতে পারেন নি এবং শেষ পর্যন্ত তিনি রাজা গণেশ ও শিহাব উদ্দীনের কাছে পরাজিত হন। এভাবে ইলিয়াস শাহী শাসনের বিরতি ঘটে।
সুলতান সাইফউদ্দীন হামজা শাহের ক্রীতদাস শিহাবউদ্দীন বায়েজীদ শাহ ৮১৪ হিজরি (১৪১২ খ্রি.) থেকে ৮১৭ হিজরি (১৪১৪ খ্রি.) পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। শিহাবউদ্দীন বায়েজীদ শাহ ও রাজা গণেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। শিহাবউদ্দীন রাজা গণেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন এবং কিছু সময়ের জন্য তাকে আটক রেখে তার ক্ষমতা খর্ব করেন। তিনি সুলতান শিহাবউদ্দীন বায়েজীদ শাহ উপাধি ধারণ করে নিজ নামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন। কিন্তু শীঘ্রই রাজা গণেশ সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং তাকে আক্রমণ করে হত্যা করেন (৮১৭হি./১৪১৪ খ্রি.)। শিহাবউদ্দীন বায়েজীদ শাহের পুত্র আলাউদ্দীন ফিরুজ শাহ কোনো রকমে দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় পালিয়ে যান এবং সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। কিন্তু রাজা গণেশ তাকে আক্রমণ করে নিহত করেন এবং নিজেই ৮১৭ হিজরিতে (১৪১৪ খ্রি.) বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
রাজা গণেশের বংশ বাংলার শাসক হয়েই রাজা গণেশ মুসলিমদের প্রতি নির্যাতন শুরু করেন। এ পরিস্থিতিতে পান্ডুয়ার সুফি-দরবেশ নূর কুতুব আলম জৌনপুরের সুলতান ইবরাহিম শর্কীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এতে রাজা গণেশ ভীত হয়ে দরবেশের কাছে এ মর্মে আবেদন জানান যেন ইবরাহিম শর্কী বাংলা থেকে তার বাহিনী প্রত্যাহার করে নেন। রাজা গণেশ তার পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে এবং তাকে সিংহাসনে বসাতে সম্মত হলে দরবেশ তার প্রস্তাব মেনে নেন। ৮১৮ হিজরিতে (১৪১৫ খ্রি.) এ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ইবরাহিম শর্কী দরবেশের অনুরোধে বাংলা ত্যাগ করেন।
যদু জালালউদ্দীন আবুল মুজাফফর মুহম্মদ শাহ নামে ৮১৮ হিজরিতে মুদ্রা চালু করেন। তিনি মাত্র এক বছর ও কয়েক মাস রাজত্ব করেন। তাঁর পিতা রাজা গণেশ ৮১৯ হিজরিতে (১৪১৬-১৭ খ্রি.) সিংহাসন দখল করে নেন এবং জালাল উদ্দীনকে পুনরায় হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করান। এবারে রাজা গণেশ দনুজমর্দন দেব উপাধি ধারণ করে ৮২১ হিজরি (১৪১৮ খ্রি.) পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। অতঃপর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্র সিংহাসনে বসেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর ভ্রাতা যদু কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন (৮২১ হি./১৪১৮ খ্রি)। এ সময়ে যদু পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ উপাধি ধারণ করেন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে প্রায় পনের বছর রাজত্ব করে ৮৩৭ হিজরিতে (১৪৩৩ খ্রি.) মৃত্যুবরণ করেন।
সুলতান জালালউদ্দীনের পর তাঁর পুত্র শামসুদ্দীন আহমদ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তিনি ৮৩৯ হিজরি (১৪৩৫-৩৬ খ্রি.) পর্যন্ত রাজত্ব করেন। আহমদ শাহের নির্যাতনমূলক কার্যকলাপ সকলকেই হতাশ করে। এ অবস্থায় নাসির খান ও সাদী খান নামে তার দুজন ক্রীতদাস তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করেন। এর অব্যবহিত পরেই নাসির খান ও সাদী খান সিংহাসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ন হন এবং এ বিবাদে নাসির খান তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেন। কিন্তু তিনি মাত্র কয়েকদিন বাংলা শাসন করার সুযোগ পান। শীঘ্রই অভিজাতবর্গ তার ক্ষমতার বিরোধিতা করেন এবং তাকে হত্যা করেন।
পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশ শামসুদ্দীন আহমদ শাহের হত্যার পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে অভিজাতবর্গ সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের এক বংশধর নাসির উদ্দীনকে ৮৩৯ হিজরিতে (১৪৩৫-৩৬ খ্রি.) বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। এভাবে ইলিয়াসশাহী বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন সুলতান নাসিরউদ্দীন ‘আবুল মুজাফফর মাহমুদ শাহ’ উপাধি নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রায় চবিবশ বছর রাজত্ব করেন। তিনি ৮৬৪ হিজরিতে (১৪৫৯-৬০ খ্রি.) মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রুকনুদ্দীন বারবক শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ন্যায়বান, উদার, বিদ্বান ও বিজ্ঞ সুলতান ছিলেন। হাবশী ক্রীতদাসদের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল এবং এ কারণে তিনি বহুসংখ্যক হাবশীকে নিয়োগ দান করেন। এ হাবশী ক্রীতদাসরা বাংলার রাজনীতিতে খুবই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। বারবক শাহ ৮৭৯ হিজরিতে (১৪৭৪ খ্রি.) মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর পরে তার পুত্রশামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ সিংহাসনে বসেন। ইউসুফ শাহের রাজত্বকালের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে শরীয়া আইন কঠোরভাবে এবং নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করেছিলেন।
তিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিধানসমূহ পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য আলেমদের নির্দেশ দেন। ইউসুফ শাহের মৃত্যুর পর (সম্ভবত ৮৮৬ হি./১৪৮১ খ্রি.) অভিজাতগণ তাঁর পুত্র দ্বিতীয় সিকান্দরকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু কয়েকদিন নামমাত্র রাজত্ব করার পর অভিজাতগণ তাকে সিংহাসনচ্যুত করে নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহের পুত্র ফতেহ শাহকে সিংহাসনে বসান। তিনি জালালউদ্দীন মুজাফফর ফতেহ শাহ উপাধি ধারণ করেন। তাঁর রাজত্বকালের শেষের দিকে হাবশী ক্রীতদাসগণ দরবারে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং দরবারের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ পদ দখল করে নেয়। ফতেহ শাহ বারবক নামে তার এক ক্রীতদাস কর্তৃক ৮৯৩ হিজরিতে (১৪৮৭ খ্রি.) নিহত হন। ফতেহ শাহের মৃত্যুর সাথে সাথে ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনের অবসান ঘটে।
১৩৪২ থেকে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে ইলিয়াস শাহ, সিকান্দর শাহ, জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ, নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ, রুকনউদ্দীন বারবক শাহ, ইউসুফ শাহ ও জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ-এর আমলে বাংলার সালতানাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। বলতে গেলে, সমগ্র বাংলা এবং পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিকটবর্তী কিছু এলাকা বাংলা সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
ইলিয়াস শাহী বংশ যথানিয়মে পরম্পরা অনুসারে যোগ্য শাসকদের তৈরি করেছে। এ শাসকগণ তাদের সহিষ্ণুতা ও শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ওপর প্রায় সত্তর বছর শাসন কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা ছিল তাদের বড় কৃতিত্ব; পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া ছিল আরও বড় কৃতিত্বের কাজ। এ সবই তাদের জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য বহন করে।
বাংলা সাহিত্যের শুভ উত্থান:
মুসলমান সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত এবং বিভিন্ন নামে পরিচিত বাংলা ভাষাভাষী সমগ্র অঞ্চলকে একত্রিত করে সমগ্র অঞ্চলের নাম বাংলা রাখেন, সম্পূর্ণ দিল্লির প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে বাংলা পরিচালনা করেন॥
মূলত সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এর শাসনামল থেকেই বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ভাবে উত্সাহ দেয়া হতে থাকে॥ রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে হিন্দুরা সংস্কৃত বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য চর্চায় আগ্রহী হয়॥ শুধু তাই নয়, মুসলিম শাসকদের উত্সাহে হিন্দুরা তাদের রামায়ন বাংলায় অনুবাদ করে॥ সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের শাসনামল ছিল ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, এই সময় থেকেই বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের শুরু ধরা হয়॥ আর ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সুচনা ধরা হয়॥ তবে বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ / প্রাচীন যুগে পালদের দ্বারা চর্যাপদ ছাড়া বাংলা ভাষায় আর কিছুই রচিত হয়নি॥
বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের আরেকজন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দ )॥ তার শাসনামলেই রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্য গ্রন্থ বড়ু চন্ডিদাসের লেখা শ্রীকৃষ্ণকির্তন॥ বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহাম্মদ সগীরের লেখা ইউসুফ-জুলেখা কাব্য গ্রন্থও এই সময়ে রচিত হয়॥
সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পুত্র ছিল সুলতান সিকান্দার শাহ, আর সুলতান সিকান্দার শাহের পুত্র ছিল সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ॥ এই গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের কবর নারায়ণগঞ্জের সোনারগায়ে অবস্থিত॥ বাংলার আরেক শাসক আলাউদ্দিন হুসেন শাহও বাংলা ভাষার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন॥
তবে কিছু কিছু বাঙালি হিন্দু কবি বাংলা সাহিত্য চর্চা পছন্দ করতেন না, তারা সংস্কৃতের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি॥ তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কবি আব্দুল হাকিম একটি কবিতা লিখেন--
"যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি."
বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারিতে এ কবিতাটি ব্যবহার করা হয়, যদিও এটি ৫২র প্রেক্ষাপটে নয়, বরং বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের সংস্কৃত প্রেমীদের নিয়ে লেখা একটি কবিতা॥
মুসলিম শাসকরাই মূলত হিন্দুদেরকে বাংলা সাহিত্য মুখী করে তুলে. মুসলিমদের রচিত বাংলা সাহিত্য ও হিন্দুদের রচিত বাংলা সাহিত্যের মধ্যে একটা তফাত ছিল॥ হিন্দুদের রচিত সাহিত্যের ধারাকে মঙ্গল কাব্য বলা হয়॥ এগুলি ছিল মূলত দেব-দেবীদের কাহিনী কেন্দ্রিক-শ্রীকৃষ্ণকির্তন, মনসামঙ্গল ইত্যাদি॥ কিন্তু মুসলমানদের রচিত সাহিত্য ছিল মূলত মানুষ কেন্দ্রিক--ইউসুফ-জুলেখা, লায়লী-মজনু, শিরি-ফরহাদ ইত্যাদি॥ হিন্দুদের সাহিত্তে যেমন দেব-দেবীর বিষয়গুলি ছিল তেমনি মুসলমানদের রচিত সাহিত্য মানুষ কেন্দ্রিক হলেও সেখানে ধর্মীয় বিষয়গুলি বিভিন্নভাবে নিয়ে আসা হত॥ কিন্তু হিন্দু-মুসলিম কেউ কাউকে কটাক্ষ করে কিছু লিখতনা॥
হিন্দু-মুসলিম এই দুটি ধারার বাইরে শ্রী চৈতন্য দেব একটি নতুন ধারা শুরু করেন যেটা বৈষ্ণব পদাবলী নামে পরিচিত॥ শ্রী চৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্ম নামে একটি নতুন ধর্ম চালু করেন আর তার সাহিত্যের উদ্দেশ্য ছিল এই ধর্মকে প্রচার করা॥ তার ধর্মের মূল বক্তব্য ছিল মানব প্রেম, ভালোবাসা. মঙ্গল কাব্যের তুলনায় বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের বিচারে অনেক উন্নত ছিল এবং অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল॥ অনেকে বলে থাকেন হিন্দুরা যেভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে ছিল, শ্রী চৈতন্য দেবের আবির্ভাব না হলে হিন্দুদের এই স্রোত আটকানো যেত না॥ বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগে মুসলমানদের আরেকটি বড় অবদান হচ্ছে হাজার হাজার পুথি রচনা করা যেগুলে এখনো গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে শুনা যায়॥
মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে
সূফি বরষণ
তথ্যসূত্র
১. অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি, কোলকাতা, ১৯৭৫
২. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস: সুলতানি আমল, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮২
৩. ওয়াকিল আহমদ, বাঙলার লোক-সংস্কৃতি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৪
৪. ডেভিড ম্যাক্কাচ্চিওন, বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম শিল্পরীতির ধারাবাহিকতা, এক্ষণ, ষষ্ঠ বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা, কোলকাতা, ১৯৬৮
৫. সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাসের দু’শ বছর : স্বাধীন সুলতানদের আমল, কলকাতা, ১৯৬২
৬. Jadu Nath Sarker (ed), history of Bengal, Vol. 11, University of Dhaka. Dhaka, 1976 (Third impression), 58.
৭. সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলায় মুসলিম অধিকারের আদিপর্ব, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ১৯৮৮, চিত্র ৪।
৮. আবদুল করিম, বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল), বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৭ (২য় প্রকাশ), ১৫৫।
৯. N.K. Bhattasali, Coins and Chrnology of the Early Independent Sultans of Bengal, W. Heffer & Sons, Carmbridge,1922, 114.
১০. Abdul karim, Corpus of the Muslim Coins of Bengal (Down) to A.D. 1538), Asiatic Society of Pakistan, Dhaka, 1960, Type- D. 80; N.K. Bhattasali, Ibid, 127 (Class II [b]).
২| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৩৭
সূফি বরষণ বলেছেন: thanks bro
©somewhere in net ltd.
১| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:৫৫
ম.র.নি বলেছেন: এ পর্বটা দারুন লাগছে।