![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
খোলা চোখে
হাসান ফেরদৌস, নিউইয়র্ক | আপডেট: ০০:৪০, আগস্ট ২১, ২০১৫ | প্রিন্ট সংস্করণ
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের সামনে এই মুহূর্তে প্রধান চ্যালেঞ্জ তাঁর রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ নয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, হিলারিকে এখন তাঁর দলের সমর্থন আদায়ের জন্য লড়তে হচ্ছে এমন একজনের সঙ্গে, যিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য নন। এমনকি তাঁকে আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিকও বলা যায় না। তিনি হলেন ভারমন্ট থেকে নির্বাচিত, মার্কিন সিনেটের একমাত্র স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি মার্কিন কংগ্রেসের একমাত্র স্বঘোষিত ‘সমাজতন্ত্রী’। হিলারির মতো তিনিও আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থিতার জন্য লড়ছেন।
ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ারের নেওয়া একটি সাম্প্রতিক জনমত গণনায় দেখা যাচ্ছে, হিলারি ও বার্নি স্যান্ডার্সের প্রায় সমান জনসমর্থন রয়েছে। এই গণনা অনুসারে সার্বিকভাবে স্যান্ডার্সের তুলনায় হিলারি মাত্র ৬ শতাংশ ভোটে এগিয়ে আছেন, যা পরিসংখ্যানগতভাবে ‘টাই’ বা সমসংখ্যক। একই জনমত গণনা অনুসারে, নিউ হ্যাম্পশায়ারের ভোটারদের কাছে স্যান্ডার্স এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থী। হিলারির পক্ষে সেখানে জনসমর্থন ৫৪ শতাংশ, বার্নি স্যান্ডার্সের ৫৯ শতাংশ।
একজন চিহ্নিত বামপন্থী, সাধারণ নির্বাচনে যাঁর বিজয়ের সম্ভাবনা কার্যত শূন্য, ডেমোক্রেটিক ভোটারদের মধ্যে তাঁর এই ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা হিলারি ক্লিনটনের জন্য রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। পরিচিতির দিক দিয়ে হিলারি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অর্থ ও নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় তাঁকে পাল্লা দেওয়া স্যান্ডার্সের কেন, রিপাবলিকান পার্টির কোনো একক প্রার্থীরও নেই। তা সত্ত্বেও হিলারি স্যান্ডার্সের ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জের সামনে এই নাজুক অবস্থায় রয়েছেন, তার কারণ নিজ দলের এক বড় অংশ বিভিন্ন প্রশ্নে তাঁর ‘প্রগতিশীল’ চরিত্র নিয়ে সন্দিহান। এই দলের বামঘেঁষা সমর্থকেরা, যাঁরা মার্কিন রাজনীতিতে বৃহৎ পুঁজির প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন, মনে করেন, হিলারি ওয়ালস্ট্রিটের খুব ঘনিষ্ঠ ও বৈদেশিক নীতি প্রশ্নে দক্ষিণপন্থী। এই সব সমর্থকের জন্য কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী হতে পারতেন ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত উদারনৈতিক সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন। কিন্তু ওয়ারেন জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট পদে হিলারির প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন না। এই অবস্থায় দলের প্রগতিশীল অংশ তাদের ‘দ্বিতীয় পছন্দ’ হিসেবে বার্নি স্যান্ডার্সকেই মনোনীত করেছে।
বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে স্যান্ডার্সের ‘জিহাদ’ কোনো লুকোছাপার ব্যাপার নয়। নিজের প্রার্থিতা ঘোষণার সময় তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, তাঁর বিবেচনায় মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বৃহৎ পুঁজি। ‘এ দেশের মাত্র ছয়টি বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে, যা আমেরিকার মোট জাতীয় আয়ের ৬০ শতাংশ।’ তাঁর উল্লসিত সমর্থকদের সহর্ষ করতালির মধ্যে স্যান্ডার্স ঘোষণা করেন, বৃহৎ পুঁজির ক্ষমতা খর্ব ও আয়ের পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে মার্কিন সমাজের চলতি অসমতা মেটাতে তিনি বদ্ধপরিকর। তেমন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছিলেন বারাক ওবামা। স্যান্ডার্সের কথায়, নাগরিক সমর্থনের ওপর নির্ভর করার বদলে ওবামা রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে সহযোগিতার পথ অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন। সেটি ছিল ওমাবা প্রশাসনের প্রথম ও প্রধান ভুল। তিনি সেই ভুলের ফাঁদে পা দেবেন না।
