নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী জোয়ারের ভেলোসিটি এতোটাই প্রবল ছিল যে তার ঢেউ খুব সহজেই কাঁটাতারের সীমানা ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। ছলাত্ ছলাত্ শব্দে আছড়ে পড়ছে বিরোধী শিবিরের রাজনীতিতে। শ্যাওলাপড়া সে রাজনীতিতে দিচ্ছে নতুন দোলা। সত্যিই তাই! ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে জামায়াত-বিএনপি যেভাবে লেজ গুটিয়ে গর্তে ঢুকে পড়েছিল এবং দীর্ঘ শীতনিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছিল, সে নিদ্রাভঙ্গের কোনোরূপ সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে কেউ দেখবে বলে ভাবতে পারেনি। অথচ তা এখন দৃশ্যমান বর্তমান। মোদী জ্বরে আক্রান্ত বিএনপি-জামায়ত যেন ভেল্কি দেখাতে চাইছে। মুন্সীগঞ্জের জনসভায় (২৮.৫.১৪) যেন গর্জে উঠেছেন বিএনপি নেত্রী। স্বভাবসুলভ জনতার বরাত দিয়ে বলেছেন এবার একুশ নয়, বেয়াল্লিশ বছর ক্ষমতার বাইরে রাখবেন আওয়ামী লীগকে। হুঙ্কার ছেড়েছেন, অতিসত্বর নির্বাচন দিয়ে মানে মানে সরে না পড়লে সরকারকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সরাবেন। গত পাঁচ বছরে যে বিএনপি একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি সত্যিকারভাবে সফল করতে পারেনি, এমনকি যৌক্তিক গণদাবিকে সামনে রেখেও জনগণকে সংগঠিত করতে পারেনি, প্রতিবেশি দেশের এক তাত্ক্ষণিক রাজনীতি সংক্রমণ তাদের ভেতর কতোটুকু স্থায়ী প্রভাব ফেলবে তা প্রমাণ সাপেক্ষ।
রাজনৈতিক ধ্বংসস্তূপ থেকে বিএনপি'র এই ফিনিক্স পুনরুত্থানের প্রচেষ্টায় আর কিছু না হোক অন্তত চায়ের কাপে ঝড় উঠছে। রাজনীতির অ্যারিনায় নকড্ আউট বিএনপি'র উঠে বসার প্রচেষ্টায় অনেকে নতুন আশায় বুক বাঁধতে চাইছে। বিএনপি'র দীর্ঘ, পৌনঃপুনিক ব্যর্থতায় বিরক্ত অনেকে আবার এই তাত্ক্ষণিক রাজনৈতিক উত্তেজনাকে ইন্ডিয়ান সামার (Indian Summer) অর্থাত্ বৃদ্ধের অকাল যৌবনের মতো ক্ষণস্থায়ী মনে করছে। বিরোধী দল হিসেবে যে দূরদৃষ্টি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখিয়ে বিজেপি কংগ্রেসের মতো একটি সর্বভারতীয় পুরনো দলকে কুপোকাত্ করতে সক্ষম হয়েছে সেই রাজনৈতিক ধীশক্তি আর দূরদর্শিতা কি বিএনপি'র আছে? বিএনপি নেত্রীর মুন্সীগঞ্জ বক্তৃতা আর যাই হোক, শ্লীল রাজনৈতিক ভাষণ পদবাচ্য নয়। খেউড়ে-খিস্তি আর উস্কানিতে ভরা এই বক্তৃতার সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া চলমান রাজনীতিতে কোনো সমঝোতার পথ দেখাতে পারবে বলে মনে হয় না। বিজেপি'র ক্ষমতারোহণের মূল কারণ আত্মশক্তি, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা তাদের চলার পথকে আরো সুগম করেছে। প্রতিপক্ষের দুর্বলতার বিষয়টি বিএনপি'র ক্ষেত্রেও হয়তো বা প্রযোজ্য ছিল, কিন্তু আত্মশক্তিহীন জামায়াত-নির্ভর বিএনপি রাজনৈতিক দাবা খেলায় ঠিক চালটি দিয়ে উঠতে পারেনি। তাই মোদী-জোয়ারে গা ভাসিয়ে বৈতরণী পার হতে চাইছে।
তারেক জিয়ার প্রবাসী রাজনীতি বাংলাদেশের-রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। জেল-জরিমানার ভয়ে দেশে আসতে না পারলেও তিনি হতোদ্যম পার্টির মনোবল চাঙ্গা করার জন্যে- অনলাইন তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন নতুন তত্ত্বের বোমা ফাটাচ্ছেন ফাঁকা মাঠ গরম করবার জন্যে। মরহুম পিতাকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করে একবার বাহবা কুড়াবার চেষ্টা করলেন। এখন আবার তাঁর অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ জায়েজ করার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ রাজনীতিক হিসেবে নতুন ফতোয়া দিচ্ছেন। তবে বিশেষভাবে ইতিহাস-অজ্ঞ এই যুবক অজ্ঞতাবশত কিংবা ইচ্ছা/ ঈর্ষাবশত বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক জীবনকে ব্যর্থ বলে এক