নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শঙ্কাপ্রেম

মেহেদী হাসান তামিম

কবিতা ব্যক্তিগত মত নয়, বেদনাঘাত বা আনন্দৌন্মুখতা হতে যে উচ্চারণ বেরিয়ে আসে তাই কবিতা। -কাহলিল জিব্রান

মেহেদী হাসান তামিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

♥ অশান্তির থেকে কষ্ট উত্তম; জীবনের তিন অংশের ব্যবচ্ছেদ ♥

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৮

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন:

প্রীতিলতা ভেবেছিল রোমান প্রেমে গদগদ হয়ে তাকে যে সংক্ষিপ্ত নামে ডাকবে তা হয় প্রীতি নয়তো লতা, আর এর যদি একটু বেশী গদগদ হয় তবে বড়জোর প্রিয়ে বলে ডাকবে। এর আগের তার সব বয়ফ্রেন্ডরা তো তাই করেছিল। কিন্তু রোমান যে আসলেই ব্যতিক্রম সেটা আবারো করল প্রমাণ।

যেদিন ডিপার্টমেন্টে তাদের প্রথম ক্লাস ছিল প্রীতি সেদিন ঘুণাক্ষরেও বোঝেনি এই কাল বর্ণের কোঁকড়ানো আউলাচুলের বাউলাবেশের ছেলেটির সাথেই যে তার প্রেম হবে। যদিও রসের ছিটেফোটাও নাই তবুও ডিপার্টমেন্টের নামটি হলো রসায়ন। প্রীতি কোনদিন এটাও ভাবেনি তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কাঠখোট্টা নিরস বিভাগে ভর্তি হতে হবে। এমনিতে সারা জীবন কেটেছে কুমিল্লা সরকারী কলেজের গণিত বিভাগের মাস্টার যিনি শুধু সে বিভাগেরই না পুরো কলেজের সবচেয়ে কড়া মাস্টার হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন, তার কন্যা পরিচয়ে। বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই কুমিল্লা শহরের আশেপাশের এলাকার ছেলে মেয়েরাও তার কাছে যেত প্রাইভেট পড়তে। অন্য কোন ছাত্রছাত্রীরা ডাকলে প্রীতির কোন সমস্যা ছিলনা কিন্তু তার কলেজের বন্ধুরা যখন তার বাবাকে পাগলা কানাই বলে ডাকতো তখন তার শরীর রাগে ক্ষোভে কিটকিট করে উঠত। যদিও প্রীতি বাবার কলেজে ভর্তি হতে চায়নি, তবু সুড়সুড় করে সেখানে গিয়ে ক্লাস শুরু করার জন্য বাপের একটা হুংকারই যথেষ্ট ছিল। সেখানে প্রীতি মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েও ভর্তি হতে পারলনা তার বাবার ভাষ্য অনুযায়ী যেহেতু সে মেডিকেল কলেজটি সাত সাগর তের নদী পরের দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত। তার বাবা যেহেতু কোনদিন দিনাজপুরে যায়নি এবং তার ধারণা সেখানে যেতে হলে পুরো একটা দিন চলন্ত অবস্থায় থাকতে হয় তাই শেষ পর্যন্ত বাপের মেয়েকে ডাক্তার বানানোর শখটাকে বুড়িগঙ্গার ঘোলাটে, দুর্গন্ধময় পানিতেই বিসর্জন দিতে হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক- ইউনিতের ভর্তি পরীক্ষায় ৬১২ নম্বর সিরিয়াল প্রাপ্ত ছাত্রীটির তাই শেষ ঠিকানা হলো রসায়ন এবং রোকেয়া হলের এক্সটেনশন এর ১১২ নং কক্ষ।

আর প্রেম করার জন্য রোমান আজিজ যার বাড়ী কিনা পঞ্চগড়, দিনাজপুর থেকে আরো দুইঘন্টা সড়কপথ যে জেলার দূরত্ব। কিন্তু প্রেম, ভালোবাসা, প্রীতি, প্রহসন, দুঃশাসন তো আর জেলা উপজেলা শহর দেখে আসেনা। সে আসে নীরবে, টিপে টিপে পা ফেলে আর যায় যখন, তখন যায় আওয়াজ দিয়ে সবকিছু উথাল পাতাল, এলোমেলো করে দিয়ে।

