নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একশত সিপাহী ঢাল-তলোয়ার লইয়া যে ক্ষমতা না রাখে, অনুতাপের হাত তাহার চেয়ে অধিক ক্ষমতা রাখে।
প্রবাসী-আয়ের ৩৯ শতাংশ অর্থই খরচ হয় কেবল পরিবারের খাদ্যের সংস্থানে। আরও ৩৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে হয় শিক্ষা, যাতায়াত, কাপড় কেনাসহ নানা ধরনের প্রয়োজনীয় খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে। বাকি ২২ শতাংশ অর্থের মধ্যে ৫ শতাংশ খরচ হয় টেলিভিশন, ফ্রিজ, মুঠোফোনসহ নানা ধরনের বিলাসপণ্য কিনতে, আর ১৭ শতাংশ দিয়ে কেনা হয় জমি বা ফ্ল্যাট।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, খাদ্যসহ জীবন নির্বাহে এভাবে প্রবাসী-আয়ের বেশির ভাগ অর্থ খরচ না করেও উপায় নেই। কারণ, ৭৮ শতাংশ প্রবাসীরই পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকায় এসব পরিবার খাবার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতেই প্রবাসী-আয়ের সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করে। খুব একটা অর্থ বিনিয়োগ হয় না।
বিবিএস দেশে প্রথমবারের মতো প্রবাসী-আয় ব্যবহার নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। প্রবাসী-আয় পায় এমন নয় হাজার ৯৬১টি পরিবারের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে গত মাসে এই ফলাফল প্রকাশ করেছে বিবিএস। ২০১২ সালে এসব পরিবার কী পরিমাণ প্রবাসী-আয় পেয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ করেছে বিবিএস।
বিবিএসের প্রবাসী-আয় ব্যবহার-সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রকল্পের পরিচালক দিলদার হোসেন জানান, প্রবাসী-আয় নিয়ে এত বৃহৎ পরিসরে এর আগে কখনো সমীক্ষা হয়নি। এই সমীক্ষার মাধ্যমে প্রবাসী-আয়ের ব্যয় বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী-আয় দেশে আসে, সেই অর্থ কোন কোন খাতে খরচ হয়, তা জানা গেছে। এই সমীক্ষাটি ভবিষ্যতে নীতিনির্ধারণে সহায়তা করবে।
বর্তমানে ৮৬ লাখ বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। তাঁদের সিংহভাগই শ্রমিক। বিবিএস বলছে, প্রবাসে থাকা জনশক্তির ৮৭ দশমিক ৬৪ শতাংশই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ না নিয়েই বিদেশে যান। এ ছাড়া প্রকৌশলী, চিকিৎসকসহ দক্ষ জনশক্তিও রয়েছেন। শ্রমিক থেকে শুরু করে দক্ষ জনশক্তির সবাই প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠান। ২০১২ সালে এক হাজার ৪০৯ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রার সমমূল্যে ৮৯ হাজার কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। যা চলতি অর্থবছরের বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটের সমান। চলতি অর্থবছরে প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা হবে।
বিবিএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, বিদেশে থাকা নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে একটি পরিবার বছরে দুই লাখ পাঁচ হাজার ৬৪২ টাকা প্রবাসী-আয় পায়। এর মধ্যে নগদ অর্থ আসে এক লাখ ৯৭ হাজার ৩৯৫ টাকা। আর আট হাজার ২৪৭ টাকার টেলিভিশন, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, গয়নার মতো পণ্য আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণত ধনী পরিবারের সদস্যরা বিদেশে কাজ করতে যান না। দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা পরিবারের সদস্যরাই বিদেশে যান, মাস শেষে দেশে টাকা পাঠান। ফলে খাবার খরচসহ দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেই প্রায় সব টাকা খরচ হয়ে যায়।
ড. এবি মির্জ্জা আজিজের মতে, সরাসরি বিনিয়োগ না করলেও ভোক্তাপণ্যে এসব পরিবার খরচ করায় সামষ্টিক অর্থনীতির উপকারই হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ভোক্তাপণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ আকৃষ্ট হচ্ছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রবাসী-আয় পায়, দেশের এমন ৭৮ শতাংশ খানা বা পরিবারের একমাত্র আয় প্রবাসী-আয়। এর একটি বিপজ্জনক দিকও আছে। কোনো কারণে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক কোনো সংকটে আয় বন্ধ বা দেশে ফিরে আসতে হলে এসব পরিবার চরম বিপাকে পড়ে যায়।
ভোগেই বেশি খরচ: বিবিএসের সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রবাসী-আয়ের ৭৪ দশমিক ৬৮ শতাংশই বিনিয়োগ হয় না।
একটি পরিবার বিদেশে থাকা সদস্যদের কাছ থেকে বছরে যে পরিমাণ টাকা পায়, তার মধ্যে খরচ হয় এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২৯ টাকা। এর মধ্যে আবার খাবারে ব্যয় হয় ৬৪ হাজার ৭৬৫ টাকা। আর জামাকাপড়, পড়াশোনা, প্রসাধনী কেনা, চিকিৎসা, যাতায়াতসহ দৈনন্দিন জীবনে খাদ্যবহির্ভূত খাতে ব্যয় আরও ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা। আর জমি, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, ফ্রিজ, আসবাব ইত্যাদি কিনতে খরচ হয় আরও ৩৭ হাজার ১৮৮ টাকা।