স্যান্ডার্স নির্বাচিত হওয়ার আগেই রিপাবলিকান প্রতিপক্ষের সঙ্গে ঠোকাঠুকির যে রণকৌশল বেছে নিয়েছেন, ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের কাছে তা ভ্রান্ত বলে বিবেচিত হলেও দলের তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থকদের তা উল্লসিত করেছে। বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে আক্রমণ ছাড়াও স্যান্ডার্স সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা ও ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন বেতন বৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়েছেন। অর্থনীতির সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে ও বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধের পক্ষে তাঁর অবস্থান এই সব তৃণমূল সমর্থকের মধ্যে স্যান্ডার্সের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে।
এমন একজন ‘সমাজতন্ত্রী’ প্রার্থীর কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা রয়েছে? অধিকাংশ পর্যবেক্ষক একমত, তেমন সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম পর্বে এর আগেও অনেক বামপন্থী প্রার্থী পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন, কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই ঝরে পড়েছেন। যেমন: ভারমন্টের সাবেক গভর্নর হাওয়ার্ড ডিন ও মানবাধিকার নেতা জেসি জ্যাকসন।
তা সত্ত্বেও হিলারি ক্লিনটন বার্নি স্যান্ডার্সের চলতি জনপ্রিয়তা আমলে না নিয়ে পারছেন না। স্যান্ডার্সের পক্ষে যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন গড়ে উঠছে, সেখানে হিলারি তাঁর নিজ দলের সমর্থকদের ক্রমবর্ধমান সন্দেহের মুখে পড়ছেন। পর্যবেক্ষকেরা একে ‘এন্থুজিয়াজম গ্যাপ’ বা উৎসাহের খামতি বলে চিহ্নিত করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি সরকারি কম্পিউটার ব্যবহার না করে বেআইনিভাবে ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবহার করেছেন, এই অভিযোগে রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস তাঁর বিরুদ্ধে যে তদন্ত শুরু করেছে, হিলারির সমর্থন হারানোর সেটি আরেকটি কারণ। ওয়ালস্ট্রিটের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম ও স্বামী বিল ক্লিনটনের ফাউন্ডেশনের হিসাবে গরমিল ডেমোক্রেটিক তৃণমূল সমর্থকদের অস্বস্তি বাড়িয়েছে।
এই অবস্থায় নিজের অবস্থা সুদৃঢ় করতে হিলারি ক্লিনটন তাঁর চিরাচরিত মধ্যপন্থা পরিত্যাগ করে অধিকতর ‘প্রগতিশীল’ অবস্থান গ্রহণ করা শুরু করেছেন। ঘণ্টাপ্রতি বেতন বৃদ্ধি, বৈষম্য হ্রাস, আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রতি পুলিশি অনাচার রোধে বিচারব্যবস্থার পুনর্গঠন, অবৈধ অভিবাসীদের আইনীকরণ ইত্যাদি প্রশ্নে হিলারি রীতিমতো বামমুখী অবস্থান নিয়েছেন। এ কথা নিশ্চিত, বার্নি স্যান্ডার্সের কাছ থেকে এমন জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি না হলে হিলারি এত দ্রুত তাঁর অবস্থান বদলে বামমুখী হতেন না। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, হিলারি ও তাঁর রণকৌশলবিদেরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে নির্বাচনী প্রচারণার এই পর্যায়ে দলের সমর্থকদের নিকটবর্তী হওয়ার এটিই সর্বোত্তম পথ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এখনো দেড় বছর বাকি। চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর রিপাবলিকান প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার আগে ‘বার্নি স্যান্ডার্স’-সংকট এড়াতেই যে হিলারি এই বামঘেঁষা পথ অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এতে তাঁর প্রতি দলের সমর্থকদের উৎসাহে খামতি দেখা দেবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
হাসান ফেরেদৗস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
©somewhere in net ltd.