যেহেতু প্রীতির কপালে প্রেম ছিল রোমানের সাথেই তাই কাল আর ধলো, বিতার্কিক আর তোতলা, ট্যারা না এনাক্ষী, লম্বা আর খাটো, হেমায়তপুর আর বোদা এসব কিছুই বিবেচনা কিংবা যাচাই বাছাই করার সময় ও সুযোগ কোনটাই হয়ে উঠলনা। শুধু আবেগ আর আবেগন, আবেশ আর আবেশন। সুযোগ হলেই হানিফ মামার নিথর ক্যান্টিন, মাঝেমাঝে চারুকলা হয়ে দৃক গ্যালারী। এরকম সময়গুলোতে ছেলেমেয়েরা বুঝি শিল্প সংস্কৃতির বিশাল সমঝদার হয়ে যায়। মাঝেমাঝে তাদেরকে এমন সব চিত্রপ্রদর্শনী অথবা বেইলীরোডের নাটকপাড়ার মঞ্চনাটকে আবিষ্কার করা যায় যেখানে হয়ত চারুকলা অথবা নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের একজন কেউও যায়নি বা সে ব্যাপারে কোনরকম আগ্রহই দেখায়নি। প্রেমিক যুগলের মধ্যে যে কিনা আবার সিংহরাশির জাতক বা জাতিকা সে সেসব প্রদর্শনীতে আধুনিক চিত্রশিল্পের গুরুত্ব নিয়ে আঁকা জটিল কোন চিত্র অপর পক্ষকে বোঝাতে সক্রিয় হয়ে উঠে। আমাদের গল্পের পাত্র পাত্রীর মধ্যে active বা সক্রিয় সদস্য প্রীতি আর passive বা মাথা নাড়িয়ে সবকিছুতে একমত পোষণ করা সদস্য রোমান। সে শুধু মাথা ডানে আর বামে, উপরে আর নীচে নাড়াত, আর প্রীতি এটা, ওটা, সেটা কত কি যে বোঝাত।

বিরোধী দলের মতো প্রয়োজন অপ্রয়োজনে সবসময় শুধু বিরোধীতাই নয়, বুঝুক না বুঝুক বিরোধিতা নয়, রোমান কখনো তে বিরোধীতা করেইনি যেন প্রীতিই তার আব্বা আম্মা, সব সিদ্ধান্তই একেবারে ঝাক্কাস ররকমের সঠিক, সে যা কিছুই বলুক দ্রুত মাথা ঝাকিয়ে, নাড়িয়ে শতভাগ ক্ষেত্রে প্রীতির যেকোন ভাবনার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করত। সবসময় সহমত পোষণ করার এই ব্যাপারটি প্রীতির সবসময় ভালো লাগত না, সে চাইত মাঝেমধ্যে তার প্রেমিক পুরুষ বুনোষাঁড় হয়ে উঠুক, হিংস্রতা প্রদর্শন করুক ব্যাঘ্রমামার মতো- আঁচড় দিয়ে গর্বিত দাগ ফেলুক গ্রীবা, পেট, নিতম্বে।

আমার সুচিন্তিত পর্যবেক্ষণ ও গো যোগ এষনা বলে এসময়গুলো দুনিয়ার প্রায় তাবত প্রেমিকযুগল একটা কমন রোগে ভোগে। যদিও এরোগের কথা ডাক্তার ফার্মাসিস্টরা জেনেছেন কিনা তা আমার জানা নাম, রোগটার কোন নাম আছে কিনা সে ব্যাপারেও এই অধম একেবারেই নিরেট অজ্ঞ। তবে এ রোগের নাম আমরা দিতে পারি lightophobia syndrome বা আলোকভীতি বা আলোক অসহিষ্ণুতা। প্রেমিকেরা এসময় শুধু প্রায়ান্ধকার ঘুপচি, জনমানব শূণ্য রেষ্টুরেন্টের আলোআঁধারি খেলা করা কেবিন বা ক্যান্টিন, ডিপার্মেন্টের খোলা ছাদ যা সবুজ শ্যাওলায় ছেয়ে থাকে, সামনে বিশাল পেটমোট গর্জন অথবা চাপালিশ গাছঘেরা পার্কের আড়াল বেঞ্চটি সম্পর্কে পুঙ্কানুপুঙ্খভাবে সঠিক খোঁজ রাখেন, এবং কেন সময়ে এসব যায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হলে অন্য কোন পার্টির আগে থেকে তা দখল করার সুযোগ থাকেনা সে সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় রোমানদেরকে কেউ খুঁজে না পেলে, সন্ধ্যার পরে কলাভবনের আঁধারময় গ্যারেজ, মলচত্বর, টিএসসির ভিতরে, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পেছনে, নাটমন্ডলের ডানেবামে একবার রেকি করলেই সাধারণত পেয়ে যাবার কথা।

