নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আমারি মত.................।

তাজ - সৈয়দাবাদী ।

শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, এম পিও ভুক্ত কলেজ

তাজ - সৈয়দাবাদী । › বিস্তারিত পোস্টঃ

আত্মসমর্পণ করলে কি আমাকে শহীদ বলা হতো?

২১ শে আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১১:৪৭

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

হুমায়ূন আহমেদ এবং জাফর ইকবালের বাবা ফয়জুর রহমান পাকিস্তানের একজন নিষ্ঠাবান নিবেদিত পুলিশ অফিসার ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ বা জাফর ইকবালের বাবা হিসেবে নয়, একজন ভালো মানুষ হিসেবেই তাকে সবাই জানত। হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের ‘জীবন যে রকম’ আমি বেশ কয়েকবার পড়েছি। লেখাটি অসাধারণ। প্রতিটি নারী-পুরুষের পড়া উচিত। বইটি পড়লে মেয়েরা যেমন বুঝতে পারবে অতীত দিনে তাদের সামাজিক অবস্থা কী ছিল, স্বামীর সাথে তারা যত্রতত্র যখন তখন কথা বলতে পারত না। শ্বশুরবাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে তবেই স্বামী-স্ত্রীর দেখা হতো। অতটা পর্দা এবং দূরত্ব ছিল বলেই চরম আকর্ষণ ছিল। একে অন্যের জন্য নাড়িছেঁড়া টান অনুভব করত। ইদানীং কোনো কিছু পেতে যখন কোনো কষ্ট করতে হয় না, তখন কোনো কিছু হারালেও নাড়ি ছিঁড়ে না। এ অতি সাধারণ ব্যাপার। হুমায়ূন আহমেদের কলম ছিল আরবি ঘোড়ার চেয়ে তেজি। তবু আমার মনে হয় তার অনেক লেখাতেই সুড়সুড়ি থাকলেও কালজয়ী হবে না। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, নজরুল, মশাররফ হোসেন, গোলাম মোস্তফা এদের লেখা পড়লে যেমন বারবার আলোড়িত হতে হয়- হয়তো তেমন হবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি কারো পক্ষে বিপক্ষে নই। এখন পক্ষে বিপক্ষের বয়সও নেই। আমি সারাজীবন নিজের আত্মার পক্ষে কাজ করেছি। ছোটবেলায় জ্ঞান বুদ্ধি ছিল না, তাই এটা ওটা করেছি। বয়স হওয়ার পর সব সময় নিজের কাছে দায়ী থেকেছি। তাই যা খুশি তা করতে, বা যা খুশি তা বলতে পারি না। যদিও আমার কাজকর্ম সব সময় স্বার্থান্বেষীদের বিরুদ্ধে যায় বলে সামর্থ্যবানেরা পেছনে লেগে থাকে। প্রিয়জনেরাও ভয়ে থাকে তাদের কোনো দুর্বলতা বলে দিই কি না। আসলে আমি হয়তো সবার মতো নই। আমি কারো কাছে কিছু লুকাতে চাই না। কারণ আমি জানি, জগৎস্র্রষ্টা দয়াময় আল্লাহ সব জানেন, সব দেখেন। জীবন অবসানে যার সামনে আসামি হিসেবে দাঁড়াতে হবে তিনি যখন সব জানেন এবং দেখেন, তখন দুনিয়ার মানুষকে ভয় করে লাভ কী? তাই সত্য বলার চেষ্টা করি। সব যে পারি তা নয়, ভুলও যে হয় না তা-ও নয়। কিন্তু ভুল বুঝতে পারলে কাকের মতো ঠোঁট পুছে অস্বীকার করি না। জাফর ইকবাল এবং হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান শহীদ কি না, দেশপ্রেমিক কি না এ নিয়ে গত পর্বে যা লিখেছিলাম তা পুরো হয়নি। তাই কোনো জিনিস স্পষ্ট না হলে বিভ্রান্তি হয়। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সাথে প্রায় ১১ মাস পর গত ৪ আগস্ট দেখা হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। তার মধ্যে এক সময় তিনি বলেছিলেন, ‘তুই মাফ চাইতে গেলি কেন? আমি যা বলিনি, যা করিনি, তার জন্য মাফ চাইতে হবে কেন? আমি একজন মুসলমান, হজ করেছি, প্রতি বছর কোরবানি দিই।’ অনেক দিন পর তার সাথে দেখা তাই তর্ক করিনি। শুধু বলেছি, আপনি যা বলেননি তার জন্য মাফ চাইতে যাবেন কেন, কথাটি যেমন ঠিক তেমন এই যে আপনি বলেননি তা দেশবাসীকে বলেননি তাও ঠিক। আপনি বলেছেন, নেত্রী বললে আপনার কথা প্রত্যাহার করবেন। তাহলে আপনার কাছে জননেত্রীর গুরুত্ব কি আল্লাহর চাইতে বেশি? আর কথা বাড়াইনি। কোরবানির পর কোনো এক দিন তর্ক এবং আলোচনা করতে যাবো। তাই আয়েশা ফয়েজের লেখা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের এসডিপিও ফয়জুর রহমানকে নিয়ে আলোচনা করিÑ
