![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবীর চৌধুরী
জানুয়ারী ২, ২০১১
kabir-chow2সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের আদর্শ ছিল উদার মানবিকতার, শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামী প্রতিবাদের, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার। প্রাচীন চর্যাপদের যুগের কাহৃুপাদ, মধ্যযুগের চন্ডীদাস-আলাওল, পরবর্তী সময়ের রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-লালন-হাছন রাজার ঐতিহ্য এবং সমকালের শামসুর রাহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবু বকর সিদ্দিক ও হাসান আজিজুল হক প্রমুখের কাজ আমাদের প্রেরণা যোগায়। আর শুধু সাহিত্যকর্ম নয়, চিত্রকলা, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, সর্বত্র আমরা লক্ষ করি মুক্তির আনন্দজাত সৃজনশীলতা। এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন তুচ্ছ করার মতো নয়। কিন্তু এখনো আমাদের অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে, এবং এগিয়ে যাবার জন্য আমাদের সামনের পথকে নিষ্কণ্টক করতে হবে। পথে কারা কাঁটা বিছিয়ে দিচ্ছে? তারাই যারা বাংলাদেশের চার মৌল স্তম্ভ গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী, যে মূল নীতিগুলি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। এর পরিবর্তে বাংলাদেশের অশুভ নক্ষত্র, অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী জনৈক জেনারেল এবং তাঁর অনুসারীরা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী ভাবধারাপুষ্ট উদ্ভট বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব।
বর্তমান সময়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হলে যেসব জিনিস আমাদের পেছনে টেনে রাখছে সেসব সস্পর্কে সদা সচেতন থাকতে হবে। ধর্মান্ধতা, জঙ্গী মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে উপেক্ষা ক’রে নিজেদের অন্ধ বিশ্বাসের শৃঙ্খলে বন্দি ক’রে রাখার প্রবণতা আমাদের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করছে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
আমি আরেকটি বিষয়ের উপর জোর দিতে চাই। বিজ্ঞান ও উদার মানবিকতার পাঠের মধ্যে একটা সমন্বয় আনা খুবই জরুরী। আমরা আমাদের চোখের সামনে আমাদের পৃথিবীকে দ্রুত বদলে যেতে দেখছি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবিত বিকাশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন মানুষকে নিকটে নিয়ে আসছে, জন্ম নিচ্ছে একটা বিশ্বপল্লী। যোগাযোগ ব্যবস্থায় মোবাইল টেলিকম্যুনিকেশন, ই-মেইল, ইন্টারনেট, ইলেকট্রনিক কমার্স প্রভৃতি মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। তথ্য প্রযুক্তির এই সব উন্নতির ফলে জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের সুযোগ-সুবিধা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। আগামী দিনগুলিতে বাংলাদেশের মতো দেশের পক্ষেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য আহরণ করে তুলনামূলক ভাবে কম সময়ের মধ্যে পুঁজি বিনিযোগ করে উন্নত দেশসমূহের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদ্যা অর্জন করা সম্ভব হবে। অনেক ক্ষেত্রে বড়ো আকারের ভৌত অবকাঠামো ছাড়াই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আত্মীকরণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে।
