![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সুশোভন
॥এক॥
বিকাল ৪ টে বেজে ৪৫ মিনিট, শীতকাল দিনটা ২৪শে ডিসেম্বর ১৯৯০,ঋত্বিকা একাই হাঁটছিল রাজবল্লভ পুরের সেই বিশাল মাঠটার ওপর দিয়ে। কিচ্ছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যে নামবে, তাই চারদিক জনমানবশূন্য আর এই জায়গাটায় লোকের আনাগোনা খুব কম। ওর বন্ধু সায়নী আর বাকিরা গতকালই পৌঁছে গেছে রাজবল্লভপুরে সায়নীদের বাগানবাড়িতে,ওখানে ২৫ শে ডিসেম্বর ওদের ফিস্ট আছে। ঋত্বিকা ওর B.Sc 2nd year পরীক্ষার জন্য সায়নীদের সঙ্গে যেতে পারে নি।সায়নী ওকে সব রাস্তা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল,বলেছিল হাওড়া থেকে ২ টো ট্রেন আসে একটা ৭টায় আর একটা ১২টায় ট্রেন থেকে নেমে গরুর গাড়িতে সোজা গেলে একটা মাঠ পড়বে,সেটা পেরিয়ে ১৫ মিনিট সোজা গেলেই আমাদের বাগানবাড়-পথে কোনো অসুবিধা হলে লোককে বাগানবাড়ি যাবো বললেই দেখিয়ে দেবে।ঋত্বিকা ভেবেছিলো সকালের ট্রেনটাতেই যাবে, কিন্তু বাড়ির সবার অদ্ভুতভাবে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যাওয়ায় দুপুরের ট্রেনটায় যেতে হয়। ৩ টের সময় ট্রেন থেকে নেমে কোনো গরুর গাড়ি না পাওয়ায় হেঁটেই যাচ্ছিল ঋত্বিকা,তারপর মাঠে এসেই বিপদ! সে একাই বেরিয়েছে বাড়ি থেকে, কিন্তু এখন ভাবছে বাবার কথা শুনলেই ভালো করত, একা অচেনা জায়গায় আসাটা ঠিক হয়নি।কারণ সে গত ২ ঘণ্টা ধরে হাঁটছে মাঠটার ওপর দিয়ে আর তার মনে হচ্ছে সে একই
জায়গায় বারবার ঘুরছে । শেষে ক্লান্ত হয়ে ভাবল যদি একটা কোনো বাড়ি এখানে থাকত একটু রেস্ট নেওয়া যেত।ঠিক সেই সময় দূরে ঝোপের মধ্যে যেন একটা প্রাসাদ জাতীয় বাড়ির চূড়া দেখতে পেলো । সে ভাবল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যে হবে এর মধ্যে কিছুতেই সায়নীদের বাড়ি পৌঁছতে পারবে না, তাই সারারাত তো আর মাঠে থাকা যায় না,এই ভেবে সে একটু আশ্রয়ের জন্য ওই বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। মাঠের এই দিকটায় কেউ আসে না তাই জঙ্গলে ভরে গেছে। ঋত্বিকা কোনো রকমে যখন জঙ্গল পেরিয়ে বাড়িটার বিশাল ফটকের সামনে এসে পৌঁছলও তখন ৫টা ২০।বাড়িটার চারদিকে উঁচু পাঁচিল ঘেরা তবে পুরোটাই এখন লতায় ঢেকে গেছে, তার ফাঁক দিয়ে একটা কালো মার্বেলের উপর সোনালী অক্ষরে সে কিছু লেখা দেখতে পেলো। ঋত্বিকা সেটা একটু পরিষ্কার করে দেখল বাড়িটার নাম PINK HEART PALACE ,তৈরি করেছেন গভর্নর জেনারেল Thomas Rite সাল ১৮৭২। বিশাল গেটটায় একটা বহু পুরানো ভাঙা তালা ঝুলছিল ঋত্বিকা তালাটা সরিয়ে খুব কষ্ট করে বিশাল গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকলো ।
॥দুই॥
এক সময় পাথর বাঁধানো রাস্তা আর তার দুই ধারে সুন্দর ফুলের বাগান ছিল এই জায়গায়,এখন চারিদিক জঙ্গলে ভরে গেছে। রাস্তাটা আর বাগানের মধ্যে যে শ্বেত পাথরের গ্রিক শিল্পকলায় তৈরি মূর্তিগুলো ছিল সেগুলো লতায় ঢাকা পড়ে গেছে।ঋত্বিকার সব কিছু যেন চেনা চেনা লাগছিল। আমরা কোনো আত্মীয়ের বাড়ি অনেক বছর পর গেলে যেমন চারপাশের পরিবেশ বদলে যায় সব আমাদের চেনা অথচ সব কিরকম অন্য রকম ঋত্বিকার মনে কিছুটা সেরকম অনুভূতি হল । এরকম কেন হল সে বুঝতে পারলো না সে তো এখানে এই প্রথম এলো ।যাই হোক সে কোনোরকমে রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে গেলো । সোজা এগিয়ে গিয়ে যেখানে রাস্তাটা শেষ হয়েছে সেখানে একটা বিশাল ফাউন্টেন্ট আর তার মাঝখানে ও চারিধারে সুন্দর গ্রিক শিল্পকলায় তৈরি নানারকম মূর্তি যদিও ফাউন্টেন্টটা দিয়ে এখন আর জল পড়ছে না, আর সবটাতেই সময়ের
