![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভারতবর্ষ বিভাজন-পরবর্তী বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ছিল, তখন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক খুবই বৈরী ছিল। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভারতের বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। দুই দেশের মধ্যে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের কঠোর মনোভাবের কারণে চোরাচালানও শূন্যের কাছাকাছি ছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে ৭১ অবধি ভারতের সাথে পাকিস্তানের তিনটি সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ তিনটি যুদ্ধের মধ্যে শেষোক্তটি ঘটে ১৯৭১ সালে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
বাংলাদেশ স্থলভাগে পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে ভারত বেষ্টিত। বাংলাদেশের সাথে ভারতের স্থলসীমানা চার হাজার ২৩ কিলোমিটার। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে মিয়ানমারের সাথে ২৭১ কিলোমিটারব্যাপী স্থলসীমানা রয়েছে। ভারতের যেসব রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের স্থলসীমানা রয়েছে এ রাজ্যগুলো হলো- পশ্চিম বাংলা, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম। ভারতবর্ষ বিভাজন-পূর্ববর্তী আসাম একটি একক রাজ্য ছিল। বিভাজনের পর আসামকে সাতটি রাজ্যে বিভক্ত করা হয়। এ রাজ্যগুলোকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়। সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে চিকেন নেক করিডোর নামে সরু পথ দিয়ে সংযুক্ত। ভারতের মূল ভূখণ্ডের যেকোনো রাজ্য থেকে স্থল পথে সেভেন সিস্টার্সের যেকোনো রাজ্যে যেতে হলে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। এ পথ দিয়ে যাত্রা এক দিকে বিপদসঙ্কুল, অপর দিকে প্রচুর সময়ক্ষেপী। সেভেন সিস্টার্স খনিজ ও বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। কিন্তু যাতায়াতব্যবস্থা দুর্গম হওয়ায় সেভেন সিস্টার্সের সম্পদ ভারতের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। এ কারণে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সেভেন সিস্টার্সের সম্পদ যথাযথ অবদান রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর রাতারাতি ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য বেড়ে যায়; কিন্তু এ বাণিজ্য একমুখী। প্রতি বছরই বাংলাদেশের সাথে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ছে; কিন্তু ভারত থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, সে তুলনায় রফতানি নগণ্য। বিগত বছর ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৯০৮ কোটি টাকার পণ্য, অপর দিকে রফতানি ছিল তিন হাজার ৫৪৪ কোটি টাকার পণ্য। বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতে যে পরিমাণ পণ্য রফতানি করে তা দ্রুত বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু ভারতের রাজ্য সরকারগুলোর নেতিবাচক ভূমিকার কারণে বাণিজ্য বাড়ানো প্রতিনিয়ত বাধার মুখে পড়ছে। বাংলাদেশের এমন অনেক রাজ্য রয়েছে, যা সমগ্র ভারতে বাজার পাওয়ার জন্য মানসম্মত। কিন্তু যখনই বাংলাদেশের বিশেষ কোনো পণ্য ভারতের বাজারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার অশুল্ক বাধা আরোপ করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে পণ্যটিকে ভারতীয় পণ্যের প্রতিযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তা ছাড়া ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে সে দেশের মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ যে সনদ দেয়, তা কোনো ধরনের প্রশ্ন না তুলেই বাংলাদেশ সচরাচর গ্রহণ করে থাকে; কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য ভারতে রফতানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমাদের মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সনদ গ্রহণ না করে সে দেশের শুল্ক কর্তৃপক্ষ আমাদের রফতানি করা পণ্যের নমুনা তাদের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে পাঠায়। এ প্রক্রিয়ায় ১০-১৪ দিন সময় অযথা বিনষ্ট হয়। আর এ কারণে সেখানকার বাজারে আমাদের পণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণের কারণে পচন রোধ এড়ানো অনেক সময় দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়।
যেকোনো দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মৌলিক চাহিদা- অন্ন বস্ত্র বাসস্থান স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ইত্যাদি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিনির্মাণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও রফতানি বাড়ানোর ঊর্ধ্বমুখী ধারা যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হয়।
ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টিতে ভারতের অনন্য অবদান ছিল। আর তাই ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও চাহিদা ব্যাপক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা প্রতিনিয়ত হতাশার বেড়াজালে পড়ে হোঁচট খাচ্ছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের যেসব অমীমাংসিত সমস্যা স্বাধীনতা-পরবর্তী বিরাজমান, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অভিন্ন নদীগুলোর সুষম পানিবণ্টন, বাণিজ্যবৈষম্য দূর করা, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বৈরী মনোভাব প্রত্যাহার, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের পণ্যের চোরাচালান রোধ, সীমান্তহত্যা বন্ধ, ভারতের মধ্য দিয়ে ভুটান ও নেপালে ট্রানজিট সংযোগ স্থাপন, অচিহ্নিত স্থল ও সমুদ্র সীমানা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর। উল্লিখিত সমস্যাগুলোর মধ্যে সমুদ্রসীমানা চিহ্নিতকরণ গেল বছর চূড়ান্ত হয়েছে। স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণ এবং ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালীন চুক্তি দলিল হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে।
ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সেভেন সিস্টার্সে যাওয়ার জন্য স্থল, নৌ ও রেলপথে দীর্ঘ দিন ধরে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার জন্য কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে বলে আসছিল, ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা স্থাপন। ইতঃপূর্বে বিভিন্ন সময়ে এক দেশ অপর দেশকে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট নাকি করিডোর সুবিধা দেবে- এ বিতর্ক চলে আসছিল। সম্প্রতি বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেভেন সিস্টার্সের কানেকটিভিটি দেয়া হবে এবং এর বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের মধ্য দিয়ে ভুটান ও নেপালের সাথে কানেকটিভিটির সুযোগ পাবে। এ ধরনের কানেকটিভিটি স্থাপন করা হলে এ চারটি দেশের যানবাহন এক দেশের ভেতর দিয়ে অপর দেশে চলাচল করবে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের যোগাযোগ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক। কিন্তু এ ধরনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত শুল্ক দেয়ার বিধান না থাকলে সড়ক অবকাঠামোর যে ক্ষতি হবে, তা নিয়মিত মেরামতের মাধ্যমে সচল রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।
ভারত কানেকটিভিটি সুবিধা ছাড়াও সেভেন সিস্টার্সের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আসছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া পরবর্তী আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যথাযথ শুল্কের বিনিময়ে এ ধরনের ব্যবহার উভয় দেশের স্বার্থের জন্য অনকূল।
বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে নৌ-ট্রানজিট রয়েছে, তা অভিন্ন নদীগুলোর নাব্যতার অভাবে পুরোপুরি বছরব্যাপী কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ জন্য নদীগুলোর ব্যাপকভাবে ড্রেজিং প্রয়োজন। কিন্তু পণ্য চলাচলের জন্য বাংলাদেশ যে শুল্ক পায় তা কোনোভাবেই ড্রেজিং ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে উভয় দেশ আনুপাতিক ভিত্তিতে ড্রেজিংব্যয় মেটানোর দায়িত্ব নিলে সমস্যাটি সমাধানের পথ প্রশস্ত হবে।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের কংগ্রেস দলের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, তখন বাংলাদেশকে স্বল্পসুদে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ ঋণটি শর্তযুক্ত ঋণ ছিল এবং তাতে উল্লেখ ছিল, প্রকল্প সংশ্লেষে বহির্দেশ থেকে যেসব কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি ও সেবা নিতে হবে তার ৮০ ভাগ ভারত থেকে নিতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক সফরের সময় দুই বিলিয়ন ডলারের আবদ্ধ ঋণচুক্তি আগের ঋণের শর্তে স্বাক্ষরিত হয়েছে। উভয় ঋণের অর্থ দিয়ে রেল ও সড়কপথ সংস্কার ও নির্মাণ, নৌ ও সমুদ্র বন্দরের জেটিসুবিধা সম্প্রসারণ, নদীর নাব্যতা বাড়ানোর জন্য নদী খননে যে অর্থ ব্যয় হবে, তাতে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের স্বার্থই অধিক রক্ষিত হবে। তা ছাড়া উভয় ঋণের আওতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলাচলের জন্য ভারতে নির্মিত বাস সরবরাহের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ যতটুকু না লাভবান হবে, তার চেয়ে অধিক লাভবান হবে সে দেশের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ দিন ধরে ভারত দাবি করে আসছিল, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অনুরূপ বাংলাদেশও দাবি করে আসছিল, বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ বিষয়ে উভয় দেশের ইতিবাচক মনোভাবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সম্পূর্ণ যে সুরাহা হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না।
ফেনসিডিল উৎপাদন ১৯৮২-পরবর্তী বাংলাদেশে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া পরবর্তী অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চার পাশে ভারতীয় ভূমিতে প্রায় ১৫০টি মাদকসম ফেনসিডিল উৎপাদন কারখানা গড়ে ওঠে। প্রতিদিন ভারত থেকে বাংলাদেশে দুই-তিন লাখ বোতল ফেনসিডিল পাচার হয়ে আসে, যার মূল্যমান বাংলাদেশী টাকায় চার-ছয় কোটি টাকা। বছরের হিসাবে এর মূল্যমান দাঁড়ায় ১৪৬০-২১৯০ কোটি টাকা। ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে গরুসহ অন্যান্য পণ্য আসার ক্ষেত্রে প্রায়ই চোরাকারবারিদের ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে নিহত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে এ পর্যন্ত কোনো ফেনসিডিল চোরাকারবারি নিহত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। সীমান্তসংলগ্ন কারখানাগুলো শুধু বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য ফেনসিডিল উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেÑ এ বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা উদ্বিগ্ন হলেও ভারত সম্পূর্ণরূপে নির্বিকার।
