নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শঙ্কাপ্রেম

মেহেদী হাসান তামিম

কবিতা ব্যক্তিগত মত নয়, বেদনাঘাত বা আনন্দৌন্মুখতা হতে যে উচ্চারণ বেরিয়ে আসে তাই কবিতা। -কাহলিল জিব্রান

মেহেদী হাসান তামিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

♥জীবনানন্দ দাশ: চেনা অচেনার গন্ডি পেরিয়ে♥ -------------------- মেহেদী হাসান তামিম

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৫

রাত্রি ১১টা ৩৫ মিনিটে আজকের এই দিন ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ সালে কবি জীবনানন্দ দাশের দেহ জীবন ত্যাগ করেন। তাঁর প্রতি আনত শ্রদ্ধার্হ



"আমি কবি – সেই কবি – আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরাপালকের ছবি" সে কবি বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি, তিমির হননের কবি, তিনি কবি জীবনান্দ দাশ। যে ছেলেটির মাতা ছিলেন গৃহস্থ পরিবারের আদর্শ একজন নারী, সেই কুসুমকুমারী দাশের কবিতা - আদর্শ ছেলে,
'আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে '
- যখন বাঙালী সমাজের শিশুশ্রেণীর অন্যতম পাঠ্য, তাঁরই সন্তান কালের ডাকে যে 'জীবনানন্দ দাশ' হয়ে উঠবেন সেটা সহজে অনুমেয়। কবি জীবনানন্দ কে হয়ত চেনা সম্ভব কিন্তু ব্যক্তি জীবনানন্দকে আমরা কতটা চিনি! একজন ব্যক্তি তাঁর জীবনে কতটা বোধের অধিকারী হলে কবি জীবনানন্দ হয়ে উঠেন, হয়তবা একজীবনে তা উপলব্ধি করা সম্ভবও নয়!

দুইভাই একবোনের মধ্যে শিক্ষক ও সাহিত্যপীপাসু পিতামাতার সর্বজ্যেষ্ঠ সন্তান; তাঁর ডাকনাম ছিল মিলু।পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন বলেই ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের গান শুনে তার বেড়ে ওঠা।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে আট বছরের মিলুকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে ১৯১৫ সালে ম্যাট্রিকি এবং ১৯১৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজীতে অনার্স সহ বিএ ডিগ্রী,১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপরে তিনি আইন নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলেও তা শেষ করেননি।

তাঁর ৫৬ বসন্তের ছোট্ট একটুকরো জীবনটি কেটেছে চরম দারিদ্র ও সংগ্রামের মধ্যে। পেশা মূলত শিক্ষকতা হলেও কর্মজীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে কোথাও থিতু হতে পারেননি। তিনি অধ্যাপনা করেছেন বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যার মধ্যে আছে সিটি কলেজ, কলকাতা (১৯২২-১৯২৮), বাগেরহাট কলেজ, খুলনা (১৯২৯); রামযশ কলেজ, দিল্লী (১৯৩০-১৯৩১), ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল (১৯৩৫-১৯৪৮), খড়গপুর কলেজ (১৯৫১-১৯৫২), বড়িশা কলেজ (অধুনা 'বিবেকানন্দ কলেজ', কলকাতা) (১৯৫৩) এবং হাওড়া গার্লস কলেজ, কলকাতা (১৯৫৩-১৯৫৪)। তাঁর কর্মজীবন ছিল বন্ধুর, খরস্রোতা নদীর মতো, কখনো চর জাগে তো কখনো তলিয়ে যায় গভীর অতলে। জীবিকার প্রয়োজনে কবিকে জীবনভর যুঁঝতে হয়েছে। চাকুরী খুঁজতে তার জীবনে অনেক চটির সুখতলি ক্ষয়ে গিয়েছে। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে দারুনভাবে আর্থিক এবং মানসিক সহযোগীতা যুগিয়েছেন কবিকে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর সময় তিনি হাওড়া গার্লস কলেজ কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ বেকার জীবনে তিনি ইন্সুরেন্স কোম্পানীর এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন এবং জীবনের অধিকাংশ সময়ে গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালিয়েছেন। বন্ধুর সাথে ব্যবসায়ের চেষ্টাও করেছিলেন বছরখানেক। দারিদ্র্য এবং অনটন ছিল তার কর্মজীবনের নিত্যসারথী।

