![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আনিসুল হক | 14-08-2015
10
আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার অনেক কারণ আছে: আনিসুল হক একজন তরুণ এগিয়ে এল আমার দিকে। ‘আমি কি আপনার সঙ্গে ছবি তুলতে পারি?’ আমি বললাম, ‘কী পড়ছ?’ ‘এবার ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম।’ ‘রেজাল্ট কী?’ তরুণটি খুব সংকোচের সঙ্গে বলল, ‘বাংলায় ভালো করিনি তো, তাই গোল্ডেন ফাইভ পাইনি।’ আমি বললাম, তাতে কী হয়েছে?
সবাই তো সবকিছুতে ভালো করবে না। তুমি যে জিপিএ ফাইভ পেয়েছ, এটা তো খুব ভালো ফল। একদম মন খারাপ কোরো না। সে বলল, ‘জিপিএ ফাইভ না পেলে ভালো জায়গায় ভর্তি হওয়া যায় না।’ আমি বললাম, ‘তুমি যাকে ভালো জায়গা বলছ, সেটা তো তোমার জন্য ভালো না-ও হতে পারে। যেখানে ভর্তি হবে, সেখানে ভালোভাবে পড়াশোনা করবে। দেখবে, তোমার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া বন্ধুদের অনেকের চেয়ে তুমি ভালো করছ।’
এবার নাকি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষার ফল-বিপর্যয় ঘটেছে। গণমাধ্যমে এই নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা-বিশ্লেষণ দেখতে পেলাম। নেতা-নেত্রীরা বলছেন, এই বিপর্যয়ের জন্য বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি দায়ী। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস না হওয়ায় এই বিপর্যয়, সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে যশোর বোর্ডে, সেখানে ১০০ জনে ৫৪ জনই ফেল করেছে, কেউ কেউ বলছেন, এক বোর্ডের প্রশ্নপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে অন্য বোর্ড থেকে, একাধিক সেট ছিল যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয়, যশোর বোর্ডের ছেলেমেয়েরা নিজেদের আগের বছরের প্রশ্ন কনসাল্ট করে প্রস্তুতি নিয়েছিল, তাই তারা বিপদে পড়েছে।
আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার অনেক কারণ আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কোনো ছাত্র যদি ভালোভাবে লিখতে ও পড়তে না পারে, সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে না পারে, তাহলে সেটা বেশ দুশ্চিন্তারই কথা। আর শিক্ষার্থীরা যাতে কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউটর ও গাইড বই-নির্ভর না হয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে যাতে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে, এ জন্য সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হলো। গাইড বই ব্যবসায়ীরা এটাকেও ব্যবসার নতুন সুযোগ হিসেবে নিয়েছে—মওকা, মওকা—তারা বলছে, সৃজনশীল পদ্ধতিতে ভালো করতে হলে আমাদের গাইড বইয়ের বিকল্প নেই। আমাকে অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেন, স্কুলের শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান, তিনি সৃজনশীলের উত্তর লিখে দিয়ে বাচ্চাদের মুখস্থ করান, সেটা না লিখে অন্য কিছু লিখে দিলে বাচ্চারা নম্বর কম পায়। শুনে দমে যাই। যশোর বোর্ডের ফল বিপর্যয়ের একটা কারণ নাকি গাইড বই থেকে প্রশ্ন না আসা।
শিক্ষা বিষয় নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, গবেষণা করেন, নীতিনির্ধারণ করেন, সাধারণ অভিভাবকদের কাছ থেকে পাওয়া আমার এই অভিযোগগুলো নিয়ে খানিকটা ভাবতে পারেন। তবে আমার এই লেখা প্রধানত তাদের জন্য, যারা জিপিএ ফাইভ পায়নি, কিংবা যারা ফেল করেছে পরীক্ষায়।
প্রথমে বলে রাখি, ভালো ফল করা ভালো। খুব ভালো ফল করা আরও ভালো। তবে ভালো ফল মানেই যে সেই ছাত্রটি সবচেয়ে বেশি জানে বা জীবনের পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ভালো ফল করাটা আসলে একটা কৌশল, এটার সঙ্গে পরিশ্রমের সম্পর্ক আছে, মেধারও আছে, তবে প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সেন্টার ফল ভালো করার শর্টকাট বুদ্ধি শিখিয়ে দিতে পারে। মানে ‘জিনিসটা আসলে কী’ না বুঝেই একটা বিষয়ে বেশি নম্বর পাওয়া সম্ভব।