ছাপ স্পষ্ট ।আর এর পরেই সেই পিঙ্ক হার্ট প্যালেস ,নিওক্ল্যাসিকাল আর গথিক শিল্পকলায় তৈরি প্রাসাদ ,ঋত্বিকার চোখের সামনে একটা আবছা ছবি ফুটে উঠল সাদা রঙের খুব সুন্দর একটা প্রাসাদের আর তার মাথার কাছে একটা গোলাপি হার্টের ডিজাইন ঠিক ক্রাউনের মধ্যে লাগানো হিরের মতো,সে বুঝতে পারলো না এই পোড়ো প্রাসাদটা দেখে তার মনে কেন এরকম ছবি ফুটে উঠল। সে প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল তার সামনে পড়ল বিশাল একটা কারুকার্য করা দরজা,দরজায় কোনো তালা ছিল না । সে দরজা যতটা সম্ভব জোরে ঠেলল খোলার জন্য। দরজাটা বিকট শব্দ করে খুলতেই বেরিয়ে এলো ১০০ বছরের জমে থাকা ধুলো আর সঙ্গে কিছু বাদুর আর চামচিকে ঋত্বিকার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ঋত্বিকা ভেতরে ঢুকল তখন তার হাতঘড়িতে দেখল ৫ টা ৫০ বাইরের আলো ক্ষীণ হয়ে এসেছে তাই প্রাসাদের ভেতরে অন্ধকার ।ঋত্বিকা ব্যাগ থেকে টর্চটা বার করে জ্বালালও । টর্চের ছোটো আলোক বৃত্তের বাইরে বিশাল সেই ঘরটা আরো অন্ধকার লাগছিল। ঋত্বিকার মনে হল সব তার খুব চেনা সে মনে মনে বলল “সব যেমন ছিল ঠিক তেমনটাই আছে”। সে ভাবল কতকগুলো মোমবাতি জালানো উচিত,সে মোমবাতি নেওয়ার জন্য ঘরের ডানদিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় ডাইনিং স্পেসের আলমারির ড্রয়ার থেকে কয়েকটা মোমবাতি আর লাইটার বার করে চারিদিকে মোমবাতি স্ট্যান্ডে, মোমবাতি জ্বালালও । সে খুব অবাক হল ,সে কি করে জানলো কোথায় কি আছে , সে যেন দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, একটা ভাগ সব কিছু করছে আর একটা ভাগ যেটা আসলে সে, সবকিছু দূর থেকে দেখছে। মোমবাতির আলোয় সে ডাইনিং রুমটা ভালো করে দেখল । সিলিঙে সুন্দর কারুকার্য করা , মেঝে দাবার ছকের মতো সাদা এবং কালো। সে ডাইনিং রুমের চারদিকে বিভিন্ন ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো ।ঘরগুলোয় পালঙ্ক,আলমারি নানা রকমের আসবাবপত্র রয়েছে আর রয়েছে অনেক সাদাকালো ছবি। একটা ঘরে একটি ব্রিটিশ দম্পতির ছবি, না ,পুরো ব্রিটিশ নয় কারণ মহিলাটি ব্রিটিশ পোশাক পরে থাকলেও তাকে দেখে বোঝা যায় তিনি ভারতীয়, তাদের অনেক ছবি গোটা ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে হয়তো এই ঘরটা তাদের বেডরুম ছিল। আর একটা ঘরে তাদের সঙ্গে একটি বাচ্চা ছেলের ছবি, তাদের ছেলে, সেই ছেলেটির ছোটো থেকে বড় হয়ে ওঠার নানা রকম ছবি রয়েছে সেই ঘরে তার মধ্যে হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটা পোট্রেইট। এটা সেই ছেলেটার বেশ বড়বেলার ছবি। কোনো উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ অফিসারের ছবি, চোখগুলো নীল আর নাকটা টিকালো কিন্তু চুল ও গায়ের রঙ ভারতীয়দের মতো। ছবিটা দেখে ঋত্বিকার চোখে জল এসে গেলো। সে যেন তার অনেক দিনের চেনা এই ছবির মানুষটিকে অনেক দিন পর দেখতে পেল , তার মুখ দিয়ে বেরলো “রাইট আমার Jhon Rite!” কথাটা বলে সে ভাবল এটা কি এই ছবির লোকটার নাম? সে কি করে জানলো , আজ তার সঙ্গে এসব কি ঘটনা ঘটছে? তার প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা করতে লাগল আর চোখের সামনে কুয়াশার পর্দা ঢাকা দৃশ্যের মতো নানারকম ছবি ভেসে উঠতে লাগলো। ঋত্বিকা তাড়াতাড়ি সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ডাইনিং রুমে । সেখানে দেওয়ালে নানা রকম পেইন্টিং টাঙানো আছে , হঠাৎ সে ডাইনিং রুম থেকে একটা ঘরে ঢোকার মুখে একটা ছবি দেখে চমকে উঠলো সেটা ছিল কারুকার্য করা একটি চেয়ারে বসা , ব্রিটিশ গ্রাউন পরিহিতা একটি মেয়ের পেইন্টিং যদিও ধুলোয় প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে তাও সব বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে , খুব পরিপাটি করে যত্ন সহকারে আঁকা , আর মেয়েটার মুখটা ছিল অবিকল তার মুখ- হ্যাঁ তার মুখ । ঋত্বিকা হাত দিয়ে ভালো করে ধুলোগুলো পরিষ্কার করে ভালো করে মুখটা দেখল। কোনো ভুল নেই এটা তারই মুখ ।কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ! সে সেই ঘরটায় ঢুকলো সেখানে তার আরও সাদাকালো ছবি ছিলো তার মধ্যে একটা ছিল খ্রিষ্টান বিয়ের সাদা গ্রাউন পরা, হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে বিয়ের ছবি তার সঙ্গে ছিল জন রাইট আরো অনেক লোকজন। এটা ছিল তাদের বিয়ের ছবি ।তার মাথা যন্ত্রণা বেড়ে গেল, চোখের সামনে সমস্ত ছবিগুলো ঘুরতে লাগলো, সে একটা রকিঙ চেয়ারের উপর পড়ে গেল তারপর সব অন্ধকার।
॥তিন॥
ঋত্বিকা যেন কোনো স্বপ্নের মধ্যে পৌঁছে গেছিল। তার সামনে একের পর এক ঘটনা যেন ঘটে যেতে লাগল- সে মাটির উঠান নিকচ্ছিল তার মা ঠাকুর ঘর থেকে বলল “ঋতুমা, একটু বড়ঠাকুরের থানে পূজোটা দিয়ে আয় তো। আর ও বাড়ির ফুলিও যাবে বলছিল ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাস”। সে মায়ের কাছ থেকে পূজোর থালাটা নিল। মা বলল “আজ গতবারে মেলা থেকে যে শাড়িটা কিনে দিয়েছিলুম ওটা পড়ে যাস”। ঋতু ছিল তাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোটো মেয়ে। তার আগে সবচেয়ে বড়ো অন্নপূর্ণা, তারপর তার পাঁচ দাদা, তারপর সে, সবচেয়ে আদরের ছোটো মেয়েকে মা শখ করে নাম দিয়েছিল ঋতুপর্ণা। তাদের গ্রামের সবার মতো তারাও পেশায় চাষি ,কিন্তু অন্যদের থেকে তাদের অবস্থা বেশ ভালো ছিল।
সে আর ফুলি বেরিয়ে পড়ল। অনেকটা পথ যেতে হবে। ফুলি মানে ফুলেশ্বরি তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তাকে সে তার সব মনের কথা বলত। সে প্রায়ই তাকে মজা করে বলত “ ইংরেজগুলোকে কি সুন্দর দেখতে হয় ইশ্, যদি ওরকম একটা লাল টুকটুকে ইংরেজ আমার বর হত” কিন্তু কে জানত এটা তার জীবনে সত্যি হতে চলেছে- তাদের গ্রাম থেকে মন্দিরে যাবার রাস্তায় পড়তো একটা জঙ্গল খুব বড়ো না হলেও সেখানে খরগোশ,তিতির আরো নানারকম ছোটো ছোটো প্রাণী থাকত, আর সেগুলো শিকার করতে ব্রিটিশ সৈন্যরা আসতো। ঋতু এখানেই প্রথম ইংরেজদের দেখেছিল। সেদিনও তারা যখন যাচ্ছিল একজন ইংরেজের বন্দুকের আওয়াজ তারা শুনতে পেল। ঋতু বলল “নিশ্চই কোনো ইংরেজ শিকার করতে এসেছে” তারা এগিয়ে চলল। হঠাৎ তাদের সামনে উপস্থিত হয় ঘোড়ার পিঠে চড়া সেই ইংরেজ। ঋতু আর সে নিষ্পলক চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফুলি ঋতুকে নাড়া দিয়ে বলল “আরে আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে চল তাড়াতাড়ি”। তারা এগিয়ে গেল। ঋতু বলল “ইংরেজটাকে কেমন অন্যরকম দেখতে গায়ের রং, চুলের রং আমাদের মতো”। ফুলিও বলল “ভারী আজব ব্যাপার”।তাদের আশপাশের গ্রাম থেকে ইংরেজদের নানারকম অত্যাচারের কথা শোনা যেত। কিন্তু তাদের গ্রাম তখনও ইংরেজদের হাতে পড়েনি তার কারণ জমিদার রাজা মহেন্দ্র সিংহরায়। রাজা মহেন্দ্রর ছিল একটা বড় লেঠেল বাহিনী আর অনেকগুলো বন্দুক কোনো ছোটো সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করার পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল কিন্তু কোনো বিশাল বাহিনীর সামনে তারা সহজেই পরাজিত হতে পারত । এর মধ্যে হঠাৎ শোনা যায় লর্ড লিটন নামে এক ব্রিটিশ গভর্নরের সঙ্গে খাজনা নিয়ে তার বিবাদ শুরু হয়েছে আর লর্ড লিটন যে কোনো দিন এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের গ্রামে হাজির হতে পারে। এদিকে লিটন যাতে সহজেই রাজা মহেন্দ্রকে হারানো যায় তার সুযোগ খুঁজছিল। তাই সে তার বন্ধু থমাস রাইটের ছেলে জন রাইটের বাড়ি মানে পিঙ্ক হার্ট প্যালেসে আশ্রয় নিয়েছিল। জমিদার বাড়ির সমস্ত খবর জানার জন্য লিটন সেখানকার একটি বংশী নামের চাকরকে টাকার লোভ দেখিয়ে