নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুত্বপুর্ণ একটি দিন। এই দিনেই সিপাহী জনতার আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশে গনতন্ত্রের পথ সুগম হয়। বাংলাদেশের শৈশবে সংঘঠিত ইতিহাসের পাতায় স্বমহিমায় স্থান পাওয়া এই গুরুত্বপুর্ণ দিনকে নিয়ে নতুন প্রজন্মের একজন যুবক হিসেবে আর সকলের মত আমারও রয়েছে জানার তীব্র আগ্রহ। কয়েকটি বইয়ের মধ্যমে অবশ্য সেই দিনের প্রয়োজনীতা ও ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করার কিছুটা চেষ্টা করেছি। ঘটনাবহুল ১৯৭৫ সালের ২ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অনেক ঘটনা ঘটেছে এবং আরও ঘটনা ঘটারও সম্ভাবনা ছিল। মূলত খালেদ মোশাররফ কতৃক ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে ব্যর্থ বিপ্লব ঘটানোর একটা আকাশ কুসুম অবাস্তবতার কারনেই ৭ নভেম্বেরের সৃষ্টি। সেনাবাহিনীর প্রতিটি জোয়ান তথা সারাদেশের আপামর জনসাধারনের প্রিয় এবং আস্থাভাজন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে হটিয়ে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ। ২ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনার বাস্তব ফলাফল পাওয়া যায় ৭ নভেম্বর যা বিপ্লব ও হংহতি দিবস হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে অমরত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছ।
২ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বরের ঘটনাবলী থেকে স্পস্টতই দেখা যায় খালেদ মোশাররফ প্রকাশ্যেই জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে মসনদে আরোহন করতে চেয়েছিলেন। খালেদ মোশাররফ ও তার কয়েকজন অনুসারী পরিকল্পিতভাবে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর মধ্যে কুৎসা রটনা শুরু করে। খালেদ মোশররফের ক্ষমতা দখলের পেছনে মদদ যুগিয়েছিল ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। মেজর ডালিম লিখেছেন "ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন চেষ্টা চালাচ্ছে আর্মির মধ্যে কিছু লোকের মাধ্যমে একটি প্রতি বিপ্লব ঘটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভক্তি সৃষ্টি করে দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে ২৫ বছরের আওতায় বাংলাদেশে সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপ করে জনাব তাজুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি অনুগত সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিনত করা" (যা দেখেছি, যা বুঝেছি ও যা করেছি, পৃষ্ঠা ৫০৩) । মেজর ডালিম খালেদ মোশররফের প্রধান উস্কানিদাতা হিসেবে শাফায়াত জামিলের কথা উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন কর্নেল তাহের। জিয়ার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তার ঘাড়ে পা দিয়ে পিছন দিয়ে ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কর্নেল তাহের ৫ নভেম্বর থেকে তার বিপ্লবী গণবাহিনীর মাধ্যমে সেনানিবাসে সৈনিকদের মধ্যে "সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই" শ্লোগান সংবলিত প্রচারপত্র ব্যাপকহারে বিলি করায় সৈনিকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং অফিসাররা সম্ভাব্য বিপদ আচ করতে পেরে রাতের অন্ধকারে পরিবারসহ সেনানিবাস থেকে পালাতে থাকে। কর্নেল তাহেরের লক্ষ্য ছিল বন্দিদশা থেকে জিয়াকে মুক্ত করে নিজেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করা। আর এ উদ্দেশ্যে তিনি খালেদ মোশররফসহ অফিসারদের বিরুদ্ধে সৈনিকদের ক্ষেপিয়ে তোলেন। কিন্তু বিধি বাম। ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ায় সামনে দিয়ে খালেদ মোশররফ কিংবা পিছন দিয়ে কর্নেল তাহের কারও পক্ষেই ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৭ নভেম্বর অনেক সম্ভাবনাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে দেশপ্রেমিক সিপাহীবৃন্দ কতৃক জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার মাধ্যমে সাধারন জনগনের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে। ৬ নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাত থেকেই গত কয়েকদিনের অবস্থা সম্পুর্ণ বদলে যায়। লে: ক: (অব আব্দুল হামিদ তার লেখা বইয়ে ওই দিনের বর্ননা দিতে গিয়ে লেখেন, "৭ নভেম্বর সিপাহী-বিদ্রোহের দিনগুলোই ছিল সবচেয়ে কঠিন সময়। সিপাহীদের নিয়ন্ত্রনে ছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। সিপাহীদের দাপটে অফিসারদের পলায়ন ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। এক অবিশ্বাস্য ঘটনা"। (তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা)
লে: ক: আব্দুল হামিদ ছিলেন ৭ নভেম্বের ঘটনার একজন উল্লেখযোগ্য প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি তখন সেনাবাহিনীতে ঢাকা স্টেশন কমান্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার চোখের সম্মুখে ঘটিত নানা ঘটনা তার লিখিত বই 'তিনটি সেনা অভ্যথান ও কিছু না বলা কথা' থেকে বিক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হল।
রাত ১২টায় সুবেদার মেজর আনিসুল হকের ইঙ্গিতে শুরু হল সিপাহী বিদ্রোহ। চারিদিকে অসংখ্য বুলেটের তীব্র আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে উঠল পুরো সেনানিবাস। সৈনিকদের নয়নের মণি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে তারা আজ বদ্ধ পরিকর। যেকোন মুল্যে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সেনাপ্রধান হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাই তাদের মুল লক্ষ্য। ১২ টা থেকেই তাহেরের বিপ্লবী গণবাহিনীর সদস্যরা এবং বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত সিপাহীরা জিয়াকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে জিয়ার বাসায় চারপাশে সমবেত হতে লাগল। জিয়াকে মুক্ত করতে আসা কয়েকটি ইউনিটের মধ্যে মেজর মহিউদ্দীন ও সুবেদার মেজর আনিসের নেতৃত্বে টু ফিল্ডের কতিপয় সৈন্য সর্বপ্রথম জিয়ার বাসভবনে পৌছায়। অবস্থা বেগতিক বুঝে জিয়াকে পাহারারত ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমন্টের এক প্লাটুন সৈনিক শুন্যে গুলি ছুড়তে ছুড়তে উল্টো দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। গেট খুলার মত সেখানে উপস্থিত কেউ না থাকায় সৈন্যরা গেট ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে "জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ, সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই" স্লোগান দিয়ে বেশ কিছু সৈনিক জিয়ার বাসায় ঢুকে পড়ে। তারা জিয়াউর রহমানকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে পীড়াপীড়ি শুরু করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান বন্দী থাকার কারনে পরিস্থিতি না বুঝায় যেতে অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে মেজর মহীউদ্দীন বলেন, "স্যার আমরা আপনাকে নিতে এসছি, আপনি আসুন" প্রতিউত্তরে জিয়াউর রহমান বলেন, "আমি রিটায়ার্ড করেছি। আমি কিছুর মধ্যে নাই। আমি কোথাও যাব না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।" মেজর মহীউদ্দীন আবার বলেন, "আমরা আপনাকে নিয়েই যাব। আমরা আপনাকে আবার চিফ বানাতে চাই। দোহাই আল্লাহর আপনি আসুন।" এভাবেই জেনারেল জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করা হ। লে: ক: আব্দুল হামিদ বলেন, "ভয়ে ভয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দোতলার ছাদে উঠলাম। দেখলাম উম্মাদ সৈনিকবৃন্দ জিয়ার বাসার দিকে ছুটে যাচ্ছে ও জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ শ্লোগান দিচ্ছে। দেখা গেল জিয়ার বাসা থেকে একটা জীপ ঠেলে নিয়ে চিৎকার আর নৃত্য করতে করতে বেরিয়ে আসছে। বুঝলাম জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে আসা হচ্ছে।"
