নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
বাংলাদেশে সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শ্রমজীবী ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। এসব দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের পিতা-মাতাই অশিক্ষিত ও অসচেতন। ফলে শিশুর শিক্ষাগ্রহণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু বিদ্যালয়নির্ভর। এসব শিশু শিক্ষার্থী খেয়ে-না খেয়ে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। এতে শিশু শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সুষ্ঠুভাবে পাঠগ্রহণ ও বিকাশ লাভ করতে পারে না। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় (সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা) ধরে পাঠগ্রহণ তাদের মানসিক দিক থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছয় থেকে ১১ বছরের শিশুরা এই দীর্ঘ সময়ের পাঠগ্রহণে কতটুকু মনোযোগী হতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির আশঙ্কাও থেকে যায় যথেষ্ট। এ ছাড়া অনেক বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে স্থানসংকুলান ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা অসহনীয় দুর্ভোগে পড়ে। আবার কিছু বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় বিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। ফলে তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারে না। যদি শিশু সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবে সঠিকভাবে যেকোনো বিষয়ে ভালো ধারণা কিংবা জ্ঞান লাভ করতে না পারে, তবে সে জীবনের পরবর্তী ধাপে বিষয়গুলোকে সহজভাবে প্রয়োগ করতে পারে না। একজন শিশু শিক্ষার্থী যখন কোনো বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে, তখনই সে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করার সুযোগও লাভ করতে পারে। তাই শিশুর শিক্ষাগ্রহণ এমন হওয়া উচিত, যাতে পরবর্তী জীবনে ওই শিক্ষাকে তার ভবিষ্যতের পাথেয় হিসেবে গণ্য করার সুযোগ পায়।
প্রাথমিক শিক্ষার মান এবং শিক্ষকের মর্যাদা
৯ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে 'প্রাথমিকে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভালোভাবে শিখছে না' শিরোনামে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর মানোন্নয়নে অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হলো শিক্ষকের মানোন্নয়ন। শিক্ষকের মান ভালো না হলে শিক্ষার্থীকে ভালো শেখানো সম্ভব নয়। একজন দক্ষ শিক্ষকের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে শিক্ষার্থীর মানসম্মত পাঠগ্রহণ ও শিক্ষার গুণগত মান। আমরা জানি, প্রতিবেশী দেশগুলোতে শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নের অন্যতম দিক হিসেবে শিক্ষকের মানোন্নয়নের কথা চিন্তা করা হয়। সঙ্গে যথাযথ ও উপযুক্ত পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য উন্নত দেশের কথা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মানে হতদরিদ্র-সুবিধাবঞ্চিত এক পেশাজীবী শ্রেণী। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোটা অনুযায়ী ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো শিশুর মাতা। এসব শিক্ষকের বেশির ভাগেরই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয়। ফলে শিক্ষকও যথাযথ মনোযোগী হতে পারেন না।
এ ছাড়া আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান। এখানে মাধ্যমিক পাস থেকে শুরু করে মাস্টার্স যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ন্যস্ত। কর্তৃপক্ষ হয়তো মনে করতে পারে, একজন মাধ্যমিক পাস শিক্ষকই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য উপযুক্ত কিংবা যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের দক্ষতার কথা কোনোভাবেই বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু একজন শিক্ষক যদি দক্ষ না হন তাহলে কোনোভাবেই ওই শিক্ষক দক্ষ জনশক্তি গড়তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভূমিকা রাখতে পারবেন না। কাজেই শিক্ষাকাঠামোর অন্যতম উপাদান 'শিক্ষক নিয়োগ' ও 'শিক্ষকের বেতন কাঠামোর' ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে আরো সচেতন হওয়া দরকার।
ইতিমধ্যেই সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করেছে। পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকদের বেতনও বাড়ানো হয়েছে। সরকারের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। গণমাধ্যমে এ খবর শুনে আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি অবাকও হলাম। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদটি বাংলাদেশ স্বাধীনতালাভের ৪৩ বছর পরও তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিল। সংগত কারণেই প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা তৃতীয় শ্রেণী থাকলে সহকারী শিক্ষকের পদমর্যাদা চতুর্থ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখনো সহকারী শিক্ষকদের মর্যাদা তৃতীয় শ্রেণী নাকি চতুর্থ শ্রেণী, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। যেকোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষার মানোন্নয়নে নানা ধরনের অঙ্গীকার দিয়ে থাকে। কিন্তু তারা সরকার গঠন করতে পারলেও তা বাস্তবায়নে গড়িমসি করে। এ কথা আমরা সবাই জানি, একটি জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত সে জাতির শিক্ষা কাঠামোর উন্নয়ন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষার কাঠামোগত উন্নয়নে নানাবিধ ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণও ছিল সরকারের অন্যতম একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। যখন 'দিনবদলের সনদ' নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, তখনো শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিবেচনায় 'শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন' কাঠামোর প্রতিশ্রুতি ছিল। বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও একই প্রতিশ্রুতি বহাল আছে।
সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর হলো শিক্ষক। সেটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হোক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হোক। সবার মর্যাদা একই পাল্লায় মাপা দরকার। আর সেই পাল্লাটি হলো 'শিক্ষক মর্যাদা'র পাল্লা। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যেকোনো পর্যায়ের শিক্ষকই হোক, তাঁদের মর্যাদা অন্য যেকোনো পেশার তুলনায় আলাদা। শুধু বেতন আর পদমর্যাদাই বড় কথা নয়, এর জন্য দরকার উপযুক্ত সম্মান। একজন প্রধান শিক্ষককে দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদায় উন্নীত করে একদিকে যেমন তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে, অন্যদিকে একটি শ্রেণী কাঠামোর মধ্যে ফেলে শিক্ষককে মর্যাদাগত দিক থেকে খাটো করা হয়েছে।
অতএব প্রাথমিক শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে পারলে সমগ্র শিক্ষা কাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর শক্তিশালী করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়-সময়সূচি নিয়েও কর্তৃপক্ষের আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। শুধু পদমর্যাদা বৃদ্ধি কিংবা নামমাত্র বেতন বৃদ্ধি করে শিক্ষকদের সন্তুষ্ট করার প্রবণতা থেকে বের হয়ে এসে গোটা ব্যবস্থারই একটি পরিবর্তন আবশ্যক। এমনকি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক থেকে মাস্টার্স যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে কিছুটা ভিন্নতা আনা দরকার। এ প্রক্রিয়ায় দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের মূল্যায়ন করা সহজ হবে। অন্যান্য চাকরিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ফলাফল বিবেচনায় বেতন ইনক্রিমেন্ট বা সুবিধা দেওয়া হয়, যা প্রাথমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নেই। কাজেই বিদ্যালয়ের সময়সূচি, শিক্ষকের বেতন, দক্ষতা ও মর্যাদাগত দিক থেকে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আনা দরকার। এতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করি। সুত্র
©somewhere in net ltd.