তাদের প্রেম ছিল কচুপাতায় জমা ভোরের শিশিরবিন্দুর মতো পিচ্ছিল, তপ্তদুপুরে মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো অস্থায়ী - এই ভালো তো, এই ওবামা - পুতিন। শরীরের প্রতিটি পরতেপরতে অস্থিরতা, অভিমান, অভিযোগ আর আকর্ষণ ও আবেগ - প্রতিটি নড়াচড়া, প্রতিটি শব্দচয়ন, প্রতিটি বাক্যগঠনে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেও পেরে উঠে যায়না, ভুল একটা হয়েই যায়।

" সীমার দিকে তুমি অভাবে তাকিয়েছিলে কেন", "তোমাকে আজ পিংক কালারের টিশার্টটা পরে আসতে বলেছিলাম, পড়োনি কেন? ", "কোন নাপিতের কাছে চুল কেটেছো, ডান দিকটা সমান হয়নি কেন", " আজ কি টিথ ব্রাশ করোনি, যাও এক্ষুনি হলে যাও ব্রাশ করে আসো" - এরকম হাজার হাজার সমস্যায় এমুহূর্তে জর্জরিত রোমান। আসলে তার ঝগড়া করতে ভাল লাগেনা বা প্রীতির প্রতি তার ভালবাসাটা সুগভীর, অতল যাই হোকনা কেন, কোনভাবেই তাকে চটাতে চাইতনা রোমান। কারন এব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা ঘরপোড়া গরুর মতোই - চটিয়ে দিলে সব ধকল রোমানের, প্রীতিকে ম্যানেজ করতে ফুল কেনার বাড়তি খরচ, সারাক্ষণ ঘ্যাণরঘ্যানর করে আহ্লাদের আতিশয্যে প্রায় তার পায়ের কাছে নুঁইয়ে পড়া, চাংখারপুলে গিয়ে কালাভুনার সাথে দেশীমুরগীর ঝালফ্রাই দিয়ে ভাত খেতে গিয়ে অতিরিক্ত টাকা খরচ, সন্ধ্যায় হলের পেছনের ফোনে দোকানে গিয়ে নিজের মনে করে ফোনটি নিয়ে জাঁকিয়ে বসা এবং সেখানে অপেক্ষারত অসংখ্য মানুষদের রাগান্বিত চোখগুলোর দিকে না তাকিয়ে না বোঝার ভাণ করে কথা চালিয়ে যাওয়া, পারলে যেন টেলিফোনের ভিতর দিয়ে তার কাছে গিয়ে মাপ চেয়ে আসা, এগুলোর কথা চিন্তা করলেই অক্কা যাওয়ার দশা হয় রোমানের, যেকোন মূল্যে সে এসব প্রতিহত করতে চায়।

সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি প্রীতিলতার নামটা সংক্ষেপ করে সেটা বললে এভাবে প্রীতি জ্যান্ত শিং মাছের মতো তড়াক তড়াক করে লাফানো শুরু করবে। সেদিন সকাল সকাল একটি বিশাল লাল গোলাপ ( সম্ভবত ফার্মে চাষ করা, মুরগীর মতো ফার্মের গোলাপ) শাহবাগ থেকে কিনে রোমানকে কল দিয়ে হল থেকে বের করল। ক্যান্টিনে নাস্তা খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় খুব আদুরে আদুরে, আহ্লাদে আটখানা নয়, আঠারোখানা হওয়ার সম্ভবনাই বেশী- সেরকম হয়েই জিজ্ঞেস করল,

- রোম আমার জানটুস রোম পাখি তোমার আমাকে এতবড় এই নাম প্রীতিলতা ডাকতে কষ্ট হয়না বুঝি! তুমি রোমিও একেবারেই রোমান্টিক না, ভালবেসে আমার নামটা একটু ছোট করে নিলেও পার।