এদিকে জিয়ার মুক্তির খবরে তাহের ক্ষমতায় আরোহন করার স্বপ্নজাল বুনতে লাগলেন। তিনি পুরো অভুত্থানের কৃতিত্ব দাবী করলেন এবং পুরষ্কারস্বরুপ রাস্ট্রক্ষমতায় আসীন হতে জিয়ার সাথে জিদ ধরলেন। লে: ক: আব্দুল হামিদ লিখেন, "জিয়াকে মুক্ত করার কিছুক্ষন পরেই তাহের টু-ফিল্ড রেজিমন্টে ছুটে আসে। তখন রাত প্রায় ২-৩০ মিনিট। ওই সময় জিয়ার কক্ষে গুটিকয় অফিসার: কর্নেল আমিনুল হক, মেজর মহীউদ্দীন, মেজর জুবায়ের সিদ্দীক, মেজর মুনীর, সুবেদার মেজর আনিস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জিয়া ও তাহের উভয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। জিয়া বললেন, তাহের তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে বাচিয়েছো। তাহের বলল, আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। এদিকে আসুন প্লিজ, তাহের তাকে নিয়ে কক্ষের একটি নিভৃত কোণে গেল। বহুক্ষন ধরে তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকল। একসময় তাদের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হল। এক ফাকে জিয়া বারান্দায় এসে সুবেদার মেজর আনিসকে কানে কানে বললেন, আনিস সাহেব ওকে কোনভাবে সরিয়ে দিন এখান থেকে। সাবধান বহু পলিটিক্স আছে। তাহের জিয়াকে টু-ফিল্ড থেকে বের হয়ে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চাইছিল। জিয়া যেতে রাজি হন নি সংগত কারনেই।
সাধারন সৈনিকদের ধারনা ছিল জিয়াকে মুক্ত করার পরপরই সিপাহী-বিদ্রোহ শেষ হয়ে যাবে। তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে, কিন্তু বাইরের বিপ্লবী সৈনিক ও বিপ্লবী নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ছিল ভিন্ন, অনেক গভীর। সমস্ত প্লান-প্রোগ্রামই ছিল সাধারন সৈনিকদের এবং বিপ্লবী তাহের গ্রুপের। শত শত সৈনিকদের পদভারে টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট তখন প্রকম্পিত। এদের মধ্যে বহু সৈনিক দেখা গেল এলোমেলো খাকি ড্রেসে। পায়ে ছিল বুটের বদলে সাধারন জুতা। অনেকের মাথায় টুপিও নাই। এরাই ছিল জাসদের বিপ্লবী সংস্থার সদস্যবৃন্দ। সিপাহী বিদ্রোহের রাতে খাকি উর্দি পরে তারা মিশে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের সাধারন জোয়ানদের সাথে। উপস্থিত শত শত সৈনিকদের মধ্যে কে বিপ্লবী সৈনিক, কে আসল সৈনিক বুঝা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তারাই অফিসারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছিল। টু-ফিল্ডে বসেই জিয়া বেতার ভাষন দিলেন। টু-ফিল্ডের অফিসেই রেডিও রেকর্ডিং ইউনিট এনে জিয়ার একটি ভাষন রেকর্ড করা হল ভোর বেলা প্রচার করার জন্য। সংক্ষিপ্ত ভাষনে জিয়া ঘোষনা করেন, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বায়িত্বভার হাতে নিয়েছেন। দেশের এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অনুরোধে তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি সবাইকে এই মুহূর্তে শান্ত থেকে নিজ নিজ দ্বায়িত্ব পালন করার আহবান জানান। তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া অফিস-আদালত, বিমানবন্দর, মিল-কারখানা পুনরায় চালু করার অনুরোধ জানান। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ আমাদের সহায়।