অন্যদিকে, খারাপ ফল করলেই জীবন ব্যর্থ হয়ে যায় না। আমি ভাবি, রংপুর জিলা স্কুলে আমাদের ব্যাচে ৮০ জনের মতো ছাত্র ছিল, তাদের কেউ ফার্স্ট হতো, কেউ সেকেন্ড, কেউ টেনেটুনে পাস করত, কেউবা ফেল করত। এখন, পাস করে বেরোনোর ৩৪ বছর পর কে কী করছে। দেখতে পাই, প্রায় সবাই ভালো করছে। যে ফার্স্ট হতো, সে-ও ভালো করছে, যে সেকেন্ড হতো, সে-ও ভালো করছে, যে পাস করতে পারত না, সে-ও ভালো করছে। জীবন কাউকেই খালি হাতে ফেরায় না। মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন, জীবনের সারমর্ম তিনি মাত্র তিনটা শব্দে প্রকাশ করতে পারেন, ‘জীবন চলেই যায়।’ আর আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জীবন হলো একটা বাইসাইকেলের মতো, তুমি যদি পড়ে যেতে না চাও, তোমাকে এটা চালিয়ে যেতে হবে।’
ভালো জায়গায় ভর্তি নিয়ে সদ্যপ্রয়াত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের কাহিনিটা বলে নেওয়া দরকার। তিনি হতে চেয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। ১৯৫৭ সালে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নিয়ে তিনি আসেন দেরাদুনে, পাইলট হওয়ার পরীক্ষা দিতে। তিনি নবম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু পাইলট হিসেবে নেওয়া হবে আটজনকে। তিনি চরম হতাশ হন। এমনকি আত্মহত্যা করার কথাও ভাবছিলেন। এই সময় ঋষিকেশের সাধু স্বামী শিবানন্দের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। স্বামী সব শুনে তাঁকে বলেন, ‘তোমার নিয়তিকে মেনে নাও, জীবনে এগিয়ে যাও। বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়া তোমার নিয়তি নয়। তুমি কী হবে জীবনে, সেটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু এটা পূর্বনির্ধারিত। এই অকৃতকার্যতা ভুলে যাও, কারণ এটার দরকার ছিল তুমি আসলে যা হবে, তা হওয়ার জন্য। এর বদলে তুমি তোমার অস্তিত্বের আসল মানে অন্বেষণ করো। তুমি যা তা-ই হও, সন্তান আমার, ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করো।’ এ পি জে আবদুল কালাম অনেক বড় বিজ্ঞানী হয়েছিলেন, হয়েছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্টও। বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়ার চেয়ে সেটা খারাপ হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটবেলায় ছিলেন প্রবলেম চাইল্ড। একটার পর একটা স্কুলে তাঁকে পাঠানো হচ্ছে, তিনি মন বসাতে পারছেন না। শেষে তাঁকে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত পাঠানো হলো, তিনি ব্যারিস্টারি পড়লেন না। আইনস্টাইন কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। কাজেই পরীক্ষার ফলের সঙ্গে জীবনের সাফল্যের সম্পর্ক সবক্ষেত্রে নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আছে। আমাদের ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র জাহিদ হাসান, যিনি আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক গবেষক দলের নেতৃত্ব দিয়ে সেই ভরহীন কণা খুঁজে পেয়েছেন, ৮৫ বছর আগে যাঁর কথা তত্ত্বীয়ভাবে বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, সেই জাহিদ হাসান ঢাকা বোর্ডে ফার্স্ট স্ট্যান্ড করেছিলেন। কাজেই আমি বলব, ভালো রেজাল্ট করা ভালো, তার চেয়েও বড় কথা, জিনিসটা ঠিকভাবে বোঝা, হৃদয়ঙ্গম করা, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করা, নিজের মধ্যে মানবিক গুণাবলি ও নেতৃত্বের গুণ প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের যেমন বিজ্ঞানী লাগবে, আমাদের তেমনি ভাবুক দার্শনিক লাগবে, আমাদের যেমন অর্থনীতিবিদ লাগবে, তেমনি আমাদের লাগবে উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে, এদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের মেধা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেসব দেশে বড় উদ্যোক্তা হচ্ছেন, তাঁদের অধীনেই দেশ-বিদেশের কত মানুষ কাজ করছে। অন্যদিকে, আমাদের যে ভাইবোনেরা বিভিন্ন দেশে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, দেশে পাঠাচ্ছেন রেমিট্যান্স, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন, কখনো কখনো শিকার হচ্ছেন বৈষম্যের, প্রতারণার, নিপীড়নের; শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাঁদের করে তুলতে পারে দক্ষ শ্রমিক, তাঁরা তখন টেকনিশিয়ান হিসেবে লাভ করবেন উচ্চতর অবস্থান ও বেতন।
