নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর বিষয়ে লিখতে গিয়ে শুরুতেই প্রাসঙ্গিকভাবে প্রতিবেশী দেশ ভারত সম্পর্কে দুটো কথা উল্লেখ না করলেই নয় আর তা হলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মহান নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তথা ভারত সরকার বাংলাদেশকে যে নজিরবিহীন নিঃস্বার্থ সহায়তা দিয়েছে তার জন্য কিছু কুলাঙ্গার ছাড়া গোটা জাতিই দেশটির প্রতি কৃতজ্ঞ। জাতি চিরকাল শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ করবে শ্রীমতী গান্ধীর অবদানকে।
ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। অবস্থানগত কারণেই সে দেশের সঙ্গে বৈরিতা নয়, বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে সব সময়ই বাংলাদেশ আন্তরিকতার পরিচয় দেয়া ছাড়াও বহু ক্ষেত্রে দেশটিকে প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত ছাড় দিয়ে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো শ্রীমতী গান্ধীর প্রয়াণের পর থেকে অনুরূপ আন্তরিকতা ও দৃৃষ্টিভঙ্গির নিদর্শন আমরা দেখতে পাইনি সে দেশের পরবর্তী সরকারগুলোর কাছ থেকে। সীমান্তে তুচ্ছ কারণে-অকারণে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন, তিস্তা চুক্তি, ফারাক্কার ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তি, নদীর অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ, অসম বাণিজ্যসহ বহু ক্ষেত্রে বিরোধ দীর্ঘকাল ধরে রয়েই গেছে। সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক যেন সুদূর পরাহত আর সদ্ভাব, সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার দেখা তো নাই। মর্যাদা আর থাকে কোথায়।
তারপরেও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে বার বার যতটুকু উজাড় করে দেয়ার তার সবটুকুই দিয়ে আসছে নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এবং সমূহ ক্ষতি মেনে নিয়ে। যার জন্য এই সরকার ও তার দলটিকে কঠিন মূল্য দিতে হচ্ছে বরাবরই। দুর্মুখ, সমালোচক ও বিরোধীপক্ষের তীব্র নিন্দা, ভর্ৎসনা, অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই চলতে হচ্ছে একা। ফলে দিনে দিনে কট্টর ভারতবিরোধী একটি শিবিরও গড়ে উঠেছে শক্তিশালীরূপে। যারা মনেপ্রাণে ভারতবিরোধী নয়, এরাও দাঁড়িয়ে গেছে তাদের সঙ্গে একই ময়দানে। এটা এসেছে প্রবঞ্চনা, হতাশা, প্রাপ্তির খাতাশূন্য থাকা এবং সর্বোপরি ভারতের আগ্রাসী ভূমিকা দেখে। ফলে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হয়েছে আওয়ামী সরকারবিমুখ। অবস্থাদৃষ্টে এটাই বিবেচিত যে, ভারত ছাড়া আওয়ামী লীগের অন্য কোন বন্ধু নেই। বিশ্বায়নের যুগে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে নানান জটিলতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী সরকারের গড়ে ওঠেনি সদ্ভাব।
তাই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আমেরিকার মতোই প্রবল ক্ষমতাধর একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত কারণেই বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার। কারণ ভারতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার আওয়ামী সরকারের জন্য যতটা থাকে ভরসার তার বিন্দুমাত্র ভরসাও থাকে না কংগ্রেসের পতন ঘটলে অন্য সরকারের ওপর। তাছাড়া রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার দুর্বল হলেও আওয়ামী সরকারের আর আশা-ভরসার কিছু থাকে না। যা নিকট অতীতের অভিজ্ঞতাই বলে দেয় স্পষ্টভাবে।
বাংলাদেশের প্রতি নতুন মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ কী হবে তা দেখার ও বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। তাই এমন মেঘে ঢাকা একটি অস্বস্তিকর ও অনিশ্চিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর একটি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলেই বিবেচনা করা যায়। যার প্রাপ্তি, ফলাফল এবং সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা বাংলাদেশের জন্য উন্মোচন করবে এক নতুন দিগন্ত। শুধু তাই নয়, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিশেষ দুটি বড় দেশের অযাচিত চাপ প্রয়োগ ও সুবিধা আদায়ের অপচেষ্টা থেকেও বাংলাদেশকে একটি শক্তির বলয়ে থাকার সুবিধায় পরোক্ষভাবে শক্তির ভারসাম্যকেও রক্ষা করবে। দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্বল ও অসহায় অবস্থার ইমেজ ও মানসিক চাপ থেকেও অনেকটা মুক্ত থাকতে পারবে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনে একজন লবিস্টের ভূমিকা পালনকারী অভিভাবক প্রাপ্তির বিষয়টাই বা কম কিসে।
চীন সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে পাঁচটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন, তা এক কথায় ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী। এ কথা বলাই বাহুল্য, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ চীন অতি দ্রুত ও অল্প সময়ে উন্নতির যে চরম শিখরে পৌঁছেছে তা এক কথায় পৃথিবীর বিস্ময়। এভাবে চরম উন্নতির শিখরে পৌঁছার নজির দুনিয়ার আর কোন জাতির নেই। এদিক থেকে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের নেয়ার এবং পাওয়ার মতো বহু কিছুই আছে। যা বাংলাদেশকেও দ্রুত নিয়ে যেতে পারে সমৃদ্ধির শিখরে। ক্ষমতাসীন সরকার দেশকে দ্রুত একটি মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে যেভাবে এগোচ্ছে তা চীনের সহয়তায় আরও বেশি উৎকর্ষময় রূপে ত্বরান্বিত হতে পারে। সার্বিক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠীর জীবনমানকেও তা বিস্ময়করভাবে পাল্টে দিতে পারে। ফলে চীন পাশে থাকলেই চলবে। অন্য কারও কাছে দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন পড়বে না বাংলাদেশের।