হাত করেছিল। সেই চাকরটি জমিদার বাড়ির এবং গ্রামেরও অনেক খবর রাইটের বাড়িতে পৌঁছে দিত। লিটন ছিল একজন খুনী, নারী লোলুপ শয়তান, সে যে গ্রামই দখল করত সেই গ্রামের কোনো মেয়ে বউ লিটন আর তার সেনাবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেত না। জন রাইট সে কথা জানত তাই লিটনকে সাহায্য করার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না কিন্তু বাবার বন্ধু আর তার থেকেও উচ্চপদস্থ লিটনের কথাও সে ফেলতে পারেনি তাই রাইট, লিটনকে সাহায্য করতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাইটের অন্য একটা উদ্দেশ্যও ছিল, রাইট ঋতুকে প্রথম দেখেই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল, সে তার একটা পোট্রেইটও এঁকেছিল। একদিন বংশী প্যালেসে খবর দিতে এলে রাইট বংশীকে ছবিটা দেখেয়ে জিঞ্জেস করল “আচ্ছা বংশী তুমি এই মেয়েটাকে চেন? তোমাদের গ্রামেই থাকে।” দেঁতো হেঁসে বংশী বলল “আরে চিনব না কেন- এতো ভুবন চাটুজ্যের মেয়ে, আমার মেয়ে ফুলির বন্ধু, আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে। দেখতে খুব মিষ্টি, হেঁ হেঁ হুজুর কোথায় দেখলেন একে? খুব মনে ধরেছে বুঝি?”। লিটন তখন ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কথাগুলো শুনতে পায় আর তারপর ঘরে ঢুকে বলে “কি my dear friend একে পছন্দ? ঠিক আছে আমি কথা দিলাম আমাদের জয়ের পর এই মেয়েটা তোমার পুরস্কার”। লিটন বুঝেছিল তাদের কাছে অনেক বড় সেনাবাহিনী থাকলেও রাজা মহেন্দ্রর বীর বাহিনীর সামনে জেতা খুব সহজ কাজ নয়। তারা নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিলেও স্বাধীনতা দেবে না। তাই লিটন জমিদারের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানের দিন চুপিসারে আক্রমণ করে। জমিদারের সৈন্যরা প্রস্তুতি নেওয়ার কোনো সুযোগই পেল না, তাও তারা প্রথমে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও আক্রমণ প্রতিহত করার প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু তারা শেষ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় লিটন আর তার সেনাবাহিনী জয়লাভের পর চারিদিকে যথেচ্ছ লুটপাট চালায়, আর গ্রামের মেয়েদের উপরতো তাদের অত্যাচারের কোনও শেষ ছিল না। এদিকে জয়লাভের পরের দিন রাইট কয়েকজন সৈন্য নিয়ে ঋতুদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ঋতুর বাবা আর দাদাদের ধূলিসাৎ করে রাইট নিজে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ঘোড়ারগাড়িতে তুলে দিল। ঋতু শুনেছিল ইংরেজরা মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের সর্বনাশ করে কালাপানি পার ছেড়ে দেয় অথবা বেচে দেয় তাই সে বাঁচার যথাসম্ভব চেষ্টা করেছিল অন্যদিকে তার বাবা কুলীন বংশে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার মায়ের অনেক আপত্তি সত্ত্বেও, বিয়ে ঠিক করেছিল তিন কুড়ি দশ বয়সের একটা লোকের সঙ্গে তাই সে একান্ত মনে চাইছিল বিয়েটা যাতে আটকে যায়। তার দিদি অন্নপূর্ণারও বিয়ে হয়েছিল চার কুড়ি বয়েসের একটা লোকের সঙ্গে, একবছরের মধ্যেই সে মারা যায়, আর তার দিদিকে তার সঙ্গে চিতায় উঠে সতী হতে হয়। এইরকম ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচতে সে যেতে আর কোনও প্রতিবাদ করল না আর এই ইংরেজটাকে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিন থেকেই ভালো লেগেছিল। গাড়িটা থেমে গেল। রাইট গাড়ির ভেতরে ঢুকে ঋতুর হাতপায়ের বাঁধন খুলে দিল আর পরিষ্কার বাংলায় বলল “নামো”। সে নামতে ইতস্তত করায় রাইট তাকে হাত ধরে নামিয়ে দিল। গাড়ি থেকে নামতেই তার চোখের সামনে সে দেখল পিঙ্ক হার্ট প্যালেস। তার নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, এরকম প্রাসাদ সে জীবনে আগে কখনও দেখেনি। তার মনে হচ্ছিল, সে স্বপ্নের মধ্যে ঠানদিদির গল্পে শোনা কোনো রাজপ্রাসাদের সামনে পৌঁছে গেছে। রাইট তার হাত ধরে টেনে তাকে প্যালেসের ভেতরে নিয়ে গেল। ঋতু দেখল বাড়িটার বাইরেটা যেমন সুন্দর ভেতরটাও তেমনি সুন্দর। সেইসময় রাইট বলল “তুমি আজ থেকে এখানেই থাকবে মিসেস স্মিথ তোমার দেখাশোনা করবেন আর তুমি ওনার এবং আমার সব কথা শুনে চলবে। তোমার প্রথমে একটু অসুবিধা হবে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে আর আশা করছি তুমি এখান থেকে পালিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার কোনোরকম চেষ্টা করবে না কারণ তোমার বাড়ির লোকেরা একটা ব্রিটিশদের হাতে তুলে নিয়ে যাওয়া মেয়েকে কখনই বাড়িতে কেন গ্রামেও ঢুকতে দেবে না”।ঋতু সব কথাগুলো খুব অবাক হয়ে শুনছিল, সে বলল “আচ্ছা আপনি এত পরিষ্কার বাংলা বলেন কি করে”? আর আপনাকে দেখতেই বা অন্য ইংরেজদের থেকে আলাদা কেন?” রাইট তখন বলল “আমার সঙ্গে এসো তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি” বলে তাকে উপরতলার একটা ঘরে নিয়ে গেল। ঋতু দেখল সেখানে একজন বাঙালী সধবা স্ত্রীলোক আর তার সঙ্গে একজন বিদেশী লোকের ছবি আরও অনেকগুলো ছবিতে স্ত্রীলোকটি ইংরেজ মহিলাদের মতো পোশাক পরে আছে। রাইট বলল “তোমাকে আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয় নি আমি জন রাইট, আমার বাবার নাম থমাস রাইট আর মা রানীবালা দেবী। ছবিটা দেখেই নিশ্চয়ই বুঝেছো আমার মা ছিলেন বাঙালী। আমার মায়ের খুব ছোটো বয়েসে একটি বৃদ্ধের সাথে বিয়ে হয়েছিল। সেই বৃদ্ধ কয়েক বছর পর মারা যায় আর মাকে তার সঙ্গে সতীদাহ করা হচ্ছিল বাবা সেই সময় মাকে সতীদাহর হাত থেকে রক্ষা করেন এবং বিয়ে করেন”। ঋতু বলল “আপনার মা কি এখানেই আছেন?” রাইট বলল “না, আমার মা,বাবা গতবছর ইংল্যান্ডে যাওয়ার সময় জাহাজ ডুবি হয়ে মারা যান। আমার মা চাইতেন আমিও কোনো বাঙালী মেয়েকেই বিয়ে করি। তবে বিয়ের আগে তোমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। আর কাল থেকেই তোমার শেখা শুরু হবে তোমার নামটা যেন কি? ”। ঋতু বলল “আমার নাম ঋতুপর্ণা সবাই আমাকে ঋতু বলে ডাকে”। রাইট বলল “ঠিক আছে আমিও তোমাকে ঋতু বলেই ডাকব”। প্রথম দিনটা ঋতুর কোনো রকমে কাটল তার বেডরুম ছিল ওপরের তলায়। সেই ঘরটার রং, বিছানা,পর্দা সব কিছু ছিল গোলাপি, তাই ঘরটার নাম ছিল পিঙ্করুম। রাইট থাকত ব্লু রুমে কারণ তার প্রিয় রং ছিল ব্লু। প্যালেসে এরকম আরো নানারকম রঙের ঘর ছিল। পরের দিন রাইট ঋতুকে অনেকজন টিচারের সামনে দাঁড় করাল এবং একে একে তাদের পরিচয় দিল “ইনি মিসেস ব্রিগেনজা, ইনি তোমাকে ব্রিটিশ কালচার এবং ম্যানার্স শেখাবেন, ইনি মিস ডরথি,ইনি তোমাকে পোশাকের পাঠ দেবেন, মিসেস চার্চিল লেখাপড়া শেখাবেন, মিস অ্যান্ডারসন গান ও পিয়ানো শেখাবেন, মিসেস উইংকিলস্টন ব্যালে ডান্সিং মানে নাচ শেখাবেন, মিসেস লিংকন ব্রিটিশ কুকিং শেখাবেন, আর মিঃ স্মিথ আঁকা শেখাবেন আশা করছি তুমি এদের কথার অবাধ্য হবে না এবং তাড়াতাড়ি শেখার চেষ্টা করবে আমার বাবা মাকেও এই সব কিছু শিখিয়েছিলেন আর আমার মা সবকিছুতেই অনেক ব্রিটিশ মহিলার থেকেও যথেষ্ট ভালো ছিলেন”। ঋতু এইসব দেখেশুনে খুব অবাক হয়ে গেছিল সে যা ভেবেছিল সব তার থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। ঋতু বলল “আমি সবকিছু খুব ভালো করে শিখব”। রাত্রে ঘুমনোর সময়টুকু ছাড়া কোনোসময়ই তার ছুটি ছিল না। এমনকি খাওয়ার সময়ও ছুরি কাঁটার ব্যবহার ও আরও নানা জিনিস তাকে শিখতে হত। এইভাবে একটা বছর কেটে গেল। সারা বছর রাইটের সঙ্গে রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে শুধু দেখা হত আর তার মধ্যে good night wish ছাড়া আর কোনো কথা হত না। একবছরে সে অনেক কিছুই শিখে গেছিল। একদিন রাইট মিসেস স্মিথকে দিয়ে ঋতুকে চায়ের আসরে ইনভাইট করল। সেখানে রাইট বলল “আচ্ছা, ২৫ শে ডিসেম্বর ক্রিসমাসের আগের দিন যদি আমরা বিয়ে করি কেমন হয়?