![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফ্রিম্যাসনারি বিশ্বের প্রাচীনতম গুপ্ত গোষ্ঠী। যে গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের জেরুজালেমের টেম্পল অভ সলোমন-এর কারিগরদের ভিতর। যে গোষ্ঠীটি সাধন করে বিশ্বের প্রাচীনতম রহস্যময় জ্ঞান, যে গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত মধ্যযুগের কুখ্যাত নাইট টেম্পলারদের বিচিত্র অনৈক কর্মকান্ড; যে গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত ষোড়শ শতকের ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তির যুগ বা ‘এজ অভ এনলাইটমেন্ট’ এবং সপ্তদশ শতকের ‘ম্যাসনিক গিল্ড’ বা ‘রাজমিস্ত্রিদের সংঘ’; সেই গোষ্ঠীই সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং সমাজবিপ্লবের পিছনে সক্রিয় ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অদৃশ্য নিয়ন্তা বলে মনে করা হয় যে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীটিকে - সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত ফরাসি লেখক ভলতেয়াল, জার্মান সঙ্গীতবিদ মোজার্ট, মার্কিন বৈজ্ঞানিক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে বর্তমান কালে প্রাক্তন ‘যুদ্ধাপরাধী’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ...এমন একটি রহস্যময় গুপ্ত গোষ্ঠীর উদ্ভব এবং ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহলী হয়ে উঠি বৈ কী ...
১৯৯৭ সালে Christopher Knight এবং Robert Lomas একটি বই লেখেন। সে বইয়ের নাম Hiram Key. এ বইতে বিচিত্র ইতিহাস তুলে ধরেন। ক্রিস্টোফার নাইট এবং রবার্ট লোমাস এরা দুজনই ম্যাসন- অর্থাৎ ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর সদস্য। এঁরা ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যর মতো ফ্রিম্যাসোনারি গোষ্ঠীর প্রকৃত ইতিহাস সম্বন্ধে তেমন কিছু জানতেন না। কারণ ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট স্তর অতিক্রম না করলে সদস্যদের ‘গুপ্ত রহস্য’ জানানো হয় না। সে যাই হোক। এরা দুজন অত্যধিক পরিশ্রম করে প্রাচীন মিশরীয় নথিপত্র, পুরাতন এবং নতুন বাইবেল, প্রাথমিক খ্রিস্টীয় দলিলাদি এবং হিব্রু শাস্ত্রাদি, ডেড সি স্ক্রল এবং ফ্রিম্যাসনারি কৃত (রিচুয়াল) বিশ্লেষন করে ‘হাইরাম কি’ বইতে দেখান যে আধুনিক ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর উদ্ভব অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে মনে করা হলেও প্রকৃতপক্ষে গোষ্ঠীটির শিকড় নিহিত খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের জেরুজালেমের টেম্পল অভ সলোমন-এর stonemasons দের মধ্যে। এবং বড় বিচিত্র এবং বিস্ময়কর সে ইতিহাস।
রাজা সলোমন (খ্রিস্টপূর্ব দশম শতক) যাদুবিদ্যা ও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞার জন্য প্রখ্যাত ছিলেন। যে কারণে তাঁর পক্ষে টেম্পল অভ সলোমন-এর স্থাপত্য নকশাটি স্বয়ং ইয়াওয়ের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। যে কারণেই ওই স্বর্গীয় নকশাটি হয়ে উঠেছিল এক অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের উৎস। সে নকশা সম্বন্ধে জানতেন হাইরাম আবিফ নামে এক মেধাবী কারিগর। ইনি ছিলেন টেম্পল অভ সলোমন- এর প্রধান স্থপতি। হিব্রু বাইবেলে টায়ার নগরের রাজা হাইরাম এর নাম থাকলেও হাইরাম আবিফ -এর নাম নেই। অবশ্য বাইবেলে হাইরাম আবিফ কে নাপ্তালি গোত্রের ‘বিধবার সন্তান’ বলা হয়েছে । হিব্রু বাইবেলের সেকেন্ড বুক অভ ক্রনিকলস-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে সে বর্ণনা রয়েছে। রাজা সলোমন টায়ারের রাজা হিরামের কাছে দূত পাঠিয়ে জানালেন যে তিনি একটি উপাশনারয় নির্মাণের উদ্যেগ নিয়েছেন এ জন্য বিভিন্ন মালমশলা এবং কারিগর প্রয়োজন। রাজা সলোমন - এর প্রথম দাবি ছিল ... a specially gifted craftsman. রাজা সলোমন বললেন: "Send me now a man cunning to work in gold, and in silver, and in brass, and in iron, and in purple, and crimson, and blue, and that can skill to grave with the cunning men that are with me in Judah, and in Jerusalem:" উত্তরে টায়ারের রাজা হিরাম বললেন:: "I have sent a cunning man,endued with understanding. The son of a woman of the daughters of Dan, and his father was a man of Tyre."
