![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
: আসিফ নজরুল
দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক | 14-09-2015
1
অর্থমন্ত্রী, আগে বাস্তব পরিস্থিতি জানুন : আসিফ নজরুল গত বৃহস্পতিবার স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে প্রভাষক নেওয়ার কথা ছিল। আমি এই বিভাগের অ্যাডভাইজর। মেয়েকে স্কুল থেকে তুলে তাড়াতাড়ি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে রওনা দিই। কিন্তু গাড়ি আবাহনী মাঠের পর আর আগে বাড়ে না।
হেঁটে কোনোমতে ইউনিভার্সিটিতে আসি। কাজ সেরে বেলা তিনটার দিকে বের হয়ে দেখি, চারপাশ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। আমার গাড়ি আটকে আছে কয়েক বিল্ডিং পরে একটি ব্যাংকের সামনে। সাতমসজিদ রোডের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছেন তাঁদের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে। ঢাকার আরও কিছু রাজপথে তাঁদের অবস্থানের কারণে নিশ্চল হয়ে গেছে শহর!
অনেক বলে-কয়ে, আমার ক্লাস টুতে পড়ুয়া মেয়ের কষ্টের কথা বলে আমার গাড়ি নিয়ে উল্টো দিকের ব্যারিকেডের ফাঁক গলে বের করতে সমর্থ হই। তারপরও বাসায় ফিরতে তিন গুণ সময় লেগে যায় আমার। শেরাটনের সামনে এসে দেখি প্রিজন ভ্যানের লোহার শিকে মুখ ঠেকিয়ে আহাজারি করছে বন্দীরা। ভ্যানের ড্রাইভার জানান, তিন ঘণ্টা ধরে তাঁরা রাস্তায়। কাশিমপুর যেতে আরও কত ঘণ্টা লাগবে কেউ জানে না। প্রিজন ভ্যানের ড্রাইভার দরজা খুলে বাতাস পাওয়ার চেষ্টা করছেন। বললেন, কয়েদিদের তো মারা যাওয়ার দশা হয়েছে, স্যার!
শেরাটন থেকে আমি হেঁটে আসি ফুলার রোডে আমার বাসায়। গাড়ি নিয়ে একই পথে আমার ড্রাইভার আসে পাক্কা এক ঘণ্টা
পর! সারা শহরের মানুষ স্মরণকালের এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাসায় ফেরে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাস্তায় জমায়েত হয়েছেন রোববারও। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কে জানে!
আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এই আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না। যানজটের কষ্ট নয়, আমি মর্মাহত হয়ে এই আন্দোলন নিয়ে তাঁর গত কয়েক দিনের অদ্ভুত এবং বিভ্রান্তিকর কথাগুলো নিয়ে ভাবছি। অর্থমন্ত্রীর নানা কথাবার্তায় এটি স্পষ্ট যে, তিনি প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থীর ওপর সম্পূর্ণ নতুন এবং অপ্রত্যাশিত একটি করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন কোনো রকম হোমওয়ার্ক ছাড়া! ভ্যাট আরোপের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি এমন সব কথা বলেছেন, তাতে মনে হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এর শিক্ষার্থী সম্পর্কে বাস্তব ধারণার অভাব রয়েছে।
২.
অর্থমন্ত্রীর কথা শুনলে মনে হয়, তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ভ্যাট আরোপ করেছেন তাঁরা অনেক টাকার মালিক বলে! তাঁর ভাষায়: ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র যারা, আমাদের দেশের অবস্থান বিবেচনায় তারা বিত্তশালী। আমি ৩০টি কলেজের স্টেটমেন্ট নিয়ে হিসাব করে দেখেছি, তাদের দৈনিক খরচ এক হাজার টাকা। মাসে প্রত্যেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে। ৩০ হাজার টাকা যেখানে খরচ করে, সেখানে আমি কত চাচ্ছি? ৭৫ টাকা। সেটা না দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আমি বুঝি না।’
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মাননীয় অর্থমন্ত্রী আপনি কলেজের স্টেটমেন্ট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের খরচ বুঝলেন কীভাবে? আপনি কি আসলে ৩০টি ইউনিভার্সিটির খরচ বুঝিয়েছেন? যদি সেটিও হয়, আপনি ভুল করেছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবও যদি করা হয়, গড়ে ছাত্রদের মাসে ৩০ হাজার টাকা পড়ার খরচ দিতে হয় না, দিতে হয় গড়ে এর অর্ধেকের মতো। সবচেয়ে বড় কথা, ছাত্রদের খরচ ৩০ হাজার হোক আর ১০ হাজার হোক, তাতে কি তাঁরা বিত্তশালী হয়ে যান? বিত্তের মানদণ্ড যদি তা-ই হয়, তাহলে তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা ১৫ টাকা মাসিক বেতনে পড়েন, তাঁদের হতদরিদ্র বলতে হবে! আসলে কি তাই?