তোমার কোনোও আপত্তি আছে? ঋতু এইদিনটার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করছিল। তাই ঋতু খুব আনন্দের সঙ্গে সন্মতি জানালো। নির্দিষ্ট দিনে চার্চে তাদের বিয়ে হল। বিয়ের পর অনেক অতিথিদের সঙ্গে তাদের ফটো তোলা হল ঋতু এর আগে কখনও ফটো তোলা দেখেনি তাই সে দেখে প্রথমে বেশ ভয় পেল তারপর তার খুব মজা লাগল। এই বছরে ঋতুর টিউশন অনেকটাই কমে গেছিল কারণ অনেক কিছুই তার শেখা হয়ে গেছিল যেমন ব্রিটিশ কুকিং,আদব কায়দা। তার মতো ভাল ব্রিটিশ রান্না অনেক ব্রিটিশ লেডিও করতে পারত না। পিঙ্ক হার্ট প্যালেসটা তার খুব প্রিয় ছিল। তার মনে হত স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তো এটাই। সে রাইটকে যতটা ভালোবাসতো এই প্যালেসটাকেও ততটাই ভালোবাসতো। সে অতবড় প্যালেসের প্রত্যেকটা ঘর, আসবাবপত্র নিজের হাতে পরিষ্কার করত,নিজেই বাগানের দেখাশোনা করত। দেখতে দেখতে আরো একটা বছর কেটে যায়। সারা বছরে ঋতু রাইটের সঙ্গে অনেক সুন্দর মূহুর্ত কাটিয়েছিল রাইট তাকে নিজের হাতে ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিল ঋতুর মনে হত পৃথিবীতে যত বাঙালী মেয়ে আছে তার থেকে সুখী বোধহয় আর কেউ নয়। কিন্তু সুখ বোধহয় কারোর বেশী দিন সয় না। রাইট তাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী পালন করার প্ল্যান করছিল সেই সময় জানতে পারে তাকে একটা জরুরী কাজে বাইরে যেতে হবে ঋতু শুনে খুব দুঃখ পেল। রাইট বলল “আমি ২৪ শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঠিক ফিরে আসব”। রাইট চলে গেল। এদিকে মিসেস ব্রিগেনজার একটা ডায়মন্ড নেকলেস ঋতুর খুব পছন্দ হয়েছিল। উনি বলেছিলেন এটা তাকে তার হাসব্যান্ডের বিবাহবার্ষিকীতে দেওয়া উপহার। ঋতুর গয়নার প্রতি বেশী লোভ না থাকলেও সে জানার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল রাইট তাকে কি উপহার দেবে। সে রাইটকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু রাইট প্রতিবার শুধু সারপ্রাইজ বলে এড়িয়ে যেত। যাইহোক সেই দিনটা অবশেষে এসে গেল ২৪ শে ডিসেম্বর ১৮৯০।ঋতু সকাল থেকে নানারকম রান্না,বাড়ি সাজানোয় ব্যস্ত ছিল। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে হয়ে গেল। ঋতু সেজেগুজে তৈরি হয়ে বেডরুমের রকিং চেয়ারটায় বসে রাইটের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল ।
॥চার॥
কি যেন একটা শব্দে ঋত্বিকার ঘুম ভেঙে গেল। সে ধড়মড় করে উঠে পড়ল সে ভাবল এতক্ষণ কি সে স্বপ্ন দেখছিল। হঠাৎ চারদিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল সে যেন তার স্বপ্নে দেখা সেই ঘরে পৌঁছে গেছে, চারদিক নতুনের মতো ঝকঝক করছে, আর আলোয় ভরে গেছে তার মাথার ওপর একটি বড় ঝাড়বাতি জ্বলছে। সে আয়নার দিকে এগিয়ে গেল দেখলো তার পরনে একটি সুন্দর ব্রিটিশ গ্রাউন। তার কান আবার চলে গেল সেই শব্দটার দিকে, ঘোড়া ছোটানোর শব্দ, হ্যাঁ, রাইট ফিরে আসছে, সে তার কথা রেখেছে। ঋত্বিকা তার কাছে যাওয়ার জন্য দৌড়ালো প্রথমে বেডরুম তারপর ডাইনিং রুম পার হয়ে নীচে গেল তারপর প্যালেসের বাইরে পৌঁছালো তারপর গেটের কাছে গিয়ে নিজেই গেট খুলে দিল এর মধ্যে সে দেখতে পেলো প্যালেসের চেহারা বদলে গেছে, সেটা যেন ফিরে গেছে ১০০ বছর আগে ১৮৯০ সালে, চারিদিকে আর কোনো জঙ্গল নেই বাগান থেকে গোলাপের গন্ধ ভেসে আসছে আর ফাউন্টেন্ট থেকে জল পড়ছে। সেও যেন আর ঋত্বিকা নেই রাইটের অপেক্ষারত স্ত্রী ঋতুপর্ণা