![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম | 07-09-2015
2
কেন চাই নির্বাচিত ছাত্র সংসদ : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলোর ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে সেগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের সামাজিক সংগঠন এবং অন্যদিকে তা তাদের এক ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন। শিক্ষার্থীদের পাঠ্য-চর্চার পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, খেলাধুলা শরীরচর্চা, গান-বাজনা, নাট্যচর্চা, বিতর্ক, সাহিত্যচর্চা, আনন্দ-উত্সব ইত্যাদি সংগঠিত করাসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড এরা পরিচালনা করে থাকে।
স্বাধীনতার পরপরই অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে আমি ভি.পি নির্বাচিত হয়ে এ ধরনের কতো কাজ যে শুরু করেছিলাম তার সব এখন মনেও নেই। বার্ষিক ট্যালেন্ট শো, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নাটক মঞ্চায়ন, নাট্য প্রতিযোগিতা, নাটচক্রসহ গ্রুপ থিয়েটার স্থাপনে সহায়তা, ডিন রিড-পূর্ণদাস বাউলসহ দেশি-বিদেশি গায়কদের নিয়ে কনসার্টের আয়োজন, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশ ইত্যাদি বহু কাজ এক-দেড় বছরে আমরা সম্পাদন করেছিলাম। অল্প সেই সময়কালের মধ্যে ‘মাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা’ প্রকাশ, ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্য নির্মাণ, শহীদ মিনারের দৃশ্যপটের সাজসজ্জা ও প্রভাতফেরির ব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাশ্রমে এফ. রহমান হলের ব্যারাক নির্মাণে সহায়তা প্রদান, দুর্ভিক্ষ ও বন্যার সময় লক্ষ লক্ষ রুটি বানিয়ে প্রতিদিন দুর্গত এলাকায় প্রেরণ, বন্যা পরবর্তী সময়ে ঢাকার রেসকোর্স ও মহসিন হল মাঠে বীজতলা নির্মাণ করে কৃষকের মধ্যে ধানের চারা বিতরণ, ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার অভিযান পরিচালনা ইত্যাদি অনেক ধরনের কর্মসূচি আমরা বাস্তবায়ন করেছিলাম।
তাছাড়া পরীক্ষায় নকল প্রতিরোধ অভিযান পরিচালনা, অটো প্রমোশনের বিরোধিতা, পরীক্ষা পেছানোর জন্য তথাকথিত ‘আন্দোলনের’ বিরোধিতা ইত্যাদি নানা ধরনের পদক্ষেপও আমরা নিয়েছিলাম। আমাদের এসব প্রচেষ্টা অনেকটাই সফল হয়েছিল। যদিও একশ্রেণির নকলবাজ ‘ছাত্র’ ‘সেলিমের দালালি চলবে না’ ‘সেলিমের কল্লা চাই’ বলে শ্লোগান দিয়ে ডাকসু অফিস তছনছ করেছিল। শিক্ষাবর্ষ শুরুর দিনটিতে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের ফুলের স্তবক প্রদান ও ছোট ছোট ভাষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের সম্মান জানিয়ে সবাই মিলে শোভাযাত্রাসহ শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে নতুন বছরের কার্যক্রমের সূচনার রেওয়াজ চালু, ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন বর্ষের সেরা ছাত্রদের ছবি নোটিস বোর্ডে টাঙ্গানোর ব্যবস্থা ইত্যাদিও আমরা চালু করেছিলাম। এ ধরনের কাজের জন্য প্রয়োজন ছাত্র সংসদের। এসব কাজ সৃজনশীলভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব পালন করাই হলো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলোর কর্তব্য।