আর শিক্ষার্থীরা যা হতে চায়, তা-ই তাদের হতে দেওয়া উচিত; যা পড়তে চায়, তা-ই তাকে পড়তে দেওয়া উচিত। আমরা জানি, সাকিব আল হাসানের বাবা ছোটবেলায় সাকিবের ক্রিকেট ব্যাট কেটে ফেলেছিলেন, এই আশঙ্কায়, বড় হয়ে ছেলে না আবার ক্রিকেটার হয়ে যায়। আমাদের সাতক্ষীরার মুস্তাফিজ। ছেলে শুধু খেলতে ছুটে যায় মাঠে। ক্লাস সিক্সে যখন সে পড়ে, তার বাবা তার জন্য চারজন গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছিলেন, ছেলেকে পড়ার টেবিলে আটকে রাখতে। তবু ছেলে ছুটে ছুটে যায় মাঠে। ৪০ কিলোমিটার দূরের সাতক্ষীরার সুন্দরবন ক্রিকেট একাডেমিতে তাকে নিয়ে যেতেন তার সেজ ভাই, সেই মুস্তাফিজ আজ ক্রিকেটের বিশ্ব রেকর্ড বইয়ে।
পরীক্ষার ফল ভালো হোক আর না হোক, হতাশ হলে চলবে না। জীবনের সাইকেল প্যাডেল মেরে চালিয়ে যেতেই হবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকের জন্য অপেক্ষা করছে সাফল্যের সোনার মেডেল। তাই বলে শিক্ষার্থীরা পড়বে না বা ক্লাসে শিক্ষকেরা পড়াবেন না, তা হবে না। পড়াশোনা ঠিকভাবে করতে হবে। পাওলো কোয়েলহোর আলকেমিস্ট বইয়ে একটা গল্প আছে। এক বাবা তাঁর ছেলেকে পাঠিয়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির প্রাসাদে উপদেশের জন্য। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, আমি তোমাকে উপদেশ দেব, তার আগে তুমি পুরো বাড়ি ঘুরে দেখো, তোমাকে একটা চামচ দিচ্ছি, চামচে তেল ভরে দিলাম, তুমি বাড়িটা ঘুরবে, কিন্তু তোমার চামচ থেকে যেন তেল পড়ে না যায়। ছেলেটি পুরো বাড়ি ঘুরে এল, সদাসতর্ক, চামচের তেল সে পড়তে দেয়নি। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, পাশের ঘরে কী আছে। ছেলেটি বলতে পারল না। কারণ সে চামচের দিকে তাকিয়ে ছিল। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, তুমি আবার যাও, চামচে তেলও থাকবে, আবার কোথায় কী আছে, দেখে আসবে। ছেলেটি আবার ঘুরল, ফিরে এসে বলল, এবার আমি বলতে পারব, কোন ঘরে কী আছে। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, তোমার চামচের তেল কোথায়। দেখা গেল, পড়ে গেছে। জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, এটাই তোমার প্রতি আমার উপদেশ। আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখার দেখব, শেখার শিখব, আনন্দ করার করব, কিন্তু চামচ থেকে যেন তেল পড়ে না যায়।
শিক্ষার্থীরাও সবকিছু করবে, তারা বই পড়বে, খেলবে, সংস্কৃতি চর্চা করবে, বেড়াবে, হইহুল্লোড় করবে, কিন্তু পরীক্ষার পড়াটাও ঠিকঠাক করবে। তবে লেখাটা শেষ করতে চাই বিল গেটসের উক্তি বলে প্রচারিত একটা কথা দিয়ে। বিল গেটস নাকি বলেছেন, ‘আমি হার্ভার্ডে পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে ফেল করেছিলাম, আমার এক বন্ধু সব সাবজেক্টে সেরা নম্বর পেয়েছিল, সে এখন আমার প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি করে।’
তবে বিল গেটস এ-ও বলেছেন, তিনি ছোটবেলা থেকেই বই পড়তেন, বিচিত্র বই, এখনো তাঁর ঘরে, তাঁর টেবিলে, ট্রেনে, প্লেনে যেখানেই থাকেন না কেন, তাঁর হাতে থাকে বই। তাঁর উক্তি: ‘আই রিয়েলি হ্যাড আ লট অব ড্রিমস হোয়েন আই ওয়াজ আ কিড, অ্যান্ড আই থিংক আ গ্রেট ডিল অব দ্যাট গ্রিউ আউট অব দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট আই হ্যাড আ চান্স টু রিড আ লট।’
যারা ফল খারাপ করেছ, তারা হতাশ হয়ো না, আবার চেষ্টা করো এবং জেনে রেখো, রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন থেকে শুরু করে শচীন টেন্ডুলকার বা মেসি—কেউই ভালো ফলের জন্য বিখ্যাত হননি, ভালো কাজ করেছেন বলেই তাঁরা প্রাতঃস্মরণীয়। ফল যা-ই হোক না কেন, তোমরা ভালো কাজ করার চেষ্টা করো। প্রতিভা আর কিছুই না, কোনো কাজ খুব মন দিয়ে সাধনার মাধ্যমে করার ক্ষমতা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
©somewhere in net ltd.