৬ তারিখ রাত ১২ টায় সিপাহী বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ মুশাররফ সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাইভেট কার নিয়ে বঙ্গভবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান। তার সাথে ছিল কর্নেল হুদা ও হায়দার। খালেদ প্রথমে রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। নুরুজ্জামান তাকে খাকি ড্রেস পাল্টিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। সে তার নিজের একটি প্যান্ট ও বুশ শার্ট খালেদকে পরতে দেয়। ৪র্থ বেঙ্গলে সর্বশেষ ফোন করলে ডিউটি অফিসার লে: কামরুল ফোন ধরে। সে তাকে প্রকৃত অবস্থা অবহিত করেন। এবার খালেদ বুঝতে পারেন অবস্থা খুবই নাজুক। তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল রেজিমন্টে আশ্রয় গ্রহন করতে যান। প্রথমে নিরাপদেই তার বিশ্বস্ত ইউনিটে আশ্রয় নেন। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ। তাকে দেওয়া হয় খালেদের আগমনের সংবাদ। তিনি তাৎক্ষনিক টেলিফোনে টু-ফিল্ডে সদ্যমুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার ইউনিটে খালেদ মুশররফের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেন। জিয়ার সাথে জলিলের ফোনে কিছু কথা হয়। কর্নেল আমিনুল হক বলেছেন, তিনি ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং জিয়াকে বলতে শুনেছেন, যেন খালেদকে প্রানে মারা না হয়। যাহোক, ভোরবেলা দেখতে দেখতে সিপাহী বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে লাগতে শুরু করল। পরিস্থিতি কর্নেল নওয়াজিশের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। তারা খালেদ ও তার সহযোগীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সিপাহীরা তাদের টেনে হিচড়ে বের করে। জানা গেছে মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভিতর প্রবেশ করে। তার সাথে একজন বিপ্লবী হাবিলদারও ছিল। সে চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল, 'আমরা তোমার বিচার চাই।' খালেদ শান্ত কন্ঠে জবাব, ঠিক আছে তোমরা আমার বিচার কর। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো।' স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার বলল, 'আমরা এখানেই তোমার বিচার করব'। খালেদ ধীরস্থির, বললেন, 'ঠিক আছে তোমরা আমার বিচার কর'। খালেদ দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। ট্যা-র-র-র-র! একটি ব্রাশ ফায়ার! আগুনের ঝলক বেরিয়ে এল বন্দুকের নল থেকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী খালেদ মোশররফ। সাঙ্গ হল বিচার। শেষ হল তার বর্নাঢ্য জীবনেতিহাস।
মধ্যরাতে জিয়াউর রহমানকে কিছুটা কমান্ডো স্টাইলে বিনাবাধায় মুক্ত করার পর সকালবেলা বিপ্লবীদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে শত শত সৈনিক তাদের ইউনিটের ট্রাকে চেপে স্লোগান দিতে দিতে শহরের দিকে ছুটতে থাকে। তাদের হুকুম দেওয়ার, বাধা দেওয়ার কেউ নেই। নতুন শ্লোগান উঠল, 'সিপাহী জনতা ভাই ভাই'। অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার! রাস্তায় রাস্তায় শ্লোগানমুখর জনতা বেরিয়ে আসে সৈনিকদের সাথে একাত্নতা ঘোষনা করতে। দেখতে দেখতে সিপাহী বিপ্লব মোড় নেয় ঐতিহাসিক 'সিপাহী জনতার' বিপ্লবে। শহরে রাস্তায় মানুষের ঢল। সিপাহী-জনতা-ভাই ভাই। ভোরবেলা বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংকগুলো প্রবল বেগে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়া এলো। সারা রাত তারা শান্তভাবে ক্যান্টনমেন্টের উত্তর কোণে বসে বসে ঘটনা পরখ করছিল। বিপ্লবী সুবেদার সারওয়ারের ডাকে ভোর পাচটার দিকে তারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে শহরের দিকে ধেয়ে যায়। রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক। জনতা প্রবল উল্লাসে ট্যাংকগুলো ঘিরে ধরে সিপাহীদের সাথে মিশে গিয়ে নৃত্য করতে থাকে। সিপাহী জনতার উল্লাস ব্যাপক উম্মাদনায় রুপ নেয়। সর্বত্র এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। 'সিপাহী জনতা ভাই ভাই। সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ।'