স্বাভাবিক ভাবেই কম্পিউটারের কথা আমার মনে জাগে। বহু বিবর্তন ও উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কম্পিউটার মানুষের কর্মক্ষেত্রকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে, মানবজাতির সামনে অপরিসীম সম্ভাবনাময় এক ভবিষ্যতের দরোজা খুলে দিয়েছে। আমরা এখন লক্ষ করছি যে যতো সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে কম্পিউটার নির্মাতাগণ ততোই নতুন নতুন জিনিস আমাদের উপহার দিচ্ছেন। কম্পিউটার সংযোজনে ব্যবহৃত চিপস এবং যন্ত্রাংশ আয়তনে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে, গতি দ্রুততর হচ্ছে, ব্যবহারের বহুমুখীনতা বাড়ছে এবং দামও শস্তা হচ্ছে। আগামী দিনগুলিতে কম্পিউটার মানুষের জীবনকে অনেক কায়িক পরিশ্রমের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেবে। এখানে একটা বিষয় আমাকে কিছুটা ভাবায়। এটা সম্ভব যে আগামী তিন-চার দশকের মধ্যে মানুষ অসম্ভব রকম কম্পিউটার নির্ভর হয়ে পড়বে। তখন কম্পিউটার নির্ভর প্রযুক্তির সাহায্যে রোবোটিং ইঞ্চিনিয়ারিং মানুষের কায়িক শ্রমকে নিত্য প্রয়োজনীয় করে তুলবে। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক প্রক্রিয়ায় প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্বপরিচালিত রোবোট মানুষের চাইতে নির্ভুলভাবে যে কোনো পৌনঃপুনিক কাজ দ্রুততার সঙ্গে, নিরাপদে এবং স্বল্প ব্যয়ে, সম্পন্ন করতে পারবে। এখানেই শেষ নয়। এখন গবেষনা চলছে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সৃষ্টি করার জন্য।
এসব জেনে চমৎকৃত হবার পাশাপাশি আমি কিছুটা বিচলিতও বোধ করি। কম্পিউটার পরিচালিত রোবোট ও কৃত্রিম মেধায় সাহাষ্যে যখন কলকারখানায় উৎপাদন চলবে, কূপ ও সমুদ্রবক্ষ থেকে তেল ও গ্যাস আহরিত হবে, শৈল্য চিকিৎসায় অভূতপূর্ব উন্নতি হবে তখন মানুষের ভূমিকা কি হবে? সে কি শুধু বিনোদন, ভোগবিলাস ও যৌনতার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখবে? এখানেই বিজ্ঞানীদের একটা গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেহেতু মানুষই কম্পিউটার নির্মাতা সেহেতু মানুষকেই স্থির করতে হবে মেধার কতোটুকু সে কম্পিউটারকে দেবে, কতোটুকু নিজের হাতে রাখবে।
আমরা স্পষ্ট দেখছি যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবিত বিকাশের প্রভাব শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্যসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে পড়ছে। আরো পড়বে। আমার আশা উন্নততর জৈব প্রযুক্তি রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশের অবক্ষয় রোধে সাহায্য করবে। জিন বিষয়ক গবেষণার মাধ্যমে আগামী বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যেই হয়তো জিনের কাঠামো বিষয়ক সব তথ্য ও জিনের নানা ফাংশান সম্পর্কে জানা যাবে। তখন প্রত্যেক মানুষের থাকবে তার নিজস্ব জিন কার্ড এবং তার ভিত্তিতেই তার চিকিৎসা হবে। মানুষের আয়ু অনেক বেড়ে যাবে, তার যৌবন অনেক বেশি কাল স্থায়ী হবে।
এক সময় বিজ্ঞানীদের মনে একটা শঙ্কা ছিল, এই জেনেটিক ইঞ্চিনিয়ারিং কি শেষ পর্যন্ত প্রাণী জগতে কোনো বিপর্যয় ঘটাবে? কিন্তু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেখা গেছে যে জেনেটিক ইঞ্চিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন পর্ব যতোটা বিপজ্জনক আশঙ্কা করা গিয়েছিল বাস্তবে ততোটা নয়। তবে এসত্যটি তো আমাদের সবার জানা যে বিজ্ঞানের প্রতিটি বড়ো আবিষ্কার যেমন বিপুল ইতিবাচক সম্ভবনা নিযে আসে তেমনি বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কারও জন্ম দেয়। পরমাণু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের সে-অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাই মানবজাতিকে অবশ্যই উপলদ্ধি করতে হবে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তার জন্য যে বিপুল আর্শীবাদ বয়ে এনেছে তা মানবজাতির কোনো অংশের ক্ষমতালিপ্সা, অহংবোধ কিংবা দায়িত্বহীনতা কিংবা সামগ্রিকভাবে বিশ্ব মানবকল্যাণ সম্পর্কে ঔদাসীন্য ওই আশীর্বাদকেই ভয়ঙ্কর অভিশাপে রূপান্তরিত করতে পারে। সেজন্যই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পাশাপাশি হিউম্যানিটিজ ও সোশ্যাল সায়েন্সের পাঠ, সীমিত আকারে হলেও, সবার জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার।
বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বিশ্বসমাজ প্রতিষ্ঠিত না হলে মানবজাতি দেশ-সম্প্রদায়-ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে সুখী ও শান্তিময় জীবন যাপন করতে পারবে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি হওয়া সত্বেও আজও বিশ্বের বহু মানুষ চরম দরিদ্র, বুভুক্ষু, গৃহহীন ও বেকার। তারা নিরাপদ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত,স্বৈরাচারী শাসনের নিগড়ে আবদ্ধ, ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছান্ন।
কিন্তু আমি আশাবাদী মানুষ। স্বদেশের দিকে তাকালে আমি দেখি যে বর্তমান পরিবেশ প্রগতির শক্তির অনুকূলে। নানা জনকল্যাণমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে, অন্ধকারের শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করার কাজ চলছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি হয়েছে, নতুন শিক্ষানীতি অভিনন্দিত হচ্ছে।
বাইরের বিশ্বের দিকে তাকালে সেখানেও কিছু কিছু আলোর রেখা দেখছি আমি। লাতিন ও মধ্য আমেরিকার কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু হচ্ছে। ব্রাজিলে প্রগতির হাওয়া বইছে। তবে অন্যদিকে গুয়াতানামো বে-র বন্দিশালার কদর্য নির্যাতনের চিত্র, প্যালেষ্টাইনীদের উপর ইসরাইলের অব্যাহত হামলা বিশ্বের জলবায়ুর ক্ষেত্রে ধনী ও ক্ষমতাধর পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা আমাকে পীড়া দেয়।
পৃথিবীর কয়েক বছরের ইতিহাসে অনেক গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে কিংবা ক্ষয়িঞ্চু হয়ে পড়েছে। আমরা মনে করতে পারি মায়া, ইনকা, অ্যাজটেক, প্রাচীন গ্রিক-রোমান-মিশরীয়-পারসিক ও আরব সভ্যতার কথা। কেন এমন ঘটলো? মোটা দাগে চিহ্নিত করতে চাইলে আমরা হয়তো বলতে পারি যে পরিবর্তন বিমুখীনতা, সৃজনশীলতার অভাব এবং স্থবির অন্তর্মুখীনতাই এ অবক্ষয়ের পেছনে কাজ করেছে। ভবিষ্যৎ দিনগুলিতে আমাদের অবশ্যই সৃজনশীলতার উপর জোর দিতে হবে, পরিবর্তনবিমুখ হলে চলবে না, অতীতের গৌরবগাথায় ডুবে থাকা রোমান্টিক অন্তর্মুখীনতার বাতাবরণ ছিন্ন করে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমার বিশ্বাস আমরা পারবো। আর একটি কথা। আশা ও আনন্দের কথা। সম্প্রতি দেশের জন্য একটি জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণীত হয়, সরকার কর্তৃক তা অনুমোদিতও হয়েছে। এটা প্রণয়নের জন্য সরকার আমাকে সভাপতি করে ১৯ সদস্যের একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। সকলের আন্তরিক সহযোগিতার ফলে আমরা চার মাসের মধ্যে একটি জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করতে সক্ষম হই এবং ওই নীতি সর্বমহলের ব্যাপক অভিনন্দন লাভ করে। বাংলাদেশে সম্ভবতঃ এই প্রথম বারের মতো এমন একটি ঘটনা ঘটলো। তবে আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নাই। গৃহীত শিক্ষানীতি নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। সেখানে পরিমার্জনা ও পরিশীলনের সুযোগ আছে।
শিক্ষানীতির বাইরে আশা ও আনন্দের আরো দুটি বিষয় আছে। এক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ওই জঘন্য অপরাধীদের বিচার করা অত্যাবশ্যক। আমি আশা করি দ্রুততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ওই বিচার কার্য সম্পাদিত হবে। দুই, ধর্মীয় জঙ্গী মৌলবাদ নির্মূল করার ক্ষেত্রে সরকারের সাম্প্রতিক কর্মতৎপরতা ও এব্যাপারে জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা আমাকে বিশেষ আশান্বিত করেছে। সমাজদেহ থেকে ওই মারাত্মক দুষ্ট ক্ষত হয়তো আমরা অনতিবিলম্বে অপসারণ করতে সক্ষম হ’ব।
কবীর চৌধুরী
©somewhere in net ltd.