![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতা ব্যক্তিগত মত নয়, বেদনাঘাত বা আনন্দৌন্মুখতা হতে যে উচ্চারণ বেরিয়ে আসে তাই কবিতা। -কাহলিল জিব্রান
- নে বাপধন, এলা এইডাই খায়া নে। আইতত তেরাণ আসবাইর পারে। তখোন হামরা খেঁচুরি খামোনে।
মোকাররম নিজেও কথাটার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয়ে আছে। তবু সাত বছরের অতটুকু ছেলেটার কষ্ট সহ্যও করতে পারছে না। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেই বাপের অন্তরটা হুহু করে উঠছে। এমনিতেই মুখটা অনেক ছোট্ট তার উপর একদিন তেমন কিছুই না খাওয়াতে সেটা শুকিয়ে যেন বাতাসে উড়তে থাকা পায়ের নীচে পড়লে মরমর শব্দে চূর্ণ হয়ে যাওয়া বড়গাছগুলো থেকে পড়ন্ত শুকনো মরাপাতার মতোই মরমরে দেখাচ্ছে আমির আলীর মুখটা। নিজের উপর খুবই বিরক্ত মোকাররম কেন ছেলেটারে মায়েদের সাথে আগেই শহরের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠায় দিলনা। অবশ্য তখনো বানের পানি এত দ্রুত যে বেড়ে যাবে কেউই বুঝে উঠতে পারেনি। এতো বয়স্ক, গ্রামের সবচেয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষ ইদ্রিস আলী মোকাররমের তাড়াহুড়োকরে মা বৌ আর দুইটা আন্ডাবাচ্চাকে শহরের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠাতে দেখে বলে উঠেছিল,
- কি মিয়া, তুইতো দেখছ জোর করি বাণ নামাবু এইঠেকোনা। আরে অত্তি খুলিত দেখি আনু পানি এলাও বিরিজের মেলা নীচত আছে।
ইদ্রিস চাচার সেই কথাটা মনে করে এখন শান্তনা খোঁজার চেষ্টা করছে মোকাররম। তার বড়ভাই গফুর মিয়া তো উল্টো বকাই দিয়েছিল তাকে,
- আরে মুই বুঝনুনা তোমরাগুলা এতো কেনে উতলা হইলেন। এত্তি এত বাণের পানি উটবার দেখছে কেউ কুনদিন। আরে এরশাদের আমলেত তো হামার গ্রামত এত পানি আইসে নাই।
- ভাইজান, এটা তুই কি কহেচিস, আইসেনাই বলি আর আইসেবেনা কুনো গেরানটি কওয়া যায়। মুই কহেছো তুইও ভাবীকসহ তামানগুলাক একসাথে পাঠায় দে কেনে। হামরা এলা ঘরের জিনিসপাতি গোছ করি বৈকালে যাইম।
গফুর ছোট ভাইয়ের কথা তো শুনেইনি বরং বলদ বলে গালি দিয়ে মোরের দোকানঘরে গরুর দুধের পানসে চা খেতে চলে গিয়েছিল। এখন দুই তিন ঘর পরের ছাদে পুরো পরিবারসহ গুটিশুটি মেরে বসা থাকা ইদ্রিস পারতপক্ষে মোকাররমের ঘরের ছাদের এদিকটায় তাকাচ্ছে না। ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে তার এটা কোন ব্যপার না, একটু পরেই পানি নেমে যাবে আর সে তখন ছোটভাইয়ের বলদামির ঘটনা রৈরৈ করে সারা গ্রামে বলে বেড়াবে। কিন্তু পানি নামার তো কোন লক্ষন নাই বরং বাড়ছে হুহু করে। ঘন্টাখানিক আগেও মোকাররম সুপারি গাছটার উপর থেকে নীচের দিকে গুনে ১৩ নম্বর গিটে পানির চিহ্ন মনে মনে দিয়ে রেখেছিল। কিছুক্ষণ পরপর গুনছে আর ঘেমে উঠছে সে, প্রতিবার গোনার সময়ে এক এক করে গিট কমতে কমতে সেটা এখন সাতে গিয়ে নেমেছে। বেশ কিছুক্ষনধরে আর অবশ্য সাত থেকে নামতে হয়নি এটা ভেবে কিছুটা হলেও ভাল লাগছিল মোকাররম মিয়ার। গতকাল সকালের কথা মনে হলো তার, এই সময়ে সে তখন জমির আলীর ক্ষেতে দিনচুক্তি কাজ করছে, তার বারবার মনে হচ্ছিল আগেরদিন সেসময়ে সে আর মনছুর মিলে দুই জমির মাঝের আইলে বসে মহাজনের বাড়ী থেকে পাঠানো কড়া করে পোড়ানো শুকনো মরিচ আর খাটি ঝাঁঝালো ঘানিতে ভাঙানো সরিষার তেল দিয়ে বানানো লালআলুর ভর্তার সাথে বিঘতখানিক পানিতে ডোবানো একগামলা পান্তাভাত আর প্রায় একমুঠো কাচা লবন দিয়ে চুকচুক করে পান্তাভাতের অমৃতের থেকে ঢের বেশী স্বাদের পানিটুকু পরম যত্নে খুব সন্তর্পণে খুব ধীরে ধীরে যতটা ধীরে খাওয়া যায় তার থেকেও আরো ধীরে যাতে তাড়াতাড়ি তৃপ্তিটা শেষ না হয়ে যায়, সেই খাবার ঘটনাটা। পান্তা খাবার সময় একটিবার ছেলে আমির আলীর কথা অথবা পরিবারের কথা তার মাথায় আসেনি অথচ এখন সেই ঘটনাটিই তাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছে। তার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল কেন সে কোনদিন কিছু খাবার সময় ছেলেটার কথা, পোয়াতি বৌটার কথা তার মনে পড়েনা।
মানুষ বিপদে পড়লেই মনে হয় সবচেয়ে বেশী অতীতের অপরাধের কথা মনে করে আর খোদার কাছে সেই কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে, মাফ চায়। এ যেন প্রিয় সন্তানের তার বাবা মার কাছে বারবার শপথ করা সেই "আর করব না বাবা" কথামালার মতোই "খোদা এইবার আমারে এ বিপদ থেকে উদ্ধার কর তারপর আমি সবসময় তোমাকে স্মরণ করে চলব, ভুলেও কোন ভুল করব না"। মোকাররম কিন্তু সত্যিকার অর্থেই ভাবছে, আল্লাহ শুধু আমার ছেলেটার জন্য হলেও তুমি কোন ফেরেশতারুপী মানুষের দ্বারা কিছু হলেও একটা খাবার পাঠিয়ে দাও, বাকী জীবনটা তোমার গোলাম হয়েই কাটিয়ে দিব। সেই চা-মুড়ি খাওয়া সকালে গ্রামের যে ছেলে দুইটাকে মোকাররম সবচেয়ে অপছন্দ করত তারা কিভাবে যেন দুটো কলাগাছকে কিছুটা ভেলার মতো বানিয়ে ভাসতে ভাসতে এসে এককোচা মুড়ি দিয়ে গেল তারপর কিছুক্ষণ আগে কয়েকটা শালুক, কুমড়া ফুল দিয়ে গেছে। মুড়ি কিভাবে পেয়েছিল সেটা জানার প্রয়োজন মনে করেনি সে, শুধু তার অপছন্দ করা ছেলে দুটির জন্য অন্তর নিংড়ে দোয়া বেরিয়ে এসেছিল মনের অজান্তেই,
- আল্লাহ তোমগেরে ভাল করবে...