ছাত্রছাত্রীদের সামাজিক সংগঠন হিসেবে নানাবিধ কাজের পাশাপাশি ছাত্র সংসদগুলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো শিক্ষার্থীদের ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। ক্লাসরুমের ভাঙা চেয়ার-বেঞ্চ-টেবিল, সাদা হয়ে যাওয়া ব্ল্যাকবোর্ড, লাইব্রেরিতে বইয়ের স্বল্পতা, সেশন জট, টয়লেটের সমস্যা ইত্যাদি থেকে শুরু করে ছাত্র বেতনের হার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাস সার্ভিস ব্যবস্থাপনা, শিক্ষানীতি, শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ, মুক্তিবুদ্ধি চর্চার অবারিত সুযোগ, সমাজের সামগ্রিক গণতন্ত্রায়ণ ইত্যাদি নানা বিষয় ছাত্র সংসদের এখতিয়ারভুক্ত। ছাত্র জীবন ও শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে এগুলো প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। এসব বিষয় ছাড়াও আছে পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত নানা বিষয়। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থাও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ও ছাত্র জীবনকে সরাসরি স্পর্শ করার সাথে সাথে জ্ঞান চর্চার পরিবেশকে এবং ছাত্র জীবন অব্যাহত রাখার আর্থিক সামর্থ্যকেও বহুলাংশে প্রভাবিত করে। এসব বিষয়ে কথা বলা, সক্রিয় থাকা, সংগ্রাম করা ছাত্র সংসদগুলোর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাছাড়া সকল শিক্ষার্থীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা শিক্ষার একটি প্রধান লক্ষ্য। দেশ-জাতি-জনতার সেবক হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলাটা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই অন্যতম কাজ। এভাবেই চলে আসে রাজনীতির প্রসঙ্গ। কিন্তু সে রাজনীতির প্রসঙ্গ আসে দলীয় বিবেচনা থেকে নয়। তা আসে ছাত্র সমাজের সাধারণ স্বার্থের বিবেচনা থেকে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব যদি হয়ে থাকে শিক্ষার্থীদেরকে দেশপ্রেমিক ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে এবং সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা তাহলে ক্লাসের পাঠ্যক্রমের সীমাবদ্ধ থেকে তা বাস্তবায়ন করা যে সম্ভব নয়, সেটা ব্যাখ্যা করার অপেক্ষা রাখে না। ক্লাসের বইপত্র-লেকচারের বাইরে তাদের নানামুখী সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অধিকারবোধের জাগরণ, জনসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ড, স্বদেশ ও বিশ্বের নানা ঘটনার সাথে পরিচয় ও সম্পৃক্তি, মুক্ত চিন্তার বিকাশ, যুক্তিবাদী মানসিকতা কার্যক্রম আত্মস্থ করা, সৃজনশীলতার বিকাশ ইত্যাদি এক্ষেত্রে আবশ্যক কাজ। নির্বাচিত ছাত্র সংসদ হতে পারে এসব কাজের একটি প্রধান বাহন। পাঠ্যবই, ক্লাস, লেকচার, পরীক্ষা ইত্যাদি যেমন কিনা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবশ্যিক অঙ্গ, ঠিক সমান গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি হলো ছাত্র সংসদের মাধ্যমে পরিচালিত কাজকর্ম। যুক্তির কথা হলো এই যে, নিয়মিতভাবে ক্লাস, পরীক্ষা ইত্যাদি না দিতে পারলে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেয়া হয়, ঠিক তেমনি বছর বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন না করতে পারলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়া উচিত। অথচ গত আড়াই দশক ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাচিত ছাত্র সংসদের কাজকর্ম ছাড়াই চলতে দেয়া হচ্ছে। এর কারণ আসলে কি?
ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না কেন?
