নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আমারি মত.................।

তাজ - সৈয়দাবাদী ।

শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, এম পিও ভুক্ত কলেজ

তাজ - সৈয়দাবাদী । › বিস্তারিত পোস্টঃ

জাসদের ঘরে ফেরা না-ফেরা

২৮ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৯


রাজনীতি

মহিউদ্দিন আহমদ | আপডেট: ০১:৫১, আগস্ট ২৭, ২০১৫ |




অলংকরণ: তুলিআমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টির আবরণে বাম রাজনীতি শুরু হয়েছিল বিশ শতকের বিশের দশকে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবে তখন উপনিবেশ এবং সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কমিউনিজম তত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। এই আকর্ষণের পেছনে আবেগ, ভালোবাসা এবং রোমাঞ্চের ঘাটতি ছিল না। ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন মস্কো ও পিকিং—এই দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। তবু বামপন্থার প্রতি তরুণদের আগ্রহ কমেনি।
নদীতে যখন জোয়ার আসে, তখন জলের সঙ্গে অনেক জঞ্জালও ভেসে আসে। এ দেশের বাম রাজনীতিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটা সময় ছিল, যখন গোটা দশেক শব্দ, যেমন—পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, সর্বহারা, বিচ্যুতি, হঠকারিতা, বস্তুবাদ, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি মুখস্থ আওড়াতে পারলেই বামপন্থী হওয়া যেত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অনেকেই শখের বামপন্থী হয়ে যেতেন। তারপর ক্যারিয়ারের ধান্দায় পড়ে গেলে ওই শব্দাবলি কর্পূরের মতোই উবে যেত।
ষাটের দশকের শেষ দিকে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি এ দেশে খুবই জনপ্রিয় হয়, বিশেষ করে তরুণসমাজের মধ্যে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র, বিপ্লব—এই শব্দগুলো আমাদের প্রজন্মকে প্রবল বেগে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের মধ্যেও একধরনের মেরুকরণ ঘটে এবং বুঝে কিংবা না বুঝে প্রায় সবাই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দেওয়া শুরু করে। ঠিক এ সময় ছাত্রলীগের মধ্যে বিভাজনের রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং একটি গ্রুপ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ স্লোগান দিতে থাকে।
মাস দুয়েক আগে এক আলাপচারিতায় অধ্যাপক রেহমান সোবহান আমাকে একটি তথ্য জানালেন। বাহাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নীতিনির্ধারণী ভাষণ দেবেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান হেয়ার রোডের গণভবনে বসে ভাষণের খসড়া তৈরি করছেন। খসড়ায় ‘সমাজতন্ত্রের’ উল্লেখ ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে যুবনেতা সিরাজুল আলম খান এসে উদয় হলেন। তিনি অধ্যাপকের হাত থেকে কলম নিয়ে বক্তৃতার খসড়ায় ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটির আগে খসখস করে ‘বৈজ্ঞানিক’ শব্দটি বসিয়ে দিলেন।
‘আমরা লড়ছি সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য’—এই আপ্তবাক্যটি সম্বল করে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ আলাদা কাউন্সিল সভা করল এবং কয়েক মাসের মধ্যেই জন্ম নিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ। জাসদ তরুণসমাজের বড় একটা অংশকে বিপ্লবী রোমান্টিকতার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এরপরের ইতিহাস মোটামুটি সবারই জানা।
জাসদে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন অনেকেই। জন্মের সময় থেকে ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পদত্যাগের আগ পর্যন্ত দলটির সভাপতি ছিলেন মেজর (অব.) মোহাম্মদ আবদুল জলিল। তিনি একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাঁর মন্তব্য হলো, জাসদের অধিকাংশেরই ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান পর্যন্ত ছিল না। ফলে কেবল বিশ্বাস, অন্ধ আবেগ এবং রোমান্টিকতা প্রশ্রয় পেয়েছে। আচার-আচরণে বিপ্লবী এবং বিদ্রোহের ভাব ঠিকই ফুটে উঠেছে, কিন্তু দর্শনগত জ্ঞানের অভাবে বিপ্লবী চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটেনি। (সূত্র: মেজর জলিল রচনাবলি, ১৯৯৭)
জাসদের বিপর্যয় শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। দলটি তখনই নানাভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ফসল ঘরে তুলতে না পারার কারণে দলটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। তারপর শুরু হয় ভাঙনপর্ব। আশির দশকে জাসদের মধ্যে দুটি ধারা লক্ষ করা যায়, একটি হলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে শামিল থাকা। এর ফলেই অন্যান্য বাম দলসহ গড়ে ওঠে ১৫-দলীয় ঐক্যজোট। অন্য ধারাটি ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক জোটে না থাকা। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫-দলীয় জোটে ভাঙন ধরে। জাসদের ওই সময়ের মূল নেতাদের মধ্যে কাজী আরেফ আহমদ, মনিরুল ইসলাম ও শরীফ নূরুল আম্বিয়া জোটে থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। বিপক্ষে ছিলেন দলের অন্যতম প্রধান নেতা ও সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু। কাজী আরেফের দোদুল্যমানতার কারণে দলে ইনুর প্রভাব বেড়ে যায় এবং ১৫-দলীয় জোট ভেঙে পাঁচদলীয় বাম জোট তৈরি হলে জাসদ তাতে যোগ দেয় এবং নির্বাচন বর্জন করে। মনিরুল ইসলাম ওই সময় একটা পুস্তিকাও লিখেছিলেন: পাঁচদলীয় বাম ঐক্যজোট আত্মহত্যার শামিল। ১৯৯১-এর নির্বাচনে জাসদ ‘শাটল কর্ক’-এর মতো একবার আওয়ামী লীগের দিকে, একবার বিএনপির দিকে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার জন্য ছোটাছুটি করে এবং শেষমেশ একা একাই নির্বাচন করে একটিও আসন পেতে ব্যর্থ হয়।