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনার কাছে অনুরোধ, বাস্তব অবস্থার খোঁজখবর নিন। জানার চেষ্টা করুন অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দুরবস্থার কথা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের পিতাদের মধ্যে অবস্থাপন্নরা যেমন আছেন, তেমনি আছেন মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিক, পুলিশের দারোগা বা মুদি দোকানদারও। কোনো কোনো শিক্ষার্থী আছেন, যাঁদের তিনটি টিউশনি করে বা আড়ং, মীনাবাজার, নান্দুস্-এ আট ঘণ্টা চাকরি করে নিজের পড়ার খরচের একটি বড় অংশ জোগাড় করতে হয়।
আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অনেক ছাত্রছাত্রী আছেন, যাঁরা আমলা, বড় ব্যবসায়ী বা বড় আইনজীবীর সন্তান। ছাত্র আন্দোলনের ভয় আছে বলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক টাকা বেতন বাড়ানোর সাহস পায় না কোনো সরকার। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে
সেই ভয় নেই মনে করে কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ টাকা বেতনের চেয়ে শত গুণ শুধু ভ্যাট আরোপ করা হলো? এটি করে কি প্রকারান্তরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উসকানি দেওয়া হলো না? রাজপথে আমাদের ভোগান্তির দায় তাহলে কার?
৩.
সম্মানিত অর্থমন্ত্রী, আপনি একবার বলেন ভ্যাট ছাত্রদের দিতে হবে, আরেকবার বলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হবে! সবশেষে আপনি বললেন আন্দোলন হচ্ছে বলে এ বছর ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, কিন্তু সামনের বছর থেকে তা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের! এর মানে কি এটি যে ভ্যাট দেওয়া বা না দেওয়া শিক্ষার্থীর আন্দোলনের ওপর নির্ভরশীল? সামনের বছর বা তার পরের বছরও যদি আন্দোলন হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভ্যাট দেবে, আর আন্দোলন না হলে দেবেন শিক্ষার্থীরা? এটি কি শিক্ষার্থীদের অব্যাহত আন্দোলনে থাকার প্রণোদনা নয়? আপনি আবার এও বলেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেরা ভ্যাট দিয়ে পরে যাতে ছাত্রদের কাছ থেকে আদায় করতে না পারে, সে জন্য ছাত্রদের নজর রাখতে হবে। আপনার কি মনে হয় না ছাত্রদেরকেই এটি করতে হলে আগামী দিনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে?
আমার মূল প্রশ্ন ভ্যাট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই বা দিতে হবে কেন? শিক্ষার ক্ষেত্রে ভ্যাটের প্রশ্ন আসে কীভাবে? ভ্যাট মানে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বুঝি শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা গ্রহণের ওপর কোনো ভ্যাট তাই হতে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত আইনে বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয় হবে অলাভজনক। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান তাহলে ভ্যাট দেবে কেন? এই ভ্যাট তারা যদি বিভিন্ন ফি বাড়িয়ে বা নানা ধরনের নতুন ফি আরোপ করে ছাত্রছাত্রীদের থেকে আদায় করে নেয়, তাহলে তা বন্ধ করবেন কীভাবে?
দেশের কোনো আইনে এসব নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। নতুন আইন করে যদি ছাত্রদের খরচ নির্দিষ্ট করা হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রম এমনকি বর্তমান সুবিধাদি (লাইব্রেরি, ল্যাব, সহশিক্ষা কার্যক্রম) কমিয়ে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষ তা পুষিয়ে নেবে। ভ্যাট আদায়ের জন্য উচ্চশিক্ষাকে এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ছাত্রদের স্বার্থহানি করা কীভাবে সঠিক হতে পারে?
৪.
অর্থমন্ত্রীর কথা শুনলে মনে হতে পারে দেশের অর্থমন্ত্রীর প্রধান কাজ হচ্ছে নির্বিচারে রাজস্ব আরোপ করে সরকারের টাকা বাড়ানো। আসলে কি তাই? সরকার নীলকর আদায়কারী কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। সরকারের বরং অন্যতম কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমুখী আর্থিক ব্যবস্থাপনা। সংবিধান অনুসারে এটি করার ক্ষেত্রেও সরকারকে ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা এবং জনস্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের কাছে অনুরোধ, উন্নয়নের জন্য, দেশ চালানোর জন্য বা অন্য যেকোনো কারণে টাকার প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক লুট করে, বিদেশে পাচার করে বা নানাভাবে দুর্নীতি করে লোপাট করা লাখো–কোটি টাকা আদায়ের চেষ্টা করুন। যাঁরা কয়েক কোটি টাকার ফ্ল্যাট, কয়েক শ কাঠা জমি, কয়েকটি পারিবারিক হলিডে রিসোর্ট করার বা বছরে কয়েকবার বিদেশে শপিং করার মতো অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তাঁদের ওপর অতি উচ্চহারে ট্যাক্স আরোপ করুন। জমি বেচে, মধ্যপ্রাচ্যে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বা ধারদেনা করে সন্তানের উচ্চশিক্ষার খরচ জোগাতে জর্জরিত পরিবারের ওপর শিক্ষা-ভ্যাট আরোপ করার নির্দয় ও অমানবিক চিন্তা পরিত্যাগ করুন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুধু নন, যেকোনো শিক্ষার্থীর ওপর ভ্যাট বা ট্যাক্স আরোপের আগে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে
জানুন। শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তান, আমাদের ভবিষ্যৎ। এঁদের ওপর অন্যায় করা হলে শুধু রাজপথ নয়, গোটা দেশের ভবিষ্যৎই থমকে যেতে পারে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
©somewhere in net ltd.