সমীক্ষার ফল অনুসারে, চট্টগ্রাম বিভাগের লোকজন খাবারদাবারের পেছনে সবচেয়ে বেশি, ৪৮ শতাংশ খরচ করেন। এর পরেই রয়েছে সিলেট। তবে খাবারের পেছনে প্রবাসী-আয় কম খরচ করেন রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ। এই অঞ্চলের মানুষ মাত্র ২৪ শতাংশ খরচ করেন খাবারের পেছনে। অন্যদিকে রংপুরের মানুষ প্রবাসী-আয়ের সবচেয়ে বেশি অংশ বিনিয়োগ করেন। বিবিএস মনে করছে, রংপুরের কিছুটা অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরাই বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই প্রবণতা খুবই কম।
বিনিয়োগ হয় না: প্রবাসী-আয়ের অর্থ খুব বেশি উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হয় না। বিবিএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, একটি পরিবার বছরে প্রবাসী-আয়ের মাত্র ৫২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। এর মধ্যে সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা খরচ হয় ওই প্রবাসীর বাড়িঘর মেরামত ও নির্মাণে। সামাজিক মানমর্যাদার উন্নতির প্রতীক হিসেবেই মূলত বাড়িঘর মেরামত বা নির্মাণ করা হয়। উল্লেখ্য, ৫২ শতাংশের বেশি প্রবাসীর ঘর কাঁচা। এসব ঘরবাড়ি মেরামত বা পুনর্নির্মাণেই এই অর্থ ব্যয় হয়। আর মাত্র ৫ শতাংশের কিছু বেশি অর্থ খরচ হয় ব্যবসা-বাণিজ্যে।
প্রবাসী-আয় পায় এমন পরিবারগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই কোনো ধরনের সঞ্চয় করে না। বিদেশ থেকে যে আয় আসে, তার পুরোটাই খরচ করেন এসব পরিবারের সদস্যরা। আর ৫৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় করে থাকে। সঞ্চয়ের পরিমাণ বছরে গড়ে ২৭ হাজার ১২৬ টাকা। তবে সঞ্চয়ের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থই ব্যাংক হিসাবে পড়ে থাকে। সরকারের বিনিয়োগ কর্মসূচিগুলো যেমন—বন্ড, বীমা, সমবায় সমিতি, মেয়াদি আমানত বা এফডিআরে খুব বেশি বিনিয়োগ করেন না তাঁরা।
খরচের ভার নারীর হাতে: পরিবারের প্রধান হিসেবে প্রবাসী-আয়ের খরচ করার দায়িত্ব নারীর হাতেই ন্যস্ত রয়েছে। এসব পরিবারের উপার্জনসক্ষম পুরুষটি বিদেশে থাকেন। আর দেশে তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা থাকেন। এমন পরিবারের যে অর্থ প্রবাস থেকে আসে, তার পুরোটাই খরচ করার দায়িত্ব পড়ে পরিবারের প্রধানতম সদস্য নারীর ওপর।
জাতীয়ভাবে দেশে ১৬ শতাংশ খানার প্রধান নারী। অথচ বিবিএস বলছে, প্রবাসী-আয় পায় এমন খানা বা পরিবারগুলোর ৪৮ শতাংশের প্রধান একজন নারী। তাঁরাই সংসার চালান, প্রবাসী-আয় খরচ করেন। কিন্তু অর্থের ব্যবস্থাপনা করার মতো দক্ষতা তাঁদের নেই। এমনকি অতীতে এমন খরচের সুযোগও ছিল না। এখন তাঁরাই বিপুল পরিমাণ প্রবাসী-আয় খরচ করার দায়িত্ব পালন করেন। এর ফলে যথাযথ বিনিয়োগ বা অর্থের ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না।
সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় ৪৫ শতাংশ প্রবাসী তাঁদের আয় পাঠান পিতা-মাতার কাছে। আর ৩৯ শতাংশ আয় আসে স্ত্রীর হাতে।
সাড়ে ৬১ শতাংশ অর্ধশিক্ষিত: বিবিএসের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রায় ৮৩ লাখ পুরুষ প্রবাসী-আয় দেশে পাঠান। এ ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। অথচ ৫৩ লাখ বিদেশগামী এসএসসি পাস করেননি। আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বিদেশে গেছে এক শতাংশেরও কম বা দশমিক ৬২ শতাংশ।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধু শ্রমিক হিসেবেই ৫০ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গেছেন। আর চাকরি নিয়ে যান ৩৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ বা ২৯ লাখ প্রবাসী। আর প্রবাসীদের মাত্র পাঁচ লাখের মতো বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করেন।
প্রবাসী-আয়ে বাংলাদেশ অষ্টম: বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী-আয় পায় ভারত। ২০১২ সালে দেশটি পেয়েছে ছয় হাজার ৭২৬ কোটি ডলার। এরপরের স্থানে রয়েছে চীন। সে বছর পাঁচ হাজার ৭৭৮ কোটি ডলার আয় করেছে চীন। আর প্রবাসী-আয় দেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ এক হাজার ৪০৯ কোটি ডলার প্রবাসী-আয় পেয়েছে। বাংলাদেশের ওপরে থাকা দেশগুলো হলো: ফিলিপাইন, মেক্সিকো, ফ্রান্স, নাইজেরিয়া ও মিসর।
নিজেদের দেশে অর্থনীতির সম্প্রসারণের কারণে চীন ও ভারত বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি ক্রমান্বয়ে কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগও বাড়ছে বলে মত দেওয়া হয়েছে বিবিএসের সমীক্ষায়।
আজকের প্রথম আলো থেকে কপি করা
©somewhere in net ltd.