আমি জীপ নিয়ে একবার শহরের অবস্থা দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। শহরের শাহবাগ মোড় পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে। হাইকোর্টের সামনে আর যেতে পারলাম না। হাজার হাজার মানুষ জীপ দেখে 'আল্লাহু আকবার' বলে নৃত্য করতে করতে ছুটে আসল। আমি বিপদ বুঝে ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি জীপ ঘুরাতে বললাম। কিছুটা শান্ত দেখে কাকরাইলের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম, সেদিকেও একই অবস্থা। মিলিটারি গাড়ি দেখলেই আনন্দের অতিশয্যে জনতা তা ঘিরে ধরছে আর জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছে। রেসকোর্সের কাছে কয়েকটি ট্যাংকের উপর বহু সিভিলিয়ান চড়াও হয়ে ফূর্তি করতে দেখলাম। আমি আর গুলিস্তানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেলাম না। সবাই ছুটছে এক অপূর্ব আবেগে, মুক্তির আনন্দে। অভূতপূর্ব দৃশ্য। শহরের রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে দেখলাম, সৈনিকরা বিভিন্ন ইউনিট থেকে ট্রাক বের করে এনে রাস্তায় সিভিলিয়ানদের সাথে মিশে মিছিল করছে আর শ্লোগান দিচ্ছে, 'আল্লাহু আকবার। সিপাহী জনতা ভাই ভাই। জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ'। সিপাহী জনতার এমন মিলন দৃশ্য ইতঃপুর্বে আর কখনও দেখিনি। সিপাহী বিদ্রোহের সাথে জনতার একাত্নতা ঘোষণা, এক ঐতিহাসিক ঘটনা। শতাব্দীর এক অবিস্নরনীয় মুহূর্ত।"
সন্ধা নামার সাথে সাথে এক অজানা আতঙ্ক সারা ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ল। টু-ফিল্ডের আশেপাশে বিভিন্ন রকমের সৈনিকরা এখানে ওখানে জটলা করছিল। আশে পাশে সৈনিকরা অস্ত্র কাধে ঘোরাফেরা করছে। রাস্তায় দেখি বেশ কিছু অফিসার গাড়ি করে, রিক্সা করে ফ্যামিলি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাস্তা ঘাট সন্ধ্যার আগেই একেবারে ফাকা হয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে ঐ মুহূর্তে ক্যান্টনমেন্টে কমান্ড কন্ট্রোল আর ডিসিপ্লিন বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বিপ্লবীদের প্রপাগান্ডা, হাজার হাজার বিপ্লবী লিফলেটস্ ইত্যাদির প্রভাবে ইতোমধ্যে সাধারন সৈনিকদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে লক্ষ্য করলাম। তারা অফিসারদের প্রতি অবজ্ঞাভরে তাকাচ্ছিল। ৪র্থ বেঙ্গল এবং টু-ফিল্ড রেজিমন্টের কিছু বিশ্বস্ত অফিসার জেসিও এবং সৈনিক জেনারেল জিয়াকে আগলে রেখেছিল। কিছুক্ষন পরেই সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাঙ্কের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল রাস্তায়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনে পৌছে মেজর নাসের ও মেজর গাফফারকে তাদের হাতে তুলে দিতে চাপ প্রয়োগ করল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল আমিন, মেজর মুনীর ও সৈনিকেরা অফিসারদের তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করল। আফিসারদ্বয় বেচে গেলেন। রাত আনুমানিক ১২টা। হঠাৎ গেটে তুমুল চিৎকার হট্টগোল। তারা নিচতলায় কর্নেল শামসের বাসায় আক্রমন করে বসল। শামসরা সবাই পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছেন। তারা