হাইরাম আবিফ জেরুজালেম এলেন। রাজা সলোমন তাঁর কাছে টেম্পল অভ সলোমন - এর ঐশী নকশাটি হস্তান্তর করলেন। হাইরাম আবিফ কাজ শুরু করলেন। নির্মীয়মান টেম্পল অভ সলোমন ঘিরে পাথর-কাটার মিস্ত্রিদের সংঘ বা Masonic Guild গড়ে উঠেছিল। প্রতিভাবান এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন হাইরাম আবিফ অনিবার্যভাবেই হয়ে উঠলেন তাদের গুরু বা Master Mason । তিনি প্রতিদিন তাঁর শিষ্যদের মূল দৈব নকশা (যেটি কিং সলোমন ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন) থেকে অল্প অল্প করে নির্দেশ দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছিলেন উপাসনালয়টি। কথা ছিল- নির্মাণকাজ শেষ হলে হাইরাম আবিফ স্থাপত্যের নিগূঢ় জ্ঞান তাঁর শিষ্যদের জানিয়ে দেবেন-যে গূহ্যজ্ঞানের অধিকারী হলে অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী হওয়া সম্ভব (... এ প্রসঙ্গে বর্তমান কালের architect দের কথা ভাবা যেতে পারে, যেন তারা অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী; বিশেষ করে তাদের বিস্ময়কর স্থাপত্যকর্ম, আর্থিক প্রতিপত্তি এবং সামাজিক মর্যাদা স্থপতিদের এক অতিপ্রাকৃত স্তরেই নিয়ে গিয়েছে) । সে যাই হোক। সংঘের কয়েকজন শিষ্য ধৈর্য হারায়। তারা স্বর্গীয় পরিকল্পনা জানার জন্য হাইরাম আবিফ কে হত্যা করতে উদ্যত হয়।
বাইবেল অনুযায়ী টেম্পল অভ সলোমন-এর অভ্যন্তরীণ নকশা। খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকে এই স্থাপত্য জ্ঞান আয়ত্বে এসেছিল। তৎকালীন সময়ে স্থাপত্যবিদ্যাকে গূহ্য এবং নিগূঢ় জ্ঞান মনে করা হত। যার কেন্দ্রে থাকতেন একজন প্রধান স্থপতি। বর্তমান কালের ভাষায় প্রধান স্থপতিকে architect না বলে বলা হত Master Mason । পরে আমরা দেখব যে আধুনিক ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীতে তিনটি ডিগ্রি রয়েছে। যেমন, (১) Entered Apprentice – দীক্ষার প্রাথমিক স্তর। (২) Fellow Craft – এটি মধ্যবর্তীকালীন ডিগ্রি, এসময় নানা ধরণের শিক্ষালাভ হয় (৩) Master Mason – এই ডিগ্রি না-হলে গোষ্ঠীর অন্যান্য গোপন কৃত্যে অংশ নেওয়া যায় না। Master Mason হওয়াই একজন প্রাথমিক ফ্রিম্যাসনারি সদস্যের মূল লক্ষ।
হাইরাম আবিফ প্রতিদিন দুপুরে উপাসনালয়ে প্রার্থনা করতেন। একদিন পূর্ব দরজার কাছে একজন শিষ্য তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়ায় এবং পবিত্র নকশার-জ্ঞান দাবি করে। হাইরাম আবিফ তাকে বলেন, তা কী করে সম্ভব! আর আমি তো বলেছি যে নির্মাণ কাজ শেষ হলে আমি তোমাদের সবাইকে পবিত্র স্থাপত্যের জ্ঞান দেব। শিষ্যটি তাঁর গলায় তীক্ষ্ম পাথর দিয়ে আঘাত । হাইরাম আবিফ রক্তাক্ত হলেন এবং তীব্র যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এর পর দক্ষিণ দরজায় আরেকজন শিষ্য তাঁর পথ রোধ করে এবং পবিত্র স্থাপত্যের জ্ঞান দাবি করে; হাইরাম আবিফ সে জ্ঞান দিতে অস্বীকার করেন। শিষ্যটি তাঁকে ধারালো একটি নির্মানযন্ত্র দিয়ে আঘাত করে। রক্তাক্ত হাইরাম আবিফ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পশ্চিম দরজায় আরেকজন শিষ্য তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায় এবং সেও পবিত্র স্থাপত্যের জ্ঞান দাবি করে। মুমূর্ষ রক্তাক্ত হাইরাম আবিফ সে জ্ঞান দিতে অস্বীকার করেন। শিষ্যটি তাঁকে এবার সুতীক্ষ্ম ছেনির উপর্যপুরি আঘাতে হত্যা করে। মৃত্যুর আগে নাকি হাইরাম আবিফ এই বলে চিৎকার করেন, ‘বিধবার সন্তানকে কে সাহায্য করবে?’
