নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যাহা বলিব সত্য বলিব

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।

তালপাতারসেপাই

লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।

তালপাতারসেপাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরাজিতের পুনরুত্থান, বিজয়ীর প্রস্তুতি

২৯ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ৮:২৬

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো অপশক্তির পরাজয় ঘটেছিল। পরাজিত হয়েছিল ধর্মকেন্দ্রিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক ও বাহকরা। পাকিস্তানের ২৪ বছরে এসব অপশক্তি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বাতাবরণে শক্তি সঞ্চয় করলেও মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি ব্যাপক গণযুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু রণাঙ্গনে পরাজিত হলেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে এদের বিলীন করা যায়নি। বরং বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এদের ক্রমান্বয় পুনরুত্থান ঘটতে থাকে, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য দুর্ভাগ্যজনক একটি বড় সংকট।

মুক্তিযুদ্ধের পর পরই পাকিস্তান বাহিনীর স্থানীয় দোসরদের ঘৃণ্য অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এ লক্ষে আইন তৈরি করা হয়, সারা দেশে ৭৩ টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। কিন্তু আইনের সীমাবদ্ধতা, বিচারিক সংকট ও যুদ্ধ-পরবর্তী কালের অলঙ্ঘনীয় কিছু বিপন্নতায় সে বিচার সঠিকভাবে চলতে পারেনি। দালাল আইনের কয়েকবার সংশোধনী আনার পরও সংকট কাটানো যায়নি। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা সচতুরভাবে এর ভুল ব্যাখ্যা করে পরিস্থিতি ঘোলাটে এবং জনমনে দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়। অন্যদিকে যুদ্ধ পরবর্তীকালে স্বাধীনতাকামীদের আত্মতুষ্টি কিংবা প্রস্তুতিহীনতাও অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের পুনরুত্থানকে সহজ করে।

১৯৭৫ সালে প্রায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিরা রাতারাতি নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়। জে. জিয়াউর রহমান জেল থেকে বন্দি স্বাধীনতাবিরোধীকে মুক্তিদান করেন। এমনকি বিচারে যারা দণ্ডপ্রাপ্ত হয় তাদেরও দালাল আইন বাতিলের কারণ দেখিয়ে মুক্ত করা হয়।

মোটকথা, জেনারেল জিয়া পরাজিতদের পুনরুত্থানের কাজে সরাসরি মদদ জোগান। সব শ্রেণি-পেশার প্রায় চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং কট্টর পাকিস্তাপন্থীদের তিনি পুনর্বাসন করেন। শাহ আজিজের মতো স্বাধীনতাবিরোধীকে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানান। গোলাম আযমের মতো শীর্ষ যুদ্ধপরাধীকে বাংলাদেশে এসে রাজনীতি করার সুযোগদান করেন। আব্দুল আলিমের মতো যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রী বানান। জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামের ধ্বজাধারী দলগুলোকে তিনি পুনর্জন্মদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা এবং হত্যা, গণহত্যা, জখম, অপহরণ ও নারী নির্যাতনের নিকৃষ্ট অপরাধে যাদের বিচার হওয়ার কথা ছিল, তারা এই সুযোগে তাদের অপরাধের কোনো রকম অনুতাপ না করেই রাজনীতি ও সমাজের নানা স্তরে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। শুরু হয় পরাজিত অপশক্তির প্রাথমিক পুনরুত্থান।

পরাজিতদের দ্বিতীয় পুনরুত্থান ঘটে জে. এইচ এম এরশাদের সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের ৯ বছরে। এ সময়টায় পরিকল্পিতভাবে দেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্জন্ম লাভে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ বিরোধী, এমনকি সামাজিক প্রগতি বিরোধী অপশক্তিগুলোর দুয়ারে এমন সংকেত দেয়া হয়, যাতে তারা সব ক্ষেত্রে পুনর্বাসিত এবং দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

সেদিনের ইতিহাসের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমার বিশ্বাস যে, এসব অপকর্ম করা হয় মূলত দুটি কারণে। এক. আওয়ামী লীগ, যে দলটি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং শত প্রতিক‚লতা ও সীমাবদ্ধতার পরও মুক্তিযুদ্ধপন্থী মূল রাজনৈতিক দল, তার ভিত্তিকে দুর্বল করা। দুই. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি ও পালাক্রমিক ভারত বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটিয়ে নিজেদের শাসনকে দীর্ঘায়িত করা এবং রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়া। বলা যায়, এই দুই উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশের সামরিক শাসকেরা বেশ সফল হয়েছিল। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতির নবতর আবির্ভাবের পথ প্রশস্ত করেছিল। অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ সংগঠিত শক্তি হিসেবে যে সব বামপন্থী দল ও সংগঠন যুদ্ধোত্তরকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো, তারাও তাদের প্রার্থিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে প্রায় সব সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে একাত্তর বিরোধীদের পুনর্জাগরণ নিশ্চিত হয়।