অন্তত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনার একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। চীনের তৈরি সকল ধরনের পণ্য সামগ্রী বহু আগেই গোটা পৃথিবীর বাজার দখল করে বসেছে। সস্তা শ্রম এবং মানসম্পন্ন উৎপাদিত পণ্যের স্বল্প মূল্য বিশ্ববাজার দখলে এই ভূমিকাটি রেখেছে। এসব কারণ ছাড়াও সেখানে সুলভ কাঁচামাল, কারিগরি ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি থাকায় সারা পৃথিবীর বিনিয়োগকারীরা তাদের পণ্য উৎপাদনে ছুটে গেছে চীনে।
এখন চীনের বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। দেশটির সার্বিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ জীবনমান দ্রুত অপ্রত্যাশিতভাবে উন্নত হওয়ায় সস্তা শ্রমের সুযোগ আর নেই সেখানে। তাই নিজ দেশেরই চীনা কল-কারখানার মালিক ও সেদেশে আগত বিদেশী বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীরা সস্তা শ্রমে উৎপাদনের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন ভিন্ন দেশে। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের কাছের দেশগুলোতে এরা বিনিয়োগে হয়ে উঠেছেন ব্যাপকভাবে আগ্রহী এবং ইতোমধ্যে বিনিয়োগও করেছেন বিপুল অঙ্কের মূলধন। এসব দেশে যেমন সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান তেমনি লাঘব হয়েছে বেকারত্ব। আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তো আছেই।
ধরা যাক, গার্মেন্টস সেক্টরের কথা। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বাজার রয়েছে চার শ’ পঞ্চাশ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যার ৩৭ শতাংশ একাই দখলে নিয়ে চীন রয়েছে শীর্ষ স্থানে। বাংলাদেশের হাতে রয়েছে মাত্র পাঁচ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী এ বাজার উত্তরোত্তর সম্প্রসারিত হলেও চীন আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না নিজ দেশে গার্মেন্টস বা অন্যান্য পণ্য-সামগ্রী উৎপাদন করে বিশ্ববাজারে মনোপলিভাবে ব্যবসা করতে। সস্তা শ্রমে পণ্য উৎপাদনের জন্য এখন তারাও ছুটছে অন্য দেশে। এ জন্য বাংলাদেশ বহু আগে থেকেই তাদের নজরে থাকলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি আর বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না থাকায় চীনাসহ অন্য অনেক দেশেরই বিনিয়োগকারীরা ফিরে গেছে।
এ বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই দায়িত্ব নিয়ে যদি একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারেন তাহলে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে শুধু চীন থেকে অন্য দেশে প্রত্যাবর্তনকারীদেরই জায়গা দিতে হিমশিম খাবে বাংলাদেশ।
চীন তার চিরাচরিত প্রচলিত পণ্য-সামগ্রী উৎপাদনের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে এখন বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেছে হাইটেক সামগ্রী উৎপাদনের দিকে। জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে চীন এমন একটি অবস্থানে পৌঁছুতে চায় যে তাদের প্রতিদ্বন্দী কেউ থাকবে না। তারা সব সময়ই থাকবে নাম্বার ওয়ানে। এই লক্ষ্যেই তারা বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে গবেষণায়। বছর কয়েক আগে চীন সরকার এ বিষয়ে একটি বিশেষ ঘোষণা দিয়ে বলেন, তাদের টার্গেট হলো আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে তারা নোবেলে পুরস্কারের সব পুরস্কারই করায়ত্ত করতে চায় এবং সেই লক্ষ্য নিয়েই চলছে নিরবচ্ছিন্ন কর্মযজ্ঞ ও প্রস্তুতি।
সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, চীনের সঙ্গে পারস্পরিক, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উত্তরোত্তর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী অটুট বন্ধন গড়ে তোলা মানেই বাংলাদেশের প্রভূত লাভ এবং অর্জন নিশ্চিত হওয়া, যা অন্য কোন দেশের কাছ থেকে সেভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের অতীত নিকট এবং বর্তমানের অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের পর প্রতীতি জন্মেছে, চীনের সঙ্গে থাকা মানেই আমাদের অসম্ভব স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখা। নিশীথ রাতে সূর্য দেখা এবং একটি নতুন দিনের আনন্দে মেতে ওঠা, এ আমার একান্ত আশাবাদ। এতকাল নির্ভরশীলদের ওপর বিশ্বাস করে আমরা শুধু ঠকেই গেছি। এবার বিশ্বাসের হাতটা বাড়িয়ে দিলাম পরম ভরসায় অন্যখানে। মন বলে, এবার আমরা ঠকব না। বিশ্বাস ও ভরসার এ নতুন তরীতে পা দিলাম বঙ্গবন্ধুকন্যার নতুন দিগন্তের দিকে যাত্রাপথে। এ তরী আমাদের তীব্র জল সঙ্কট বা জলশূন্য খরায় আটকে যাবে না কোথাও। আমরা অতল জলে ভেসে যাব এবার মনের সুখে বন্ধুর ঘরে-গভীর সমুদ্রবন্দরে। বঙ্গবন্ধুকন্যার এ যুগান্তকারী পদক্ষেপ হয়ে থাক ইতিহাসের একটি টার্নিং পয়েন্ট। একটি উজ্জ্বল মাইলফলক।
সুত্র
©somewhere in net ltd.