রোমান ভাবল আবার কি থেকে কি হয়ে যায়, তাড়াহুড়ো করে বলল,
- ময়নাপাখি তোমার নামতো অনেকআগেই মনেমনে ঠিক করে রেখেছি।

শুনতেই প্রীতি আনন্দিত হয়ে কাঁধে চড়াটাই বাকী রাখল শুধু, ব্যাপক উৎসাহ আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করল কি, বলোনা কি ভেবেছো আমার নাম? বলো, বলো, তাড়াতাড়ি বল, তুমি আগেই ঠিক করে রেখেছো আমাকে তা বলোনি, দেখেছো কি দুষ্টু তুমি!
একটুক্ষণ চুপ করে থাকল রোমান, তারপর বলল,
- তোমার নাম প্রীতিলতার মাঝখানের দুটি অক্ষর নিয়ে তোমায় এখন থেকে ডাকব আমি "তিল"। আমার আদরের - তিল।

বিবাহিত জীবন :

স্বাভাবিকভাবে ছেলে মেয়েরা সমবয়সী হলে ছেলেদের প্রতিষ্ঠিত হতে একটু বেশীই সময় লাগে। দুজনে একসাথে পাস করে বেরুলেও মেয়েটির যে চাকরি নেই সেটা চোখে না পড়লেও, ছেলেরটা ঠিকই চোখে পড়বে। অবস্থাদৃষ্টে রোমানের দশা তাই, যেহেতু সে কোন আয় রোজগার করে না, তাই সাক্ষাতকার আর এর ওর ওখানে পরিচিত হতে পাঠানোর কারণটা খুব সহজে টের পেল সে। সবাই যাচাই করে নিতে চায় তাদের মেয়েটাকে চালানোর যোগ্য কিনা ছেলেটা। রোমানের এক পর্যায়ে খুব বিরক্ত লাগতে শুরু করল, এমনিতে বিসিএসে রেজাল্ট দেয়না তার উপরে উঠতে বসতে প্রেমিকার থ্রেড,
- আমার কিন্তু এবার আর কিচ্ছু করার থাকবে না। আর আটলাতে পারছিনা, বাসা থেকে মনেহয় আর সময় দিবে না।
রোমানের সোজা উত্তর,
- দাড়াও প্রধান মন্ত্রীকে ফোন করে বলি, কেন আমার বিসিএসের রেজাল্ট দিচ্ছেন না, আমার প্রেমিকাকে কিন্তু আর রক্ষা করতে পারছি না। এর দায় কিন্তু আপনাকেই নিতে হবে।

যাইহোক বহু ঝামেলার পরে রোমান ও প্রীতিলতার বিয়েটা শেষমেষ হলো। প্রীতিকে বিয়ে করতে কম পেরা নিতে হয়নি রোমানকে, আজ বড় আপার কাছে তো কাল মেজ আপার কাছে ভাইভা, পরিচিত হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। বহু সাধনার পরে চড়াই উতরাই পেরিয়ে অবশেষে রোমান ও প্রীতির পরিচয় হলো বর বৌ।

প্রথম কয়েকমাস আনন্দ আর আনন্দ। আকাশে বাতাসে চারিদিকে যেখানে তাকায় তাদের ভালো লাগে। কিন্তু এর পর প্রীতির মধ্যে পেয়ে বসল প্রতিষ্ঠিত হবার বাসনা। তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ইন্টারভিউ, রিটেন এর কার্ড আসতে থাকে। রোমানের মনে ভাবনা হলো আমি তো বিসিএস চাকরি করছিই, প্রীতির কেন চাকরি করতে হবে। মুখে কিছু না বললেও ভাবভঙ্গিতে রোমান প্রীতিকে বুঝিয়ে দেয় তার চাকরি করার ব্যাপাটা তার পছন্দ হচ্ছেন। প্রীতি বুঝলেও মুখে কিছুই বলে না, মনে মনে ভাবে, এত কষ্ট করে এতদূর পড়াশোনা করলাম সংসারের এই হেঁসেল ঠেলবার জন্য!