কবি ছিলেন অসম্ভব গম্ভীর প্রকৃতির এবং চরম ধৈর্যশীল একজন ব্যক্তি মানুষ। ভালোবাসতেন পরিবারকে, সংসারের টুকিটাকি কাজগুলো ভালবাসতেন। দুই ছেলে মেয়ে, স্ত্রী লাবণ্যের পেন্সিলের মাথা ধার করা, ফাউন্টেন কলমে কালি ভরার কাজগুলো নিয়ে কখনো ভাবতে হতনা। এমনকি ছেলেমেয়েকে রাত জেগে ঘুম পাড়ানোতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ভালবাসতেন গুরুত্ব পেতে, সামান্য অসুখে আশা করতেন সেবা শুশ্রূষা পেতে। তাঁর রাশভারী স্বভাবেও মাঝেমাঝে কৌতুক করতেন । আর খেতে ভালোবাসতেন ডিম। ডিমের যেকোন পদ দেখলেই তিনি লোভ সামলাতে পারতেন না। ছেলের পাতের থেকে ডিমের কিছু অংশ খাওয়া নিয়ে বাপ ছেলের খুনসুটি প্রায়শই লেগে থাকতো।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তাঁর স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' কবিতাটি লিখেন, বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যা পরবর্তীতে ১৯২৭ সালেতাঁর প্রথম কাব্য সংকলন 'ঝরা পালক' এ স্থান করে নেয়। সেসময় থেকে বিভিন্ন নামীদামী পত্রিকা কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতিসহ অন্যান্য পত্রিকাতে তাঁর বিভিন্ন লিখা ছাপা হতে থাকে। সে সময় থেকেই তিনি তাঁর পারিবারিক উপাধি 'দাশগুপ্তের' বদলে কেবল 'দাশ' লিখতে শুরু করেন।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৯ই মে তারিখে তিনি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকা শহরে, পুরোনো ঢাকায় সদরঘাট সংলগ্ন ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। লাবণ্য গুপ্ত সে সময় ঢাকার ইডেন কলেজে ছাত্রী ছিলেন। জীবনানন্দ দাশের বিয়েতে কবি বুদ্ধদেব বসু, অজিতকুমার দত্ত প্রমুখ কবি উপস্থিত ছিলেন।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্মের কাছাকাছি সময়ে তাঁর 'ক্যাম্প' কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত 'পরিচয়' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন। কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার, অনেকে কবিতাটি অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন।

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি একগুচ্ছ গীতিকবিতা রচনা করেন যা তাঁর রূপসী বাংলা কাব্যের প্রধান অংশ। এই কবিতাগুলি জীবনানন্দ বেঁচে থাকা অবস্থায় প্রকাশ করেননি। ১৯৫৪-তে তাঁর মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তাঁর বোন সুচরিতা দাশ এবং ময়ুখ পত্রিকা খ্যাত কবি ভূমেন্দ্র গুহ।

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ তাঁর পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন কলেজে ফিরে সেখানকার ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সে সময়ে কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমর সেন একটি নতুন কবিতা পত্রিকা বের করেন, যার নাম "কবিতা"। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতে জীবনানন্দের 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি স্থান করে নেয় । কবিতাটি পড়ার পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেবকে লেখা একটি চিঠিতে একে 'চিত্ররূপময়' বলে মন্তব্য করেন। কবিতা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে (পৌষ ১৩৪২ সংখ্যা; ডিসে ১৯৩৪/জানু ১৯৩৫) তাঁর সেই অমর "বনলতা সেন" কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ১৮ লাইনের কবিতাটি বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম এখনো। পরের বছর জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "ধূসর পাণ্ডুলিপি" প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দ এর মধ্যেই বরিশালে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলেন।

