![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রধান বার্তা সম্পাদক@ http://www.shironaam.com/
১.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছরে এসে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আসলে কত সেটা নিয়ে বিভিন্ন সরকারের সময় বিভিন্ন তালিকা হয়েছে। বারবার হয়েছে রাজনীতিকরণ। ১৯৮৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন। এই তালিকা নিয়ে কোন বিতর্ক কখনও হয়নি। একই বছরে আরেকটি তালিকায় এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা হয়। পরে শেখ হাসিনার সরকারের(১৯৯৬-২০০১) আমলে একটি তালিকায় দুই লাখ দুই হাজার ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়। দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ চার হাজার ৮০০। ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে জাতীয় তালিকায় (গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়নি) সংখ্যা ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮। এই সংখ্যা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, সরকারের গেজেটে ৪৩ থেকে ৪৫ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম ঢুকেছে।
সে হিসাবে ১৯৮৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের করা তালিকায় (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট/ ভারতীয় তালিকা) মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। সেই তুলনায় এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ।
১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভোটার-সূচক তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ৮৬ হাজার। আওয়ামী লীগের আমলে (১৯৯৬-২০০১) সবুজ মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয় এক লাখ ৮২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। সেখান থেকে বাছাই করে ২৭ হাজার ৫৪৮ জনকে বাদ দিয়ে লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশ করা হয় এক লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জনের তালিকা। এর ফলে বিএনপি সরকারের সময়ের (১৯৯৪) তুলনায় আওয়ামী লীগের সময় সংখ্যা বাড়ে ৯৬ হাজার।বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯৮ হাজার ৫২৬। আগের আওয়ামী লীগ সরকারের তুলনায় জোটের তালিকায় নতুন অন্তর্ভুক্ত হয় ৪৪ হাজার ৭৪ জন। বর্তমান মহাজোট সরকারের মেয়াদে নতুন তালিকাভুক্ত হয়েছে ছয় হাজার ২৭৪ ।
গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের জেলাভিত্তিক তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে এ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বমোট সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। জানা গেছে, জোট আমলে প্রণীত তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১। ১৯৯৭-২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রণীত ভোটার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন। গেজেটে ১ লাখ ৯৮ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়েছে। আরো ১২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম গেজেটে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
বাংলাদেশে বারবার সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এ পর্যন্ত পাঁচটি তালিকা হয়েছে। তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদে বস্তাবন্দী হয়ে আছে আরও প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার আবেদন।
অর্থাৎ সর্বশেষ যে তালিকা তাতে নিঃসন্দেহ যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আসলে এক লক্ষাধিক হতে পারে। বাকি বিরাট একটা সংখ্যা সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে কোন না কোনভাবে চাকরি ও বিভিন্ন সুযোগ রাষ্ট্র থেকে নেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে আলোচনার কারণ হল এভাবে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি সরকাররের পালাবদলের বদলে যায় একটি সুযোগসন্ধানী মহলের ভাগ্য যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন সুবিধা লাভ করে আর আরেকটি পক্ষ যারা মেধা দিয়ে সরকারি চাকরিতে আবেদন করে কোটার কারণে বারবার মেধা বনাম কোটার যুদ্ধে পরাজিত হয়। সংখ্যাটা অনেক দীর্ঘ।
২.