ভারত সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক দেশ এবং সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনীব্যবস্থা গড়ে ওঠায় কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনমতের প্রতিফলনে বিজয় নির্ধারিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশসহ ভারতের প্রতিবেশী সব দেশে তারা সব সময় সম্পূর্ণরূপে তাদের স্বার্থের অনুকূল এমন সরকার দেখতে চায়। আর তাই ভারতের অবৈধ প্রভাবের কারণে বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে জাতীয় নির্বাচন কলুষিত হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। ভারত প্রকৃতই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে থাকলে এবং তার নিজের ও প্রতিবেশীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে সম গুরুত্বারোপ করে থাকলে তাকে অবশ্যই উদারতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এ ধরনের উদারতা দীর্ঘ দিন ধরে ভারত যে দলটি শাসন করেছে সে দল, অর্থাৎ কংগ্রেস বারবারই দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বারের নির্বাচনে ভারতে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির প্রতি ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রত্যাশা ভিন্ন রূপ। ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের প্রত্যাশা তিনি কতটুকু পূরণ করতে পারবেন, তা তার কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করছে। আর তাই তিনি যদি কংগ্রেসদলীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের মতো বৃহৎ দেশের প্রধানমন্ত্রীর হিসেবে প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভাতৃত্বসুলভ মনোভাবের পরিবর্তে প্রভাব অক্ষণœœ রাখার মনোভাব পোষণ করেন, সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক রাজনীতিতে তিনি যে সফলতা দেখাতে পারবেন, এমনটি ভাবার অবকাশ সীমিত।
অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ থেকে কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের কর্ম ও শ্রমলব্ধ অর্থ অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ও কম সমৃদ্ধ দেশে পাঠানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ভারতের ক্ষেত্রে সেটি উল্টো। ভারত বাংলাদেশের চেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয়রা বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত থেকে যে পরিমাণ অর্থ সে দেশে পাঠায়, তার পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। এ বিবেচনায় ভারত বাংলাদেশ থেকে সে দেশের কর্মজীবী মানুষের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে, তা ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম। অনুরূপ বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভারত যে পরিমাণ অর্থ পায়, সেটিও ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম। ভারত থেকে প্রতি বছর চোরাচালানের মাধ্যমে যে পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশে ঢোকে তার মূল্যমান হিসাব করে বলা কঠিন হলেও অর্থনীতিবিদদের ধারণা, ৫০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। তা ছাড়া বাংলাদেশীরা ভ্রমণ, চিকিৎসা, কেনাকাটা ও পড়ালেখা সংশ্লেষে ভারতে গিয়ে যে অর্থ ব্যয় করে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা তার পরিমাণও ৩০ হাজার কোটি টাকার কম হবে না। এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ থেকে ভারত প্রতি বছর বিভিন্ন খাতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে, তা স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে শূন্যের কোঠায় ছিল। ভারতের মতো একটি বড় রাষ্ট্র যেটি প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্র থেকে সব দিক দিয়ে লাভবান হচ্ছে, তার কি উচিত নয় এ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির দ্রুত উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করে অর্থনৈতিকভাবে সব ধরনের বাধা অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক সেদিকে নজর দেয়া। আমরা ভারতের অতীত সরকারগুলোর আমলে নিঃস্বার্থভাবে এরূপ নজর দেয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করিনি। আর তাই সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তিতে বৃহৎ দেশটি যদি ক্ষুদ্র দেশটির সমস্যার প্রতি আন্তরিক হয়, সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হওয়ার পথের বাধাগুলো অতিক্রম করা যে সহজ হবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা অমূলক নয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক - See more at: Click This Link
©somewhere in net ltd.