নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এই দিনটিকে আমরা অভিহিত করেছি 'শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস' হিসেবে। প্রশ্ন আসতে পারে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ তো হয়েছিল ৯ মাস ধরে, সে ক্ষেত্রে কেন ওই ১৪ ডিসেম্বর তারিখটি বিশেষ একটি দিন হিসেবে নির্ধারিত? জবাবটি পরিষ্কার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় বাঙালি দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতাবিরোধীরা যখন তাদের পরাজয় অবধারিত স্পষ্ট বুঝতে পারে, তখনই গণহত্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী হত্যার সংখ্যাও বাড়িয়ে দেয়। উদ্দেশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। এই দেশের যাঁরা কৃতী সন্তান, যাঁদের মেধা ও মনন দেশপ্রেম বাড়ায়, জাতি গঠনে সাহায্য করে, শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদান রাখে, সর্বোপরি দেশের গৌরব বাড়ায় এবং মুখ উজ্জ্বল করে, তাঁদের নির্মূল করতে হবে, যাতে বিজয় এলেও মেরুদণ্ডহীন জাতি হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে যখন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়, ৬ ডিসেম্বরে ভারত যখন বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তখনই বলা চলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অখণ্ড পাকিস্তানের মৃত্যু হয়ে গেছে, বাকি ছিল শুধু আনুষ্ঠানিক দাফন। সেই দাফনটিই হয় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দাফনের আগেই মরণ কামড়ের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যা।
বুদ্ধিজীবী হত্যার রকমফের
প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকেই। পাকিস্তানি সমর্থক কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বলে থাকেন, একাত্তরের মার্চে যে হত্যাকাণ্ড হয় তা ছিল গণহত্যা, নির্দিষ্ট বুদ্ধিজীবী হত্যা নয়। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা যায়, বেছে বেছে, চিহ্নিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষককে কেন হত্যা করা হলো, হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার পর তিন দিনের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়, এক সপ্তাহের মধ্যেই ঋষিতুল্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অমানবিক নিষ্ঠুর অত্যাচার সহ্য করে শহীদ হন, যশোরের আইনজীবী মসিউর রহমান অত্যাচারে অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন, তখন এই প্রশ্নগুলো আসবেই- এসব বুদ্ধিজীবী কি সত্যিই পরিকল্পিত হত্যার শিকার, না কথিত গণহত্যার অংশ? গণহত্যার অংশ বললে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হত্যাযজ্ঞের গুরুত্ব কখনোই কমবে না। কারণ সাধারণ মানুষকে কোন অপরাধে হত্যা করা হবে? অপরাধ করেছে ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং, প্রতিশ্রুতি দিয়ে, নির্বাচনের ফল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে গেলেও তাদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে না দিয়ে যে গণহত্যা শুরু করেছিল, তা পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের স্রষ্টা পাকিস্তান। সেই পাকিস্তান আজ ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে বলে একের পর এক সামরিক শাসন; আরেক দফা টুকরা হওয়ার অপেক্ষায়। ইতিহাসের রায় প্রমাণিত হয় সময় নিয়ে, মোক্ষম সময়ে। পাঞ্জাবি নিষ্ঠুর শাসন অথবা কর্তৃত্ব যত দিন বলবৎ থাকবে তত দিন পাকিস্তান আর যা-ই পাক, প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে না।
বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার যত রকম পন্থা পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অবলম্বন করেছিল, এর মধ্যে প্রথম বিবেচনায় ছিল শিক্ষক হত্যা। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি 'শহীদ বুদ্ধিজীবী-কোষগ্রন্থ' প্রকাশ করে। সেখানে বুদ্ধিজীবী সংজ্ঞা নিরূপিত হয় এভাবে- শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিশিষ্ট সমাজসেবক, খেলোয়াড়, সংস্কৃতিকর্মী ইত্যাদি। এই সংজ্ঞা থেকে এ তথ্যই প্রমাণিত হয়, দেশ, সমাজ, জনগণ ও ইতিহাসে যাঁরা অবদান রাখতে সক্ষম, তাঁদের নিঃশেষ করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, পাকিস্তানি অর্ধশিক্ষিত সামরিক, আধাসামরিক সৈনিকদের জানার কথা নয় কে কোন পেশায় নিয়োজিত। কে তাঁদের চিনিয়ে এবং ধরিয়ে দিয়েছিল? লেখাই বাহুল্য, এ দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী কুলাঙ্গাররা। তারা চিহ্নিত ব্যক্তিদের বাড়িঘর চিনিয়েছে, রাস্তাঘাট দেখিয়ে নিয়ে গেছে।
ইতিহাসের বিচার যে কোনো প্রকার দয়াদাক্ষিণ্য প্রদর্শন করে না, তার প্রমাণ স্বাধীনতা লাভের ৪০-৪২ বছর পর (১৯৭১ সালের পর) আবার নতুন ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে; যারা ভেবেছিল বিস্মৃতিপরায়ণ বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সব অপকর্ম ভুলে গেছে, তারা আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে তাদের জঘন্যতম ঘৃণ্য অতীত জাতির কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বুদ্ধিজীবীদের নিধন নিয়ে অজস্র পেশার অগণিত মানুষের নামোল্লেখ করা যায়। আমি এখানে মাত্র কয়েকজনের কথা বলব, যা শুনলে মনে হবেই মানুষ কতখানি নিষ্ঠুর হলে এমন নির্মমভাবে আরেকজনকে হত্যা করতে পারে। প্রথমেই বলি বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, সেই 'অপরাধ' পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ভোলেনি বলে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ শ্রীদত্তকে এমন নির্যাতন করা হয়েছিল যে তাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে টয়লেটে যেতে হতো। চট্টগ্রামের কুণ্ডেশ্বরীর নূতনচন্দ্র সিংহকে বৃদ্ধ বলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে প্রথমে হত্যা করেনি; কিন্তু বাংলাদেশবিরোধী ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানি সৈনিকদের বাধ্য করে হত্যা করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে ২৫ মার্চ রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগৃহ থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে জগন্নাথ হলের মাঠে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলিতে হত্যা করে ছাত্রদের সঙ্গেই গর্তে পুঁতে ফেলে; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়ুমকে পদ্মার পারে জীবন্ত বালুচাপা দেয়; সৈয়দপুরে ডাক্তার শামশাদ আলীকে জ্বলন্ত রেল ইঞ্জিনের ভেতর ফেলে হত্যা করে; ঢাকার মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসাকে জবাই করে মাথাটা সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে; মাগুরায় শিক্ষিকা লুৎফুন নাহার হেলেনাকে জিপের পেছনে বেঁধে শহরের রাস্তায় টেনে নিয়ে মেরে ফেলে- এ রকম আরো অজস্র হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, যা কল্পনায়ও অকল্পনীয় মনে হবে।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার পরিকল্পনা নেয় গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ কি এই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না? একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন। তাঁরই সরাসরি ছাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা নাজিম মাহমুদকে ড. হোসায়েন বলেছিলেন, 'দ্যাখো, আমি সবাইকে যে কথা বলি, ড. কাদেরকে সেদিন যে কথা বলেছি, তোমাকেও তাই বলি- ওরা যদি তোমাকে গুলি করতে চায়, তাহলে কপালের ঠিক মাঝখানে ওদের গুলি করতে বোলো, painless death, absolutely painless.' (যখন ক্রীতদাস : স্মৃতি ৭১- নাজিম মাহমুদ, পৃষ্ঠা ৫৫, দ্বিতীয় প্রকাশ)।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের পরিণতি কী হওয়া উচিত তা মনে হয় ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই।
সুত্র
©somewhere in net ltd.