পরীক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সংশোধিত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। সংশোধিত ফলে ৪৬ হাজার ২৫০ জন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। যা প্রথমবারের প্রকাশিত ফলে উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থী থেকে ৩৪ হাজার ২১৭ জন বেশি। অর্থাৎ এতো বিপুল পরীক্ষার্থীকে নিয়ে 'ফাউল গেম' খেলেছিল পিএসসি।
সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রতিযোগী নিয়ে গত ২৪ মে ৩৪তম বিসিএস’র এক ঘণ্টাব্যাপী ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
পিএসসির তথ্যমতে, দুই লাখ ২১ হাজার ৫৭৫ জন প্রার্থী পরীক্ষার জন্য অনলাইনে আবেদনপত্র জমা দেন।
বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দিতে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ৩৪তম বিসিএসের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পিএসসি। ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত সরকারি চাকরি প্রার্থীরা অনলাইনে আবেদন করেন।
এবার রংপুরে প্রথমসহ সাতটি বিভাগীয় শহরের ১৭৪টি পরীক্ষা কেন্দ্রে ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়।
৩৪তম বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে দুই হাজার ৫২টি পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
এর আগে ৮ জুলাই প্রথমবারের মত প্রিলিমিনারিতে কোটা বরাদ্দ রেখে ফল প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে উত্তীর্ণ হয় মাত্র ১২ হাজার ৩৩ জন।
এই ফল বাতিলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠায় পিএসসি ১০ জুলাই ফল পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের জীবনকে তারা তুচ্ছ করেছেন তাদের মূল্যায়ন অবশ্যই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সবার করা উচিত। কিন্তু কতটা?স্বাধীনতার ৪৩ বছরে রাষ্ট্রের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করা হয়েছে সেটা এখনও অব্যাহত রয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের কথা বিবেচনা করে এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশক পর তাঁদের সন্তানদের বেলায় এটা প্রয়োগ করার কোনো কারণ নেই। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরাও কোটা সুবিধা ভোগ করেন। কোটা রাখতে গেলেও কত দিনের জন্য থাকবে, তা নির্ধারণ করা দরকার।
প্রশ্ন হলো, একটি সভ্য দেশে কী করে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকে। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা সম্মান করি, শ্রদ্ধা জানাই। সে জন্য ৫ বা ১০ শতাংশের একটি কোটা থাকতে পারে। বাংলাদেশের মতো এমন কোটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তার মতে, কোটাব্যবস্থা সংবিধানের পরিপন্থী।
১৯৭২ সালে সরকারি কর্মচারী নিয়োগে মাত্র ২০ ভাগ ছিল মেধা কোটা, ৪০ ভাগ জেলা কোটা, ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর ১০ ভাগ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা। ১৯৭৬ সালে এই কোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন করে মেধা কোটায় বরাদ্দ হয় ৪০ ভাগ, জেলা কোটায় ২০ ভাগ। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আগের মতোই ৩০ ভাগ পদ রাখা হয়। ১৯৮৫ সালে এ ব্যবস্থা আবারও বদলানো হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ ভাগ, নারীদের জন্যে ১০ ভাগ এবং প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্যে ৫ ভাগ পদ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ ভাগ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়।
১৯৭৩ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে ৩৫০টি পদে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের পর এই সুযোগ আর সম্প্রসারণের কোনো যুক্তি ছিল না। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন বাদে বাকি সব সদস্য তাই সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে মাত্র একজন প্রচলিত কোটাসমূহ বহাল রেখে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। অথচ ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থার আরও সম্প্রসারণ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়, পরে তাঁদের পাওয়া না গেলে তাঁদের জন্য নির্ধারিত পদগুলো শূন্য রাখার নীতি গৃহীত হয়। সর্বশেষে পিএসসির তুঘলকি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ ব্যাপকভাবে সংকুচিত করা হয় কোটাধারীদের স্বার্থে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে অন্তত ছয়টি বিধানে সমতা ও বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আছে। সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা, ২৮ অনুচ্ছেদে বৈষম্যহীনতা এবং ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে সব নাগরিকের সুযোগের সমতার কথা বলা আছে। অবশ্য ২৮ অনুচ্ছেদে নারী, শিশু ও নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য এবং ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে অকাট্য দলিল। এই দলিল অনুসারে নারী কিংবা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণী হিসেবে উপজাতিদের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় কোটা থাকতে পারে। কিন্তু সেটি তত দিনই থাকা সংগত, যত দিন সরকারি চাকরিতে তাঁদের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত না হয়। আবার সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে,অনগ্রসর অঞ্চলের জন্য নয়। ফলে জেলা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি সন্দেহজনক।
১৯৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সম্পর্কে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কিছু বলা নেই। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল যে গণপরিষদে, তার বিতর্কের দলিল অনুসারে ২৮ বা ২৯ অনুচ্ছেদ প্রণয়নের আলোচনকালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা (যেমন কোটা) প্রদানের কথা উত্থাপিত হয়নি। কেবল সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান প্রসঙ্গে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় (বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক, সরকারি বিবরণী, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৭০-১)।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এ টি এম শামসুল হকের নেতৃত্বে গঠন করা হয়। কমিশনটি ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিশন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদগুলোতে মেধা কোটা ১০ ভাগ বাড়িয়ে ৫৫ করার সুপারিশ করে। ২০০৮ সালে পিএসসির উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় 'কোটা সিস্টেম ফর সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট ইন বাংলাদেশ' সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষা পরিচালনা করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. আকবর আলি খান ও সাবেক শিক্ষাসচিব কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ। ওই সমীক্ষায় পিএসসি শিক্ষাবিদ, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, উপজাতি, নারীনেত্রী ও ছাত্রদের মতামত নেয়। এসব মতামতের ভিত্তিতে পিএসসি সরকারের কাছে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ করে। পিএসসি সূত্র জানায়, ওই সুপারিশে বিদ্যমান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে ১৫ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ এবং উপজাতি ৫ শতাংশ রাখার সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে পিএসসি জেলা কোটা তুলে দেওয়া এবং বাকি ৭০ শতাংশ মেধাবীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করে। ২০০৮ সালের মার্চে সমীক্ষা প্রতিবেদনটি পিএসসি চেয়ারম্যান ড. সা'দত হুসাইনের কাছে জমা দেওয়া হয়। ওই বছরই পিএসসি তাদের রিপোর্ট ও সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেয়।