কোনদিন মোকাররমের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন ছিলনা যে পুকুর ডোবা থেকে শাপলা শালুক অথবা কুমড়া ফুল ছিড়ে কাঁচাই খেতে হয়। জমির আলীদের মতো অতটা অবস্থাসম্পন্ন না হলেও হালচাষ মজুর কামলাগিরি করে অন্তত ভাতের অভাবে পড়তে হয়নি কোনদিন। বৎসরে দুই তিনবার তো গরুর মাংস, মুরগীর মাংস, সুগন্ধি চিকন চালের ভাত খেতে পারে তারা। মোটামুটি সুখের সংসার, অভাব নাই, চাহিদা নাই, কিছুতে আপত্তি নাই, চোখে সুরমা লাগিয়ে গায়ে আতর দিয়ে মাসে দুই-একবার শহরে গিয়ে ছারপোকাদের বসতবাড়ি ভাঙ্গা মরচে পরা চেয়ারে বসে পর্দার একেবারে সামনের দিকে বসে বাংলা সিনেমার মোটামোটা নায়িকাদের নাচ গান, আর শাকিব খানের ডায়ালগ শুনে শিষ দেওয়া অথবা নায়িকার শ্বশুরবাড়ীর অত্যাচার দেখে চোখ ভাসানো, ফেরার পথে বৌ বাচ্চাদের জন্য খেসারী ডালের তেলচুপচুপে বরফঠান্ডা বড়া'র জীবনটা ভালোই লাগে মোকাররমের। কিন্তু তার মনে হলো সে যে কখনো আল্লাহকে ডাকা বা নামাজ পড়ার কথা চিন্তা করেনি সেকারণেই আজ এতোবড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সে বেশী কষ্ট পাচ্ছে তার অপরাধের সাজা ছেলেকে ভোগ করতে হচ্ছে এই ভেবে। নিজেই কাঁচা শালুক চিবিয়ে খেতে গেলে সবকিছু ঠেলে কিছু না থাকা পেট থেকেও কি যেন উগরে বের হয়ে আসতে চাইছে, ছেলেকে কিভাবে জোর করবে। সেসময়ে মনে হচ্ছিল তার সেমুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যর্থ মানুষ, ব্যর্থ পিতা সে, চোখের সামনে সন্তান ক্ষুধার জ্বালায় কাতরাচ্ছে অথচ কোনকিচ্ছু করার সামর্থ্য নাই তার।
সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। চারিদিকে সবকিছু কেমনজানি নিশ্চুপ নিস্তেজ নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে। বড় ভাই ইদ্রিস শরীরটাকে এলিয়ে দিয়েছে, অনেকক্ষণ হয়েছে বিড়ি ধরায় না আর, হয়ত শেষ সব, তার দৃষ্টিতে "কোন ব্যপার না" ভাবটা এখন আর একেবারেই নেই বরং মাঝেমাঝে সে ছোটভাইয়ের দিকে অসহায় আকুতিভরা অজানা কোন দৃষ্টিতে একটু পরপর তাকাচ্ছে। মেকাররমের চোখও একটা শূন্য দৃষ্টি আর দীর্ঘশ্বাস দিয়ে তার উত্তর দিচ্ছে। ছেলেটার শরীরে আর একবিন্দু শক্তি বোধহয় অবশিষ্ট নেই, সে এখন আর কাতরাচ্ছে না, ফুপিয়ে কাঁদছেও না।
প্রকৃতিতে সূর্যের কোন ন্যুনতম চিহ্নও নাই। পানি এখন স্থির, মাঝদুপুরে সূর্যটা যখন বরাবর মাথার উপরে ছিল তখন সুপারি গাছের যে ছয়টা গিট গুনেছিল মোকাররম, যতক্ষন আলো ছিল সে পর্যন্ত আর তার কোন পরিবর্তন হয়নি। তার শরীরটা, চিন্তা করার শক্তিটাও মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে শূন্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। আবছা অন্ধকার তার, তার মতো সে গ্রামের অনেকের দৃষ্টি এখন গ্রামে ঢোকার সে রাস্তাটির দিকে, যা পানির নীচে বিলীন। তবু তাদের ক্ষয়ে যাওয়া ঝাপসা দৃষ্টিগুলোর মনে হচ্ছিল বিলীন হওয়া সেই রাস্তার মিলিয়ে যাওয়া প্রান্তটি দিয়ে কয়কজন দেবদূত ছলাত ছলাত শব্দ তুলে এক ডেস্ক খিচুড়ীভরা নুহ নবীর নৌকার মতো একটি নৌকা তাদের দিকে জীবন নিয়ে এগিয়ে আসছে।
১৫ আগষ্ট ২০১৭
প্রচ্ছদ শিল্পী - ধ্রুব এষ
©somewhere in net ltd.