‘‘সকাল ১০টার দিকে একজন লোক একটা চিঠি নিয়ে এলো। চিঠি লিখেছেন থানার ওসি তফাজ্জল হোসেন। তিনি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী থানা খালি না করে সেখানে রয়ে গেছেন, কোর্ট ইন্সপেক্টর আলাউদ্দিন এবং সিআই আব্দুল হালিম সাহেবও এসে গেছেন। মিলিটারিরা এসেছে এবং কোনো সমস্যা হয়নি। ওসি লিখেছেন কাজলের আব্বা যেন অবিলম্বে চলে আসেন। কারণ অন্য সবাইও চলে এসেছে কোনো রকম সমস্যা হবে না।
চিঠিটা আমাদের খুব বিচলিত করে দিলো। প্রথমত, এখানে গোপনে থাকা হচ্ছে, চিঠি নিয়ে কেউ যদি চলে আসে সেটা গোপন হতে পারে না। আমি বললাম, এখন কী করবে?
কাজলের আব্বা বললেন, যদি না যাই আমার নামে হুলিয়া দিয়ে ধরার জন্য চলে আসবে। ছেলেমেয়ে সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। কোথায় পালাব আমরা এতগুলো মানুষ? আমাকে যেতে হবে।
আমি তোমার সাথে যাই।
না তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকো।
তাহলে ইকবাল যাক তোমার সাথে।
না না, কী বলছ! বিপদ হতে পারে।
তোমাকে একা যেতে দেবো না। আল্লাহর মর্জি কোনো বিপদ হবে না। সবাই আছে। একটু পরে কাজলের আব্বা ইকবালকে সাথে নিয়ে নৌকা করে রওনা হলো। আমার আল্লাহর ওপর খুব বিশ্বাস। নফল নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি, আল্লাহ তাদের ওপর কোনো বিপদ নামাতে পারেন না। পর দিন বিকেলে ইকবাল একা ফিরে এলো, খালি পা, গায়ে একটা ছেঁড়া শার্ট, পরনে লুঙ্গি। গ্রামের মাঝ দিয়ে একজন মাঝিরে নিয়ে পালিয়ে এসেছে, তাকে এভাবে দেখে আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। নিঃশ্বাস আটকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ইকবাল?
ইকবাল একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আব্বা গতকাল বিকেলে মিটিংয়ে গেছেন, আর ফিরে আসেননি। সবাই বলছে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। আমি আর নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম। এক মুহূর্তে আমার জীবনের সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেল।”
সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে ভোট দিলে পাকিস্তানিরা স্তম্ভিত হয়ে যায়। তাদের কাছে রিপোর্ট ছিল শেখ মুজিব এমনিতেই পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় নেতা, সারা দুনিয়া একটা নির্বাচন চাইছে, সরকার একটা নির্বাচনের কথাও দিয়েছে। মুখ রক্ষার জন্য হলেও একটা নির্বাচন হওয়া দরকার। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতার প্রতি আস্থাশীল। শক্তি প্রয়োগ করে সেটা খুব একটা নষ্ট করা যাবে না। এখন রাস্তাঘাটে শক্তিশালী, সংসদেও তারা না হয় একটা শক্তিশালী বিরোধী দল হবে তাতে ক্ষতি কী। যত চেষ্টাই করুক আওয়ামী লীগ পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে ৮০-৯০ অথবা ১১০-২০টার বেশি সিট পাবে না। বাকিদের নিয়ে পাকিস্তানিরা যেকোনোভাবে সরকার চালাতে পারবে। এই গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে এলএফও’র মধ্যে সত্তরের নির্বাচন হয়েছিল। নির্বাচনের আগে কত শর্ত! এমন মনে হচ্ছিল, কোনো রোগী সে খেতে পারবে না, বসতে পারবে না, শুতে পারবে না, ঘুমাতে পারবে না, জেগে থাকতেও না। মানে কী করবে, সে যেন কীও করতে পারবে না। এমন একটা অবস্থার মধ্যে নির্বাচন। সারা পৃথিবী অবাক হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো সিট পায়নি। ৮৩ সিট নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। অন্য দিকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩০০ সিটের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ সিটের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। দু’টির একটি ময়মনসিংহ নান্দাইলের নুরুল আমিন, অন্যটি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায় পান। নির্বাচনে যেন পাকিস্তানের বাড়া ভাতে ছাই পড়ে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন ঢাকায় বসার কথা ছিল। জল্লাদ ইয়াহিয়া এক সময় ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর জেনারেলরা নানা কৌশলে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে বাধা সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। সেদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির সভা ছিল। মানুষ ক্ষেপে যায়। মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ পূর্বাণী হোটেলের সামনে একত্র হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টনে সভার আহ্বান করে। সেখানে জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু হাজির হন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে শাজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। অন্য দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আ স ম আব্দুর রব বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পরিস্থিতি দ্রুত এগোতে থাকে। তারপর আসে সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। আর যদি একটা গুলি চলে, আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না, ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
আবার ইয়াহিয়া এলেন, ভুট্টো এলেন আলোচনা চলল। পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি প্রশাসন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। ধানমন্ডি ৩২ সড়কের বাড়ি থেকে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন একের পর এক নির্দেশ জারি করতে লাগলেন। তার নির্দেশ সব সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে থাকলেন। সেটা পুলিশ-ইপিআর, বেসরকারি কর্মচারী কেউ বাদ ছিল না। আর পালন না করে কোনো উপায়ও ছিল না। সারা দেশের মতো পিরোজপুরের পুলিশ এবং বেসরকারি কর্মকর্তারাও আওয়ামী লীগের নির্দেশে জনগণের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জয় বাংলা বাহিনী গঠনের আহ্বান জানায়। সারা দেশে এক অভূতপূর্ব জাগরণের সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকভাবেই পিরোজপুরও এসব থেকে বাদ ছিল না। বিখ্যাত হুমায়ূন আহমেদ এবং জাফর ইকবালের বাবা এসডিপিও ফয়জুর রহমানও জনসাধারণের সাথে সক্রিয় ছিলেন। যত দিন পিরোজপুর হানাদার মুক্ত ছিল তত দিন দুর্গম পিরোজপুর ছিল স্বাধীনতার আন্দোলনের লীলাভূমি। আর ফয়জুর রহমান এসডিপিও হিসেবে সেখানকার নেতাকর্মীদের ছিলেন ভরসার স্থল।
২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদাররা সভ্য জগতের সব নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি পদদলিত করে নিরস্ত্র ঘুমন্ত জাতির ওপর ট্যাঙ্ক, মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক রাতেই ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে চার-পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হয়। ঢাকার রাজারবাগ, পিলখানায় ছোটখাটো প্রতিরোধ হলেও বলতে গেলে সবই ছিল একতরফা। আদিম হিংস্র্র নরঘাতকেরা ট্যাঙ্ক মেশিনগান নিয়ে যখন দেশের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে, তখন একে একে সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ, এ দিকে নরসিংদী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সীমান্ত, অন্য দিকে সিলেট, চিটাগাং সব জায়গায় একই অবস্থা। হানাদাররা যখন জেলা মহকুমাগুলো দখল করে নেয় তখন অনেক বাঙালি কর্মকর্তা চাকরিতে যোগ দেন। পিরোজপুরে এসডিপিও ফয়জুর রহমানের ঘটনাও মোটেও এর ব্যতিক্রম নয়। পাকিস্তান হানাদারেরা বিশাল বহর নিয়ে যখন পিরোজপুর দখল নেয়, তখন বেশির ভাগ সরকারি কর্মচারী গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। পিরোজপুরের এসডিও, এসডিপিও কেউ বাদ ছিলেন না। আয়েশা ফয়েজের লেখাতেই আছে। কথা ছিল থানার ওসি তফাজ্জল হোসেন সব কিছু ফেলেফুলে পালাবেন, তা তিনি করেননি। হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান যখন পরিবার পরিজন নিয়ে বাবলায় অবস্থান করছিলেন, তখন এক দিন সকালে ওসির চিঠি যায়। ওসি তফাজ্জল হোসেন লিখেছেন, ‘মিলিটারিরা এলেও আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। আরো অনেকেই চাকরিতে যোগদান করেছে, আপনিও চলে আসুন।’ সেই হিসেবে জনাব ফয়জুর রহমান পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেন অথবা চাকরিতে যোগদান করেন। যোগদানের সময় বিখ্যাত জাফর ইকবাল বাবার সাথে ছিলেন। জাফর ইকবাল এবং হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি, ঢাকাতেই ছিলেন। স্বাধীনতার পর তারা মুক্তিযুদ্ধের বই লিখে মাথার তাজ হয়েছেন আর আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্ত ঝরিয়েও নানাভাবে সমালোচিত নিন্দিত অবহেলিত অপমানিত। জনাব ফয়জুর রহমানকে চাকরিতে যোগদান না করে পালিয়ে থাকা অবস্থায় হানাদাররা যদি হত্যা করত আমি অবশ্যই তাকে শহীদ হিসেবে গণ্য করতাম। কিন্তু চাকরিতে যোগদান করা কাউকে শহীদ বলি কী করে? জানি আমাদের দেশে বিচার নেই, বিবেচনা নেই। ফয়জুর রহমানের মতো সিরাজগঞ্জের এসডিও শামসুদ্দিন মার্চের শুরুতে লোকজন নিয়ে এক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। বেশ দৌড়াদৌড়িও করেছেন। পাকিস্তান হানাদারেরা নগরবাড়ি ফেরি পার হয়ে পাবনা সিরাজগঞ্জ দখল নিতেই জনাব শামসুদ্দিন তার নিকটাত্মীয় শফিউল আজমের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাকে হানাদারেরা নির্যাতন করে মেরে ফেলে। সে জন্য তাকে গত বছর স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আত্মসমর্পণ করলে স্বাধীনতা পুরস্কার আর শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে গেলে নিন্দাÑ এ হলো বাংলাদেশের বর্তমান ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার ডিসি ছিলেন নুরুল কাদের। তখন সিরাজগঞ্জ পাবনার একটা মহকুমা। পাকিস্তানিরা পাবনা দখল নিলে ডিসি নুরুল কাদের আত্মসমর্পণ না করে প্রতিরোধ চালিয়ে যান। একপর্যায়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারে যোগদান করে কাজ করেছেন তাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। নুরুল কাদেরের অধীনে ক’দিন নাচানাচি করে যিনি আবার পাকিস্তানের পদলেহন করতে গিয়েছিলেন তাকে দেয়া হয়েছে পুরস্কার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে জীবিত অথবা মৃত কেউ ধরে দিলে তাকে এক লাখ টাকা পুুরস্কার দেবেÑ এ ঘোষণার পর আমি যদি আত্মসমর্পণ করতাম, হানাদারেরা আমায় মেরে ফেললে আমাকে কি শহীদ বলা হতো? জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি, ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়েছি। এরপরও যখন তথাকথিত বঙ্গবন্ধুপ্রেমীরা গালাগাল করেন, তখন কষ্ট না হয়ে পারে না। নিশ্চয় অনেকে আমাকে পছন্দ করবেন না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও পাকিস্তানিরা করেনি। তেমনি এখনো না হয় কেউ কেউ করবেন না। তাই বলে যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোরÑ অমন হবে কেন?
আজ আমার মনটা ভালো না। সখিপুরে আমার বাড়ির সামনের জনাব মজিদ গত পরশু মারা গেছেন। ভদ্রলোক গত মহররমে আমায় খিচুিড় খাইয়েছিলেন। মাটিতে বসে সে খিচুড়ির অমৃত স্বাদ আজো আমার মুখে লেগে আছে। আল্লাহর কী বিধান! আরেক মহররম এলো না, তার আগেই সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে লোকটি চলে গেল। সকালে জানাজায় গিয়েছিলাম ছাতিহাটিতে বাবা-মায়ের কবরের পাশে। মাকে হারিয়ে আমি যখন দিশেহারা, দুনিয়ার সব আকর্ষণ থেকে দূরে চলে যাচ্ছিলাম তখন আমার ঘরে মা কুশিমণি এসে সব শূন্যতা ভুলিয়ে দেয়। তাকে ঘিরে অন্ধকার ঘর যেন আলোয় আলোয় ভরে যায়, চার দিকে আনন্দ আর তৃপ্তি। সেই কুশিমণিকে চার-পাঁচ বছর যে লালন পালন করেছে সে আমার গ্রামের মেয়ে আয়েশা। মামা বলে ডাকতো আমায়। ’৭২ এর পর থেকেই আমাদের কাছে ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামে আমি যখন নির্বাসনে সে তখন ছোট বোন শুশুমার সাথে আবুধাবিতে। আবার শেষ বয়সে আমার কলিজার টুকরো বুকের ধন কুশিমণিকে দেখাশোনা করেছে। সেই আয়েশা গত পরশু শনিবার এ দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। তাই ব্যথাতুর বুকে লিখতে মন বসছে না। আল্লাহ যেন তাদের সব গোনাহ মাফ করে বেহশতবাসী করেনÑ আমিন।
- See more at: Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.