নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
১.
কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ আপিল বিভাগ অপরিবর্তিত রাখলে, তা রিভিউ করা যাবে কি-যাবে না এমন বিতর্ক শুরু হয় গত ১০ তারিখ ফাঁসির সময় ঘোষণার পর থেকেই। এক পর্যায়ে, রাত সাড়ে দশটায় মাননীয় চেম্বার জজের আদেশে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যায়। কাদের মোল্লার আইনজীবীরা, যারা, ট্রাইবুনালে মামলার শুনানি চলাকালে নিজেদের ডাকা হরতালে নিরাপত্তার কথা বলে, দিনের পর দিন অনুপস্থিত থেকে, মামলাকে বিলম্বিত করার সুযোগ নিয়েছে; তারা, সেই নিজেদের ডাকা হরতাল-সহিংসতায় গত দুদিন দৌড়ঝাঁপ করেছে ষাড়ের মতো। কিন্তু তাদের বৈধ-অবৈধ সকল চেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে, রিভিউ আবেদনটি যথোপযুক্ত আইনি প্রক্রিয়ায় খারিজ হয়ে যাওয়ায়। বড় একটি জটিলতা-বিভ্রান্তিরও নিরসন হয়ে গেছে এর ফলে : আপিল বিভাগের রায়, অন্তত এ-ক্ষেত্রে, পুনর্বিবেচনার আওতায় আসবে না আর। এ-জাতীয় বিষয়ে আইনগত জটিলতা নিরসনের একটি শক্ত অভিজ্ঞতাও হয়ে গেলো আমাদের আইনি-প্রশাসনের। সামান্য অস্পষ্টতা জিইয়ে রেখেও রায় কার্যকর করার চেষ্টা যে সরকার বা সংশ্লিষ্টরা করেননি সেজন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। আমরা জানি; স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমরা, নিজেদের সাংবিধানিক অধিকারে প্রতিষ্ঠিত একটি আইনে এমন কিছু অপরাধীর বিচার করছি, যারা, ১৯৭১-এ সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে সংজ্ঞায়িত ও সুনির্দিষ্ট ঘৃণ্যতম কিছু অপরাধ করেছিল। এমন অপরাধীদেরও, সভ্য-জগতে-বিদ্যমান সর্বোচ্চ আইনি সুবিধা দিয়ে বিচার করার গর্ব জাতি হিসেবে আমরা করতে পারি। সামান্যতম মানবতা-দয়া-দাক্ষিণ্যের তোয়াক্কা না করে, এ-সব অপরাধী একটি সুসজ্জিত, নিয়মিত বাহিনীর প্রত্যক্ষ ছায়াতলে থেকে দিনের পর দিন খুন-ধর্ষণ-গণহত্যা-লুঠপাট-অগ্নিসংযোগের মত অপরাধ চালিয়েছিল।
এ-বিচার কাজ কখনোই নিষ্কণ্টক ছিল না। এখনও নেই। দেশি-বিদেশি চাপ ও ষড়যন্ত্র; যা ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকেই শুরু ও জোরদার হয়েছে; যা অব্যাহত আছে এখনও । কেবল কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়ে যাবার পর তা গুটিয়ে যাবে, এমন ভাবার কারণ নেই। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বৃটিশ রাজনীতিক ব্যারনেস সাইয়েদা হুসেইন ওয়ার্সি আজ এসেছেন এসব বিষয়ে তদ্বির চালাতে। গত কয়েকদিনে জাতিসংঘ মহাসচিব, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের হাই কমিশনার বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার; বাংলাদেশে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ইত্যাদি নানা বাহানায় অব্যাহতভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। যা মূলত ছিলো জাতি হিসেবে এ-দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর চাপ। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হলে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে যাবার হুমকি দিয়েছেন জন কেরি। একজন কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিলে প্রতিক্রিয়ায় কতজন সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হবে, এমন প্রশ্ন তুলেছেন জামায়াতের অর্থপুষ্ট লবিস্ট ও বৃটিশ আইনজীবী ডেভিড বার্গম্যান। এমন আরও অনেক সরাসরি কূটনৈতিক চাপের মুখোমুখি সরকারকে হতে হয়েছে সন্দেহ নেই।
২.