কোটা পদ্ধতি সংস্কারের জন্য ২০১১ সালের মার্চে পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদনেও সুপারিশ করা হয়। দুই বছর পার হওয়ার পরও সেই সুপারিশ আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান কোটাব্যবস্থায় 'শতভাগ নিখুঁতভাবে' উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। এ কারণে 'সরল' একটি কোটা পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। পিএসসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে কোটাসংক্রান্ত যে নীতিমালা চালু আছে, তার প্রয়োগ 'অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ'। প্রচলিত কোটা পদ্ধতির জটিলতার কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করা প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে পিএসসির সুপারিশ হলো- মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও উপজাতি প্রাধিকার কোটায় নিয়োগ হবে জাতীয় পর্যায়ে প্রার্থী বণ্টনের ভিত্তিতে। এর ভেতর আবার জেলা বা বিভাগভিত্তিক কোটা বা জনসংখ্যার ভিত্তিতে নিয়োগের হিসাব আনলেই জটিলতা বেড়ে যাবে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এ ধরনের পদগুলো জাতীয়ভিত্তিক নিজস্ব মেধানুক্রম অনুযায়ী ওই কোটায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে বণ্টন করা যেতে পারে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি), জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের আস্থা অর্জনকারী সংস্থা বা কমিটিগুলো কোটা পদ্ধতিতে থাকতে না চাইলেও এই কোটাতেই সরকারগুলোর অগাধ আস্থা। কোটা পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসার দীর্ঘদিনের চেষ্টা ও সুপারিশ পায়ে ঠেলে উল্টো নতুন করে কোটা আরোপ করেছে বর্তমান সরকার। আর পুরনো কোটার আওতাকে সম্প্রসারণ করে প্রকৃত মেধাবীদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। উৎকৃষ্টদের ডিঙিয়ে নিম্ন মেধার লোকরা নিয়োগ পাওয়ায় জনপ্রশাসন দিন দিনই অকার্যকর হচ্ছে।
আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য জেলা কোটার সৃষ্টি হলেও তা অকার্যকর। এসব কোটা জটিলতার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিশন, কমিটি, এমনকি পিএসসি নিজেও এসব কোটা থেকে বের হয়ে আসার সুপারিশ করেছে। সবই ফেলে রাখা হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের কথা বিবেচনা করে এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশক পর তাঁদের সন্তানদের বেলায় এটা প্রয়োগ করার কোনো কারণ নেই। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরাও কোটা সুবিধা ভোগ করেন। কোটা রাখতে গেলেও কত দিনের জন্য থাকবে, তা নির্ধারণ করা দরকার।
পিএসসির সূত্রে জানা গেছে, কোটা পদ্ধতিতে সব শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় না। টেকনিক্যাল ক্যাডারে অপূরণকৃত পদ পূরণের লক্ষ্যে ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ২৩তম বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। ওই পরীক্ষায় উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়ায় ৭০৯টি পদের বিপরীতে কমিশন মাত্র ৭৯ জন প্রার্থীর বিষয়ে সুপারিশ করতে পেরেছিল। ২৮তম বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে মোট ৬৫৭ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ৩৪৭ জনই নিয়োগ পান বিভিন্ন কোটায়। ২৯তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারের ৪১২ জনের মধ্যে ২১১ জন কোটায় আর ২০১ জন মেধা পরীক্ষায় নিয়োগ পান। পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসন্ধানে দেখা যায়, কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারে কোটায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি থাকে। ৩০তম বিসিএসে প্রাধিকার কোটায় ৭৮৪টি, ৩১তমতে ৭৭৩টি পদ খালি রাখা হয়েছে। ৩০তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৬১৩, মহিলা ৩২ এবং উপজাতীয় কোটায় ১৩৯টি পদ খালি ছিল। সর্বশেষ ৩১তম বিসিএসে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় প্রাধিকার কোটার ৭৭৩টি পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৫৫০, মহিলা ৫৪ জন ও উপজাতি ১২৯টি। এসব পদ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
বিসিএসে পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত মেধা কোটায় ৪৫ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি-নাতনি কোটায় ৩০ শতাংশ, মহিলা কোটায় ১০ শতাংশ, উপজাতি কোটায় ৫ শতাংশ এবং জেলা কোটায় ১০ শতাংশ নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আরো রয়েছে প্রতিবন্ধী কোটার ১ শতাংশ, যদিও তা ৫৫ শতাংশ কোটা হতে প্রাধিকারের ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়। অর্ধেকের বেশি পদ কোটার মাধ্যমে পূরণ করার চিত্রটি কোটার বাইরের প্রার্থীদের জন্য হতাশাজনক বলেই গণ্য হয়ে আসছে।
৩.
অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য একেবারে সীমিত আকারে কোটা সংরক্ষণ করতে হলেও ব্যাপকভিত্তিক কোটা সংরক্ষণ বাতিল করা প্রয়োজন। বিসিএসের মতো নিয়োগে দক্ষতা ও মেধার প্রয়োজন এত বেশি যে এর ব্যত্যয় ঘটলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোটার নামে বৈষম্য ও কম মেধার লোকদের জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের বড় রকমের ক্ষতি করা হচ্ছে। কোটা পদ্ধতির ফলে অনেক অযোগ্য জনবল নিয়োগ পাচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে বড় একটি অংশ। এভাবে দিনের পর দিন মেধাবী ও কোটাবিহীন প্রার্থীরা চাকরির বাজার থেকে ছিটকে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ সরকারি চাকরিতে আগ্রহ হারাবে। ফলে মেধাশূন্য একটি বড় অংশ প্রশাসনের অংশীদারিত্ব করবে যা কোন ভাবেই কাম্য নয়।
দেশের সূর্যসন্তানরা ১৯৭১ সালে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন দেশের জন্য। তাদের অবদান বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ স্মরণ করে। কিন্তু যেভাবে ৪২ বছর যাবত কোটার ওপর দাড়িয়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেক যোগ্য প্রার্থীকে ডিঙ্গিয়ে কর্মক্ষেত্রে কম মেধার পার পেয়ে যাচ্ছে সেটা মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানকে খাটো করছে। মেধা, যোগ্যতা, অবদান, মানবিকতা একসাথে যখন এগিয়ে যায় মেধা ও যোগ্যতাকে অবশ্যই তখন এগিয়ে রাখা উচিত।
যৌক্তিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে এমন একটি নিয়োগবিধি প্রণয়ন করা প্রয়োজন যেন কোনভাবে সামাজিক ন্যায্য অধিকার থেকে মেধাবীদের বঞ্চিত না করা হয়। ৫৫ শতাংশ কোটার বণ্টনে দেখা যায় এখানে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা সন্তান, ১০% নারী, ৫% উপজাতি এবং ১০% জেলার জন্য সংরক্ষিত । কোটা ব্যবস্থা প্রণয়নের যুক্তি হিসেবে নারী এবং উপজাতির বিষয়টি আপাতত মেনে নেয়ার মতো হলেও বাকী দুটি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না । কারণ বাংলাদেশে কোনভাবেই মুক্তিযোদ্ধা সন্তান বা জেলা ভিত্তিক জনগোষ্ঠী অনগ্রসর গোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত নয় । তাছাড়া কোটা বরাদ্ধের ক্ষেত্রে মোট জনসুংখ্যার তুলনায় ঐ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অনুপাতও বিবেচনা করা প্রয়োজন ।
দেশে চলমান কোটাপ্রথার শঙ্কার তাই এখন সময়ের দাবি। ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে কমিয়ে ১৫% ও অন্যান্য সকল কোটা ১৫% করলে মেধা এবং কোটার সুষ্ঠু সমন্বয় নিশ্চিত করা সম্ভব। এর ফলে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মূল্যায়ন করা হবে তেমনি নারী, উপজাতি এবং জেলা কোটাকেও প্রাধান্য দেয়া হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারি চাকরিতে মেধার যথাযথ মূল্যায়নে বিসিএসসহ সকল নিয়োগ পরীক্ষায় ৭০% মেধা ও ৩০% কোটার সমন্বয়সাধন এখন সকলের প্রানের দাবি।
লেখকঃ তাহসিন আহমেদ, মুক্ত সাংবাদিক
২| ১৮ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:৩২
মিজানুর রহমান মিলন বলেছেন: সুন্দর একটি পোস্ট ! ++++++
কয়েকদিন আগে টকশো ও নিউজের মাধ্যমে জানলাম, ৫৫ হাজার নতুন মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে ! স্বাধীনতার এত বছর পরে এখন আবার ৫৫ হাজার নতুন মুক্তিযোদ্ধা !!
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তাতে কোন সন্দেহ নেই । একটা জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ বার বার আসে না । তাই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন কমে যায় সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু বাংলাদেশে তার উল্টোটা । এখানে দিন দিন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তেছে !!!
আর মুক্তিযোদ্ধা নাতি পুতিদের জন্য কোটা রাখার কোন যুক্তি নেই । সবচেয়ে বড় কথা হল-স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে একমাত্র প্রতিবন্ধী ছাড়া আর কারো জন্য কোটা রাখার কোন যুক্তি নেই ।
©somewhere in net ltd.
১|
১৮ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:৫৩
জাতির চাচা বলেছেন: তাহারা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধে নেমেছিলেন।আজ তাহারা কোটা রক্ষার জন্য জীবন বাজী রাখবেন!!তাহারা সমতার জন্য যুদ্ধ করিয়াছিলেন!!!সমতা!! অল আর ইক্যুয়াল বাট সাম আর মোর ইক্যুয়াল দেন আদারস.।.।.।.।।