উপর তলায় উঠে আসল। তারা একেবারে আমার বেডরুমের দরজায় পৌছে হাকা-হাকি করে দরজা খুলতে বলল। আমার স্ত্রী আমাকে থামিয়ে বলল দাড়াও আমিই যাব, বলেই সে একেবারে আক্রমনকারীদের সম্মুখে এসে দাড়ালো। লেডিজ দেখে বিপ্লবীরা প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। রক্তপাগল সৈনিকরা আমার স্ত্রীকে গুলি করতে পারে ভেবে আমি নিজেই তাড়াতাড়ি দরজার পিছন থেকে বেরিয়া এলাম। একজন সিপাহী গুলি করার জন্য রাইফেল তুলতেই সমুজ আলী ও অনুগত সিপাহীরা তাকে জাপটে ধরল। ঐ বেটাই ছিল লিডার। মনে হল তারা ভিন গ্রহের বিপ্লবী সিপাহী। বাকি দু-তিন জনকে সামসের সিগন্যাল ইউনিটের মনে হল। যাহোক আমরা কোনরকম এযাত্রায় বেচে গেলাম।
৭/৮ নভেম্বর ঐ বিভীষিকাময় রাত্রে গভীর অন্ধকারে উম্মাদ সৈনিকরা অফিসারদের রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠল। ঘটে গেল বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড। সৈনিকরা মেজর করিম, মেজর আজিম, মিসেস মুজিব ও মিসেস ওসমানকে গুলি করে হত্যা করে। মেজর মুজিব প্রান নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। অর্ডিন্যান্স অফিসার মেসে সৈনিকরা হামলা করে তিনজন তরুন অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। অর্ডিন্যান্স স্টেটে দশজন অফিসারকে এক লাইনে দাড় করানো হয় মারার জন্য। প্রথমজন একজন তরুন ক্যাপ্টেন। তার পেটে গুলি করা হয়। বাকিরা অনুনয় বিনয় করলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। টিভি ভবনে তিনজন অফিসার মারা পড়ে। উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকরা দলবেধে প্রায় প্রতিটি অফিসার্স কোয়ার্টারে হামলা চালায়। ভীতসন্ত্রস্ত অফিসাররা প্রাণ রক্ষার্থে বাসা ছেড়ে অন্ধকারে পেছনের পানির ডোবায়, ঝোপ-জঙ্গলে আত্মগোপন করে সারারাত কাটায়। ১২ জন অফিসার মারা পড়ে ঐ রাতে। ঐ রাতে বিপ্লবী সৈনিকরা সত্যি সত্যি অফিসারদের রক্ত নেশায় পাগল হয়ে উঠেছিল। ভাগ্যিস অধিকাংশ অফিসার ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সন্ধ্যার আগেই শহরে তাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। সিপাহীগণ কতৃক আপণ অফিসারদের উপর হামলা এর আগে কস্মিনকালেও ঘটেনি! এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা।
লে: ক: (অব) আব্দুল হামিদের লেখা থেকে স্পষ্টত দেখা যায় জিয়াউর রহমানের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সৈনিকরা তাকে অনেকটা জোর করেই সেনাপ্রধনের পদে ফিরে যেতে বাধ্য করে। জোরপূর্বক হলেও ভালবাসা এবং মানবীয় গুনাবলীর কারনেই সৈনিকরা জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে কর্নেল আমিনুল হক ফোনে জিয়াকে বলতে শুনেছিলেন খালেদকে যেন প্রানে মারা না হয়। এ থেকে বুঝা যায় কোন ধরনের রক্তপাত জিয়াউর রহমানের উদ্দেশ্য ছিল না। আরেকটু পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ৭ নভেম্বের জিয়ার মুক্তি পরবর্তী বিশৃঙ্খলা ও অফিসার নিধনে কর্নেল তাহেরের প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে। কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী বাহিনীই অফিসারদের হত্যা করতে সৈনিকদের নানাভাবে উৎসাহিত করে এবং হত্যাযজ্ঙে তারাই মুল ভুমিকা পালন করে। আব্দুল হামিদ তার বাসায় হামলাকারীদের ভিন গ্রহের বিপ্লবী সদস্য বলেছেন। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে ঐ ভিন গ্রহের বিপ্লবীরাই ছিল কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সংস্থার সদস্য যারা সকল অফিসারদের হত্যা করে তাহেরের নেতৃত্বে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন।
সুত্র
©somewhere in net ltd.