এই সময়টাতে, বলা যায়, ১৯৭৫-এর রক্তপাতের পর থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত, বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে কখনো প্রত্যক্ষভাবে সেনাশাসিত হয়ে, কখনো আধা-সেনাশাসিত হয়ে। এ সময়ের শাসকরা প্রায় ধরেই নিয়েছিল যে, তারা সুচতুর ও সফলভাবেই একাত্তরের মৌল চেতনা ও ইতিহাস থেকে সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পরাজিত পাকিস্তানের আবহে পুনর্জীবিত করতে সাফল্য অর্জন করেছে। এ ছিল সব অর্থেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত আগ্রাসন, যার কুফল ভোগ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এরপর আসে খালেদা জিয়ার প্রথমবারের শাসন (১৯৯১-৯৬)। আমার ধারণা এই যে, এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও সেদিনকার আওয়ামী লীগ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজয়বরণ করে মূলত দুটি কারণে। একটি দলটির অতিমাত্রার আত্মাবিশ্বাস- যা সব সময়ই ক্ষতির কারণ; দ্বিতীয়টি, সুচতুর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এসব ষড়যন্ত্রের সঙ্গত কারণও ছিল। যে আন্তর্জাতিক মহল পাকিস্তানের পূর্ব অংশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল প্রকাশ্যেই এবং যারা ১৯৭৫ সালের রক্তপাতে আনন্দিত হয়েছিল প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, তারা কখনই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তান বা তাঁর দলকে আবারো রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায়নি।

দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগ তার সংকট অনুধাবন এবং পাল্টা ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে জনসমর্থন সত্ত্বেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাদের পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, খালেদা জিয়ার প্রথমবারের শাসনে আরেক দফা পুনঃনির্বাসিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। ব্যবসাবাণিজ্যে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সুচতুর পরিকল্পনায় নিজেদের পুনরুত্থান ঘটিয়েছে।

সাবেক পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ ধর্মভীরু। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- ধর্মের নামে অনাচার তারা মুখ বুজে মেনে নেয়নি। এর দৃষ্টান্ত অনেক। উল্লেখ করা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্র নির্মাণের মূল শক্তি ছিল মুসলিম লীগ, তারাই পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় বছরের মাথায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ধুয়েমুছে গেছে। কাজেই ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধপন্থী দলগোষ্ঠীগুলোর বিজয়কে ঠেকানো যায়নি। ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়েছে এবং ১৯৭৫ সালের প্রতিবিপ্লবীদের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রায় দুই যুগের ভয়ঙ্কর অপশাসনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক উৎসের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তাকে পুনরুদ্ধার করা কঠিন বৈকি। এরপরও তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে।

স্মরণ করা উচিত হবে যে, এই দুই যুগে নতুন জেনারেশনের একটি বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে, তাদের মাথায় পরিকল্পিতভাবে জাতীয় জীবনের ইতিহাস বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে; সচতুরভাবে ভারতবিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা ঢুকানো হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সামরিক ও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংকট ও বিপন্ন সম্ভাবনাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। ফলে পরাজিতদের পুনরুত্থানের পথ আরো প্রশস্ত হয়েছে।

এরপর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জামায়েতে ইসলামী দলটির প্রত্যক্ষ পুনর্বাসন ঘটেছে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে। যে দলটি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছে, সেই দলটিই ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্র্ভূত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে ঘাতক-দালালের ভূমিকা পালন করেছে!

জামায়াতে ইসলামী দলটি গণতন্ত্রের আবরণে এবং তাদের নিজ ব্যাখ্যার আদলে ইসলামকে রাষ্ট্রক্ষমতার মূল হাতিয়ার বানাতে চায়। বলা যায়, এই দলটি ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি স্বার্থরক্ষার মূল হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত। ১৯৭১ সালে তারা কেবলই পাকিস্তান বাহিনীর মূল সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়নি, পরবর্তীকালেও তারা বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষায় তৎপর হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে এরা বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের মতোই ধর্মের নামে নির্বিচার গণহত্যা, নির্যাতন করেছে, নারী নির্যাতন ঘটিয়েছে। বর্বর শক্তি প্রয়োগে পূর্ব বাংলার মানুষকে এরা পাকিস্তানের পক্ষ ধারণ করার কৌশল অবলম্বন করেছে। খালেদা জিয়া, সম্ভবত তার স্বামীর পথ ধরেই সেই দলটিকে রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশদারিত্ব নিশ্চিত করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদ ও লাখো নির্যাতিত বাঙালি নারীর অবমাননায় নিজের নামকে কলঙ্কিত করেছেন। আর সেখান থেকেই শুরু পরাজিতদের পুনরুত্থানের আরেক পর্যায়।

কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মুখোশ উন্মোচন হতে বেশি দেরি হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে উগ্র-সাম্প্রদায়িক শক্তির উন্মাদনা চরম আকারে পৌঁছে। ফলে নতুন জেনারেশনের মানুষ বুঝতে সমর্থ হয় যে, তারা এমন একটি সরকারের নেতৃত্বাধীন যাদের মূল শরিক দেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তান বাহিনীর দোসর হিসেবে হত্যা, নারী নির্যাতন ও অপহরণ-অগ্নিসংযোগের মতো ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কাজেই, ১৯৯১ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে দাবিটি গণদাবিতে পরিণত হয়েছিল, সেই দাবি আবারো জনমনে দানা বাঁধতে থাকে। দাবিটিকে সব মুক্তিযুদ্ধপন্থী দলের নির্বাচনী ইশতেহারেও স্থান করে নেয়ার কৃতিত্ব রাখে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামসহ আরো কিছু সামাজিক সংগঠন।

বলতেই হবে যে, এ সময় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর মধ্যেও গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পত্তন ঘটে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তারা মূলত বিদ্যমান রাজনীতি ও নেতৃত্বের কারণেই, পাকিস্তানপন্থী পুরনো চিন্তাচেতনার নিয়ন্ত্রিত হয়েছে দীর্ঘকাল। এবার তারা অনেকটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অভিসিক্ত হলো। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ প্রকট আকার ধারণ করলো। ঘটতে থাকলো একের পর এক উগ্র সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন। কাজেই শক্তিধর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই অপশাসনের বিরোধিতা প্রকট রূপ ধারণ করলো।

এর ফলে এলো ২০০৭ সালের সেনানিয়ন্ত্রিত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার।’ এ সরকারের সময়ই অনুষ্ঠিত হলো ২০০৮-এর সাধারণ নির্বাচন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারো ক্ষমতায় এলো একটি মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার, যা মহাজোট সরকার নামে পরিচিত।

বলতেই হবে, সীমাবদ্ধতা ও কিছু ন্যায্য সমালোচনার পরও এই সরকার বেশকিছু সাহসী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। এর একটি তিন যুগেরও বেশি সময় পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করা এবং অন্যটি একাত্তরের যুদ্ধাপারাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করা।

বলাই বাহুল্য, এই দুই পদক্ষেপ কেবল যুগান্তকরী নয়, সব অর্থেই দুঃসাহসী। কারণ ১৯৭৫ সালের আগস্টের রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধীরা যে বিজয় অর্জন করেছিল এর মধ্য দিয়ে নিশ্চিতভাবেই তার পরাজয় ঘটবে। অতএব বড় ঝুঁকি নিতে হয়েছে বৈকি শেখ হাসিনার সরকারকে। ঝুঁকি ও বিপদকে অস্বীকার করেই সরকার এগিয়ে গেছে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঐতিহাসিক পর্যায় শুরু হয়েছে ২০১০ সালে। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার যুগ পর এবং জাতীয় জীবনের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি বড় মাইল ফলক, যা জাতিকে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার পথে ধাবিত করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় অপূর্ণতা দূর করার পথকে প্রসারিত করেছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল চেতনা বিরোধী একজন সামরিক স্বৈরশাসকের হাতে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি দলটিই ছিল একমাত্র জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দল যা আওয়ামী লীগের বিপরীতে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজেকে বিকশিত করতে পারত। কিন্তু যা হওয়ার নয় তা হয়নি। দলটি ক্রমান্বয়েই পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি-পথ অবলম্বন করে এবং অনেকটা প্রত্যক্ষভাবেই জামায়াতে ইসলামীর কাছে সমর্পণ করে। এতে দলটির ভেতরে সীমিতভাবেও যে উদারপন্থীর অবস্থান ছিল তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এতে আরেক দফা লাভবান হয় জামায়াতে ইসলামী। এককালে যেমন মুসলিম লীগকে উদরস্থ করে নিজেকে বিকশিত করেছিল, এবারো জামায়াত বিএনপিকে উদরস্থ করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি নতুন মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে যেমন প্রবল সাহস ও প্রতিরোধ উপেক্ষা করে বিজয় নিশ্চিত করা হয়েছিল, এবারেও সেই সাহস ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে জাতিকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ ডিঙাতে হবে। এ কথা ভুললে চলবে না যে, যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তার শিকড়ে ফিরে নিয়ে যাওয়ার বিচার। অস্বীকার করা উচিত হবে না যে, একাত্তরের পরাজিতরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করার কাজে নিয়োজিত, তারা সংগঠিত। এর বিপরীতে বিজয়ীদের সংগঠিত এবং প্রস্তুতি সম্পন্ন করার কোনো বিকল্প আছে কি?
সুত্র

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.