একদিন একটা মাল্টিন্যাশনাল এনজিওতে একটা ভালো পজিশনে চাকরি পেয়েও গেল প্রীতি। এই হলো শুরু। রোমানের সরকারী অফিস, ৯ - ৫ টা। প্রীতির তো ওভাবে অফিস করার সুযোগ নেই, বেতন হয়ত বেশী দেয় তারা কিন্তু প্রতিটি টাকার বিনিময়ে কাজটায় একেবারে কড়ায়গন্ডায় আদায় করে নেয়।

যার কারনে প্রীতিকে রোমানের আগেই সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতে হয়। আবার বিকেলে অফিস থেকে ফিরেও রোমান কোনদিন পায়না তার বউকে। সে সময়টা তার ভীষণ একাকীত্বে কাটে, মনের মধ্যে উদয় হয় যত উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা। শুরু হয় দ্বন্দ্ব, মনের উথালপাতাল, ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। প্রথম দিকে কথায় কথায় বিরক্তি, তারপরে সেটা রুপ নেয় বিবাদ কলহে।

কেউ কারো কাছে ছোট হতে চায়না। দুজনেই ভাবে এটা অপরপক্ষের দায়িত্ব। একবারের জন্য কেউ নিজেদের মধ্যে এ বিবাদের কারণ, একজনের অন্যজনের কাছে চাওয়া পাওয়া, কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় তা নিয়ে কোনরকম কথাই বলেনা। বরং অন্যের প্রতি অভিমান ও প্রত্যাশা জমতে জমতে একসময় হিমালয়সম পাহাড় জন্মম হয়। দুজনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন পরামর্শ দেয় বাচ্চা নেবার। রোমান প্রীতির মনের ইচ্ছাটাও তাই। কিন্তু ওইযে দুজনেই তারা ভাবে আমি কেন বাচ্চার কথা বলব এটি কি ওর দায়িত্ব নয়! এভাবে চলতে থাকল বেশকিছু দিন।

যাদের জীবনে একসময় এতো প্রেম ভালোবাসা এসেছিল তারা এখন শুধিমাত্র একি ঘরের ছাদের নীচে ঘুমায়, কেউ কারো অন্তরের খোঁজ রাখেনা। কারো মনে বিন্দুমাত্র শান্তি নেই। অফিসে, বাহিরে সব জায়গাতেই নিজের কাজগুলো ঠিকমতোই করে, মানুষজনের সাথে হেসে কথা বলে, যেসব প্রোগ্রামে স্পাউসদের সাথে নিতে হয় সেখানে তারা একসাথেই যায়। তবু কিছু করেই কোন শান্তি পায়না, বুকের মধ্যে চাপা একটা ব্যাথা যেন সবসময় অনুভব করে। যেন তাদের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্বের ব্যবধান তৈরী হয়েছে। কেউ একজন এগিয়ে আসেনা, কোন স্পর্শ নেই, আদর নেই, মায়া মমতা নেই, রাগ অভিমান নেই এমনকি একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের কোন অভিযোগ অনুযোগও নেই।

এর পরের জীবন....

দূরত্বকে বাড়তে দেয়ার সু্যোগ দেয়া হলে, প্রশ্রয় দেয়া হলে, নিজের কাছে জীবনের থেকে ইগো'র মূল্য বেশী হলে, স্বামী স্ত্রীর এই আত্মিক সম্পর্কে কেউ কারো কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করলে, আলোচনা করে নিলে - ঝগড়া করার পরে বেহায়ার মতো আদর করে দিলে, কেউ কোনদিন যে নিজেদের কাছে ছোট হয়না এটা না বুঝে নিজের জিদ ধরে রাখলে, স্বর্গীয় সম্পর্কটি স্পর্শহীন ছায়াহীন মায়াহীন হলে - ঠিক যা হবার রোমান প্রীতির জীবনে তাই ঘটলো। নিত্য বহতা নদীর মতো প্রতিমুহূর্তের অশান্তি তারা আর নিতে পারছিল না যেন কেউই, কোনভাবে। তাদের মনে হল, প্রতিদিন তিলেতিলে পাওয়া সে অশান্তি থেকে অন্তত মুক্তি প্রয়োজন। কিন্তু কি আশ্চর্যরকম ভাবে পৃথিবীতে মানুষের সংসারের আরো কিছু ভয়াবহরকম সমস্যাগুলোর কাছে তাদের এই সমস্যাটি যে নিতান্ত ক্ষুদ্র, নিতান্ত জন্মশিশু, এর গাণিতিক মান যে শূণ্যের প্রায় কাছাকাছি, সেটা নিয়ে একবারো ভাববার অবকাশ হলোনা তাদের দুজনের কারুরোই!

