![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ড. জিল্লুর রহমান খান
এখন থেকে ১১ বছর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাগুলোর অন্যতম। ওই দিন বাংলাদেশের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী এবং সে সময়ে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার জনসমাবেশে এমন ভয়ঙ্কর হামলা চালানো হয়, যা ছিল নজিরবিহীন। বড় ধরনের সামরিক অভিযানের কায়দায় পরিচালিত এ হামলায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজেও আহত হন। আর মৃত্যু ঘটে ২৪ জনের। আহতের সংখ্যা তিন শতাধিক। নিহতদের তালিকায় ছিলেন জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান। আহতদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অনেক নেতা, যারা দশকের পর দশক ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধেও তাদের ছিল অনন্যসাধারণ ভূমিকা। এদের সবাইকে নিঃশেষ করার চক্রান্ত আঁটা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেদিন যে সমাবেশের আয়োজন করেছিল, তা ছিল একটি প্রতিবাদ সমাবেশ। প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি খোলা ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরুর ঘোষণা দেন। কিন্তু তিনি মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসার জন্য পা বাড়াতেই একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষেপ হতে থাকে মঞ্চকে লক্ষ্য করে। তিনিই যে ঘাতকদের মূল লক্ষ্য ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্টেম্ফারিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড।
শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকায় থাকলে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অবস্থান করতেন। এটাই স্বাভাবিক ছিল। তার ছোট বোন শেখ রেহানারও সেখানেই থাকার কথা। সেই অভিশপ্ত প্রত্যুষে তারা ছিলেন ইউরোপে। এ কারণে তারা প্রাণে বেঁচে যান। দুই বোনের জন্য ১৫ আগস্ট-পরবর্তী বছরগুলো মোটেই সহজ ছিল না। তারা ছিলেন কার্যত আশ্রয়হীন। উপার্জনের ব্যবস্থা ছিল না। সন্তানদের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। এমন অবস্থাতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি প্রিয় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তার কাঁধে তখন নতুন দায়িত্ব_ বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের সভাপতি। দেশে ফিরেই নেমে পড়তে হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ড. কামাল হোসেনের পক্ষে প্রচারাভিযানে। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে দেশে জারি হয় সামরিক শাসন। শেখ মুজিবুর রহমান দুই দফায়_ ১৯৫৮ ও ১৯৬৯ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। জনগণ এ ধরনের নিষ্ঠুর শাসন চায়নি। ভাগ্যের পরিহাস, শেখ হাসিনাকেও সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু করতে হয় সামরিক স্বৈরশাসন মোকাবেলার মধ্যে। ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে তাকে বন্দি করা হয়েছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধাচরণের জন্য। পরের বছরগুলোতেও তাকে একের পর এক কঠিন প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়। সামরিক শাসকরা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এভাবে শেখ হাসিনার জন্য নতুন করে হুমকির সৃষ্টি হয়। কারণ খুনিরা বলে চলছিল_ 'সাপ মরেছে কিন্তু বিষাক্ত লেজ রয়ে গেছে।'
রাজনীতিতে শেখ হাসিনা সক্রিয় হওয়ার পরপরই দলে প্রাণ ফিরে আসে। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ ফের শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে দলটি জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শেখ হাসিনা নির্বাচিত হন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী। ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয় এবং তিনি সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর এভাবে তিনি বঙ্গবন্ধুর দলকে ফের রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব দেখান। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তিনি ফের বিরোধীদলীয় নেতার আসনে। কেন তাকে এভাবে হত্যার চেষ্টা? কারা ছিল এর পেছনে? নিশ্চিত করেই বলা চলে, এটা কেবল কয়েকজন সন্ত্রাসীর কাজ ছিল না। যেমন ছিল না ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কয়েকজন 'মেজরের' কাজ। উভয় ক্ষেত্রেই সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন দেখেছি আমরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে চারজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডও বিচ্ছিন্ন ছিল না। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতির পরিবারের কোনো সদস্যকে আক্রমণ করা হয়নি, যেমনটি আমরা দেখেছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। শেখ হাসিনা কিন্তু এমন কঠিন সময়েও জনগণের ওপরে ভরসা রেখেছেন। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি সামরিক শাসক এইচএম এরশাদকে চ্যালেঞ্জ করেন। বলা হয়ে থাকে, ওই নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হলেও 'ভোট ডাকাতি' করে সে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরের চারটি বছর তিনি রাজপথে সামরিক সরকারকে উৎখাতের আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়, তখনও শেখ হাসিনা রুখে দাঁড়ান। তার আহ্বানে তখন এমন গণজাগরণ সৃষ্টি হয়, যা ছিল নজিরবিহীন। এক পর্যায়ে সিভিল প্রশাসন একযোগে নেমে আসে রাজপথে। সচিবালয়ের সচিব থেকে জুনিয়র অফিসার, কেরানি থেকে পিওন, সবাই নেমে আসেন রাজপথের 'জনতার মঞ্চে'। এ আন্দোলনেই বিএনপি সরকারের পতন ঘটে। সরকার বাধ্য হয় সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে। এ বছরের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে ফের ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। এ সময়ে তিনি দেশকে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সক্ষম হন। নির্মিত হয় যমুনা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। ১৯৯৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করাও ছিল তার সরকার পরিচালনায় দক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পরিস্থিতি তখন এত ভয়াবহ ছিল যে, পশ্চিমা গণমাধ্যমে বলা হতে থাকে, বাংলাদেশে বন্যা ও দুর্ভিক্ষে অন্তত এক কোটি লোকের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু তিনি ভালোভাবেই পরিস্থিতি সামাল দেন। বন্যা-পরবর্তী বোরো ধান চাষের মৌসুমে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি মৌসুম থেকেই এক কোটি টন চাল উৎপাদন সম্ভব হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের এ সফলতা বিএনপিকে হতবাক করে। তারা ক্ষমতায় আসার জন্য নতুন করে ছক কষতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে তারা জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মান্ধ দলকে সঙ্গে নিয়ে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তারা যেসব আসনে স্বল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়, সেগুলোর প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়। এসব আসনে তারা সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখার কৌশল অনুসরণ করে। ১৯৯৬ সাল থেকে পরের পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। নির্বাচনে তাদের ভোটও বেড়েছিল। কিন্তু বিএনপির কূটবুদ্ধির কাছে তারা পরাজিত হয়।
পরের পাঁচটি বছর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকার দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। এ সময়ে ধর্মান্ধ চরমপন্থি শক্তির উত্থান ঘটে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমূলে বিনাশ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তবে শুধু আদর্শ নয়, এ চেতনার অনুসারীরাও তাদের টার্গেট হয়। বিএনপি তাদের শুধু মদদই দেয়নি, অনেক ক্ষেত্রে অংশীদার হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে একসঙ্গে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় দেখা যায় তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ-প্রধান মুফতি হান্নান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অনেকেই জড়িত ছিলেন এ নিষ্ঠুর পরিকল্পনায়।
বিএনপি এখানেই থেমে থাকেনি। তারা ২০০৭ সালের নির্বাচন ম্যানিপুলেট করে ফের ক্ষমতা আসার চেষ্টা চালায়। এর প্রতিবাদে আবার শেখ হাসিনাকে জনগণের কাছে যেতে হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে জারি হয় জরুরি আইন। জেনারেল মইন উ আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীকে আমরা দেখি রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকায়। এ সময়ের বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন, যা বড় ধরনের ম্যান্ডেট দেয় শেখ হাসিনাকে। সরকার গঠন করে তিনি সমঝোতার মাধ্যমে দেশ পরিচালনায় উদ্যোগী হন। বিরোধী দলকেও এর অংশীদার করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে সাফল্য আসেনি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের সমঝোতা অপরিহার্য। নূ্যনতম কিছু বিষয়ে অবশ্যই প্রধান দলগুলোকে একমত হতে হবে। সমঝোতা অবশ্যই হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে। ইসলামকে যারা বিকৃত করে এবং এভাবে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় তাদের জন্যও কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। ইসলামে জিহাদের কথা বলা আছে জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু ধর্মান্ধ লোক যে জিহাদের কথা বলে এবং তারা যে পথ অনুসরণ করে সেটা মানুষের ক্ষতি করার জন্য। তারা উন্নয়নের বার্তা দেয় না; দেশকে পিছিয়ে রাখতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। তারা 'ব্লগার' হত্যা করে। মুক্তবুদ্ধির চর্চায় পদে পদে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। শেখ হাসিনা তাদের চক্ষুশূল। বিএনপিকে অবশ্যই বুঝতে হবে_ এ ধরনের শক্তি দেশের স্বার্থে কাজ করে না। বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। কিন্তু এখানকার জনগণ কখনোই ইসলামের নামে চরমপন্থাকে প্রশ্রয় দেয়নি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অস্ত্রবলে এ চেষ্টা করে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নতি ঘটবেই_ এটাই এখন বিশ্ববাসীর বিশ্বাস। এখানকার বিশেষ সুবিধা হচ্ছে_ জাতপাত-বর্ণ নিয়ে হানাহানি নেই। শিয়া-সুনি্নর বিরোধ নেই। ইসলামের সর্বজনীন এ আবেদনে মানুষ সাড়া দেয়। সহনশীলতার চর্চা রয়েছে সমাজের সর্বত্র। ব্রিটিশরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়েছিল। কিন্তু ক্রমে বাংলাদেশের জনগণ এ ভয়ঙ্কর দুঃসময়ের স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। এমন দেশটি উন্নত বিশ্বের সারিতে উঠে যাবে_ এটাই বাস্তব। এ পথে যারা চলতে চায় না, তারাই কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের মতো নিষ্ঠুর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে সচেষ্ট। সঙ্গত কারণেই গণতান্ত্রিক শক্তিকে সদা সচেতন থাকা চাই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; প্রফেসর ইমেরিটাস, ইউনিভার্সিটি
©somewhere in net ltd.