নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কবি হাসান হাফিজুর রহমান যে ১৪ খণ্ড স্বাধীনতার দলিল সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন, সেখানে লেখা আছে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব প্রস্তুতকৃত স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার পরে ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই বাণী অবলম্বনে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান বেলা ২টার দিকে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এরপর ২৭ মার্চ জনাব জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সে ঘোষণায় জিয়া বঙ্গবন্ধুকে জাতির মহান নেতা বলেন। বলেন যে, বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করেছেন এবং তার সরকারই বৈধ সরকার। জনগণই প্রথম স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন অনির্দিষ্টকালের জন্য পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করে তখন বাংলাদেশের জনগণ ক্রুদ্ধ, সংগ্রামী আবেগে রাজপথে নেমে স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে ব্যস্ত ছিলেন। জনগণ জলস্রোতের মতো হোটেল পূর্বানীর সামনে উপস্থিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শোনার জন্য। উপস্থিত উত্তাল জনগণকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা বিষয়টি দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রেরই ফসল। ...এ বেইনসাফীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলবে, তার পরিণতি যা-ই হোক না কেন। ষড়যন্ত্র যদি আরো চলে, তাহলে বাংলাদেশ নিজ প্রশ্নের মীমাংসা করে নেবে।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে বলবো।’ (ড. মোহাম্মদ হান্নান-বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস - পৃ: ২৫১-৫২)। এ সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ পলটন ময়দানে জমায়েত হতে থাকে। নেতৃত্ব দিচ্ছিল ছাত্রলীগ। এই সমাবেশে উনসত্তরের গণঅভ্যত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘আর ৬ দফা, ১১ দফা নয়, এবার বাংলার মানুষের ১ দফা হচ্ছে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব।’ (ঐ- পৃ: ২৫২)। আরেকটি বক্তৃতায় অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বাঙালি গণতন্ত্র চেয়েছিল, কিন্তু পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী তা দেয়নি। বাঙালিরা এবার তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করবে।’ (ঐ)। এ কথা অনুধাবন করতে হবে যে, জাতীয় অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জনগণ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় নামে। তাদের চেতনার শাণিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। এ সময় তারা জিন্নাহর ছবি পুড়িয়েছে, আইয়ুব, ইয়াহিয়া, ভুট্টোর গলায় জুতার মালা পরিয়েছে। স্লোগান দিয়েছে, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ এ কথাও স্মরণে রাখতে হবে যে, জনগণের আবেগ ও আন্দোলন দমন করার জন্য বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কাখানকে আনা হয়েছিল। ২৬ মার্চ দুপুরে টিক্কা খান ঢাকা বেতারে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘৭০ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে আমি মাটিতে পরিণত করবো, আমি মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ টিক্কাখানকে জনগণের আন্দোলনের ভয়ে বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী শপথ পড়াননি, এটাও স্বাধীনতার একটি ধাপ। স্বাধীনতার দাবিতে ক্রুদ্ধ স্লোগানরত, উত্তাল জনগণের ওপর পাক সামরিক বাহিনী গুলিবর্ষণ করে বাঙালিদের হতাহত করতে থাকে ১ মার্চ থেকেই। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেন, ‘আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’ পয়লা মার্চেই বঙ্গবন্ধু এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন যা ২ মার্চ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। সেখানে কৌশলে শব্দ চয়ন করে বলেন, ‘বাঙালিরা আর নির্যাতিত হতে চায় না। তারা একটি স্বাধীনদেশের স্বাধীন নাগরিক হতে চায়।’ এ আকাঙ্ক্ষা তিনি ২৫ মার্চ পর্যন্ত বারবার ব্যক্ত করেছেন। এ সময় তিনি ছাত্রলীগকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে বলেন এবং তা গঠিত হয় ১ মার্চ বিকাল ৩টায়। এই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগ নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। ‘এই সভায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের কাঠামো ও রূপের বিশদ আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের সভায় ‘স্বাধীনতার প্রস্তাব’ পাঠ করা হবে।’ (ড. মোহাম্মদ হান্নান- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- পৃ: ২৫৮)। এ দিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন ও উত্তোলন করা হয়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের বিশাল এক জনসভা হয়। প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন, বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো।’ এটাও এক ধরনের স্বাধীনতার ঘোষণা। এই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করে বলেন, ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে। ৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশে’। স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা’ জ্ঞাপন করা হয়। এর পরই রাজপথে স্লোগান ওঠে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ প্রবীণ সাংবাদিক এবি এম মূসা দাবি করেছেন, ‘কারও কারও মতে ২৬ মার্চ নয়, সেদিন রেসকোর্স ময়দান থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর পক্ষে প্রায়ই উদ্ধৃত হয় সেই দুটি তাত্পর্যপূর্ণ বাক্য, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘জনতার শেখ সাব যে সংগ্রামের কথা বলেছেন, তা কি আন্দোলন, বিদ্রোহ-বিপ্লব, স্বাধীনতার ঘোষণা? ... ৭ মার্চের ভাষণ শুধু একটি ঘোষণা নয়, ছিল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা।’ (মুজিব ভাই- পৃ: ৬৬-৬৭)। এবার ২৬ মার্চের মূল ঘোষণার দিনটি বিশ্লেষণে যাচ্ছি। স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু নিয়েই রেখেছিলেন। তিনি নিজেই বুয়েটের এক প্রকৌশলীকে দিয়ে বেতারে ঘোষণা টেপ করিয়ে রেখেছিলেন। ২৫ মার্চ রাত ১২টার পরে ইপিআরের এক জওয়ান ঢাকা বলদা গার্ডেন থেকে টেপটি বাজিয়ে শোনান। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে বঙ্গবন্ধু তাকে টেপটি ফেলে দিয়ে পালাতে বলেন। বলদা গার্ডেনের পুকুরের মধ্যে টেপটি ফেলে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কণ্ঠস্বর শুনে পাকবাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে আসে। পাকিস্তানি আর্মির জনসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালিক বলেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।’ (নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল- পৃ: ৮৫)। বঙ্গবন্ধু গবেষক আবদুল মতিন তার বইতে উল্লেখ করেছেন: ‘স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত মার্কিন দলিল। দি গভর্নমেন্ট অব ইউএসএ ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি। অপারেশনাল ইনটেলিজেন্স ডিভিশন। হোয়াইট হাউস সিচুয়েশান রুম। তারিখ : ২৬ মার্চ, ১৯৭১। বিষয় : পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ, রেফারেন্স : ১. আজ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক দুই অঞ্চল বিশিষ্ট দেশের পূর্বাঞ্চলকে ‘সার্বভৌম স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা দান করার পর পাকিস্তান গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল- পৃ: ১৩)। ইতিহাস লঙ্ঘন করার শক্তি কারো নেই। লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক
27-03-2014 স্বাধীনতা: চার দশক পর মাহমুদুল বাসার দৈনিক বর্তমান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কবি হাসান হাফিজুর রহমান যে ১৪ খণ্ড স্বাধীনতার দলিল সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন, সেখানে লেখা আছে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব প্রস্তুতকৃত স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার পরে ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই বাণী অবলম্বনে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান বেলা ২টার দিকে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এরপর ২৭ মার্চ জনাব জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সে ঘোষণায় জিয়া বঙ্গবন্ধুকে জাতির মহান নেতা বলেন। বলেন যে, বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করেছেন এবং তার সরকারই বৈধ সরকার। জনগণই প্রথম স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন অনির্দিষ্টকালের জন্য পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করে তখন বাংলাদেশের জনগণ ক্রুদ্ধ, সংগ্রামী আবেগে রাজপথে নেমে স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে ব্যস্ত ছিলেন। জনগণ জলস্রোতের মতো হোটেল পূর্বানীর সামনে উপস্থিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শোনার জন্য। উপস্থিত উত্তাল জনগণকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা বিষয়টি দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রেরই ফসল। ...এ বেইনসাফীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলবে, তার পরিণতি যা-ই হোক না কেন। ষড়যন্ত্র যদি আরো চলে, তাহলে বাংলাদেশ নিজ প্রশ্নের মীমাংসা করে নেবে।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে বলবো।’ (ড. মোহাম্মদ হান্নান-বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস - পৃ: ২৫১-৫২)। এ সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ পলটন ময়দানে জমায়েত হতে থাকে। নেতৃত্ব দিচ্ছিল ছাত্রলীগ। এই সমাবেশে উনসত্তরের গণঅভ্যত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘আর ৬ দফা, ১১ দফা নয়, এবার বাংলার মানুষের ১ দফা হচ্ছে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব।’ (ঐ- পৃ: ২৫২)। আরেকটি বক্তৃতায় অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বাঙালি গণতন্ত্র চেয়েছিল, কিন্তু পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী তা দেয়নি। বাঙালিরা এবার তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করবে।’ (ঐ)। এ কথা অনুধাবন করতে হবে যে, জাতীয় অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জনগণ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় নামে। তাদের চেতনার শাণিত বহিঃপ্রকাশ ঘটে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। এ সময় তারা জিন্নাহর ছবি পুড়িয়েছে, আইয়ুব, ইয়াহিয়া, ভুট্টোর গলায় জুতার মালা পরিয়েছে। স্লোগান দিয়েছে, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ এ কথাও স্মরণে রাখতে হবে যে, জনগণের আবেগ ও আন্দোলন দমন করার জন্য বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কাখানকে আনা হয়েছিল। ২৬ মার্চ দুপুরে টিক্কা খান ঢাকা বেতারে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘৭০ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে আমি মাটিতে পরিণত করবো, আমি মাটি চাই, মানুষ চাই না।’ টিক্কাখানকে জনগণের আন্দোলনের ভয়ে বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী শপথ পড়াননি, এটাও স্বাধীনতার একটি ধাপ। স্বাধীনতার দাবিতে ক্রুদ্ধ স্লোগানরত, উত্তাল জনগণের ওপর পাক সামরিক বাহিনী গুলিবর্ষণ করে বাঙালিদের হতাহত করতে থাকে ১ মার্চ থেকেই। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেন, ‘আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’ পয়লা মার্চেই বঙ্গবন্ধু এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন যা ২ মার্চ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। সেখানে কৌশলে শব্দ চয়ন করে বলেন, ‘বাঙালিরা আর নির্যাতিত হতে চায় না। তারা একটি স্বাধীনদেশের স্বাধীন নাগরিক হতে চায়।’ এ আকাঙ্ক্ষা তিনি ২৫ মার্চ পর্যন্ত বারবার ব্যক্ত করেছেন। এ সময় তিনি ছাত্রলীগকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে বলেন এবং তা গঠিত হয় ১ মার্চ বিকাল ৩টায়। এই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগ নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। ‘এই সভায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা এবং জাতীয় সংগীতের কাঠামো ও রূপের বিশদ আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের সভায় ‘স্বাধীনতার প্রস্তাব’ পাঠ করা হবে।’ (ড. মোহাম্মদ হান্নান- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- পৃ: ২৫৮)। এ দিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন ও উত্তোলন করা হয়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের বিশাল এক জনসভা হয়। প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন, বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবো।’ এটাও এক ধরনের স্বাধীনতার ঘোষণা। এই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করে বলেন, ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে। ৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশে’। স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা’ জ্ঞাপন করা হয়। এর পরই রাজপথে স্লোগান ওঠে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ প্রবীণ সাংবাদিক এবি এম মূসা দাবি করেছেন, ‘কারও কারও মতে ২৬ মার্চ নয়, সেদিন রেসকোর্স ময়দান থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর পক্ষে প্রায়ই উদ্ধৃত হয় সেই দুটি তাত্পর্যপূর্ণ বাক্য, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘জনতার শেখ সাব যে সংগ্রামের কথা বলেছেন, তা কি আন্দোলন, বিদ্রোহ-বিপ্লব, স্বাধীনতার ঘোষণা? ... ৭ মার্চের ভাষণ শুধু একটি ঘোষণা নয়, ছিল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা।’ (মুজিব ভাই- পৃ: ৬৬-৬৭)। এবার ২৬ মার্চের মূল ঘোষণার দিনটি বিশ্লেষণে যাচ্ছি। স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু নিয়েই রেখেছিলেন। তিনি নিজেই বুয়েটের এক প্রকৌশলীকে দিয়ে বেতারে ঘোষণা টেপ করিয়ে রেখেছিলেন। ২৫ মার্চ রাত ১২টার পরে ইপিআরের এক জওয়ান ঢাকা বলদা গার্ডেন থেকে টেপটি বাজিয়ে শোনান। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে বঙ্গবন্ধু তাকে টেপটি ফেলে দিয়ে পালাতে বলেন। বলদা গার্ডেনের পুকুরের মধ্যে টেপটি ফেলে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কণ্ঠস্বর শুনে পাকবাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে আসে। পাকিস্তানি আর্মির জনসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালিক বলেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।’ (নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল- পৃ: ৮৫)। বঙ্গবন্ধু গবেষক আবদুল মতিন তার বইতে উল্লেখ করেছেন: ‘স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত মার্কিন দলিল। দি গভর্নমেন্ট অব ইউএসএ ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি। অপারেশনাল ইনটেলিজেন্স ডিভিশন। হোয়াইট হাউস সিচুয়েশান রুম। তারিখ : ২৬ মার্চ, ১৯৭১। বিষয় : পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ, রেফারেন্স : ১. আজ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক দুই অঞ্চল বিশিষ্ট দেশের পূর্বাঞ্চলকে ‘সার্বভৌম স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা দান করার পর পাকিস্তান গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল- পৃ: ১৩)। ইতিহাস লঙ্ঘন করার শক্তি কারো নেই। লেখক: মাহমুদুল বাসার প্রাবন্ধিক ও গবেষক
সুত্র: দৈনিক বর্তমান (বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০১৪, ১৩)
©somewhere in net ltd.