নব্বই-এ এরশাদ স্বৈরাচারের অবসানের মাধ্যমে দেশে নির্বাচিত সরকারের ব্যবস্থা ফিরে এসেছে। কিন্তু তারপর থেকে আজ অবধি ডাকসু নির্বাচনসহ সরকার নিয়ন্ত্রিত অথবা বেসরকারি— কোনো ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ডাক্তার, আইনজীবী, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, সরকারি অফিসার-কর্মচারী, শিক্ষক— সকলেরই ইউনিয়ন, সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-সংসদ নির্বাচন এতোদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। ফলে একদিকে ছাত্র সমাজের অধিকার খর্বিত হচ্ছে, দেশপ্রেমিক সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে তাদের গড়ে ওঠা বিঘ্নিত হচ্ছে, অন্যদিকে সমাজের সার্বিক গণতন্ত্রায়ন হোঁচট খাচ্ছে। এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? এই প্রশ্নের জবাবে নিম্নলিখিত কারণগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমত: ছাত্র সংসদগুলোকে ‘বি-রাজনীতিকরণ’ (de-politicise) করার চিন্তা ও প্রবণতা ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে অন্যতম বাধা। ছাত্র সংসদ থাকলেই ছাত্রদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নকে ভিত্তি করে রাজনীতি, দেশ, দুনিয়া, জনতা অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলো আসবেই। কিন্তু শাসকশ্রেণির একাংশের ভয় ঠিক এখানেই। ছাত্রদেরকে দেশ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থেকে, রাজনৈতিক-সামাজিক ইস্যু নিয়ে বিচলিত হওয়া থেকে দূরে রেখে কেবলমাত্র বইয়ের পোকা অথবা মগজের বিমূর্ত শক্তি বৃদ্ধির উপকরণ হিসেবে গণ্য করার আপাতত নির্দোষ কিন্তু অবাস্তব ও প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদ পোষণকারীরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পথে অন্তরায়। তাদের ভয়, পাছে না ছাত্ররা দেশ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে ভাবতে ও সক্রিয় হতে শুরু করে। অথচ তারা সহজ এই কথাটা বুঝতে চায় না যে, দেশের কথা ভাবাটা, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠাটা শিক্ষারই একটি অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
দ্বিতীয়ত: অন্যদিকে, ছাত্র সংসদগুলোকে ‘অতি-রাজনীতিকীকরণের’ (over-politicise) করার চিন্তা ও প্রবণতাও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। তথাকথিত বড় রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র সংগঠনগুলোকে দলীয় অঙ্গ-সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। ছাত্র সংসদের নির্বাচনে কারা জয়লাভ করতে পারলো বা না পারলো তার উপরেই রাষ্ট্রীয় অথবা স্থানীয় ক্ষমতা কোন দলের হাতে যাবে তা নির্ভর করে বলে তারা মনে করে। তাই, ক্ষমতা (রাষ্ট্রীয় হোক বা স্থানীয় হোক) কুক্ষিগত করার জন্য ছাত্র সংসদগুলোকে হাত করতে তারা মরিয়া হয়ে পড়ে। হিসেব-নিকেষ যদি মনে হয় যে বিজয় (সাড়ে ষোল আনা) সুনিশ্চিত নয়, তাহলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কোনো না কোনোভাবে বন্ধ করে রাখতেই তারা উদ্যোগী হয়। দু’পক্ষই যদি বিজয়ের ব্যাপারে অনিশ্চিত থাকে তাহলে উভয়ে মিলেই নিশ্চিত করে যেন নির্বাচন না হয়। আর যদি একপক্ষ নিশ্চিত ও অন্যপক্ষ অনিশ্চিত হয় তাহলে যে অনিশ্চিত সে নির্বাচন ভণ্ডুল করার পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য উঠে-পড়ে লেগে যায়। ব্যাপারটাকে ‘অতি-রাজনীতিকীকরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করার সাথে সাথে ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তিকরণ’ হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়।
তৃতীয়ত: ছাত্র সংগঠনগুলোকে প্রধানত দু’টি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনার পাশাপাশি, এগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক ও কায়েমি স্বার্থ আদায়ের উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে চাঁদাবাজি-হাইজ্যাক-ছিনতাই ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্ত আদায় করে নেয়াটা আজকাল স্বাভাবিক গা-সহা কাজ হয়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে ক্যাডার বাহিনীর দুর্দান্ত দাপট। দুই ক্যাডার বাহিনীর মধ্যে লুটপাট নিয়ে মারামারি গোলাগুলি হয়। আবার ৬০ঃ৪০ হিসেবে ভাগ-বাটোয়ারার শর্তে মিটমাটও হয়ে যায়। এসব ক্যাডার বাহিনী সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বছর বছর জবাবদিহি, তাদের রায়ে নির্বাচিত সংসদ গঠন, ছাত্র সংসদের আইনসংগত ও নৈতিক কর্তৃত্ব ইত্যাদি বিষয়কে ভয় পায়। অহেতুক ঝামেলা মনে করে। তাই তারা নির্বাচিত ছাত্র-সংসদ গঠনে বাধা সৃষ্টি করে।