আমরা না-কি এখন গভীর খাদের কিনারে। তার মানে, সামনে আমাদের গভীর পতন। ঘাটে-মাঠে-বাজারে, ময়দানে-কাফেলায়, তারে-বেতারে এমন কথা বলে কিছু মানুষ আনন্দিত হচ্ছে। এমন কথা শুনে কিছু মানুষ উৎসাহিত হচ্ছে। আর, এমন কিছু কথা বাজারজাত করে কিছু মানুষ ভয় দেখাচ্ছে : বাংলাদেশ গণতন্ত্রের মরেুদন্ড ভেঙে ফেলছে। বাংলাদেশ বন্ধুহীন জাতিতে পরিণত হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মহামান্য দাতা-ছাতাগণ। বাংলাদেশ মানবাধিকার লঙ্গনের কারখানা হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন সম্মানিত বিনিয়োগকারীগণ। মধ্যপ্রাচ্যের সুবিশাল শ্রমবাজার হারাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু, এই ভয়গুলো আমাদের গত তিন, সাড়ে তিন বছর ধরে কোনো সাম্প্রদায়িক, উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী দেখায়নি। তাদের মুখে আমরা কখনো শুনিনি এ-সব কথা। তারা একটা ভয়ই শুধু আমাদের দেখিয়ে এসেছে : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে, বাংলাদেশ অচল করে দেয়া হবে। উগ্র মৌলবাদীরা আমাদের এ-ভয়ই দেখিয়েছে শুধু। বিচ্ছিন্ন জাতিতে পরিণত হওয়া; কিংবা, আন্তর্জাতিকভাবে এক বিশাল অর্থনৈতিক-সামাজিক অবরুদ্ধতার গর্তে পড়ে যাবার ভয় আমাদের দেখিয়েছে আসলে কারা ?
আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। এথেন্স একদা পর্যায়ক্রমে শাসন করেছিলো গণতন্ত্র আর কতিপয়তন্ত্র ভাগাভাগি করে – কথিত স্বর্ণযুগের পতনের পর। সে-একই আকালের কবলে পড়তে আমাদের বাধ্য করেছিল দীর্ঘ সেনাশাসন। সেনা-স্বৈরাচারের শাসন থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যে আমরা গণতন্ত্রের বাজারের যুগেও আড়াই হাজার বছরের পুরোনো রীতি টেনে এনেছি। পাঁচ বছর গণতন্ত্র। কিছুদিন কতিপয়। আবার গণতন্ত্র, আবার কতিপয়। বাংলাদেশের সাংবিধানিক-গণতান্ত্রিক ধারার ফাঁকে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে গজিয়ে ওঠা এই কতিপয়বাদই আমাদের আসল বিপদ। বিশেষত ২০০৭-০৮ আটের কতিপয় তন্ত্রকালে আমরা দেখলাম, ঐ-সোনার খাাঁচাটি আমাদের কাল হয়ে গেছে। একটি জাতির দীর্ঘচর্চায় গড়ে ওঠা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অর্জনগুলোকে অর্থ কিংবা ক্ষমতায় কিনে ফেলা যায় না। বলে, ছলে, কলে দশজন ব্যক্তিকে পকেটে টেনে তোলা কী-আর কঠিন ? কিংবা রাষ্ট্রকে চাপে ফেলে পকেটের দশ ব্যক্তিকে ঐ-ফাঁকে ঠেসে দেয়া ? এ-এক বিশাল ছিদ্র আন্তর্জাতিক ক্ষমতার চালবাজদের জন্যে। আর, এ-এক বিশাল সুযোগ এদেশের কিছু ক্ষমতাবিলাসী নাগরিকের রাষ্ট্র-ক্ষমতার মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে ওঠার। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণী অধ্যাপক, তুখোড় সাংবাদিক; পরাজিত রাজনীতিক; উন্নয়ন মডিউলার; আইনজীবী; আমলা বা অবসরগ্রস্ত সেনাপতি কিংবা বিপনিবাজ : যাদের নেই গণসম্পৃক্তি; যাদের নেই গণলগ্ন হয়ে সংগঠিত হবার ক্ষমতা; যাদের নেই ব্যাপক জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে জনতাকে নেতৃত্ব দেবার আকাঙ্খা এদেরই কেউ কেউ ঐ-মধ্যস্বত্বভোগী হবার নির্লজ্জ বাসনায় তাড়িত হয়ে পড়েছে।
আমরা লক্ষ করি, অনেক সুন্দর কথার আড়ালে, এই কতিপয়বাদীরাই গত তিন বছর ধরে, আমাদের নানা রঙের ভয় দেখিয়ে এসেছে। এই কতিপয়বাদীরাই একটি জঙ্গি সংগঠনের মানবাধিকার দাবিতে জঙ্গিবিরোধী (জঙ্গিজন্মদাতা) আন্তর্জাতিক মোড়লদের ডেকে নিয়ে এসেছে বারবার। এই কতিপয়বাদীরাই, বিস্ময়করভাবে নির্বাচন আর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে এক করে তুলেছে। এ-দেরই সরাসরি, স্পষ্ট মদদে-সমর্থনে এমন প্রশ্নও উঠতে পারছে এখানে : ৪০ বছরের পুরোনো ব্যাপারকে টেনে এনে জাতিকে দ্বখিন্ডতি করার প্রয়োজন আছে কি-না ! সারা বাংলাদেশ ক্রমশ হিংস্র, ভয়ঙ্কর মৌলবাদী নাশকতার কবলে যেতে থাকলেও, এরাই আমাদের বলেন : অস্থিতিশীলতার জন্যে সরকারই দায়ী। এ-কতিপয়দের, এবার, সাহস করে চেনার ও মেকাবেলার দায় রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এদের কাছেই, দেশের সম্মান-সার্বভৌমত্বের চেয়ে জঙ্গি-জামাতি গণতন্ত্র বেশি জরুরি।
৩.
চলমান সরকার, শিক্ষায়-চিকিৎসায়-কৃষিতে-অর্থনীতিতে; সমুদ্র বিজয়ে; ওই-সব পন্ডিতি এমডিজি-টিজিতে; কী-সব ইমেজিং-টিমেজিং করেছে কি-না আমরা জানি না। এর চেয়ে আরও ভালোভাবে জীবিত কোনো রাজনৈতিক দল-জোটের পক্ষে দেশকে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা আছে কি-না তাও জানি না আমরা। সদিচ্ছায় কি অনিচ্ছায়, যে-কারণেই হোক; দেশি-বিদেশি এক শক্তিশালী চক্রান্তজাল ছিঁড়ে একাত্তরের ঘৃণ্য মানবতাবিরোধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। রায় দিয়েছে একের পর এক। এবং ফাঁসিও। আমরা, ঐ-কতিপয়বাদী কথিত একটি ব্যর্থ সরকারের সক্ষমতা টের পেলাম। এ-সক্ষমতা আমাদের অহংকারী করেছে। এমন অহংকারে ফুটে ওঠে একটি জাতির সার্বভৌমত্বের শক্তি। বাংলাদেশ সার্বভৌম থাকুক। যত কুশীলবই চেষ্টা করুক জাতিকে ভয় পাইয়ে দিতে। এ-জাতি ভয় পায় না। এ-জাতির মূলভূমিকার তারুণ্য কখনোই স্বদেশ ভোলে না।
এমন ডাক কে আর শোনাতে পারে : বাংলা জেগে থাকে। বাংলা ঘুমায় না। আমার মাটি আমার মা, বাংলা আমি ছাড়বো না।
সুত্র
©somewhere in net ltd.