![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুই দু’গুণে পাঁচ
আতাউর রহমান | আপডেট: ০১:০৪, আগস্ট ২৮, ২০১৫ |
বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।।
অতি সম্প্রতি বিদ্যা বিতরণ-সংক্রান্ত একটি কার্যোপলক্ষে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোনায় অবস্থিত একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামীণ জনপদ, ভাদেশ্বর নামে যেটা সমধিক পরিচিত, সেখানে প্রায় মাস খানেক অবস্থানকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপরোক্ত স্ফুলিঙ্গটি প্রায়ই আমার মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারত। সেই সঙ্গে স্মরণ পড়ত পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার নিম্নোক্ত দুটো পঙ্ক্তিও—
তুমি যাবে ভাই—যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়।
আর প্রত্যহ সকালে দণ্ড হাতে স্থানীয় কুড়া নদীর ওপারে নির্মিত পাকা রাস্তায় প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে নির্মল-স্নিগ্ধ বায়ু সেবনকালে আমার আরও মনে পড়ে যেত সেই মুখরোচক গল্পটি:
একজন লোকের বয়স ১০০ বছর। তো তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো তাঁর এত দীর্ঘ জীবনপ্রাপ্তির পেছনে রহস্য কী। তখন তিনি একগাল হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছিল ২৫ বছর বয়সে এবং বিয়ের প্রথম রাতেই বউয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়েছিল এই মর্মে যে স্বামী-স্ত্রীতে তর্কাতর্কি তো লাগবেই; তর্কে যে হারবে, সে রাগ প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে বাড়ির বাহিরস্থ বিরাট মাঠে মুক্ত বাতাস সেবন করবে। তা আমি যে বিগত পঁচাত্তর বছর বাইরে বাইরে থেকেছি এবং মুক্ত, নির্মল বায়ু সেবন করেছি, তজ্জন্য আমার আয়ু বোধ করি বেড়ে গিয়েছে।’
অতএব নির্মল বায়ুসেবন যে সুস্বাস্থ্যের পক্ষে কত উপকারী, সেটা বিদগ্ধ পাঠককে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। তা বিশেষ করে আমাদের এই রাজধানী শহরে (যেটা নাকি দুনিয়ার ১৪০টি শহরের মধ্যে বাসযোগ্যতার দিক দিয়ে নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়) এ জিনিসটার অভাব বড়ই প্রকট। এমনিতেই যানজট ও জনজটের ফলে সবাইর নাভিশ্বাস। যানজটের কথা সবাই বলেন, কিন্তু জনজটের কথা কেউ বলেন না; জনজটের ফলে ফুটপাত দিয়ে হাঁটাচলাও খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তদুপরি নিরবচ্ছিন্ন নির্মাণকাজ চলতে থাকায় ও গাড়ির ধোঁয়ায় রাজধানীর বাতাস বহুলাংশে দূষিত। তবু মানুষ সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে কেন যে এখানে মরতে আসে! এবং একবার এলে আর ফেরার নামটিও করে না!