১৯৩৬ এর নভেম্বরে তাঁর পুত্র সমরানন্দের জন্ম হয়। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা সংকলন সম্পাদনা করেন, যার নাম ছিল "বাংলা কাব্য পরিচয়" এবং এতে জীবনানন্দের 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি স্থান পায়।

১৯৩৯ সালে কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হিরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়, যাতে জীবনানন্দের চারটি কবিতা - পাখিরা, শকুন, বনলতা সেন এবং নগ্ন নির্জন হাত অন্তর্ভুক্ত হযেছিল।

১৯৪২ সালে কবির পিতৃবিয়োগ হয় এবং ঐ বছরেই তার তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ "বনলতা সেন" প্রকাশিত হয়। বইটি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা-ভবন হতে 'এক পয়সায় একটি' সিরিজের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ষোল। বুদ্ধদেব ছিলেন জীবনানন্দের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং তাঁর সম্পাদিত 'কবিতা পত্রিকা'য় জীবনানন্দের অনেক সংখ্যক কবিতা ছাপা হয়।

১৯৪৪ সালে তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ "মহাপৃথিবী" প্রকাশিত হয়। আগের তিনটি কাব্যগ্রন্থ তাঁকে নিজের পয়সায় প্রকাশ করতে হলেও, প্রথমবারের মতো তিনি তাঁর কবিতার বইয়ের জন্য প্রকাশক পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে প্রকাশিত এই কবিতগুলোতে যুদ্ধের প্রভাব দেখা যায়।

চাকরির প্রয়োজনে বরিশালে প্রত্যাবর্তন করলেও তিনি কলকাতায় অভিবাসনের কথা ভাবতেন। সুযোগ হলেই স্টিমারে বরিশাল থেকে খুলনা তারপর ট্রেনে বেনাপোল হয়ে কলকাতায় পাড়ি দিতেন।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট দেশভাগ স্থির হওয়ায় কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে সপরিবারে কলকাতায় ভাই অশোকানন্দের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে চলে যান। একান্ত প্রিয় বরিশালে আর ফিরে যাওয়া হয়নি তাঁর।

কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। তারিখটা ছিল ১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ সাল ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল, ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠ, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। অনেকে ধারণা করেন হয় আত্মহত্যা স্পৃহা ছিল দুর্ঘটনার মূল কারণ। অনেক জীবনানন্দ গবেষক মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর বাঁচার স্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা যেন কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন, যার কথা তাঁর কিছু লিখাতেও পাওয়া গিয়েছে।

গুরুতরভাবে আহত জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাঁকে উদ্ধার করে। তাঁকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। এ সময় ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ-সহ অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। তবে জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত্রি ১১টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। গত এক শত বৎসরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কোলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ মতে দুর্ঘটনার সময় দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রামলাইন পার হচ্ছিলেন কবি। আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেয়া কোন মানুষ দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রাম লাইন পাড়ি দিয়ে বাড়ী ফেরার রাস্তায় উঠবেন - সেটা কোন যুক্তিবাদী মানুষের কাছে নিশ্চয়ই আত্মহত্যার জন্য যৌক্তিক ব্যাখ্যা হতে পারেনা। আমি বিশ্বাস করি, জীবনানন্দ দাশ আত্মহত্যারর উদ্দেশ্যে ট্রাম লাইনে হাঁটেননি, অন্তত আমার পড়াশোনার গন্ডি, বিতার্কিক স্বত্তা ও লেখক বোধের বিশ্লেষণ তাই বলে।

২২ অক্টোবর, ২০১৭

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.