একই দলের মধ্যে উপ-দলীয় দ্বন্দ্ব এবং কোন ‘ভাই’-এর গ্রুপ প্রাধান্য স্থাপন করতে সক্ষম তার উপর নমিনেশন, টেন্ডার, লাইসেন্স-পারমিট, ডিলারশিপ ইত্যাদি পাওয়াটা নির্ভর করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনির্বাচিত ক্যাডার বাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রণে রাখাটা এসব উপদলীয় নেতাদের জন্যও অনেক সুবিধাজনক। নির্বাচিত ছাত্র সংসদ থাকলে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। তাই বিপক্ষ দলকে দূরে রাখার স্বার্থেই শুধু নয়, নিজের দলে ব্যক্তিগত উপ-দলীয় আধিপত্য বজায় রাখার জন্যও এসব শক্তি ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়।
চতুর্থত: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন এবং সাধারণভাবে শিক্ষক সমাজের সুবিধাবাদ ও ক্যারিয়ারিজমের বিস্তার এবং বিপজ্জনক মাত্রায় দলীয়করণ প্রবণতার প্রসার রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় ক্ষমতার খেলা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক বাণিজ্যিক স্বার্থকে একটি অশুভ আঁতাতে বেঁধে ফেলেছে। একদিকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি আর অন্যদিকে দুর্দান্ত প্রতাপশালী ছাত্র নামধারী ক্যাডার বাহিনীর সন্তোষ বিধান করাটাই প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের কাছে বড় হয়ে ওঠে। ফলে, ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা না করার ব্যাপারটা সেই স্বার্থবোধের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। নিয়মনীতি, সাধারণ ছাত্র সমাজের স্বার্থ এসব পেছনে পড়ে যায়। এভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান রুগ্নতার স্থিতাবস্থা (status quo) বজায় রেখে চলার শক্তি প্রধান হয়ে উঠে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের স্বাধীন উদ্যোগ তাই আর তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না।
তাছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সশস্ত্র তত্পরতা ও দুর্বৃত্তায়ন প্রবণতা নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে বিঘ্নিত করে চলেছে।
পঞ্চমত: সমাজ ও রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ (commercialisation) ও দুর্বৃত্তায়ন (criminalisation) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী, শিক্ষা-প্রশাসন— সকলের উপর অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে। সেকারণে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্রই গণতন্ত্র চর্চা বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার (comoditification) সাথে সাথে ছাত্র সংসদের স্বাধীন তত্পরতার যে মিল খায় না তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না।
ষষ্ঠত: দেশে চলছে ‘মুক্ত বাজারের’ নামে লুটপাটের অর্থনীতি। সেটাই সৃষ্টি ও লালন করছে লুটপাটের রাজনীতি ও সামাজিক মনস্তত্ত্ব। পুরানো সামন্তবাদী অবশেষের সাথে যুক্ত হয়েছে আধুনিক বুর্জোয়া কর্পোরেট কালচার। একদিকে অন্ধ ভক্তিবাদ ও অন্যদিকে ‘হায়ার এন্ড ফায়ার’ কায়দায় কর্তৃত্ববাদ—এই দুই সংস্কৃতির জগাখিচুড়ি পরিণতি হলো গণতন্ত্রের সর্বনাশ। এই অর্থনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার অভিঘাত এসে পড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। বছর বছর যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা, একনাগাড়ে ২৫ বছর ধরে তা প্রায় কোথাও না হওয়ার কারণ এখানেই।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও তার স্বাধীন তত্পরতা শুধু একটি অধিকারের ব্যাপারই নয়। তা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের ও দেশ গড়ার জন্য অপরিহার্য শর্তও। অথচ কোথাও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। এই অবস্থা বদলানোর জন্য যে কাজগুলো করতে হবে সেগুলো হলো—
ক. কলেজসহ উচ্চতর সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছর বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারি করা।
খ. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও তার কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি বিধিমালা জারি করা।
গ. কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে পরীক্ষার নির্দিষ্ট তারিখের অনুরূপ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে দেয়া।
ঘ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য ইত্যাদি অপরাধমূলক তত্পরতা নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি
E-mail : [email protected]
©somewhere in net ltd.