গ্রামবাংলায় প্রত্যক্ষ করা গেল, বিদ্যুৎ কখন যায় সেটা বিবেচ্য নয়, বরং কখন আসে, সেটাই বিবেচ্য
অবশ্য একদিক দিয়ে গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে আমরা ভালোই আছি বলতে হচ্ছে। কথায় আছে: ‘যদিও আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়/ তবুও আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়’। যদিও বর্তমানে বিদ্যুতের বিল আমাদের অনেক বেশি দিতে হচ্ছে, তবু কুইক রেন্টালের কল্যাণে রাজধানীতে এখন বিদ্যুতের লোডশেডিং প্রায় নেই বললেই চলে। গ্রামবাংলায় প্রত্যক্ষ করা গেল, বিদ্যুৎ কখন যায় সেটা বিবেচ্য নয়, বরং কখন আসে, সেটাই বিবেচ্য; যেমন করে পানি মেশানো দুধ বিক্রি হতে হতে শেষমেশ বাজারে দুধ মেশানো পানি বিক্রি হতে লাগল।
সে যা-ই হোক, বারান্তরে কবিগুরু তাঁর কণিকায় লিখেছেন: ‘কে লইেব মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি—/ শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।/ মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,/ আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।।’ একসময় গ্রামাঞ্চলে দিবাশেষে অন্ধকার দূরীকরণার্থে অস্তগত সূর্যের দায়িত্ব পালন করত মাটির প্রদীপ ও হারিকেন বাতি, অধুনা সেগুলোর স্থলাভিষিক্ত হয়েছে চার্জার লাইট ও জেনারেটর। আর এই সুযোগে গণচীন সস্তা টর্চ ও চার্জার লাইট দেদার রপ্তানি করে বেশ দুপয়সা কামিয়েও নিচ্ছে।
বাংলা ভাষায় একটি প্রবচন আছে: কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। এটা এ জন্য বলা হয় যে আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে আমন ধান পাকলে কৃষকের মুখে হাসি ফুটত এবং তখন ছিল বছরে একটিমাত্র ফসল। মহান স্রষ্টাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, তিনি মানুষকে উদ্ভাবনী শক্তি দিয়েছেন, বর্তমানে ইরি ধানের কল্যাণে বছরে তিন ফসল হচ্ছে। কৃষকের মুখে তাই সারা বছরই হাসি
লেগে থাকে, সারা বছরই তাঁর জন্য পৌষ মাস। এখন তাই আর সেই অর্থে প্রবচনটা বলা বোধ করি সংগত
হবে না। প্রত্যক্ষ করা গেল, কৃষকের খেতের এক অংশে পাকা সোনালি ধান ঝলমল করছে এবং আরেকাংশে তিনি নতুন চারা রোপণ করছেন। তাঁর মুখে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!’ গানের কলি একদার সাহিত্যের ছাত্রকে স্মরণ করিয়ে দেয় ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য সলিটারি রিপার’ ও সেটার ব্যঞ্জনা। আর ঘুঘু পাখির ডাক সব সময়ই মনটাকে উদাস করে দেয়। এটা আমি লক্ষ করেছি প্যারিস আর লন্ডন শহরের উপকণ্ঠেও—সর্বত্রই সমান অনুভূতি। আর হ্যাঁ, জীবনে অনেক ঘুঘু দেখেছি, ফাঁদও কম দেখিনি।
পুনশ্চ রবীন্দ্রনাথ। ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক/ রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক’। তো বৃষ্টিস্নাত সকালে ছাতা মাথায় প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে শিয়ালমামার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটতেই মনে পড়ে গেল তার চালাকি-সংক্রান্ত সেই মজার গল্পটি: সকালে গর্ত থেকে বেরিয়ে খানিক দূর যেতেই শিয়াল পড়ে গেছে ক্ষুধার্ত বাঘের মুখে। বাঘ তাকে খেতে চাইলে শিয়াল বলল, ‘তুমি বনের রাজা, অবশ্যই যাকে ইচ্ছা হয় খাবে। কিন্তু গত রাতে আমি ও আমার শিয়ালনিতে একটা ব্যাপারে তুমুল তর্কাতর্কি হয়ে গেছে। তুমি বিচার-সালিসি করে দাও, কে সঠিক ও কে বেঠিক, তারপর তোমার ইচ্ছে হয় দুজনকেই খেয়ো।’ বাঘ লোভে পড়ে রাজি হয়ে গেল। শিয়াল বাঘকে তার গর্তের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘তুমি তো আমাদের গর্তের ভেতর ঢুকতে পারবে না। তুমি গর্তের মুখে অপেক্ষা করো, আমি গিয়ে শিয়ালনিকে নিয়ে আসি।’ এটা বলেই সে গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ল; আর ফেরার নামটি নেই। বাঘ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে হুংকার ছাড়ল, ‘কই হে, ফিরতে এত দেরি কেন? তাড়াতাড়ি এসো।’
শিয়াল গর্তের ভেতর থেকে জবাব দিল, ‘আমাদের মধ্যে মিল-মহব্বত হয়ে গেছে। তোমার আর বিচার-সালিসি করতে হবে না। তুমি চলে যাও।’
আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷
©somewhere in net ltd.