হয়ে গেছে। ঐ যে রাইটকে ঘোড়ার পিঠের ওপর দেখা যাচ্ছে। তার মনে আবার সেই প্রশ্নটা জেগে উঠলো রাইট তার জন্য কি উপহার এনেছে? রাইট ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে তার সামনে দাঁড়ালো। ঠিক সেই সময় ঋতু দেখলো একটা লোক একটা বন্দুক নিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো ঋতু বুঝতে পারলো সে রাইটকে গুলি করতে চায় ঋতু রাইটকে নিশানা থেকে সরিয়ে দিল আর গুলিটা তার নিজের বুকে এসে লাগল সেই সময় উল্টোদিক থেকে আরো অনেকগুলো গুলি এসে রাইটকে লাগলো আর তারা দুজনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার শেষ নিঃশ্বাসটা পড়ার আগে সে শুনতে পেল রাইট কিছু বলছে কিন্তু কথা শেষ করার আগেই রাইট মারা গেল।
ঋত্বিকা অঞ্জান হয়ে গেছিল। যখন তার ঞ্জান ফিরলো সে দেখল সে ঋতুর জায়গায় পড়ে আছে সে বুঝতে পেরেছিল যা এতক্ষণ ঘটলো তা তার আগের জন্মের ঘটনা। সে ওঠার চেষ্টা করল আর তখনি সে দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জন রাইট। রাইটের সারা শরীর গুলি লেগে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেই অবস্থাতেই রাইট বলল “তোমার উপহারটা পিঙ্ক রুমের দেরাজে সেকেন্ড সেলে আছে। আমি চলি আবার দেখা হবে” বলে সে যেন হাওয়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল। ঋতু প্যালেসের দিকে তাকিয়ে দেখল আবার সব অন্ধকার হয়ে গেছে। সে তার রেডিয়াম ডায়েল হাতঘড়িতে দেখলো প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে সে অঞ্জান হয়ে অনেকক্ষণ পড়ে ছিল। ঋত্বিকা আবার প্যালেসের মধ্যে ঢুকলো বাতিগুলো সব নিভে গিয়েছিল কিন্তু সব কিছু তার এতটাই চেনা লাগছিল যে অন্ধকারেও তার কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না সে পিঙ্ক রুমে পৌঁছে দেরাজের কাছে গেল, সেকেন্ড সেলটা খুলল ততক্ষনে সূর্য উঠে গিয়েছিল আর সূর্যের প্রথম কিরণ পড়ে তার চোখের সামনে চকচক করে উঠলো একটা পিঙ্ক ডায়মন্ড নেকলেস। এতদিনেও তার ঔজ্জ্বল্য একটুও কমেনি। ঋত্বিকা কান্নায় ভেঙে পড়লো তার কনে হতে লাগলো রাইটকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। কিন্তু হঠাৎ তার সম্বিত ফিরে এলো তখন তার মনে হল সে কি আত্মহত্যার কথা ভাবছিল সে তাড়াতাড়ি প্যালেস থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো কারণ ওখানে আর কিছুক্ষন থাকলে হয়তো সে পাগল হয়ে যেত এবার সে খুব সহজেই মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় এলো এবং তারপর সায়নীদের বাড়িতে পৌঁছালো। সায়নীতো ঋত্বিকাকে দেখে অবাক বলল “কিরে একি চেহারা হয়েছে তোর আর তোর তো কাল সকালে আসার কথা ছিল- আজ এত সকালে পৌঁছলি কি করে?” কিন্তু কিছু বলার আগেই ঋত্বিকা অঞ্জান হয়ে পড়ে গেল। ঞ্জান ফিরতে সে দেখল তার সামনে আবার রাইট দাঁড়িয়ে তার চিনতে কোনো ভুল হয়নি, সেই মুখ। পাশ থেকে সায়নী বলল “কিরে এখন কেমন লাগছে ঠিক আছিস?” ঋত্বিকা রাইটের দিকে তাকিয়ে বলল “উনি কে?” সায়নী বলল “উনি আমাদের মলির পিসতুতো দাদা রোহিত মেহেতা বম্বেতে থাকেন এখানে কি একটা প্রপার্টি দেখতে এসেছেন তা মলি বলল আমাদের সঙ্গেই আসতে তাই উনিও আমাদের সাথেই এসেছেন । তা তুই কাল এলি না কেন? আর আজ অত সকালে কিকরে এলি আর এসেই এমন কাণ্ড বাঁধালি” ঋত্বিকা বলল “আমি কালি আসছিলাম কিন্তু তোদের ওই মাঠটায় রাস্তা ভুল করলাম আর তারপর একজন লোকের বাড়িতে রাত্তিরে থেকে আজ সকালে এলাম”। ঋত্বিকা প্যালেসের কথাটা কাউকে বলল না কারণ ওকথা সবাই শুনলে হয়তো তাকে পাগল মনে করতো। সায়নী বলল “ওঃ কাল থেকে যে কি হচ্ছে দেখ না কাল দুপুরে রোহিত দা এমন ঘুমালো যে আমরা সন্ধেবেলা রাত্তিরে কত করে ডাকলাম উঠলোই না, তারপর আজ সকালে রোহিত