নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
আমাদের মধ্যে একটি ধারণা রয়েছে যে, আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
শুধু ধারণাই নয়, অনেকে এটা বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিকভাবেই বিশ্বাস করেন। এই পার্থক্যটি চিহ্নিত করা হয় মোটামুটিভাবে যে কয়েকটি ক্ষেত্রে সেগুলো হলো :
১. আওয়ামী লীগের সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে; যেটা বিএনপির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বিএনপি তৈরি করেছিলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থেকে, সামরিক শাসন এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্যে।
২. আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় বিএনপি নামে কোন রাজনৈতিক দল ছিল না এবং জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন মেজর ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অধীনে একজন সেক্টর কমান্ডার।
৩. খাতা-কলমে রয়েছে আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে। বিএনপি এর কোনটাই বিশ্বাস করে না এবং তাদের খাতায়ও এর কোন উল্লেখ নেই।
৪. জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ ১২ ধারা বাতিল এবং ৭ ও ৩৮ ধারা সংশোধন করে একই সঙ্গে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনঃপ্রবর্তনের সূচনা করেন।
দৃশ্যত আরও দুই একটি পার্থক্য রয়েছে বাংলাদেশের এ দুটি প্রধান দলের মধ্যে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত-শিবিরের যুদ্ধাপরাধীসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করেছে এবং দ-িত কয়েকজন খুনির দ- কার্যকর করেছে। ১৯৭৫ এর ৩১ ডিসেম্বর এক সামরিক আদেশবলে রাষ্ট্রপতি সায়েমকে দিয়ে দালাল আইন বাতিল করে জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়।
আর ২০১৩ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত-শিবিরের বিচারের বিরোধী এবং এই বিচার কার্য বানচাল করার জন্য জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সারাদেশে সন্ত্রাস-সহিংসতা-হত্যা-নৈরাজ্য করেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং জেল হত্যাকা-ের খুনিদের জিয়াউর রহমান তথা বিএনপি শুধু ইনডেমনিটিই দেয়নি, তাদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করেছে। আরও একটি সাধারণ ধারণা রয়েছে এদেশের মানুষের মধ্যে_ সেটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ প্রো-ইন্ডিয়ান এবং বিএনপি অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান। একই সঙ্গে এই ধারণার সমর্থনে মনে করা হয় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পররাষ্ট্রনীতি হয় ভারতঘেষা আর বিএনপি সরকারের সময় পররাষ্ট্র সম্পর্কের ইমেজটি দৃশ্যত থাকে 'অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান'।
হিসাব করলে আওয়ামী লীগ বিএনপির রাজনীতি এবং আদর্শের ক্ষেত্রে মোটা দাগের এই পার্থক্যগুলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে। কিন্তু এর সবটাই কি রাজনীতিতে বা আচরণে অথবা প্র্যাকটিসে আমাদের চোখে পড়ে? বোধকরি সকলেই স্বীকার করবেন না, চোখে পড়ে না। বরং প্র্যাকটিস সেটা রাজনৈতিকই হোক আর ব্যক্তিগতই হোক অনেক ক্ষেত্রে যেখানে ঘোষিত আদর্শ আর রাজনীতির কারণে বিপরীত হওয়ার কথা সেখানে উভয়ের ক্ষেত্রে একই বা প্রায় একই দেখা যায়। এটাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
বস্তুত শুধু প্র্যাকটিস নয়, রাজনীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ বিএনপির ঘোষিত অঘোষিত নৈকট্য অনেকেরই চিন্তা ও প্রত্যাশার বাইরে। বাস্তবে রাজনীতির এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে সাধারণ অমিলের চেয়ে মিলই যেন প্রত্যক্ষ করছে বেশি। প্রথমেই আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সংবিধান অর্থাৎ '৭২-এর সংবিধান সংশোধন প্রশ্নটি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তীকালে স্বৈরাচারী এরশাদ সংবিধানের যে পরিবর্তন (রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম) করেছিলেন ১৫দশ সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার শুধু ধর্মনিরপেক্ষতা (ধারা ১২) আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়টি সংবিধানে পুনসংযোজন ছাড়া বাকি সবই রেখে দিয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল করার জিয়ার সংশোধনী বহাল রাখা হয়েছে যেমন রহাল রাখা হয়েছে এরশাদের ধারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে। বিএনপি-জামায়াতের আদর্শ যে ১৫দশ সংশোধনীতে আওয়ামী লীগই রেখে দিয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
আসলে বাংলাদেশের বয়স যত বাড়ছে, বাংলাদেশের রাজনীতি যত দিন পার করছে এবং বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দল যত পুরনো হচ্ছে ততই তাদের মধ্যেকার দূরত্বটা কমছে। এই দূরত্ব ফিজিক্যাল নয়, এই দূরত্ব রাজনৈতিক-আদর্শিক এবং আচরণে। এটাই আজকের দিনের বাস্তবতা আমরা চাই না চাই এটাই ঘটছে আজকের রাজনীতিতে।