হাস্যকর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করলেন। বেমালুম ভুলে গেলেন যে, বঙ্গবন্ধু ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলো কার হাত ধরে? আমি মিষ্টার জিয়া জুনিয়রকে তাঁর প্রয়াত পিতার রচিত তত্কালীন-সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত 'একটি জাতির জন্ম' শীর্ষক প্রবন্ধটি পুনর্পাঠ করার অনুরোধ জানাচ্ছি। বাংলাদেশের জন্ম-আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে তাঁর স্বর্গীয় পিতা সত্য-ভাষণ করেছেন বলে যদি তিনি মনে করেন, তাহলে তার বিপরীত গোলার্ধে দাঁড়িয়ে তিনি কোন্ সন্তান ধর্ম পালন করছেন? নাকি তিনি মনে করেন ঐ নিবন্ধ তাঁর সুচতুর পিতার চাটুকারিতার ফসল। বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে জিয়াকে লম্বা দেখানোর প্রচেষ্টা এদেশে ইতিহাসের বিদ্রূপ আর জনগণের ধিক্কার ছাড়া অন্য কিছুই পাবে না।
তবে জিয়া জুনিয়রদের এই মুজিব বিদূষণ কিংবা মোদী-তোষণ তত্পরতাকে খেয়ালী, বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো অবকাশ নেই। মোদীকে অভিনন্দন জানাতে বিএনপি নেত্রী কিংবা তাঁর পুত্রের যে ব্যগ্রতা, জামায়াতে ইসলামের যে তত্পরতা তাকে সাম্প্রদায়িকতা পীড়িত ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নতুন সূচনা ভাবতে পারলে ভাল লাগতো। কিন্তু আসলে কি তাই? মোদীর মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ আরএসএস কর্মী কি পারবেন অসাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষের ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে। যদি নাই পারেন এবং সমূহ সম্ভাবনা না পারার, তাহলে গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অর্থ কি? তাত্ত্বিকেরা আশঙ্কা করছেন, মোদীর হাতে গণতন্ত্র ঋণাত্মক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ (majoritarianism)-এর দিকে ধাবিত হতে পারে। ধর্ম, ভাষা কিংবা সামাজিক শ্রেণি নির্ধারিত এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব কায়েম করতে পারে যা বহুত্ববাদী ভারতবর্ষে অসংখ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্যে চরম হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। ভারত বৈচিত্র্যের লীলাভূমি। এখানে যেমন আছে সংখ্যাগুরু হিন্দু, তেমনি আছে সংখ্যালঘু মুসলিম কিংবা সংখ্যালঘিষ্ঠতর ইহুদি, খৃস্টান, যরুথুস্ট্রিয়, পার্শিয়ানসহ কত শত ধর্ম ও বর্ণাবলম্বী। আছে আস্তিক, নাস্তিক, সংশয়বাদী; আছে আলখেল্লাধারী দরবেশ এবং নগ্ন সাধু; আছে সমকামী, বিষমকামী, ব্রহ্মচারী, বিকৃতকাম যৌনবিলাসী।
এদের সবার সুরক্ষা দেয়াই ভারত সরকারের পরম ধর্ম। বিপুল বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য রচনা করাই ভারতীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রধান কর্তব্য বলে সর্বদা বিবেচিত হয়ে এসেছে। সংখ্যালঘিষ্ঠের সুরক্ষা এবং বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য রচনার এই দায়িত্ব কংগ্রেস সরকার যে সব সময় যথাযথভাবে করতে পেরেছে তা বলা যাবে না। আসামের মুসলিম নির্যাতন কংগ্রেসের কপালের সবচেয়ে বড়ো কলঙ্ক তিলক। তারপরও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি কংগ্রেসের ঘোষিত লক্ষ্য হওয়ায় সংখ্যালঘুরা তাদের সময় অন্তত কিছুটা স্বস্তিতে থাকে। ২০০২ সালে গুজরাটে। যে বিধ্বংসী হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিলো তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদী এবং কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলো বিজেপি। বিজেপির শাসনামলে ভারতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে বীভত্সতা তার কিছুটা আঁচ করা যায় অপর্ণা সেনের মিস্টার এন্ড মিসেস আইয়ার ছবিটি দেখলে। তবে বর্তমানের