দার ঘুম ভেঙেছে”। এর কারণ ঋত্বিকা পরে বুঝতে পেরেছিল। তারপর সারাদিনটা তাদের হাসি,মজা,গান আর আনন্দ করে কেটে গেল যদিও ঋত্বিকার এসব কিছুই ভালো লাগছিল না তার কেবলই মনে হচ্ছিল রোহিত আসলে জন রাইট। দুপুরে রোহিত বলল তাকে একটু বেরোতে হবে, আর কেউ তার সঙ্গে যাবে কিনা জানতে চাইলো। সবাই তখন তাস খেলায় ব্যস্ত তাই কেউ যেতে চাইলো না কিন্তু ঋত্বিকা বলল “আমি যাব”। রোহিত বলল “তোমার তো সকালে শরীরটা খারাপ হয়ে গেছিল এখন ঠিক আছো?” ঋত্বিকা বলল “হ্যাঁ এখন আগের থেকে ভালো আছি”। রোহিত বলল ”আমার গাড়ি আছে যেতে কোনো অসুবিধে হবে না”। ঋত্বিকা গাড়িতে যেতে যেতে বলল “আমরা কোথায় যাচ্ছি?” রোহিত বলল “এখানে পিঙ্ক হার্ট প্যালেস নামে আমার একটা পৈতৃক বাড়ি আছে সেটাই দেখতে যাচ্ছি”। ঋত্বিকা বলল “পৈতৃক বাড়ি?” রোহিত বলল “হ্যাঁ পৈতৃক বাড়িই বলা যায় আসলে আমার প্রপিতামহের জন রাইট নামে এক খুড়তুতো ভাই ছিলেন বাড়িটা তারই ছিল। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ গর্ভমেন্টের এক উচ্চপদস্থ অফিসার। তিনি ও তার স্ত্রী বিপ্লবীদের গুলিতে নিহত হন। তারা নিঃসন্তান ছিলেন তাই আমার প্রপিতামহ বাড়িটা পান। তুমি নিশ্চিই ভাবছো আমার প্রপিতামহের খুড়তুতো ভাই ব্রিটিশ কি করে হল?” একটু হেঁসে রোহিত বলল “আসলে আমরা জন্মসূত্রে সবাই ব্রিটিশ আমাদের পরিবারের একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল আমরা সবাই বিয়ে করি ভারতীয় মেয়েদের আমার ঠাকুরদা তার স্ত্রীর প্রতি এতটাই অনুগত ছিলেন যে তার পদবীকেই নিজের করে নেন। আমাদের সকলেরি একটা করে খ্রিষ্টান নাম আছে যেমন আমার নাম রাইট”। ঋত্বিকা বলল “আপনারা কখনও এর আগে ওই প্যালেসে যাননি?” রোহিত বলল “আসলে আমারদের অনেক দিন থেকেই বম্বেতে বিসনেস আছে। আমার প্রপিতামহ যখন রাইট আর তার স্ত্রীয়ের মৃত্যুর খবরটা পান তিনি এখানে এসে তাদের অন্তিম সংস্কার করেন, তারপর বাড়িটায় তালা লাগিয়ে চলে যান তারপর উনি বা আমাদের পরিবারের আর কেউ এখানে আসার প্রয়োজন বোধ করেনি। আমি এসেছি কারণ আমাদের বিসনেসের একটা শাখা আমরা কলকাতাতেও করতে চাইছি তার জন্য এখানে আমার থাকা দরকার আমি আমার দাদুর কাছে শুনেছিলাম যে এখানে আমাদের একটা বাড়ি আছে তাই ওটাকেই মেরামত করে ওখানে থাকব ভাবছি আর ব্রিটিশ কালচারের প্রতি আমি প্রথম থেকেই একটা টান অনুভব করি আর আজ তার কাছাকাছি যাওয়ার একটা সুযোগও পেয়ে গেলাম”। তারা প্যালেসে পৌঁছে গেল। রোহিত গাড়ি থেকে নেমে প্যালেসের সামনে যেতেই কেমন একটা হয়ে গেল। সে ছুটে গিয়ে প্যালেসের ভেতরে ঢুকলো ঋত্বিকাও তার সঙ্গে গেলো। রোহিত প্যালেসে ঢুকেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ডাইনিং রুমে রাখা রাইটের আঁকা ঋতুর ছবিটার সামনে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর ঋত্বিকার দিকে ফিরে বলল “ঋতু আমি কতদিন থেকে অপেক্ষা করছিলাম তোমাকে একটা গিফট দেব বলে আজ সেই অপেক্ষার শেষ হয়েছে” বলে সে দেরাজের সেকেন্ড সেল থেকে হারটা বার করে ঋত্বিকার গলায় পরিয়ে দিল। ঋত্বিকা তখন বুঝতে পারল রোহিতের আগের দিন ঘুমিয়ে পরার কারণ।
এই ঘটনার পর একবছর কেটে গেছে রোহিত আর ঋত্বিকা বিয়ে করেছে তারা এখন পিঙ্ক হার্ট প্যালেসেই থাকে। আর প্যালেস? সে আবার তার পুরোনো গৌরব ফিরে পেয়েছে। রাইট আর ঋতুর বেডরুমে (এখন যেটা রোহিত আর ঋত্বিকার বেডরুম) পিঙ্ক হার্ট প্যালেসের একটা পুরোনো ছবি ছিল এখন তার পাশে আর একটা নতুন ছবি টাঙানো হয়েছে দুটো প্রায় একি দেখতে, দুটোর মধ্যে শুধু পার্থক্য এটাই যে পুরোনোটা সাদাকালো আর নতুনটা কালার।
―₀―
কেমন লাগলো
©somewhere in net ltd.
১|
২০ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:৩৯
sushobhan nandi বলেছেন: Hi fd.