আমরা যদি দেখি অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে এখন আর মৌলিক কোন তফাত নেই। দুটো দলই এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির দল। এটা ভাল কি মন্দ সে বিবেচনা করার এখন বোধহয় আর প্রয়োজনও নেই। যতই অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান আর প্রো-ইন্ডিয়ান বলা হোক না কেন, পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে এখনও জোর দেয়ার ক্ষেত্রে, সম্পর্কের মাত্রার ক্ষেত্রে, সম্পর্কমুখিনতার ক্ষেত্রে এখনও তফাত থাকলেও, পার্থক্যের জায়গাগুলো ক্ষীণ হতে যে শুরু করেছে সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সাম্প্রতিক দুটি দৃষ্টান্ত থেকে এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে বলা যায়। ভারতের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অভিনন্দন জানানোর যে ঘটা দেশবাসী দেখেছে, তাতে অনেকেই মনে করছেন এরপর বিএনপি যখন ক্ষমতায় যাবে তখন আর তার সরকারকে আর যাই হোক অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান বলা যাবে না। বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে 'লুকিং ইস্ট' নীতিতে [ভারতকে ব্যালান্স করবার লক্ষ্যে] চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় বিএনপি। বলা যায় এই কাজটি এবার সাফল্যের সঙ্গেই বোধহয় করতে পারছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে দৃষ্টিকোন থেকেই হোক না কেন আমাদের নিকট এই দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ বিএনপি যে অভিন্ন নীতি গ্রহণ করতে যাচ্ছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এর কতটা কৌশলগত, কতটা ক্ষমতার জন্য আর কতটা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে সেই হিসাব করবার সময় এখনও আসেনি। তবে ব্যাপারটা যে ঘটছে সেটা মানতেই হবে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের সঙ্গে উভয় দলই বহুদিন ধরে একই নীতি অনুসরণ করছে। এখন ভারত-চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিন্নতার বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেলে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ-বিএনপির ঐক্য দেখে কে!
বিরোধটা আসলে থেকেই যাবে ক্ষমতার প্রশ্নে। যদিও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে যে মিলগুলো দেখা যাচ্ছে তার অনেকগুলোই ক্ষমতার প্রশ্নে আদর্শের প্রশ্নে আপস করার প্র্যাকটিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা থেকে জনমনে ধারণা জন্মেছে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলাম এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপস করছে রাজনীতি এবং ক্ষমতার প্রশ্নে। এ সব ধারণার জন্ম হয়েছে আওয়ামী লীগেরই কতগুলো কর্মকা-ে। প্রথমত মানবাধিকার অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি, এই বিচারের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বিরুদ্ধে সরকারের মহলবিশেষের প্রচারণা, গণজাগরণ মঞ্চের ভাঙন এসবই মানুষের মধ্যে ধারণা দিয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সমঝোতার একটি প্রক্রিয়া চলছে নেপথ্যে। হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক ঘোষণা ছাত্রলীগ-যুবলীগ সম্পর্কে, সরকার সম্পর্কে এই ধারণারই জন্ম দিয়েছে যে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামেরও একটি বুঝ-ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মাদ্রাসার কারিক্যুলামে যে মৌলবাদের পক্ষে পরিবর্তন এনে আপস করছে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রশ্নে। অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে ব্যবহারের কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এগুলো সবই বিএনপির এজেন্ডা। এতদিন জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে বিএনপি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে ব্যবহার করেছে, এখন খুব কৌশলে একই রাজনীতি করছে আওয়ামী লীগও। অর্থাৎ ক্ষমতার প্রশ্নে সংবিধান থেকে শুরু করে রাজনীতি পর্যন্ত বিএনপির এজেন্ডা এখন আওয়ামী লীগের এজেন্ডা হয়ে যাচ্ছে।
বহু বছর ধরে সেই পাকিস্তান আমল থেকে এই দেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীকে টেনে আনা হয়েছে বা ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকাশ্যে না বললেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণা ছিল যে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগবিরোধী। বিশেষ করে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে এই ধারণা আরও ভিত্তি পায়। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, সাধারণভাবে সেনাবাহিনী জিয়া বা বিএনপি সমর্থক। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব থেকে বরাবরই অভিযোগ করা হয়েছে যে, বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্ট থেকে, জিয়া-খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে বসে রাজনীতি করেছে। সন্দেহ নেই অভিযোগ শতভাগ সত্য। এই কারণে সাধারণ গণতান্ত্রিক মহলে এই ধারণাই বদ্ধমূল ছিল যে, বিএনপির ক্ষমতার উৎস যতটা না জনগণ তার চেয়ে বেশি ক্যান্টনমেন্ট। কিন্তু রাজনৈতিক মহলে মনে করা হচ্ছে বর্তমানে বিএনপির এই শক্তিশালী সমর্থনের উৎসটি আর তাদের সমর্থনে নেই। কারণ যাই থাকুক আর কৌশল যাই হোক না কেন বর্তমানে সেনা সমর্থন সরকারের প্রতি রয়েছে বলেই মনে করা হয়।
সেই কারণে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেকেই বলছেন কেবলমাত্র ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং জামায়াত-শিবির-হেফাজতই নয় বিএনপির শক্তির আরও সব উৎস আওয়ামী লীগ দখল করে নিয়েছে। কেউ কেউ একে আওয়ামী লীগ আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর 'রাজনৈতিক কৌশলের'ই প্রশংসা করছেন। আসলেই কি তাই?
সুত্র
©somewhere in net ltd.