বিজেপি যে অতীতের বিজেপির পুনরাবৃত্তি ঘটাবে তেমনটি নয় বলে মোদী সমর্থকেরা যে আশার আলো দেখাচ্ছেন তাতে ভারতের সংখ্যালঘুরা কতোটুকু ভরসা পাচ্ছে তা নিশ্চিত না হওয়া গেলেও আমাদের দেশের বিএনপি-জামায়াত যে তাদের হাল ভাঙ্গা রাজনীতিতে নতুন দিশা খোঁজার চেষ্টা করছেন তা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়। অবশ্য এদের হিসেবটা ভিন্নও হতে পারে। ভারতে মোদীর মুসলিম নির্যাতন বাড়লে বাংলাদেশেও নতুন করে হিন্দু নির্যাতনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পালে হাওয়া লাগবে যার ফল জামায়াত বিএনপি জোটের ঘরে নিশ্চিতভাবে উঠবে। হিন্দু-মুসলিম ডানপন্থি রাজনীতির আপাত সম্পর্ক সাংঘর্ষিক মনে হলেও শ্রেণিচরিত্র এক হওয়ায় তারা প্রকারান্তরে পারস্পরিক স্বার্থই সংরক্ষণ করে। জামায়াত বিএনপির মোদীপ্রীতির রহস্যের চাবি সেটাই।
বিজেপির ক্ষমতায়নে বিশ্ব জুড়ে গণতন্ত্রের জয়জয়কার ধ্বনিত হলেও আশংকামুক্ত হতে পারছেন না অমর্ত্য সেনের মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিশিষ্টজনেরা। ধর্ম কিংবা ভাষাভিত্তিক উগ্র সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের (majoritarianism) বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে আন্তঃজাতীয় কিংবা আন্তঃধর্মীয় মিথস্ক্রিয়ার পথ বন্ধ না হলেও দুর্গম হওয়ার আশঙ্কা তারা করছেন যা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক জনপদটির জন্য আত্মহত্যার সামিল। তবে তার প্রতিষেধকও আছে। অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ সংরক্ষণের জন্যে ভারতে সতর্ক প্রহরার কাজ করেন তাদের সুশীল সমাজ। এই সুশীল সমাজের জাগ্রত ভূমিকার কারণে পূর্বের বিজেপি সরকার রামরাজত্ব কায়েম করতে পারেনি। এবারেও মোদীকে লাগাম পরেই চলতে হবে। কিন্তু কি হবে বাংলাদেশের? বাংলাদেশকে একটি বহুত্ববাদী অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বানানোর জন্য কি জাগ্রত প্রহরার ভূমিকায় আছে কোনো সুশীল সমাজ? গণতন্ত্র যাতে উগ্র সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদে পর্যবসিত না হয় তার জন্য আছে কি কোনো চেক এন্ড ব্যালান্স?
আওয়ামী লীগ সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কতোটুকু সফল হচ্ছে? তাদের নামের মহিমা ভাঙ্গিয়ে নূর হোসেনরা যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মত্ত হয়ে সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছে, তার দায়ভাগ এড়াতে গেলে যে নির্মোহ শাসনদণ্ডের প্রয়োগ অনিবার্য তার নমুনা কি দেখা যাচ্ছে? সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া আওয়ামী লীগের সামনে কোনো বিকল্প নাই। কঠোর হাতে দুষ্টের দমন এবং কোমল হাতে শিষ্টের পালনের মধ্য দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এদেশের রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা করতে কংগ্রেসও ব্যর্থ হয়েছে। আর কংগ্রেসের ব্যর্থতার ফোকর গলে ক্ষমতায় এসেছে মৌলবাদী বিজেপি। কংগ্রেসের প্রতি-রাজনীতি যদি আওয়ামী লীগকে ধরা হয়, তাহলে বিজেপির প্রতি-রাজনীতি বিএনপি-জামায়াত। বিজেপির ক্ষমতারোহণে বিএনপি-জামায়াত যেমন তাদের রাজনীতির নতুন সমীকরণ খুঁজছে, কংগ্রেসের ব্যর্থতা থেকে তেমনি আওয়ামী লীগকেও নতুন দীক্ষা নিতে হবে। কংগ্রেসের ভুলগুলো হবে আওয়ামী লীগের জন্য সতর্ক সংকেত। মোদী-ঝড়ে ভারতের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য বিধ্বস্ত হলে তার দায়-দায়িত্ব ভারতবাসীর। কিন্তু গণতন্ত্রায়ণের নামে আমরা বাংলাদেশকে মোদীকায়িত করে দক্ষিণপন্থিদের উস্কে দিতে চাই না। এদেশে গণতন্ত্রায়ণ মানে 'মোদীকায়ন' নয়। এদেশে গণতন্ত্রায়ণ মানে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ রূপায়ন।
সুত্র
©somewhere in net ltd.