তবে কি আসলেই তাদের অশান্তি থেকে মুক্তি মিলেছিল। দুজনের মধ্যে নিজ অন্তরে সে মুহূর্তেটিতেও ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি তো নেই - ছিলনা শুধু তার প্রকাশ, তাতে সামান্যতম খাদও নেই, শুধু কে এগিয়ে যাবে সে সিদ্ধান্তটা দুজনের কেউই সময়মতো নিতে না পারায় সম্ভবত আজকের এ পরিণতি। দুজনে নিজেদের থেকে দূরে গিয়েই মনে হয় তারা যেন আগের থেকে আরো বেশীবেশী কাছে।

অশান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে না আসতেই দুর্বার, দুর্মর, দুর্জেয় কষ্ট সুনামির প্রবল বেগে যে ছেয়ে পড়েছে তাদের শরীর, মন, প্রতিটি অস্তিত্বের খাখা শূন্য আর মৃত্যুপুরীর নির্জনতা নামা ধুধু বিরানভূমিতে! তা নাহলে রাস্তায় সেই চটপটির দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় বারবার দুটি চোখ কেন সেই দুটি চোখকে খুঁজবে, প্রয়োজন না থাকলেও কেন সে বারবার পার্কের সেই বেঞ্চটিকে দূর থেকে দেখতে যাবে যেখানে একদিন তাদের জীবন ছিল, বারান্দায় বসে থাকার সময়ে কোন ঘুড়ি উড়ত দেখলে কেন কানখাড়া করে পাশ থেকে কেউ আনন্দে চিৎকার দিল কিনা তা শুনতে ইচ্ছে হবে, কেন সেই চেনা পারফিউমের সুগন্ধ নাকে এলে মন অস্থির হয়ে উঠবে; অথবা রাস্তায় ক্যাটকেটে সবুজ রংয়ের শার্টটা দেখলে কেন সে চমকে উঠবে, কোথাও চা খেতে বসলে কেন তার চোখ বেয়ে আপন ধারায় পানি গড়িয়ে পড়বে, কোন বাচ্চা ট্রাফিক সিগনালে এসে ফুল নিয়ে দাঁড়ালে কেন তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়, ঘরের কলিংবেলটা বেজে উঠলে কেন বারবার সে চমকে উঠে; অথবা কোন চিঠি এলে খুব দ্রুত খামের উপরে প্রেরকের নাম ঠিকানা দেখে দুজনের মনটাই ভীষণ খারাপ হবে, মোবাইলে টুটটুট করে এসএমএস আসতেই কেন মনটা আানচান করে উঠবে, আগ্রহভরে পড়ার জন্য মেসেজটি ওপেন করেও একটি লাইন না পড়েই কেন ফোনটি সোফায় ছুঁড়ে ফেলবে, কোন ফোনকল এলে দৌড়ে গিয়ে ধরতে গিয়েও কেন কলটি ধরবে না, কিসের প্রতীক্ষায় কিছুক্ষণ পরপর, কার নাম স্ক্রিনে ভেসে উঠবে আশায় সেখানে চোখ চলে যায়, বন্ধু তালিকায় না থেকেও কেন বিশেষ একজনের প্রোফাইল নিয়েই ফেসবুকে যত আগ্রহ হবে, অনলাইনে থাকা বন্ধুদের কোনটির দিকে না তাকিয়ে শুধু একজনের পাশে সবুজ চিহ্ন জ্বলে উঠলে খানিক শান্তি আর ততোধিক কষ্ট মিশ্রিত অনুভূতি চেপে ধরবে, বারবার সব কিছু, স- অ- ব মুছে ফেলেও, কেন মুছেফেলা সবকিছুই বারবার ফিরে ফিরে পেতে ইচ্ছে করবে, সকালবেলায় কেনইবা বালিশগুলো ভিজে থাকবে!

অদ্ভুতভাবে রোমান, প্রীতিলতা দুজনের কেউই জীবনান্দ দাশের কবিতার খুব ভক্ত না হলেও এখন তাদের সবথেকে বেশী পছন্দ জীবনানন্দ, আরো বেশী করে তাঁর যে কবিতাটির কয়েকটি লাইন প্রতিমুহূর্তে দুজনে সমানরকম অনুভব করতে থাকে,

আলো অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্‌ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়,- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়- পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।

#tamimbooks

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.