হাইরাম আবিফ-এর শেষ চিৎকার ‘বিধবার সন্তানকে কে সাহায্য করবে?’ ...এটি আজও ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর সদস্যদের বন্ধন অটুট রাখে।
তার কারণ আছে। হাইরাম আবিফ ছিলেন ‘ফ্রি’ (মুক্ত) এবং ‘ম্যাসন’ অর্থাৎ ‘কারিগর’। Freemasonry শব্দটির উদ্ভব হাইরাম আবিফ-এর এর আত্মত্যাগ থেকেই। হাইরাম আবিফ- এর হত্যাকান্ডের ৩০০০ বছর পর আজও ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠী হাইরাম আবিফ- কে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ফ্রিম্যাসোনারিদের চোখে মুক্ত এবং স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হাইরাম আবিফ একজন সর্বশ্রেষ্ঠ বীর, মহৎ প্রাণ এবং অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। হাইরাম আবিফ এর সততা ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাস এবং সততার মূলভিত্তি। প্রাণের বিনিময়ে হলেও হাইরাম আবিফ তস্করদের কাছ থেকে গুপ্ত জ্ঞান রক্ষা করেছেন এবং এই আত্মত্যাগের মহান ঘটনাটি ৩০০০ বছর ধরে ম্যাসনদের গুপ্ত গোষ্ঠী কে সচেতন এবং উদ্দীপ্ত করে রেখেছে। (পরবর্তী পর্বে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে)
... ফ্রিম্যাসনরা বলে, যারা মুক্ত এবং স্বাধীন চিন্তার অধিকারী তিনটি শক্র তাদের সর্বদা ধ্বংস করতে চায়। (১) অজ্ঞতা;(২) গোঁড়ামি; এবং (৩) স্বৈরাচার।
হাইরাম আবিফ-এর হত্যাকান্ডটি ঘটেছিল দুপুর বেলায়। খুনিরা তাঁর মৃতদেহ নির্মিয়মান উপাসনালয়ে রাবিশের নীচে লুকিয়ে রাখে এবং রাত্রে অত্যন্ত গোপনে নিকটবর্তী এক পাহাড়ে সমাহিত করে। পরের দিন খুনিরা ধরা পড়ে এবং ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে রাজা সলোমনের কানে যায়। তিনি করিগরদের নিয়ে পাহাড়ে যান। তারপর কারিগররা হাইরাম আবিফ কে কবর থেকে টেনে তুলতে ব্যর্থ হলে রাজা সলোমন প্রবল বিক্রমে সিংহের থাবায় হাইরাম আবিফ কে কবর থেকে টেনে তোলেন এবং যাদুকরী শক্তিতে নবজীবন দান করার চেষ্টা করেন । সম্ভবত বিষয়টি প্রতীকি।
বাইবেল- এর উক্তি বাদে হাইরাম আবিফ কিংবা টেম্পল অভ সলোমন-এর অস্তিত্ব সর্ম্পকে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ নিশ্চিত নন। তবুও টেম্পল অভ সলোমন-এর আদলে পরবর্তীকালে ইউরোপ এবং আমেরিকায় প্রায় ১৫০০ হাজার ‘মেসোনিক লজ’ (মিস্ত্রীদের কুঠির) গড়ে উঠেছে । যে লজের গোপন চেম্বারে ফ্রিম্যাসনরা সমবেত হয়ে আজও গোপন কৃত্যে অংশ নেয়-যে কৃত্যের কেন্দ্রে ৩০০০ বছরের প্রাচীন টেম্পল অভ সলোমন এর প্রধান স্থপতি হাইরাম আবিফ !
ক্রিস্টোফার নাইট এবং রবার্ট লোমাস Hiram Key বইটিতে লিখেছেন, The early Christians buried their most precious scrolls beneath Herod's temple shortly before they and the city was destroyed by the Romans in 70 AD. Lost to the world for over a millennium they were clandestinely unearthed and interpreted by the infamous Order of the Knights Templar who adopted these ancient teachings and the rituals as their own... অর্থাৎ ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা জেরুজালেমে হেরোদ এর টেম্পল ধ্বংস করেছিল। তার আগেই আদি খ্রিস্টানরা ওই টেম্পলের নীচে মূল্যবান পান্ডুলিপি, পবিত্র পাত্র বা হলি গ্রেইল (যে পাত্রে যিশুর পবিত্র রক্ত ছিল) লুকিয়ে রেখেছিল ... হাজার বছর পর নাইট টেম্পলার নামে আরেকটি কুখ্যাত গোষ্ঠী ক্রসেডের সময় জেরুজালেমে থাকাকালীন সময়ে সে সব আবিস্কার করেছিল, এবং পরবর্তীকালে তারা তাদের গুপ্ত গোষ্ঠীতে সেই আদিখ্রিষ্টীয় কৃত্য অর্ন্তভূক্ত করেছিল ...
ফ্রিম্যাসনারি দের সঙ্গে নাইট টেম্পলার দের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।
©somewhere in net ltd.