১৯৯৬ সালে আ স ম আবদুর রব, যিনি ১৯৮৪ সালেই আলাদা দল (জাসদ-রব) তৈরি করেছিলেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘ঐকমত্যের’ সরকারে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। জাসদ (ইনু) তখন জাসদ (রব)-এর সঙ্গে এক হওয়ার চেষ্টা করে। ওই সময় জাসদের (ইনু) মধ্যে একটা বিতর্ক ছিল যে, রবের সঙ্গে ঐক্য করার চেয়ে আওয়ামী লীগে একীভূত হয়ে যাওয়াই ভালো। রবের সঙ্গে ইনুদের মধুচন্দ্রিমা শেষ হয়ে যায় ২০০১ সালের নির্বাচনের পরপর। দলের কেউ ওই নির্বাচনে জয় পাননি। সম্ভবত ওই সময় জাসদের (ইনু) মধ্যে একটা প্রতীতি জন্মায় যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক জোটে না থাকলে পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে তাঁরা খুব শিগগির অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবেন। কেননা, সংসদীয় রাজনীতিতে সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকতে না পারলে রাজনীতিবিদ হিসেবে কোনো মর্যাদা থাকে না। এই বাস্তবতা থেকেই জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি আওয়ামী নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোটে যোগ দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন এবং জাসদের নেতা হাসানুল হক ইনু তাঁদের নিজ নির্বাচনী এলাকায় যথাক্রমে পঞ্চম ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘নৌকায়’ চড়ে তাঁরা দুজনেই বৈতরণি পার হন। দলের আরও কয়েকজন সংসদ ভবনে ঢোকার প্রবেশপত্র পেয়ে যান।
২০০৮ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির বাইরে জাসদের কোনো স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ধারা বহমান আছে কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। এই বাস্তবতায় সম্প্রতি দলের ভেতরে আলোচনা-বিতর্ক হচ্ছে। দলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়া অনেক দিন ধরেই দলের রাজনীতিতে পরিবর্তনের কথা বলে আসছেন। গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি দলের নাম বদলানো, ছাত্রলীগের বক্তব্য থেকে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ স্লোগান বাদ দেওয়া ইত্যাদি কথা বলে আসছেন। জুলাইয়ের ৩০-৩১ তারিখ দলের জাতীয় কমিটির সভায় দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের আর কোনো অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর জনপ্রিয়তার বিচারে কমিউনিস্ট পার্টি একটি ক্রমাবনতিশীল দল। চীন সর্বহারা শ্রেণির আন্তর্জাতিক লাইন পরিত্যাগ করেছে। উন্নত জীবন এবং জনগণের শাসন তাদের লক্ষ্য। সব দেশ এখন একই বিশ্বব্যবস্থার শরিক। একাত্তরে সমাজতন্ত্রের যে উন্মাদনা ছিল, আজ তার কোনো আবেদন নেই। জাসদ ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবে—এ কথা আর বাস্তবসম্মত নয়। এটা মেনে নিয়ে শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে দলকে জনস্বার্থের একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে হবে। লক্ষ্য হবে বৈষম্যমূলক সমৃদ্ধ সমাজ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ করা। এ জন্য দলকে ‘কর্মীভিত্তিক’ না থেকে ‘জনভিত্তিক’ হতে হবে। জাসদের নাম বদলানোর কথা ভাবতে হবে।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের রাজনীতির পার্থক্যের চেয়ে মিলই বেশি। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগে একীভূত হয়ে যাওয়াটাই হয়তো স্বাভাবিক প্রবণতা হতে পারত। কিন্তু বাস্তব কারণে এখনই সেটা সম্ভব হবে না বলে মনে হয়। বড় দলে লীন হয়ে গেলে ছোটদের কোনো অস্তিত্ব থাকে না। ইনু-আম্বিয়াদের চেয়ে জাসদের একসময়ের বড় নেতারাও আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে হারিয়ে গেছেন। উদাহরণ হিসেবে বাগেরহাটের কামরুজ্জামান টুকু কিংবা টাঙ্গাইলের খন্দকার আবদুল বাতেনের নাম উল্লেখ করা যায়। আলাদা দল থাকলে নির্বাচনী জোটে থেকে দর-কষাকষি করে সংসদে কয়েকটি আসন পাওয়া যায়। সেটাই বা কম কী।
জাসদ যদি আওয়ামী লীগে ফিরে যায়, সেটা হবে ‘ঘরে ফেরা’। আলাদা দল রেখে নাম বদল করলে, অর্থাৎ দলের নাম থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি বাদ দিলে আলাদা রাজনীতির মাজেজাটাই থাকবে না। সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব সহজ হবে না। আগামী ডিসেম্বরে জাসদের কাউন্সিল সভা। সেখানে জোর বিতর্ক হবে। সাধারণ সম্পাদক আম্বিয়া বেশ ঝুঁকি নিয়েছেন। কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদকের পদটি হারাতে পারেন। একটা বিষয় অবশ্য দলের ভেতরে-বাইরে বেশ চাউর হয়েছে। ‘বি-টিম’ হিসেবে থাকার চেয়ে ‘এ-টিমে’ যোগ দেওয়াই ভালো। এখন সবাই যখন ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’, তখন আলাদা থাকারই বা প্রয়োজন কী। এর উত্তর পেতে জাসদের আগামী কাউন্সিল সভা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক-গবেষক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.